পরমনিধি
টপ্পার নিধুবাবু : রামনিধি অথবা নিধিরাম সর্দার
সময়টা বোধ হয় ১৯৯৮ সাল। আমি তখন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে। শো করতে প্রায়ই কলকাতায় যেতে হয়। সেখানকার নামকরা নাট্যদল বহুরূপী, শম্ভু মিত্রের দল। সে দলের নাটক ‘পিরিতি পরম নিধি’ তখন চলছিলো। কুমার রায় ছিলেন পরিচালক। নাটকটা ঢাকায় দেখেছিলাম নাকি কলকাতায়, তা এখন আর মনে নেই। শুধু মনে আছে শ্রীমতী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন গার্গীরায় চৌধুরী। আহা… তখন গার্গী ছিলেন আমাদের… এখন যাকে বলে ক্র্যাশ। তিনি পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে আমাদের হৃদস্পন্দন থেমে যেতো, আকাশ বাতাস উঠতো কেঁপে, বাতাসে ছড়িয়ে যেতো দোলনচাঁপার সুগন্ধ।
নাটকটা ছিলো রামনিধি গুপ্তকে নিয়ে, যিনি নিধুবাবু নামে পরিচিত। বাংলা টপ্পা গানের প্রবাদ পুরুষ। সেই নাটক দেখতে গিয়েই টপ্পার সঙ্গে আমার পরিচয়। আহা, কী সুন্দর… মুগ্ধ হয়ে গার্গীরায় চৌধুরীর অভিনয় দেখতে দেখতে শুনেছিলাম ‘তোমায় ভালোবাসি বলে ভালোবাসিনে, আমার স্বভাব এই তোমা বৈ আর জানি নে’। মনে আছে সেই অপূর্ব অভিজ্ঞতার কথা। যদিও সেই গানগুলো কারা গেয়েছিলেন বা নাটকের সঙ্গীত পরিচালনা কে করেছিলেন তার কিছুই এতোদিন পরে আর মনে নেই।
তার অনেক বছর পর যখন আমার কন্যা জন্ম নেয়, তার নাম রাখি ‘নিধি’। নিধি অর্থ গচ্ছিত সম্পদ। তবে এই নামকরণের সময় আসলে মাথায় ঘুরছিলো সেই নাটকটার নাম- ‘পিরিতি পরম নিধি’।
নিধুবাবু অর্থাৎ রামনিধি গুপ্তকে জানার আগ্রহ আমার অনেক পুরনো। কিন্তু খুব বেশি কিছু জানার উপায় জানা ছিলো না। মিথ্যে বলবো না, খুব বেশি চেষ্টাও করিনি কখনো। হঠাৎ করেই যখন শাহাদাত জামান সৈকতের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং জানতে পারি তাঁর প্রকাশনা সংস্থা ‘বাংলাদেশ খোয়াবনামা’ বের করেছে ‘পরমনিধি’ নামে বইটি। সংগ্রহ করতে দেরি করিনি। দেরি করিনি পড়তেও।
বইটি পড়ার আরো একটা অন্যতম আকর্ষণ ছিলো এর লেখকের নাম। বইটি লিখেছেন কলকাতার সাংবাদিক ও লেখক শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়। এর আগে তিনি প্রথম বাঙালি সার্কাস সংগঠক প্রিয়নাথ বসু এবং বাঘের খেলা দেখানো প্রথম বাঙালি নারী সুশীলাসুন্দরীকে নিয়ে লিখেছেন ‘শার্দূলসুন্দরী’, অঙ্ক কষে পৃথিবীবাসীকে এভারেস্টের উচ্চতা জানানো বাঙালি গণিতবিদ রাধানাথ শিকদারকে নিয়ে লিখেছেন ‘মাউন্ট রাধানাথ’, জাদুকর গণপতি চক্রবর্তীকে নিয়ে লিখেছেন ‘গণপতি দ্য গ্রেট’, কুস্তিগীর গোবর গোহকে নিয়ে লিখেছেন ‘প্রিন্স গোবর গোহ’। জীবনী সাহিত্যে তিনি একের পর এক যুক্ত করে যাচ্ছেন মণি মুক্তো। যদিও সেগুলো আমার পড়া হয়ে ওঠেনি।
