:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
তিতাস অধিকারী

গল্পকার

নগরে বহু শ্রেণিশক্র তবুও কোনো অ্যাকশান নেই
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

নগরে বহু শ্রেণিশক্র তবুও কোনো অ্যাকশান নেই

সেলিম মোরশেদকে আমি চিনি না অথবা চিনি, চিনলেই-বা কী আর না-চিনলেই-বা কী এসে-যায়! চেনা বলতে আসলে কী বুঝি—কেমন চোখ, মুখ, নাক, হাত, পা, বুক, পিঠ, চুলের রঙ, গেটাপ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তাতে কী ফল হবে! বহুদিন পর রাস্তায় গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগলে প্রথমে তো বহু ব্যবহৃত ‘সরি’ শুনতে হবে; তারপর একটু খেয়াল করলে পাল্টা প্রশ্ন করবেন— কোথায় যেন আপনাকে দেখেছি ঠিক মনে করতে পারছি না! কোথায় যেন, কোথায় যেন! বলবেন কোথায়?

সত্যি করে বলুন তো শিল্প-সাহিত্যকে আমরা প্রথমদিকে কতটুকু চিনে উঠি, বড়জোর আংশিক চিনে উঠি। কিন্তু এ রকম কেন হয়? এটা শিল্প-সাহিত্যের কোনো পর্যায় কিংবা যাদুমন্ত্র কিনা আমি তো জানি না! আমি বলি কি— সময় লাগে তো সময় নিন, তখন দেখবেন সময়মতো মহৎ সাহিত্যকর্ম আপনার মাঝে আস্তে আস্তে প্রভাব বিস্তার করছে। তবে সব সাহিত্যকর্ম কি আর প্রভাবিত করতে পারে, হ্যাঁ, খুব কম জন পারে। সেলিম মোরশেদ সেই প্রভাবশালী কথাসাহিতত্যিকদের অন্যতম জন। ফলে ঘুরেফিরে আমরা হয়ে উঠি তার গল্পের জ্যান্ত চরিত্র, বিশ্বাস না হলে নিজেই দেখতে পারেন; গল্পনন্দনও তো সেই ইঙ্গিত দেয়।

সেলিম মোরশেদ বুকের কিছু অংশ নিজের জন্য রেখে দিয়েছেন! আচ্ছা সেটা থাকে থাকুক। কারণ তাঁর তো লেখার মধ্য দিয়ে নিজেকে বহুগুণসম্পন্ন প্রমাণ করতে একটুও সমস্যা হয়নি। ফলে এই গুণী কথাসাহিত্যিকের- ‘রক্তে যতো চিহ্ন’ গল্পটি যতবার পাঠ করি ততবার আমি নিছক বিশু হয়ে যাই। কেননা বিশুর কিছু জিজ্ঞাসা আমারও জিজ্ঞাসা, হাজার হাজার মানুষের জিজ্ঞাসা। বিপ্লবের নামে আসলে কী হয়, বিপ্লবের নেতৃত্ব কাদের হাতে, বিপ্লবের ভুল নিশানা, বিশুর পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় হাসপাতালের জানালা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর পার্টির কেউ যদি মোটর সাইকেলে তাকে তুলে বাঁচিয়ে দেয় মনে মনে সাহায্য প্রার্থনা এবং শেষমেষ গুলি খাওয়া অব্দি পার্টির প্রতি তার অটুট কমিটমেন্ট-কেন্দ্রিক সততা মূলত একটা ফলাফল। ফলে তিন-চার বার রিমান্ডে পুলিশ ফলাফলশূন্য, মুখ দিয়ে কিছু বের করতে পারেনি। বিশুর এই সততাকে আমরা শ্রদ্ধা করি সন্দেহ নেই এবং এটাই বীর বাঙালির বিপ্লবী যুবচেতনা। এখানে গল্পকার সেলিম মোরশেদ, আমি, আমরা ও বিশু মিলেমিশে একাকার। কেননা বিশু সামাজিক সত্য স্বীকারে প্রণোদিত এবং সে জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ফলে একসময় দেখা যায় বিশু আর জনগণের অংশ নেই, সম্পূর্ণ বিছিন্ন। এই বিছিন্নতাবোধ মহৎ সাহিত্যকর্মের নামান্তর এতে কোনো সন্দেহ নেই।

