জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা : বৃত্ত ভেঙে জীবনের ব্যাপ্তিতে ছড়িয়ে পড়া থিয়েটার
কত দিন বা কত বছর বা কত দশক বা কত যুগের প্রসব বেদনার শেষে আমাদের প্রসেনিয়ামকে, ছবিতে পরিস্ফূট এমন একটা দৃশ্য জন্মাবার জন্য অপেক্ষা করতে হলো! এমন একটা দৃশ্য দেখার জন্য আমাদের চোখ আদতে প্রস্তুত ছিল কিনা, সেই হিসাবের অংকে নিজেকে সচেতন ভাবে বিচ্ছিন্ন রেখে, প্রবল বিস্ময়ের সঙ্গে আবলোকন করলাম- বাড়ির ছাদ থেকে একটা দড়ি এসে আঁকড়ে ধরল সবুজ এক কিশোরীকে। আটকে পড়া কিশোরীকে বিদ্ধ করল দড়ি হাতের জনৈক মওলানার শ্লীল বা অশ্লীলতায় মোড়ানো একটি বাক্যের তীর, ‘মাগি, ডিম পারবার যাও’। আমরা শিউরে উঠি এমন একটি দৃশ্যের দ্যোতনায়। এমন একটি সংলাপের সারবত্তায় আমাদের ভেতরটা কুঁকড়ে ওঠে। আধোচৈতন্যের ভেতর দিয়ে আমরা দেখি, দেখতে থাকি এরপরের দৃশ্য, তারপরের দৃশ্য, দৃশ্যের পর দৃশ্য। আমরা পুরো নাটক দেখতে থাকলাম বা নাটকের বদলে দেখতে থাকলাম আমাদের জীবনের সবচাইতে মর্মন্তুদ, সবচাইতে সাহসী, সবচাইতে সচেতন ও আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে আসা বা জমাট হয়ে আসা স্তব্ধতাময়, সংকটকালীন একটা সময়ে সকলের একসাথে কান্না, সংগ্রাম আর প্রতিরোধের গা হিম করা, রক্তে আগুন ধরানো, মগজে বিস্ফারিত হওয়ার প্রায় অবিকল ঘটনাপ্রবাহ, যে ঘটনাপ্রবাহ জুড়ে সেই মওলানা আর সেই কিশোরীর কাঁপন ধরানো উপস্থিতি।
সবুজ শাড়ি পরিহিত যে কিশোরীকে একদিন মওলানার কথার তীর বিদ্ধ করেছিল, ঘটনার তীব্র প্রবাহে সেই মওলানার নির্দেশে তার অনুসারী রাজাকাররা সেই কিশোরীকে যার নাম মোমেনা, সেই মোমেনাকে তুলে নিয়ে যায়। নাটকজুড়ে কিশোরী মোমেনার সুতীব্র উপস্থিতি, জীবিত বা মৃত। জীবিত মোমেনার চেয়ে মৃত মোমেনা আমাদেরকে প্রায় আচ্ছন্ন করে ফেলে। মৃত মোমেনাকে তার ভাই আবদুল মজিদ তুলে নিয়ে আসে। আমরা দেখি সবুজ শাড়িতে ঢাকা মোমেনার লাশ নিয়ে বিলাপ করছে আবদুল মজিদ, যে মোমেনা তার ভাইকে এক কৃষ্ণ দিনে বোনের মলিন বিষণ্নতা দেখার অপরাধে ধমক দিয়ে বলেছিল, কি দেখচ তুই বারে বারে। রাজাকাররা তুলে নেয়ার চারদিন পর বুড়িগঙ্গা নদীর কিনারা থেকে বোনের লাশ তুলে আনে আবদুল মজিদ, যার একটি স্তন কাটা ছিল, পেট থেকে ঊরু পর্যন্ত ছিল ক্ষতবিক্ষত, ডান ঊরু কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত চিরে তরমুজের মতো হাঁ করে রাখা ছিল। সেই লাশ নিয়ে আবদুল মজিদ বিলাপ করে, এই লাশ মঞ্চে ফিরে ফিরে আসে আর আমাদের মনে করিয়ে দেয় কী দুঃসময় আমরা পার করে এসেছি, হায়!