রাজস্থানের উট চালকদের যে লোকগীতি টপ্পা বলে খ্যাত ছিলো, শোরী মিয়া যে টপ্পাকে ধ্রুপদের গুড়ো মিশিয়ে তুলে দিয়েছিলেন রাজা মহারাজা আর বড় বড় লোকেদের জলসাঘরে। সেই টপ্পার ঘাড় থেকে উর্দু হিন্দির ভূত তাড়িয়ে জলসাঘর থেকে নামিয়ে একেবারে শোভাবাজারের বটতলায় এক আটচালা ঘরে এনে তুললেন রামনিধি গুপ্ত। দর্শকের আসনে কামার, কুমোর, মুচি, জমিদার, রাজা সব সমান। বিনে পয়সায়। বর্ধমানের রাজা এসে পরিচয় লুকিয়ে এখানেই মাথা গুঁজে শুনে তৃপ্তি মেটান।
কিন্তু পড়েছি ‘সন্ধ্যারাতের শেফালী’। সহজ সাবলীল লেখনীতে প্রথম বাঙালি ক্যাবারে ড্যান্সার মিস শেফালির আশ্চর্য গল্প শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় হাজির করেছিলেন আমাদের সামনে। আমরা সে বই পড়ে এতোটাই বিমোহিত হয়েছিলাম যে শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা জীবনীমূলক বই কোনো যাচাই বাছাই ছাড়াই পড়তে দ্বিধা হওয়ার কারণ নেই। আর যদি সেই জীবনের চরিত্র হয় টপ্পার নিধুবাবু, তাহলে তো কথাই নেই। তার উপর প্রচ্ছদ, ছাপা, বাঁধাই সবকিছুই বেশ আকর্ষণীয়।
৬৭ পৃষ্ঠার ছোট্ট বই। বই পড়ে আমরা জানতে পারি রামনিধি গুপ্তর বাবা চাচারা বর্গীর ভয়ে কলকাতা ছেড়েছিলেন, কিন্তু ইংরেজরা বর্গী ঠেকানোর ব্যাবস্থা করলে তারা আবার ফিরে আসেন কলকাতার কুমারটুলিতে। রামকুমারকে ভর্তি করানো হয় স্থানীয় আর্মানী গীর্জায়। সেখানে পাদ্রীর কাছ থেকে রামকুমার শিক্ষালাভ করেন অক্ষরের ভাষা ইংরেজি আর হৃদয়ের ভাষা সঙ্গীত। কেরাণীর চাকরি করতে গিয়েও রামকুমারের মন মজে থাকে সঙ্গীতে। বিহারে মুসলমান ওস্তাদের কাছে নাড়া বাঁধেন। কিন্তু তখন ধ্রুপদ সঙ্গীত বলতে সব উর্দু আর হিন্দির দাপট, বাংলা সেখানে অপাঙক্তেয়। বাংলাতেও যে এমন গান হতে পারে, সেটা কেউ ভাবতেই রাজি ছিলো না। কিন্তু রামকুমার ভাবলেন। আর এই ভাবনাটাই তাঁকে অমর করে তুললো।
যদিও সময়ের বিবেচনায় বলা হয়ে থাকে কালী মীর্জাই বাংলা টপ্পার জনক। কিন্তু বাংলা টপ্পার সকল সমৃদ্ধি, সৌরভ আর গৌরভ রামনিধি গুপ্তর কণ্ঠ হতেই নিসৃত হয়। যাঁর সর্বশেষ কাণ্ডারি রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। আমরা মূলত টপ্পা শুনেছি এবং মুগ্ধ হয়েছি রামকুমারের কণ্ঠ শুনেই।