মূলত গল্পের মধ্যে আমি আরেকটি প্রতিগল্পের সন্ধান পাই সেখানে— রাষ্ট্র ও ব্যক্তি একেবারে মুখোমুখি। সিস্টেমটা এখানে এত গোলমেলে যে ব্যক্তিকে প্রশ্নের সামনাসামনি দাঁড় করিয়ে দেয়, কিন্তু নিজে অথর্ব। মেঘনাদবধ কাব্যেও আমরা প্রতিকাব্য লক্ষ করি। উপরন্তু এখানে সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত সেইসব প্রশ্ন বিশুকে বার বার পীড়া দেয়। যার কারণে পুলিশ হেফাজতে থাকা বিশু পার্টির কেন্দ্রীয় অফিস পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য বার বার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে কেননা কিছু প্রশ্ন অমীমাংসিত, কিছু নিয়মনীতির সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা আছে বৈকি বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ এ রাষ্ট্র, সমাজ ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে লড়ে যাওয়া বিশু সঠিক বিপ্লবের প্রয়োজন অনুভব করে। দলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সংশোধনের জন্য বিশু শেষমেশ জীবন বাজি রাখে, বেঁচে থাকার জন্য নয়। এই মূল্যবোধই হল ব্যক্তির মধ্যে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা। যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা অথবা সেলিম মোরশেদে বাংলাদেশে বহু শাখাপ্রশাখায় বিস্তৃত।

সেলিম মোরশেদ আকাশ ভেঙে আকাশভাঙা মাপজোপ নিয়ে নিজে ভেঙে নিজেকে বারবার প্রতিস্থাপন করে দেখেছেন কিন্তু অধিকাংশ সময় মনঃপুত হয়নি। ফলে আবারও গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে গেছেন ভূ-চক্রের সমস্ত অনু-পরমানুতে, দুঃখ-বেদনায়।

যে প্রশ্ন ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের বহুকাল আগে করার কথা ছিল সেই প্রশ্ন সেলিম মোরশেদ বিশুকে দিয়ে করিয়ে তথাকথিত সুশীল শিক্ষিত সমাজকে সংশোধন করে সংশোধনের জন্য তাগিদ দেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার বিশু প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা যাঁতাকলে পড়ে পালাতে গিয়ে জীবন দিল সেটা রাষ্ট্রব্যবস্থার লালবাত্তি। ফলে ভাবুন এবার আপনার করণীয় কী। কারণ আপনি সহজ সাধারণ মানুষ, বাঁচতে চান বৈ কি, যে কোনো মূল্যে বাঁচতে চান, সেটা কিন্তু নিজের জন্য। পার্থক্য এইখানেই, বিশু নিজের জন্য নয় জনতার জন্য বাঁচতে চেয়ে জনতার অন্ধত্ব বুঝতে পারে। বিশু টের পায় যেখানে শ্রেণিশক্রর ছড়াছড়ি সেই এলাকা বহাল তবিয়তে আছে। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকায় বিপ্লব বিপ্লব ভাব নিয়ে প্রতিবিপ্লবের ছড়াছড়ি, যারা সত্যিকারে পুঁজিবাদের লালিত দোসর। তাহলে কি সমাজ এমনভাবে সাজানো যে, আপনি যা-ই করেন কিংবা যেখানেই যান সব মাকাল ফল! সত্য উদঘাটন করা মানে বিচ্ছিন্নতা, এমন কি মৃত্যু! তবে কেন এবং কার জন্য সেটা পরিষ্কার হওয়া দরকার এবং সেটা না হওয়ায় কারণে শেষ পরিণতি আন্দাজ করে বিশু বলে, বলতে একপ্রকার বাধ্য হয় কারণ শেষাবধি যদি বলার বা জানার সময় না পাওয়া যায়, তাই সরাসরি তার আক্ষেপ— নগরে বহু শ্রেণি শক্র, তবু কোনো অ্যাকশন নেই।

ভাবুন কী জিম্মিদশা!
মানে হয়!

সেলিম মোরশেদ আকাশ ভেঙে আকাশভাঙা মাপজোপ নিয়ে নিজে ভেঙে নিজেকে বারবার প্রতিস্থাপন করে দেখেছেন কিন্তু অধিকাংশ সময় মনঃপুত হয়নি। ফলে আবারও গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে গেছেন ভূ-চক্রের সমস্ত অনু-পরমানুতে, দুঃখ-বেদনায়। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, আকাশে আমরা শুধু তখন আলো দেখি, বিপুল ভয়ংকর শব্দ শুনি, কিন্তু আকাশ দেখি না, সেলিম মোরশেদ আপনি তখন নিশ্চয় আকাশ দেখে আকাশ এঁকেছেন আর সম্ভবত এ জন্যই জেনেছেন বাঘি ধর্ষিত হতে হতেই একটু যৌনসুখ খুঁজে পায়। কী ভয়ংকর! কী ভয়ংকর!

