ঢাকার মঞ্চে মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠতম উপন্যাসের মঞ্চায়ন : কতটুকু সফল হলেন সৈয়দ জামিল আহমেদ?
বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের অসামান্য উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র মঞ্চায়ন দেখলাম আজ। যেদিন এই উপন্যাসটি পড়েছিলাম সেইদিন থেকে এই উপন্যাসটিকে এককভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস বলে মনে করি। গভীরভাবে স্বপ্ন দেখি উপন্যাসটি নিয়ে একদিন চলচ্চিত্র নির্মাণ করবো। যদি আরও পঞ্চাশজনও এই উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তবুও আমি যখন নিজেকে এই উপন্যাসের চিত্রায়নে নিজেকে প্রস্তুত মনে করবো তখন আমি একান্নতম বারের মত এই উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে হাজির করবো। এমন এক গভীর ইচ্ছা ও অঙ্গীকার মনে লালন করি। তাই নিজের এত প্রিয় একটি উপন্যাসের মঞ্চায়ন দেখতে যাওয়াটা একটি বিশেষ ঘটনা বটে।
শহীদুল জহিরের অন্য সব লেখার চাইতে তাঁর প্রথম এই উপন্যাসটি অনেক জটিল। এর চলচ্চিত্রায়ন সহজ হবার নয়। যারা এই টেক্সট সামলাতে পারবেন না তারা এমন টেক্সট নিয়ে কাজ না করাই উত্তম। এতে মহত্তম একটি সৃষ্টির কেবল অবমাননাই হয়।
ঢাকার মঞ্চে নাট্য নির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদ এক বিশিষ্ট নাম। সৈয়দ জামিল আহমেদ কোনো কাজ করছেন কেবলমাত্র এটুকুই যথেষ্ট সে কাজ নিয়ে উৎসাহ তৈরি হবার জন্য। তাই প্রত্যাশার পারদ অনেক উর্ধ্বে ছিল আজ। সে প্রত্যাশা পুরোটা পূরণ হয় নি।
সৈয়দ জামিল আহমেদ এবং তাঁর দলের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র সফল রূপায়ন হয়নি। উপন্যাসের গল্পটি খুব সুন্দর ও কার্যকরভাবে তিনি বলতে পেরেছেন কিন্তু শহীদুল জহিরের পুরোনো ঢাকার আবহ, মহল্লার মানুষের টেনশন ও আঞ্চলিকতার বুনন মঞ্চে সার্থকভাবে ফুটে ওঠেনি।
সৈয়দ জামিল আহমেদ এবং তাঁর দলের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র সফল রূপায়ন হয়নি। উপন্যাসের গল্পটি খুব সুন্দর ও কার্যকরভাবে তিনি বলতে পেরেছেন কিন্তু শহীদুল জহিরের পুরোনো ঢাকার আবহ, মহল্লার মানুষের টেনশন ও আঞ্চলিকতার বুনন মঞ্চে সার্থকভাবে ফুটে ওঠেনি।
যতটুকু আবহ তৈরি হয়েছিল নাটকটির পাত্র-পাত্রীদের অভিনয়ে, তাদের সংলাপ প্রক্ষেপণে ঠিক ততটাই ক্ষতিকারক ছিল নাটকটির আবহসঙ্গীতের ব্যবহার। চরিত্রগুলোর অভিনয় কুশলতায় যে আবেগের বুনট তৈরি হয়েছে তা চুরমার করেছে আবহসঙ্গীতের অনর্থক অত্যাচার। সঙ্গীতের ব্যবহার নাটকে তৈরি হওয়া আবহকে এতটা ক্ষতি করতে পারে তা আজ যতটা বুঝলাম এর আগে এতটা কখনও বুঝিনি। এমন আনাড়িভাবে সঙ্গীতের ব্যবহারের কারণ অনুধাবন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি। জানিনা এ কোনো নিরীক্ষা ছিল কি-না, যদি সে রকম কিছু হয়ে থাকে তাও যে ব্যর্থ হয়েছে তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
এতটা সমস্যা সত্যেও সৈয়দ জামিল আহমেদ এবং তাঁর দৃশ্যায়নের কুশলতা ভীষণ মনোগ্রাহী হয়েছে। শহীদুল জহিরের সবচেয়ে জটিল টেক্সটকে মঞ্চে এভাবে হাজির করতে পারার সক্ষমতা হয়ত কেবলমাত্র সৈয়দ জামিল আহমেদেরই আছে। এই উপন্যাসের যে বক্তব্য তা ঢাকার মঞ্চে উপস্থিত হতে দেখাটাও একটি বড় ঘটনা। এই সাহস, এই দৃঢ়তা সচল মননের কাজ কারবার। যা ঢাকার মঞ্চে সত্যিকার অর্থেই অনুপস্থিত।
নাটকটির তরুণ সকল পাত্র-পাত্রীদের অভিনয়, সংলাপ প্রক্ষেপণ ও গতি দেখবার মত বিষয়। এমন পরিশ্রম আর টাইমিং কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়েই পাওয়া সম্ভব। যা সত্যিই মুগ্ধ করেছে। সৈয়দ জামিল আহমেদের নাটক দেখা যে একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্জন তা এ নাটক দেখতে গিয়েও মনে হয়েছে। তিনি সত্যিই আলাদা সেই কারণেই হয়ত তাঁর না-পারাগুলোও বিশেষভাবে আহত করে।
শেষ কথা, যাঁরা এখনও সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ দেখেন নি, তারা বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে নাটকটি দেখতে চেষ্টা করুন। বিশ্বাস করুন, ঢাকার মঞ্চে এমন নাটক দেখার ভাগ্য কদাচিৎ হয়। সেই সুযোগ হেলায় হারানোর মত বিষয় হতে পারে না। ২০ মার্চ পর্যন্ত নাটকটির মঞ্চায়ন হবে। দেখে ফেলুন বন্ধুগণ।