একাউ ডিউকারের গল্প
থেমবা
ডাক্তার যখন কথা বলা শুরু করে, তখন তার দাদিমা দু’হাতে কান চেপে ধরেন। ‘প্লিজ, আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না।’ ডাক্তার যতক্ষণ পর্যন্ত দাদিমার কবজি চেপে ধরে এবং তারপর আলতো করে মাথার শুভ্র কেশগুচ্ছ থেকে সরিয়ে দেয়, ততক্ষণ তিনি বিড়বিড় করতে থাকেন।
‘এটা খুবই জরুরি’, ডাক্তার নরম গলায় বললো। ‘আপনি জানেন, ভেন্টিলেটর কি জিনিস?’
দাদিমা মনে মনে আহত হন। কেননা তার নাতি জোর করে তাকে কথা শুনতে বাধ্য করছে। নাতির সেই ধরনের ব্যবহার করা উচিত হয়নি। কিন্তু নাতির হাতে সময়ও ছিল না।
‘মেশিনের সঙ্গে পাইপ লাগানো আছে। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সহজ হবে,’ দাদিমা বললেন।
‘হ্যাঁ। তাদের জন্য পর্যাপ্ত নেই এবং আপনারা… আপনারা উভয়েই আশি বছরের উপরে।’
দাদিমা হুইলচেয়ারে বসা দাদাভাইয়ের দিকে ঘুরে দাঁড়ান এবং আস্তে করে একবার সামনের দিকে ঠেলেন এবং আরেক বার পেছনের দিকে টানেন। এ ভাবেই তিনি সারাদিন দাদাভাইকে হুইলচেয়ারে নিয়ে সময় কাটান। দাদাভাইয়ের সঙ্গে দাদিমা নিরন্তর কথা বলেন, যেন তিনি সত্যিই নিজের সঙ্গে কথা বলছেন।
‘আমরা ঠিক থাকবো’, দাদিমার কণ্ঠস্বরে একগুঁয়েমী ফুটে ওঠে।
‘না, আপনারা ঠিক থাকবেন না!’ বলেই ডাক্তার বুঝতে পারে সে চিৎকার করে বলেছে। তাই সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমা চায়, ‘আমি দুঃখিত।’
বুড়া-বুড়ি দু’জনেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নাতির দিকে তাকান। বুড়ার চোখ বিস্ফারিত এবং চোখের তারায় প্রশ্নবোধক অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। মনে হচ্ছিল বুড়া হয়তো একটা কিছু বলবেন, কিন্তু অপেক্ষার সময় তার দম আটকে থাকে। একসময় অবোধ মেঘের মতো একটা কিছু বুড়ার মুখের উপর দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায় এবং পুনরায় তার চোখেমুখে রাগের চিহ্ন ফুটে ওঠে।
‘দেখুন, আপনাদের জন্য আমি একটা ভেন্টিলেটর আলাদা করে রেখেছি। তবে পুরানো, কিন্তু কাজ চলে।’
এবার দাদিমার কণ্ঠস্বর চড়া হয়। ‘হাসপাতাল কি তোমাকে তাই করতে বলেছে? পুরো একটা ভেন্টিলেটর নিজের জন্য রেখে দিবে?’
‘এই খামের ভেতর আমি বিশদ ভাবে সবকিছু লিখে দিয়েছি। আপনারা যখন কাশতে শুরু করবেন, তখন আপনারা অবশ্যই যা করবেন এবং কোথায় যাবেন ইত্যাদি— সবকিছু লেখা আছে। আমি যদি আসতে না পারি, তখন…’
দাদিমা নাতিকে এমন ভাবে ভর্ৎসনা করছেন যেন নাতির বয়স দশ বছর এবং সে যেন মিসেস সিথহোলের বাগানের গাছ থেকে পীচ ফল চুরি করার সময় তার কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েছে।
‘এটাই একমাত্র পথ’, একরকম মরিয়া হয়ে নাতি বললো। ‘আপনি যখন অসুস্থ হবেন, তখন এই ভেন্টিলেটর ছাড়া আপনার অন্য কোন উপায় থাকবে না।’
‘কিন্তু আমরা তো অসুস্থ না।’ বলেই দাদিমা বুড়ার দিকে ঘোরেন এবং বুড়ার ভুড়ির ওপর আলতো ভাবে চাটি দেন। ‘তুমি কি অসুস্থ, জাবু? দেখছো, সে অসুস্থ না।’
ডাক্তার নাতি দাঁত কিটমিট করে। তারপর সে জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা খাম বের করে টেবিলের ওপর রাখে।
‘এই খামের ভেতর আমি বিশদ ভাবে সবকিছু লিখে দিয়েছি। আপনারা যখন কাশতে শুরু করবেন, তখন আপনারা অবশ্যই যা করবেন এবং কোথায় যাবেন ইত্যাদি— সবকিছু লেখা আছে। আমি যদি আসতে না পারি, তখন…’
দাদিমা তার হাতের নাগাল থেকে খামটা দূরে সরিয়ে রাখেন। তারপর নাতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বললাম তো আমরা ঠিক আছি।’
‘আপনি কিন্তু পড়ে দেখেননি’, নাতি বললো। তারপর সে হাত ঘড়ির দিকে তাকায় এবং নিঃশব্দে কিছু একটা শপথ করে। কাজে পৌঁছুতে তার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
‘এই খামের ভেতর কি লেখা আছে, তা আমি জানি। কি, জানি না জাবু?’
বলেই দাদিমা বুড়ার হুইলচেয়ার আগের চেয়ে আরো জোরে ঠেলতে শুরু করেন। তারপর বুড়া যেমন একসময় যান্ত্রিক প্রেস চালাতেন, অনেকটা প্রেস মেশিনের পিস্টনের মতো সেই রকম আগে-পিছে ঠেলতে থাকেন।
‘তুমি কি দেখেছ?’ নাতিকে উদ্দেশ্য করে দাদিমা চোখেমুখে বিজয়ীর হাসি ফুটিয়ে বললেন। ‘তোমার দাদাভাই আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। আমরা ভালো থাকবো।’
ডাক্তার কাঁধের ওপর ঝোলা ঝুলিয়ে নেয় এবং ভাবতে থাকে দেরি করে আইসিইউতে ঢুকে ডাক্তার ফরসনকে কি জবাব দেবে। ভাগ্য ভালো হলে হয়তো ডাক্তার ফরসন তখনও আইসিইউতে উপস্থিত হবেন না।
‘প্রতিজ্ঞা করেন, আপনি খামের ভেতর লেখাটা পড়বেন?’ দরজায় দাঁড়িয়ে ডাক্তার দাদিমাকে বললো। সে জানে, দাদিমা খাম খুলে পড়বেন না।
অকস্মাৎ বুড়ার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একধরনের অবসাদগ্রস্থ হাসি বেরিয়ে আসে, যা তার মুখ মোচড় দিয়ে কিম্ভুত আশ্চর্য এক চেহারা তৈরি করে। গাড়িতে বসার পরে ডাক্তার শুনতে পায় পেছন থেকে দাদিমার কন্ঠস্বর।
‘আমাদের নিয়ে চিন্তা করো না, থেমবা। আমরা ভালো থাকবো। যাও এবং মনোযোগ দিয়ে কাজ করো।’