সুখ তাই না, হ্যাঁ, সবাই আসলে সুখীই হতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন করা দরকার সুখ বিসর্জন দিয়ে আমরা কী হতে চাই? সেলিম মোরশেদ আজীবন সুখ বিসর্জন দিয়ে আসলে কি চেয়েছেন! প্রশ্নটা অমীমাংসিত। কারণ চেতনার দাবিদার মানুষ জনচেতনা পুঁজি করে মুনাফা চায়, পদপদবি চায়, খ্যাতি চায়, গাড়ি চায়, বাড়ি চায়, মাংসের টুকরো চায়, মদ চায়, মেয়েমানুষ চায়, সম্মান চায়, ষড়যন্ত্র করতে চায়, উৎখাত করতে চায়, ছিনিয়ে নিতে চায়, উৎসব করতে চায় এবং সবশেষে খুশিতে গদগদ হয়ে ক্যালেমান্টু হামবড়া ভাব দেখায়, সে যে কী একটা ব্যাপার-স্যাপার ঘটিয়ে ফেলবে সে নিজেই জানে না, আর জানবে কেমনে? ব্যাটা সরকারি মাল তা কোন ব্যাটা সরকারি হয় জনগণের জন্য? ওমুক তমুক সবাইকে তো বলতে শুনি, খুব আরামের চাকরি, কাজ নাই উপরি ইনকামও সেই রকম। ভাই আপনারা এত যে হামবড়া ভাব নেন তা বিশুর জন্য কোনো সদুত্তর আছে তো? উত্তর রেডি করে রাখুন, যে কোনো সময় বলতে হবে কেন নিজের সবকিছু মহৎ হামবড়া দেখেন! হ্যাঁ, কেন? সেলিম মোরশেদ এ দলের লোক না ফলে গল্প আছে একেবারে জীবনবোধের সাথে মানানসই।

প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সাংঘাতিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে জেঁকে বসা ঔপনিবেশিকতা, দেশভাগ, ধর্মব্যবসা, ভাষা-আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, লোকায়ত ভাব দর্শন, সবুজ অরণ্য, মাঠ, নদী, ফুল, পাখি, বন্যা, দুর্ভিক্ষ আমাদের সাহিত্যের মূল বিষয়বস্তু। এটাই তো মনে করি আমরা। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী এদেশে যে সর্বহারা ও বিভিন্ন বিপ্লবী দল ও তাদের বিপ্লবী আন্দোলনের মনস্তাত্ত্বিক একটা প্লাটফর্ম সেটা সেলিম মোরশেদের গল্পে খুঁজে পাওয়া যায়। সেলিম মোরশেদ আপনি নিজেই তো বলেছেন— মানুষের জ্ঞান প্রকৃতি সমান! তাহলে মগজ ভর্তি করে দিন দয়ালু সব প্রকৃতির উপমা উপসংহারে। তাহলে দেখতে পাব শুদ্ধতা। তারপর ফিরিয়ে আনতে হবে অশুদ্ধকে সমাজে শুদ্ধ করে। এইখানে অপরাধীকে ক্ষমা করে ফিরিয়ে আনার ঐশ্বরিক যে ব্যাপার সেটাই তো কাব্য কোকিল! আহা, কুহু কুহু…! কিন্তু একটা আক্ষেপ আমায় কিন্তু বারবার ধাক্কা দেয়। ইশ্! একবার যদি বিশুর সাথে একটা জাম্পেশ আড্ডার ব্যবস্থা করা যেত! সেই আক্ষেপ বুকে নিয়ে ছুটি, ছুটতেই থাকি, এভাবে ঠিক কতদিন তা জানি না। তারপর এসে দেখি অনেক লোকে— লোকারণ্য, এর মধ্যে থেকে বিশুকে খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা না, তবুও হাল ছাড়ি না। খুঁজতে খুঁজতে খুঁজেই চললাম দিন মাস বছর বছর, তারপরও খুঁজতে থাকি। তবে সাথে আরো একটি অতিরিক্ত কর্ম যোগ করি, সাথে আরো এক সঙ্গী নেব চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত! সে হল যে কখনো বিশুকে খুঁজে পায়নি তাকে; এবার দু’জনে খুঁজব বিশুকে।

তো চলেন যাওয়া যাক!!!

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!