:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

কবি, চিত্রশিল্পী

নিজাম উদ্দিন ও তাঁর কবিতা
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

নিজাম উদ্দিন ও তাঁর কবিতা

নিজাম উদ্দিন প্রতিকৃতি: আরিফুজ্জামান

এক যুগের

এক যুগের পরিসরে আমরা এক একজন লক্ষ জীবন যাপন করছি। কেবল খুনিরাই জীবন থেকে যা নেবার প্রয়োজনমতো নিয়ে নেয়। আমরা শুধু জীবনের রুটি খেয়ে বাঁচি আর মদ পান করি।
শহরে মৈনাকদল—
নিরবচ্ছিন্ন মৌন চোখের ভালোবাসা তাদের।
অপর মানুষ আমরা, তাই তাদের জন্য নিবেদিত সংস্কৃতির নয়া সেতুতেই আমরা খুঁটি গাঁড়ি। আমাদের জীবন যাপনের শর্তে তারা ঢুকে পড়েছে। আমাদের প্রেয়সীরা তাদের উজ্জ্বলতায় মুগ্ধ। তারা যে-পথে চলে, আমরা সেই পথে মালা গাঁথি। তাদের এক জীবনই অসীম হাঁসফাঁস তৈরি করে মননে ও মাটিতে।

 

অন্ধকার কাছে

অন্ধকার কাছে এলে কী করতে পারি, আমাকে পেড়ে ফেললে কার কী হবে? আমাকে ছাড়ানো যায় না, আবার আস্তাকুঁড়ে ফেলাও অসম্ভব।
তোমার যে কিছু সুঘ্রাণ আমার শরীরে, তুমি যাকে মা বলে ডাকো—সে যে আমার মেয়ে! চারপাশে চিৎকার-চেঁচামেচি গুনগুন ভালোবাসায় তোমার নাম। সব ছেড়ে গেলেও আমি আছি সটান, থাকব মহালয়ার সবকটা দিনে।
ত্রিশূল হাতে বধ করার খেলায় নামো, হারা-জেতার ব্যাপার নেই, আছে মিথের ভাঙাগড়া। রক্তারক্তি হোলি আছে, আছে করপোরেটের খেলা। ভয় পেয়ো না, মা-মেয়ে আজ হেসে-খেলে বাঁধবে গান। ছোড়া গুলিতে বেহাত হবে না কেউ, যে মানে না সত্যম-শিবম-সুন্দরম।

 

জেসমিন টি

জেসমিন টি আমার প্রিয়, যেমনটি তুমি। চীন দেশের হরেকরকম আয়োজন থেকে আমি তোমাকেই বেছে নিয়েছিলাম। কেন জানি হা কাঁপানো শীতে আমি তোমার দূরাগত উষ্ণতার ছোঁয়া পেতাম একা একা চা পান করে। একটি চায়ের দোকান কতটুকু পরিপূর্ণ হতে পারে, আমি তা দেখছিলাম চায়ের কুণ্ডুলী পাকানো ধোঁয়ারা যখন তোমার রুপ নিতে শুরু করে। অ্যাপ্রন পরিহিতা দোকানি একদিন ঘামধোয়া হাসি মুছে প্রশ্ন করল, আমার সঙ্গে আর কেউ নেই কেন। সেই ক্ষণিক মুহূর্তে আমার মধ্যে ভীষণ তৃষ্ণা জাগল। আর তার পরপরই আমি আরেক কাপ চায়ের অর্ডার করলাম। জেসমিন চায়ের স্বাদ অবিকল এক ও অপূর্বই লাগল। আমি ঠিক করলাম, আর কোনো উষ্ণ স্বাদ যেহেতু আমায় আর টানছে না, আমি একটু বেশি পরিমাণ চা কিনে নেব। চীন দেশের মানুষের সঙ্গে আমার চা-প্রীতির মিল খুঁজে পেয়ে আমি ঠিক করলাম বিষয়টা তোমায় জানাব। এরপর পার হয়ে গেল বেশ কিছু গা হিম করা সময়। ইতোমধ্যে জেসমিন টি আমি রেশনিং করা শুরু করলাম। আর উপায় না দেখে তোমার জন্যে তুলে রাখা কিছু চা পাতার কাঁচা গন্ধ নেবার সময় তোমার কুণ্ডুলীকৃত দেহ এসে আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিলে। মুহূর্তেই স্পষ্ট হলাম, জেসমিন টি সুস্বাদু নিঃসন্দেহে। কিন্তু আমি চীন দেশের মানুষের মতো তার স্বাদ শুষে নিতে পারব না। কারণ আমার যতটুকু নিশ্বাস—জড়িয়ে পড়েছে তোমার অন্তর্গত ঘ্রাণে।

