দাগ
এই মার্চের ২২ তারিখে জন্মদিন ছিলো; জানানো হয়নি।
‘চিতার অবশিষ্টাংশ’ নভেলায়, শ্মশান পুরোহিত কার্তিক হালদার বলছে– ‘পুরুষ ভুট হয়ে জন্ম নেয় তাই বোধ হয় নমিত হবার কষ্ট এতো, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর আকাঙ্ক্ষাটা প্রবল।’
কয়েক বছর পরে ‘কাজলরেখা’য় লিখেছিলাম– ‘মা কি তার জন্মদাগটা এখনো খোঁজে? না পেয়ে বহুদিন বলতো, দু’একজনের চামড়ার তলে থাকে, দেখা যায় মরণের সময়– সে কি জন্মেছে?’
ওদিকে গার্সিয়া মার্কেস অন্যভাবে বললেন– ‘সেটাই তোমার জন্মভুমি যেখানে তোমার পূর্বপুরুষের কবর আছে।’
শরীরের জন্মদাগটা তো সবার দেখা যায় না, তাই বোধ হয় হাঁটতে হয়, রেখে যেতে হয় পায়ের ছাপ, অনুক্ত বেদনায় তাকিয়ে থাকা– দ্যাখো– এই-যে-আমার ফুটপ্রিন্ট!
যশোর সদর থেকে খুলনায় যাওয়ার পথে সামান্য এগোলেই মুড়লী; ডাইনে মাইলখানেক পার হলে কাজীপুর-মুনশিবাড়ি– আমার দাদাবাড়ি। ৬ পুরুষের স্থানিক ইতিহাস আমার জানা। স্থাপনা ক্ষয়িষ্ণু। কেউ আছে, কেউ – কেউ নেই।
শরীরের জন্মদাগটা তো সবার দেখা যায় না, তাই বোধ হয় হাঁটতে হয়, রেখে যেতে হয় পায়ের ছাপ, অনুক্ত বেদনায় তাকিয়ে থাকা– দ্যাখো– এই-যে-আমার ফুটপ্রিন্ট!
‘আমি মীরা ও সুশীলদা’য় লিখেছিলাম– ‘তো কাজীপুরের দুইশো বছরের ঐতিহ্য গড়ে ওঠে আজিম বিশ্বাসের ভিটে মাটি থেকে। ব্রিটিশ পিরিয়ডে যশোর থেকে প্রকাশিত যশোর গেজেটে তার প্রমাণ বিদ্যমান বলে ধারণা করা হয়। কাজীপুরে মুনশি বাড়ির প্রধান দুই পূর্বপূরুষ উমেদ রাজ ও কুমেদ রাজ তৎকালীন রাষ্টদ্রোহিতার অপরাধে আফগান থেকে পালিয়ে আসেন সুন্দরবন ঘুরে এ-বাংলায়। তারা উচ্চশিক্ষিত আর পাঠান বংশোদ্ভূত। নিজ দেশে কী ধরনের অভ্যুথানে নিজেরা জড়িয়ে পড়েছিলেন এখানে এসে কাউকে তারা সেভাবে কিছু জানাননি। সুদর্শন পাঠান দুই যুবকের এমন শৌর্যবীর্য আর আরবি-ফারসির পাণ্ডিত্য দেখে আজিম বিশ্বাস তাদের বিয়ে দেন নিজ দুই মেয়ের সঙ্গে। যুবকদ্বয় বিয়ে-পরবর্তী পেশাহিসেবে বেছে নেন কোর্টকাছারির কাজ। এই পরিবারেই পরবর্তী কালে জন্ম নিলেন বিখ্যাত মাওলানা আফতাবউদ্দীন আর ভাই জাহাতাবউদ্দিন।’
‘মূলত উমেদ রাজ কুমেদরাজরা তাদের পাঠান কিংবা খান বংশ লুকিয়ে ফেলার কারণে যেটা হয়েছিলো পরবর্তী বংশধররা মাতৃকুলের অর্থাৎ আজিম বিশ্বাসের বংশকে যেমন গ্রহণ করতে পারেননি, তেমনি পিতৃপুরুষের প্রকৃত বংশকে উন্মুক্ত করাও হঠাৎ করে সহজ হয়ে না ওঠায় পূর্বপুরুষদের ট্রেড অর্থাৎ মুনশি হিসেবে নিজেদের পরিচিত করে তোলেন।’
