:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নজরুল সৈয়দ

লেখক, সাহিত্য সমালোচক

‘চিতার অবশিষ্টাংশ’: সেলিম মোরশেদ পাঠ
শিল্পকর্ম: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

‘চিতার অবশিষ্টাংশ’: সেলিম মোরশেদ পাঠ

‘স্বেভূতৈরপি তৎসঙ্গতৃষ্ণা স্মৃতি প্রতি শ্রবাচ্য’
[মৃত্যুকে স্বীকার করে আপন পঞ্চভূতের দ্বারা প্রিয়সঙ্গতৃষ্ণা…]

প্রেম অপ্রেমের যে দেহ, শব হয়ে যখন তার সব শেষ হয়, তা পোড়াতে লাগে দশ থেকে বারো মণ কাঠ। আম তেঁতুল বা চন্দন অথবা অন্য কোনো বস্তু। দেহের নিচে এক প্রস্থ কাঠ সাজাতে হয়, দেহের ওপর আরেক প্রস্থ। মাঝখানে স্যান্ডউইচের মতো শব। উত্তরে মাথা দক্ষিণে পা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লাগে পুড়ে ছাই হতে, প্রতিকূলে থাকলে কখনো কখনো তিন ঘণ্টাও লেগে যায়। তবু শবটার সবটা কি পোড়ে? মাথার অংশটা একটু দেরিতে পোড়ে। একেবারেই পুড়তে চায় না নাভি সংলগ্ন নিম্নাঙ্গ এবং খুব সামান্য কিছু নিতম্বের অংশ। ওগুলো পুঁতে ফেলতে হয় বাঁশ দিয়ে, অথবা ভাসিয়ে দিতে হয় নদীর জলে। নিঃশেষিত হতে চায় না বলে একে বলে চিতার অবশিষ্টাংশ বা নীলকমল। নীলকমল আবার এক প্রকারের পদ্ম, ফুল হয়ে ফুটে থাকে জলে।

তেমনি কিছু নীলকমল মানুষ, যাঁদের জীবনের সবটুকু পোড়া হয়ে গেছে, তবু রয়ে গেছে কিছু অবশিষ্ট, তবু তারা এই পৃথিবীর আলোবাতাসে বেঁচে থাকে অবশিষ্ট হয়ে… সেই মানুষগুলোর ঠাঁই হয়েছে শবদেহের মতোই উত্তর দক্ষিণ বরাবর বয়ে যাওয়া বুড়ি ভৈরব নদীর তীরের নীলগঞ্জ মহাশ্মশানে।

চারশো বছরের পুরনো রাজা প্রতাপাদিত্যের আমল থেকে প্রাচীন এই আড়াই বিঘের শ্মশানে আছে তিনটে বড়ো মন্দির। ষাঁড়সহ কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ, বাঘের ছালের ওপর বসা দুই ঘাড়ে দুটো বিষাক্ত সাপসমেত মহাদেব, আর সবচেয়ে বড়ো মন্দিরে অধিষ্ঠান একই সঙ্গে দুর্গা আর কালীর। একপাশে অসুরবধ করছে দুর্গা, আরেকপাশে ডাকিনী-যোগিনী দুপাশে নিয়ে স্বামীর বুকের ওপর জিভ বের করে দাঁড়িয়ে আছে কালী। কালী আর দুর্গা, মায়ের দু-রূপ, দ্বৈতসত্তা। একই মন্দিরে এই দুটি লাবণ্যের এপিঠ ওপিঠ দ্বৈরথে এবং ঐক্যে তৈরি হয় এক দ্বান্দ্বিক সৌন্দর্য!