অলংকরণ: রাজীব দত্ত

অন্তরীক্ষ থেকে

অন্তরীক্ষ থেকে উত্থিত সবকটা বৃন্তই ঝরে পড়ছে। বদ হাওয়া বইছে হিমালয় থেকে বয়ে বেড়ানো নীল নির্জনে। মা আমাদের সার-পলি ধোয়া জলে গা ধুয়ালেও কিনারায় শ্যাওলাই বাঁধছে। তিষ্ট ক্ষণকালকে জড়িয়ে জীবন বাইছি আমরা। ফলে দ্রুত হারিয়ে যাওয়াই কপালের চুম্বনে গৃহীত। আজ দিনের মুখ আঁধার করে রেখেছে দিনান্তের অপছায়া। কিন্তু সে দূরছাই বনে গেছে কবেই, পাগলি উন্মনা। বৃন্ত ঝরে পড়ার কালে সে কি বুঝতে পারে, সমুদ্র সাঁতার মানে না? চাঁদ মামার ভালোবাসা পেলেই কেবল সে ক্ষান্তি পায়। হায় উত্থান, তোর কপোলজুড়ে শীৎকার, তোর হৃদয় শূন্য মাঠ, তাই আজ খেলা জমবে। সবাইকে জকি বলছে দাম চড়বে ইফেল টাওয়ারে। আর হ্যাঁ, কেবল চাঁদের বোন মা-ই হবে সেই উত্থিত নন্দিনী। ফ্লাডলাইটে ঢাকা পড়ে যাবে সেই স্রোত আর অলকদাম, হিমালয় থেকে নীল নির্জন। এই হয়, যখন বোকাবাক্সে বাঁধা পড়ে স্বপ্ন আর বাস্তব—যমজ।

 

কেটাসট্রপি শব্দটা

কেটাসট্রপি শব্দটা ভাবতে গেলেই আগে আমার নারী কল্পনা চোখে ভাসত। তখন বালিশের শীতলতাটুকু আগুনছোঁয়ায় কুঁকড়ে যেত। গোয়ালিনীর কাঁচা দুধ, কাঁচাই রেখে দিয়ে নষ্ট আনন্দ পেতাম। ভীষণ অহংকারের কুণ্ডুলী পাকানো কাঁথায় ক্রুরতা ঢাকা পড়ত। গাড়ি-নারীর ভীড়ে আমার প্যাডেল সহজেই ড্রিবলিং করত। দোকানিকে শুধুই দোকানি, আর নারীদের যেকোনো একটা দূরাগত সম্পর্কে বেঁধে ফেলতাম। শুধু শিশুরা আমার কাছ অবাধ বিচরণ করত। শিশুতোষ সবকিছুই বিরল মাতৃত্ব ছাড়া ক্ষমার্হ। তাই স্বভাবদোষ অলংকারটি কেবল পুরুষ ধারণ করত একসময়। এখন নারী-পুরুষের স্বভাব ও লিঙ্গ বদলের ইচ্ছে জাগার সময় এসছে। তাই এখন মনে হয়, মানব সম্পর্কের কয়েকটা অরণ্য আর জনপদ পেরোলেই, আমরা জায়মান জগতে পৌঁছাব। সেসময় সবকিছুই সহজ হয়ে যাবে। যেমন খুশি তেমন সাজে জীবন বইবে নদীর তীরে। জেল-কাচারি হবে শিশুদের হ্যালোইন খেলার জায়গা। আমি তখন বহুস্বর ও সত্তায় মিশে যাব নির্মল।
পূর্বজনেরা হবে মূল, নারীরা কাণ্ড আর শিশুরা পাতা-ফুল-ফল। তখন পুরুষেরা আগাছা হতে চাইলেও কেউ মন খারাপ করবে না। কেটাসট্রপি শব্দের মূলোৎপাটন ঘটবে, অভিধান হারাবে তার ঠিকানা। তারপর দীর্ঘ হাইবারনেশনের স্তব্ধতা ভেঙে জেগে ওঠা মাত্রই সংঘর্ষ ও নির্মাণের পথে হাঁটবে বর্তমান। এখন যেমন নিনাদ শুনছি অন্তর্গত, কেন্দ্রাতীত ধেয়ে আসতে চাইছে সকলে। বাঁধা পড়ুক সবাই, এখন গোলকধাঁধার কাল!