দুই বছর আগে আব্বার ঘরটি দেখার জন্যে কাজীপুরে গিয়েছিলাম। প্রায় ত্রিশ বছর পরে। আলি চাচা কী সব যেন বলছিলেন। ‘রাজবাড়ি’, ‘জমিদারি’, ‘এস্টেট’– শব্দগুলো যখন বলছিলেন, বেশ অবাক লাগছিলো। আমার জীবনের গৌরবের কোনো গল্প আছে বলে ভাবি না, সবসময় সেই আখ্যানই লিখতে চেয়েছি, যা স্ফীত সম্পদের বিরুদ্ধে; যা হয়তোবা পারিনি। সম্পদমুখী সুখ-দু:খের লেখা লিখিনি বলে বইগুলোর ২য় সংস্করণও হয়নি। পরিজনদের বেইজ্জতির সময় পাশে দাঁড়াতেও পারিনি।
কাজীপুর থেকে ষষ্ঠিতলায় ফিরছি। প্রেসক্লাবে শুনলাম, সখিচান মারা গেছে! আশ্চর্য হয়ে ভাবি, কাজীপুর থেকে ফিরে কিছুটা ঘোরের ভেতর ছিলাম; এটা কী হলো? লাশ কাটা ঘরে সখিচানের চেহারাটা মনে পড়ে। পরিচিত ছিলো ও শহরে। সদর হাসপাতাল ওকে রিটায়ার্ড করায় বয়স পূরণের আগেই। খুব ব্যথা পেয়েছিলো। ব্রিটিশ পিরিয়ড থেকে ওর পূর্বপুরুষরা এই পেশায়। সরিয়ে অন্য লোককে অন্যায্যভাবে পদ দেয়া হলো। ওকে বয়স পূরণের আগে সরানো হলো। শুধু তা-না, রিটায়ার্ড করানো হলো, যে পেশায় ছিলো তার চেয়ে ওর বিচারে নিচু পদে। মনে হচ্ছিল জন্মদাগটা সরিয়ে দেয়া হলো। ভেঙে পড়েছিলো। শুধু ওর জন্যে শুরু করেছিলাম একটা লেখা; জায়গায় যে আসছে, (‘ইভান এলিচের মৃত্যু’র পর পদটা যেভাবে তার সহকারী পাবে, তার যে তৃপ্তি– তেমনি) ঘরের ভেতর মদের আসরে একত্রিত করাটা জরুরি ছিলো, হাসপাতালের পিলার পোস্ট থেকে কিছুটা নিচে নেমেছিলো ফোর ফরটি ভোল্টেজের বিদ্যুতের তার। পাশে ব্রাকেটের প্রায়-তার-ঘেঁষে বসেছিলো অপূর্ব এক নিশিপাখি। লোকটার ভেতর মাতাল অবস্থায় নিশিপাখিটা ধরার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হ’ল। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে যখন পড়লো, সখিচান হাতে তুলে নিয়েছিলো বাঁশি। প্রান্তিক সীমানায় থেকে ওর আত্মকথনে লিখেছিলাম: ‘মৃত্যুকে আমি দেখিনি…তবুও শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিশ্লেষণের সহায়ক হওয়া, অবাঞ্চিত আঘাতের শনাক্তকরণ, ঘেঁটে ঘেঁটে, কেটে ছিঁড়েও কী বুঝতে পেরেছি–শীতার্ত বিষণ্ণ বিহঙ্গের দিকে তাকিয়ে ভাবলো সখিচান– মৃত্যু কী? মৃত্যু কেমন?
এস্টাবলিস্টমেন্ট বা ইনস্টিটিউশন পরম্পরা কেটে, প্রগতির নামে, নতুন জন্ম দেবার নামে, জন্মদাগ সরিয়ে দেয়।
একজন লেখকই শুধু পারে মানুষের জন্মদাগ চিনিয়ে দিতে।
সবাইকে আমার জন্মদিনের শুভেচ্ছা।