মোমেনার লাশ আমরা দেখি সবুজ কাপড়ে আবৃত, তার গলায় খয়েরি জবার মতো ক্ষত ছিল, মুখটা কাত হয়েছিল, চোখ অনন্তের দিকে মেলা ছিল। সবুজ কাপড়ে ঢাকা লাশ আমাদের মনের ভেতর চাপ বাড়িয়ে দেয়, আমাদের সহ্য হয় না। খানিক পর পর একই লাশ ফিরে আসে, আমাদের দিশেহারা লাগে, আমাদের ভয় লাগে।
মোমেনার লাশ আমরা দেখি সবুজ কাপড়ে আবৃত, তার গলায় খয়েরি জবার মতো ক্ষত ছিল, মুখটা কাত হয়েছিল, চোখ অনন্তের দিকে মেলা ছিল। সবুজ কাপড়ে ঢাকা লাশ আমাদের মনের ভেতর চাপ বাড়িয়ে দেয়, আমাদের সহ্য হয় না। খানিক পর পর একই লাশ ফিরে আসে, আমাদের দিশেহারা লাগে, আমাদের ভয় লাগে। মোমেনার লাশ আবার আসে, আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি, আমরা নিঃশব্দে বলতে থাকি এ কিসের নাটক, এক দৃশ্য কেন বার বার আসে, আমাদের মনের উপর চাপ বাড়ায়, দর্শক হিসাবে আমরা স্বস্তি পাই না, নাটকের চরিত্র থাকবে মঞ্চে, আমরা দূর থেকে দেখব, সে কেন এসে দর্শককে ক্রূরভাবে মনোজগতে আক্রমণ করবে, তাদেরকে অস্বস্তি দেবে, উপদ্রুত মানসিক অবস্থার মধ্যে আমাদের মনে হয় নাটক শেষ হলেই বোধ হয় দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি থেকে রেহাই মিলবে, আমরা বেঁচে যাব।
নাটক চলতে থাকে, মোমেনার যাতায়াত শেষ হয় না, এক মোমেনা যায়, আরেক মোমেনা ফিরে আসে। দেশ স্বাধীন হলো, আবদুল মজিদের ঘরে কন্যা সন্তান আসে, মজিদ তার কন্যার নাম রাখে বোনের নামে, যে বোনের গলায় খয়েরি জবার মতো ক্ষত ছিল, তার কন্যার নাম রাখে মোমেনা, ছোট মোমেনা অস্তিত্বের ভেতর বড় মোমেনার অস্তিত্ব যে ফিরে আসে এ ব্যাপারে দর্শকের সন্দেহ থাকে না। তৈরি হয় আবার অস্বস্তি, মৃত মোমেনার পর এখন বাচ্চা মোমেনা। একাত্তর যে শেষ হয় না, একাত্তরের অস্তিত্ব যে শেষ হবার নয়, মোমেনারা মনে করিয়ে দেয়। একাত্তরের মার্চ মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যে মড়কের ভেতর দিয়ে পার হয়ে আসতে হয় মানুষকে, যে যন্ত্রণা ও আগুনের মধ্য দিয়ে জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে মানুষকে পাড়ি দিতে হয়, সে মানুষ কোনো কিছু ভোলে না। তবে একাত্তরের স্মৃতি সবচেয়ে বেশি মনে রাখে বদু মাওলানা ও তার দল, যে মাওলানা একদিন কিশোরী মোমেনাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলেছিল, দড়ির এক প্রান্ত তার হাতেই ছিল ক্ষমতার দম্ভ হয়ে। সেই মাওলানা আবদুল মজিদকে দেখে বলে, বইনের নামে নাম রাকছো, বোনরে ভুলো নাইকা? আবদুল মজিদ বুঝতে পারে একাত্তরে তার বোনকে সে বাঁচাতে পারেনি। এখন মেয়েকে বাঁচাতে হলে তার এলাকা ত্যাগ করতে হবে। সে তাই করে। তার এই দৃশ্যত পলায়নপরতার ভেতর মোমেনাকে কৌশলে বাঁচিয়ে রাখা বা একাত্তরকে বাঁচিয়ে রাখার একটা সার্বজনীন সুদীর্ঘ যুদ্ধের একটি অংশ মাত্র, এটা তার পরাজয় নয়, রণকৌশল, এটা আমরা বুঝতে পারি।
আবদুল মজিদ তার মেয়ের নাম রাখে মোমেনা, সে তা এই কারণে করে না যে, সে মোমেনার নাম ভুলে যাচ্ছে, বরং এই কারণে যে, এই নামটি ভুলে যাওয়ার নয়। দর্শকের চোখের মধ্যে, মাথার মধ্যে, চৈতন্যের ভেতর যে মোমেনা প্রবিষ্ঠ হয়, সে মোমেনাকে অস্বীকার করা যাবে না, সে মোমেনা একাত্তরকে প্রতিনিয়ত সম্মুখে টেনে আনবে। একাত্তর যে আমাদের অস্তিত্বের অংশ হয়ে চেতনায় দেদীপ্যমান, সে চেতনাকে যেন আমরা দুর্বল করে না তুলি, তার দায় দর্শক হিসাবে যেন আমরা ভুলে না যাই, সেটা মনে করিয়ে দেয়ার জন্যই জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এই সময়ে বাংলা নাটকের উৎকৃষ্টতার উদাহরণ বা অনন্যতার স্মারক এই