[খাকানি সিরওয়ানি ফারসি সাহিত্যের ইতিহাসে একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি ও গদ্য লেখক। দ্বাদশ শতাব্দির এই কবির গুরুত্ব রসিকজনের কাছে রয়েই গেছে। সাহিত্যচর্চার জন্য তার নাম সাদি, রুমি, হাফিজ ও খৈয়ামদের সাথে উচ্চারিত হয়। তিনি একজন সুফি ছিলেন।
খাকানি সিরওয়ানে ১১২২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। আর মারা যান ১১৯৯ সালে।
খাকানির পুরো নাম আফজাল আল দিন বাদিল ইব্রাহিম ইবন খাকানি সিরওয়ানি। তিনি রাজদরবারে কবিতা লিখে খ্যাতিমান হয়েছিলেন। তার পিতা ছিলেন ছুঁতার ও মুসলিম। আর মা ছিলেন খ্রিস্টান কমিউনিটির। তিনি দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়েছেন। পিতার আকস্মিক মৃত্যুর পর চাচার কাছে শিক্ষা-দীক্ষা নিয়েছেন। তার চাচা ছিলেন সিরওয়ানের শাহের দরবারের একজন চিকিৎসক ও জ্যোতির্বিদ।
যুবক বয়সে ‘হাকায়িকি’ নামে গান লিখতেন। পরে তিনি সিরওয়ানের শাসক শাহ আখিস্তানের দরবারে প্রবেশ করেন। সিরওয়ান বর্তমানে আজারবাইজাইন প্রজাতন্ত্রের মধ্যে। তার কাছ থেকেই লেখক নাম নেন ‘খাকানি’।
দরবারি জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে খাকানি মনে প্রশান্তির জন্য ১১৫৬-১১৫৭ সনের মধ্যে মক্কায় গমন করেন। সেখানে তিনি রচনা করেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তুহ্ফাত আল ইরাকাইন’ (দুই ইরাকের উপহার)। এটিতে ৫টি অধ্যায় রয়েছে। মূলত কবির ভ্রমণলিপিরই অংশ এটি। খাকানি আবার দরবারে আসলে অজ্ঞাত কারণে তাঁকে দণ্ডিত করা হয়। পরে কারাগারে বসে লেখেন ‘হাবসিয়া’ (জেল গাথা)। এটি তার অন্যতম একটি রচনা।
১১৭১ সালে আরো একবার কবি তীর্থ করতে মক্কায় যান। ১১৭৫ সনে কবির ছেলে ও স্ত্রী মারা গেলে তৃতীয়বার মক্কায় হজ করতে রওনা দেন। পরে ফিরে এসে তিনি তাবরিজে (বর্তমানে ইরানের পূর্ব আজারবাইজাইন প্রদেশ) বসবাস শুরু করেন। এ সময় তিনি তার দিওয়ান রচনা করেন।
আপামর পাঠকের জন্য তার লেখার পাঠ নেওয়া খানিকটা দুরুহ বটে। তার অনেক লেখায় খ্রিষ্টবাদের প্রভাব রয়েছে। এটা তার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি ফারসি কবিতায় এ শৈলির পথিকৃৎ বটে। আসলে তিনি দ্বাদশ শতাব্দিতে ফারসি কবিতার পূর্বের ঐতিহ্য অনুসরণ না করে কবিতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন বলেই তার কবিতা পরবর্তীতে সভাকবি ও সুফিরা পছন্দ করেছিলেন। বাংলাভাষী পাঠকের সামনে পেশ করা হলো তার পাঁচটি রুবাইয়াত।–অনুবাদক]
১.
ভালবাসা পাখির বিরহ গান-
দূত আনে প্রেমের গোপন ভাষা;
প্রেম সে তো কায়াহীন কায়া-
তোমার ভেতরে তীব্র সর্বনাশা।
২.
জগৎ তোমার দিয়েছে কী বলো? গোল গোল যত শূন্য
যাপিত জীবনে কত যে প্রাপ্তি-সবই শূন্য।
জ্ঞান গরিমায় তুমি জ্বলো দীপ-নিভে গেলে ফের শূন্য
জামশেদের পেয়ালা আমি, ভেঙে গেলে সেই শূন্য
৩.
শরাবখানা ডাকে তোমার মাতাল-প্রেমি হতে
বিপুল আছে সূরা ও গীত, মিষ্টি আহ্বান।
পেয়ালা ভরো অঢেল মদে উপচে পড়ে যেন,
গেলার ক্ষণে-চেতন রেখো প্রেমিক দিলে টান।
৪.
বললে তুমি ভণিতা নয়, রাস্তা ধরো আছে পুরস্কার
কিংবা আছে ধুলোর মত উড়ে যাবার ভয়।
কী আর করো চিন্তা তুমি আমাকে নিয়ে,
বাঁচার চেয়ে ভাল অনেক-এ পথে মরে গিয়ে।
৫.
ভালবেসে শক্ত করে ধরে ছিলে হাতখানা;
আমার ছাড়াই আছ কিন্তু সুখে বেশ।
শর্ত দিয়ে হয় খাঁটি কেউ আশেকানা?
অঙ্ক দিয়ে, গল্প দিয়ে; প্রেম তো হবে না।