যাহোক, বলছিলাম রামনিধি গুপ্তর কথা। রাজস্থানের উট চালকদের যে লোকগীতি টপ্পা বলে খ্যাত ছিলো, শোরী মিয়া যে টপ্পাকে ধ্রুপদের গুড়ো মিশিয়ে তুলে দিয়েছিলেন রাজা মহারাজা আর বড় বড় লোকেদের জলসাঘরে। সেই টপ্পার ঘাড় থেকে উর্দু হিন্দির ভূত তাড়িয়ে জলসাঘর থেকে নামিয়ে একেবারে শোভাবাজারের বটতলায় এক আটচালা ঘরে এনে তুললেন রামনিধি গুপ্ত। দর্শকের আসনে কামার, কুমোর, মুচি, জমিদার, রাজা সব সমান। বিনে পয়সায়। বর্ধমানের রাজা এসে পরিচয় লুকিয়ে এখানেই মাথা গুঁজে শুনে তৃপ্তি মেটান, কুমিল্লার জমিদার পয়সা দিয়ে লোক পাঠালে রামনিধি পয়সা ফেরত দিয়ে বরঞ্চ জমিদারকেই আমন্ত্রণ জানান শোভাবাজারের আমশ্রোতার হাটে।
এখানেই ওস্তাদের মারটা দিয়ে দেন নিধুবাবু। তাঁর কাছে বাংলা ভাষা, বাংলা সঙ্গীত, বাংলার সাধারণ মানুষের অপরিশোধযোগ্য ঋণ এখানেই। বাবুসঙ্গীতকে তিনি সাধারণ মানুষের শ্রবণের নাগালে নিয়ে আসেন। উর্দু হিন্দির ছ্যুৎমার্গ থেকে বাংলা ভাষার প্রাণে নিয়ে আসেন। গানের সুরেই রামনিধি বলেন ‘বিনা স্বদেশী ভাষা, মেটে কি আশা?’
এর বাইরে শ্রীমতীর সঙ্গে প্রেম, কেরাণীর চাকরিতে বিনয় এবং সততা ইত্যাদির গল্পও শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদেরকে বলেন। বলেন রামনিধির তিন বিবাহের কথা। কোনো স্ত্রী এবং সন্তানেরই বেশিদিন বেঁচে না থাকার কথা ইত্যাদি।
কিন্তু এতোকিছু জেনেও ঠিক তৃষ্ণা মেটেনা, এটুকু নির্দ্বিধায় বলতে পারি। নিধুবাবুর প্রসঙ্গে এলেই সবাই কেবল শ্রীমতীর প্রেমে গিয়ে ঠেকে। তাঁর জীবন এবং সঙ্গীতে এই প্রেম ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, সে অতীব সত্যি। কিন্তু আমার ধারণা রামনিধি গুপ্ত আর টপ্পা গানের এই বিবর্তন বুঝতে জানতে হবে সমকালীন সেই সময়টাকে।
বৃটিশ শাসনের প্রথম আমল, যখন ইংরেজরা ধীরে ধীরে বিস্তার ঘটাচ্ছে তাদের শোষণের হাত… স্থানীয় রাজা, জমিদার, রায় বাহাদুরদের ক্ষমতা, রাজত্ব, দাপট, সম্পদ, একক আধিপত্য আর অত্যাচারের রঙ বদলাচ্ছে… হিন্দু মুসলিম পরস্পর সচেতন (কিংবা অসচেতন) হচ্ছে নিজ নিজ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে… প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষা ব্যাবস্থার নয়া রূপ… মানুষের চিন্তা চেতনা রুচিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করছে একটু একটু করে… ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করছে রাজনীতিক মূল্যবোধ… সেই সময়টিকে বুঝতে হবে, জানতে হবে। একই সময় বা কাছাকাছি সময়ে কিন্তু আরেক রাম, রামপ্রসাদ সেন গান বাঁধছেন ‘মনরে কৃষিকাজ জানো না’!