ব্যক্তি নয়, সেলিম মোরশেদের গল্পের প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠে ব্যক্তিচরিত্রের দ্বৈতসত্তা, ব্যক্তির অন্তর্গত দ্বন্দ্ব। তাঁর গল্পে ব্যক্তি সরলরেখার মতো একরকম আচরণ করে না। ভালো কিংবা মন্দ বিচারে কেউ পার পায় না। চিতার অবশিষ্টাংশ গল্পে যেমন সেলিম মোরশেদ সমবেত করেন কিছু দ্বান্দ্বিক চরিত্রকে। বুড়ি ভৈরব নদীর তীরের নীলগঞ্জ মহাশ্মশানের ঠাকুর কার্তিকচন্দ্র হালদার, অতীতে যে একই সঙ্গে পুলিশ ও চোরাকারবারী পেশার সামঞ্জস্য বিধান করে এসেছে। মহাশ্মশানের সবচেয়ে বয়েসী চরিত্র কালিদাসী। একাত্তরের যুদ্ধে যে নিজের স্বামীকে বাঁচাতে পাকিস্তানি মিলিটারির বন্দুকের নলের সামনে পেতে দিয়েছিলো বুক, আবার স্বামী হারিয়ে যে কালিদাসী এই মহাশ্মশান-মঞ্চে হাজির হয় বড়বাবুদের শরীর-সুখ দেওয়ার চরিত্রে। সমাজে সে দুশ্চরিত্র হিসেবেই পরিচিত।

এখানে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি দিলীপকুমার সেন, কমার্স গ্রাজুয়েট। শিক্ষকতার মহান পেশায় ছাত্রীর প্রেম অস্বীকার করে, দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে অচেতন নিম্নাঙ্গ নিয়ে হাজির হয়েছিলো এই শ্মশানে। পা তার পোকাদের পাতকুয়ো, কিলবিল কিলবিল। কালিদাসী গরম পানি ঢেলে খুঁটে খুঁটে পোকা তুলে জীবিত করে তোলেন দিলীপকে। আহার না জোটা দিলীপ, দিনের পর দিন শুধু চা খেয়ে বেঁচে থাকা দিলীপ হাঁটতে পারে না; শেয়ালে কামড়ে ধরে টেনে নিয়ে যায় যে দিলীপকে, সেই দিলীপ তবু বেঁচে থাকে কিসের আশায়?

শ্যামলা গোলমুখা পঁচিশ বর্ষীয় পুষ্পরেণু, প্রেম আর শ্রদ্ধার সমন্বয় করতে সে স্বপন এবং শরৎকে ছেড়ে কাজ নেয় সুবলের চিংড়ি-ঘেরে। মাছ প্যাকিং করে মাসে বারোশো টাকা উপার্জন। কিন্তু জীবনের অর্জন? পুষ্প জানে, ‘পুরনো আর বস্তাপঁচা কথা ছাড়া তাদের কাছে নতুন কিছুই নেই’। ভাসাভাসা জ্ঞান আর এলোমেলো সংজ্ঞা দিয়ে তারা ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতা বুঝতে চায়।

ব্যক্তি নয়, সেলিম মোরশেদের গল্পের প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠে ব্যক্তিচরিত্রের দ্বৈতসত্তা, ব্যক্তির অন্তর্গত দ্বন্দ্ব। তাঁর গল্পে ব্যক্তি সরলরেখার মতো একরকম আচরণ করে না। ভালো কিংবা মন্দ বিচারে কেউ পার পায় না। চিতার অবশিষ্টাংশ গল্পে যেমন সেলিম মোরশেদ সমবেত করেন কিছু দ্বান্দ্বিক চরিত্রকে।

হিন্দু মহাশ্মশানের চিত্রপটে সেলিম মোরশেদ হাজির করেন মুসলমান সাঈদাকে। যে নিজেই এক ভীষণ দ্বন্দ্ব। ত্রিশ বছর বয়সী উপচানোস্তনা সাঈদার শরীর সুগঠিত। যে বিশ্বাস করে ‘যতো প্রেম ততো কাম’ মন্ত্রে। বলে ‘প্রেমে পড়লে আমার শরীর আমি দেবো। যতোবার প্রেমে পড়বো ততোবার শরীর দেবো। আমাকে বিয়ে করার দরকার নেই। টাকারও দরকার নেই।’ কিন্তু তবু সাঈদা কি প্রেম পায়? মা কালীর কাছে সাঈদা রাতদিন প্রার্থনা করে একজন সত্যিকারের প্রেমিকের আশায়।