অলংকরণ: রাজীব দত্ত

সারা বেলা

সারা বেলা কিছু সময় কপাল থেকে চন্দ্রবিন্দু সরে পড়ে, মা আর নৈঃশব্দ্যকে ছেড়ে যেতে চায়। বিকেলটা ক্রমশ মরাকটালে ঘুমিয়ে পড়ে।
বালিশ নারীর চেয়েও আপন হয়ে উঠতে পারে যখন নিঃসঙ্গতা ফুরায়। তুমি এলেও তাই সাড়া মেলে না, গৃহকোণে তখন চন্দ্রমল্লিকা ফোটে। ওঠো তোমার ঘেরাটোপ থেকে, মানুষ হাত বাড়িয়েই আছে। তার দিকেই ঝুঁকে পড়ো দ্বিধাহীন।
যদিও গোপন ফিকির চলছে, তবু মাটিলেপা উঠানেই নারীর ঘ্রাণ মিশে আছে। এক আঁজলা জলে তার তেষ্টা মেটাও। যদি পার আরও কয়েকজনকে তার সঙ্গে জুড়ে দাও।
এক ক্যানভাসে শত মানুষ শত রঙে নাচতে পারে। অথচ প্রত্যেকেই তার ছন্দটুকু নিজের গহনেই হারিয়ে ফেলে। আর তখনই চন্দ্রমল্লিকা ফুলবাগান ছেড়ে টাকায় বন্দি হয়।

 

আমাকে কে

আমাকে কে যেন মাঠ ফুঁড়ে হেঁড়ে গলায় বলল, ‘জোছনা খাবলে খা।’ আমি জলে খাবি খেলাম, পা না ছলকেই। চারপাশ থেকে ক্রমশ অন্ধকারময়ীরা কাছে ঘেঁষছে। দেবদারু গাছ থেকে টুক করে কাঠবিড়ালি রুপের ডালি খুলে নেমে পড়েছে। এতে বোঝা গেল, সব গাছেরই রসালো আত্মজারা স্বজনহারা এখন। মূর্তিমান অহংকার মৃন্ময়ী নারীকে দহন করতে চেয়েও অপাঙ্ক্তেয়। আমার মনে হলো, আর দেরি না করে এখন দৌড়ানোই শ্রেয়। কাছেপিঠে সকলে প্রকাশ্য ভালোবাসায় মগ্ন। কার হাসিটুকুতে মোনালিসার আঁচলের চাবিগোছা যেন। এখানে নিখুঁত ভালোবাসার অপর নাম হ্যাংলামো, আর শাস্ত্রীয় যৌনাচার হলো কাকস্য-পরিবেদনা। তার চেয়ে সহজ হলো বেপাড়ায় জোছনা স্বভাবে নারীর আত্মপ্রকাশ কিংবা ম্যাডোনা অ্যান্ড হার হরর চাইল্ড।

 

প্রতিটা মুহূর্ত

প্রতিটা মূহূর্ত জ্বলন্ত কবরে। এমনই পরিস্থিতিকে সে তার স্বপ্ন ও বাস্তবে লালন করছিল। কখনও নিরালা গার্হস্থ্যতায় বইয়ের ভাঁজে তার চোখ স্বচ্ছল ও উজ্জ্বল হচ্ছিল। একটা ‘চশমাপাহাড়’ সমান দৃষ্টিসীমা পেরিয়ে সে এক একক অজানা প্রেমের প্রান্ত ধরে ডুব দিল, পানকৌড়ি দিঘল চুলে ক্রমশ পুচ্ছ থেকে রেণুগুলিতে হল একটি শ্যামল মুখ, সুন্দর। আগত দুবছর পেরিয়ে যাবে বুকের জমিনজুড়ে, উর্বরতা। কয়েন স্বাক্ষী—অমিয়ভূষণের মতো একটি দৃশ্যগল্প লেখা হবে নদীর জ্বলে, সাতাশ ঘণ্টা। আমরা গাত্রদাহ শেষে পেরিয়ে যাব স্মৃতির প্রান্তর। হাওয়ায় পোশাক উড়ে যাবে আকাশের কার্নিশে। যার ছায়াপথে পাখিটা বিদ্ধ হয়, গড়িয়ে যায় অভিকর্ষে। এসো ছিলা-ক্লান্তি-গতি, বাহুবলে কাছে টানো—প্রাণের প্রতীতি।
সে একটা মুখোশ পরে নিল। মৃগয়া পথটি পেরোলে সে সকল প্রাণ একে একে দড়িতে জুড়ে দিল। সন্ধ্যারোদের শেষ ঝলমল জল থেকে উঠে এল সঙ্গিনী। চুল চুইয়ে পড়া জ্বলে শীতল। হারানো ত্বক। শিহরিয়া ওঠে কামশূন্য শরীরভরা ফাগুন, সাইকেলে চড়ে, সে প্রাণ খুলে চলে গেল রানওয়ে ধরে।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.