কিন্তু এতোকিছু জেনেও ঠিক তৃষ্ণা মেটেনা, এটুকু নির্দ্বিধায় বলতে পারি। নিধুবাবুর প্রসঙ্গে এলেই সবাই কেবল শ্রীমতীর প্রেমে গিয়ে ঠেকে। তাঁর জীবন এবং সঙ্গীতে এই প্রেম ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, সে অতীব সত্যি। কিন্তু আমার ধারণা রামনিধি গুপ্ত আর টপ্পা গানের এই বিবর্তন বুঝতে জানতে হবে সমকালীন সেই সময়টাকে।
ধ্রুপদী সঙ্গীতের বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাজা, বাদশা, জমিদার, রায় বাহাদুররা। শোষিত জনগনের অধিকারই ছিলো না সেই সঙ্গীত শ্রবণের। ‘গরীব ফকিন্নি’গুলো গাইবে বাউলা গান, কবিগান, আখড়ার গান ইত্যাদি। ক্ল্যাসিক্যাল শুধু বাবুদের জন্য। রামনিধি গুপ্ত যে হিসেব দিলেন পাল্টে। শাসন শোষণ আর ক্ষমতার দিগ্বদলের সঙ্গে সঙ্গীতের এই বিবর্তণের সমন্বয় খোঁজা যেতো। বইয়ের ভূমিকায় শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন ব্যক্তি রামনিধি গুপ্তকে জানতে তাঁর পরিশ্রমের কথা, তথ্যের অপর্যাপ্ততার কথা। কিন্তু সেদিকে অতোটা শ্রম না দিয়ে তিনি যদি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে রামনিধি গুপ্তকে জানার চেষ্টা করতেন, তাহলে হয়তো উপন্যাসটার ব্যাপ্তি বাড়তো, পূর্ণাঙ্গ হতো। কিন্তু তিনি ওদিকে হাঁটেননি অথবা হাঁটতে চাননি। ফলে বাংলা গানে এই যে বিপ্লবটা ঘটে গেলো কিংবা শুরু হলো, তার শুধু তথ্যটাই পেলাম, প্রেক্ষাপটটা জানা হলো না। জানাটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেলো। একজন রামনিধি গুপ্ত হুট করে সমাজে, রাষ্ট্রে আর সংস্কৃতিতে একটা পরিবর্তন বা বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পারেন না, অন্য অনেক কিছু প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে জড়িয়ে থাকে। সেখান থেকে শুধু একজন ব্যক্তির কথা আলাদা করে বললে পুরোটা বোঝা যায় না। ‘পরমনিধি’তে এই ঘাটতিটুকু রয়ে গেলো।
যাহোক, নিধুবাবু যে সর্বত্রই প্রশংসিত হয়েছিলেন তা কিন্তু না। বঙ্কিমচন্দ্র বদনাম করেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তো বাংলা সঙ্গীতের অবনতির জন্য ভারতচন্দ্র আর নিধুবাবুকেই দায়ী করেছেন। প্রধান অভিযোগ ছিলো অশ্লীলতা। যদিও পরবর্তীতে দেখা গেছে রামনিধি গুপ্তর গানের স্টাইল নকল করে অনেক অশ্লীল গান রচিত এবং গীত হয়ে নিধুবাবুর টপ্পার নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে! শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নাকি নিধুবাবুর নামও শুনতে চাইতেন না। যদিও স্বামী বিবেকানন্দ যখন বৈষ্ণবচরণ বসাকের সঙ্গে যৌথভাবে ‘সংগীত কল্পতরু’ সম্পাদনা করেছিলেন, সেখানে রামনিধি গুপ্তর চারটে হাফ আখড়াই ঠাঁই পেয়েছিলো। রাজা রামমোহন রায়ও কদর করেছিলেন নিধুবাবুর টপ্পাকে।
যাহোক, টপ্পা যাঁদের শোনা নেই, তাঁদের জন্য রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের এই অ্যালবামটির লিঙ্ক সংযুক্ত হলো—
[শুনতে ক্লিক করুন]