দিলীপের স্বীকার করা বউ অতসী এখানে ছদ্মবেশে লিলিরানী হয়ে ঘোরে, যে অপেক্ষা করে আছে স্বামী ফিরলে বাড়ি চলে যাওয়ার।

আর সাজাদ? যে এখানে কেন এসেছে, কীভাবে এসেছে তা কেউ জানে না। সাজাদ নিজে কি জানে, সে কে? এই অল্প কদিনের আশ্রয়ে সে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে ঠাকুর কার্তিকচন্দ্রের, দুজনেরই আরাধ্য নারী পুষ্পরেণু!

এই পরষ্পর দ্বন্দ্বমুখর চরিত্রগুলো এক শ্মশানঘাটে জড়ো হয়ে জীবন আর বোধ নিয়ে মুখোমুখি হয় সেলিম মোরশেদের চিতার অবশিষ্টাংশ গল্পে। পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া চরিত্রগুলোকে সেলিম মোরশেদ পাঠকের মুখোমুখি দাঁড় করান নানান ভঙ্গি আর প্রশ্নসমেত। পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করে নতুন কোনো দ্বন্দ্বের সামনে। জীবন আর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে পাঠক নিজের অভ্যন্তরে খুঁজে ফেরে এক ভিন্ন মানুষ। মাধুর্য আর কদর্যের স্বরূপ খোঁজে নিজের মাঝে।

সেলিম মোরশেদের গল্পের আরেক প্রাণ তার চিত্রময়তা। নিখুঁত বর্ণনাভঙ্গি। একটি বিকেল থেকে গোধূলি হয়ে সন্ধ্যার যে বিবরণ সেলিম তুলে ধরেন, কুরোশাওয়ার চলচ্চিত্রের মতো তা দৃশ্যমান হয় পাঠকের সামনে। ‘এ-সময় আলোর সমস্ত কপাট বন্ধ করে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ’। কিংবা শ্মশানে প্রবেশের বর্ণনায় যখন লেখেন—

‘নদীর দুপাশে বড়ো বড়ো ঝাকড়া গাছ। নদীর খাড়া গায়ে কিছু-কিছু গাছ নতমুখে ঝুঁকে আছে। গায়ে-গায়ে জড়াজড়ি। ডালে-ডালে গা লাগানো। গাছগুলো উন্নত খাড়া আর চওড়া গুড়ি দিয়ে বুক টান করে আকাশ ছোঁয়া ঋজু স্তম্ভসারির মতো উঁচুতে ওঠা। জড়াজড়ি করে পাতারা যে প্রাসাদ তৈরি করেছে তার ভেতর সূর্যের আলো প্রবেশ করা কষ্টসাধ্য।’

তখন শ্মশান আর তার আশ্রিত মানুষগুলো আলোকহীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

চাঁদের আলোয় অতসীর মোটা সিঁথিতে দেওয়া চওড়া সিঁদুর যখন দিলীপের চোখ থেকে নেমে আসা অশ্রুতে ভিজে যায় আর সেই সিঁদুর ভেজানো জল অতসীর মাথা থেকে অবিরত নেমে আসে তার মুখাবয়বে, সেখানে কোনো নারীর মুখাবয়ব না, ভিজে যায় অশ্বত্থের শেকড়! যে শতবর্ষী অশ্বত্থের ফুল থাকে ফলের ভেতর লুকিয়ে! কিন্তু অতসী যে, সে তো কখনো ফুল থেকে ফলাতে পারে না ফল!

সেলিম মোরশেদ গল্পের শেষেও পাঠককে এই দ্বন্দ্বের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখেন।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!