বৃত্তকে ভেঙে জীবনের ব্যাপ্তিতে ছড়িয়ে গেছে। জাতীয় নাট্যশালা বা রঙ্গমঞ্চের আলো ও শব্দের ভেতর অজস্র শব্দ বা শব্দহীনতার টুপটাপ আলোক বৃষ্টির মধ্যে নিজেকে অক্ষত রেখে বা ক্রমাগত ভাঙচুর মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে আমি যে এই নাটকটি দর্শক হিসাবে দেখতে পেরেছি, এটাও কালক্রমে ইতিহাসের অংশ হবে। আর যারা এই নাটকের অংশ তাদের অনুসারী হবে ইতিহাস। দর্শক হিসাবে আমাদের চোখ প্রস্তুত না থাকায়, কান পরিষ্কার না হওয়ায় এবং নতুনকে গ্রহণ করার মানসিকতা থেকে ভিনগ্রহে বসবাস করায়, নাটকের বয়ান ও বিনির্মিত দৃ্শ্য আমাদেরকে বিচলিত করে তোলে। আমরা বলেতে থাকি নাটক কেন চেনা দৃশ্যপট ভেঙে, চেনা গল্পের কাঠামো ভেঙে, প্রচলিত আয়তনকে ভেঙে মনের উপর চাপ ফেলবে, কোরাসের কণ্ঠস্বর কেন কিন্নরকণ্ঠ হবে না যা মিষ্টি তরলের চেয়ে অধিক মিষ্টতায় মধুর মতো আমাদের কানের ভেতর গড়িয়ে পড়বে। আমরা কি কখনো এমন একটি নাটকের অপেক্ষায় বসেছিলাম যেখানে মৃত মোমেনা সবুজ লাশ হয়ে দর্শকের বুকের উপর সমস্ত নাটকজুড়ে চেপে ধরবে, আমরা বুঝতে পারব নাটক দেখে আমাদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
দর্শক হিসাবে আমাদের চোখ প্রস্তুত না থাকায়, কান পরিষ্কার না হওয়ায় এবং নতুনকে গ্রহণ করার মানসিকতা থেকে ভিনগ্রহে বসবাস করায়, নাটকের বয়ান ও বিনির্মিত দৃ্শ্য আমাদেরকে বিচলিত করে তোলে। আমরা বলেতে থাকি নাটক কেন চেনা দৃশ্যপট ভেঙে, চেনা গল্পের কাঠামো ভেঙে, প্রচলিত আয়তনকে ভেঙে মনের উপর চাপ ফেলবে, কোরাসের কণ্ঠস্বর কেন কিন্নরকণ্ঠ হবে না যা মিষ্টি তরলের চেয়ে অধিক মিষ্টতায় মধুর মতো আমাদের কানের ভেতর গড়িয়ে পড়বে।
বস্তুত একাত্তর সালে সেই ঝঞ্ঝার সময় যখন দিনের আলো ছিল কৃষ্ণবর্ণ তরলের মতো এবং শব্দের জগৎ পাহাড় ভেঙে পড়ার মতো সহস্রখণ্ডিত, আগুনের লেলিহান শিখায় যখন সমগ্র দেশ পুড়েছে, পলায়নের জন্য দেশে বস্তুত তখন কোনো জায়গা ছিল না, তখন বাড়ির ভেতর কি বাইরে কোথাও আর নিরাপদ ছিল না এবং পরিণতিতে কিশোর আবদুল মজিদকে খুঁজে বের করে বয়ে নিয়ে আসতে হয় মোমেনার লাশ। আমরা কি এমন একটা নাটক দেখতে চেয়েছিলাম যেখানে রায়সা বাজার বা কলতাবাজার বা আরমানিটোলা বা মালিটোলা বা লক্ষ্মীবাজার বা সিদ্দিকবাজার বা পাটুয়াটুলি বা নারিন্দা বা বাড্ডা বা জিঞ্জিরা বা নয়াবাজারের আকাশে কাকেদের উড়াউড়ি, যাদের উদরপূর্তি হয়েছিল মানুষের মাংসে। আমরা কি এমন একটি নাটক দেখতে চেয়েছিলাম যেখানে একাত্তরের মৃত শহিদদের সাদা খুলি সবুজ কলাপাতার উপর সাতটি সারিতে সাজানো হলে বুটি তোলা জামদানি শাড়ির কথা মনে পড়বে, যে জামদানি অঙ্গে ধারণ করে আমাদের মা এবং প্রেমিকারা, কন্যা এবং কন্যাদের কন্যারা জীবনের উৎসবে সঞ্চারিত হয়। বস্তুর প্রাণতত্ত্ব যদি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতো তাহলে হয়তো বলতে পারতাম নাটক কখনো কখনো ব্যক্তির প্রত্যাশার চাহিদাকে অতিক্রম করে তার বুকের ভেতর চোখের সামনে নির্মিত নাট্যদৃশ্য এমন একটা বোধের জন্ম দেয় যার সহজাত কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণে ব্যর্থ হয়ে তাকে অবসন্ন করে তোলে আর চোখের উপর ভাসতে থাকে একাত্তর।
‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ এই কারণে জরুরি না যে আমরা একাত্তর ভুলে যাচ্ছি, এই কারণে জরুরি যে এর মধ্যে তীব্রতর একাত্তরের উপস্থিতি। একাত্তরকে আমরা বহন করে নিয়ে যেতে চাই আমাদের পুত্র ও কন্যাদের মাঝে এবং পুত্র ও কন্যাদের পুত্র ও কন্যাদের মাঝে এবং তার পুত্র ও কন্যাদের মাঝে…