নিদা ফাজলির পুরো নাম: মুকতিদা হাসান নিদা ফাজলি। জন্ম তার ১৯৩৮ সালে। হিন্দি ও উর্দু ভাষার খ্যাতনামা কবি, গীতিকার ও সংলাপ রচয়িতা। সাহিত্যে অবদান রাখবার জন্য ২০১৩ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে।
দিল্লিতে জন্ম তার একটি কাশ্মিরী পরিবারে। গোয়ালিয়রে বড় হন ও সেখানেই পড়াশোনা করেন। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন তিনি। তার বাবাও উর্দু ভাষার কবি ছিলেন। দেশবিভাগের আঠার বছর পর ১৯৬৫ সালে তার পিতৃপরিবার পাকিস্তানে চলে যায়। ফাজলি ভারতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৪ সালে তিনি জীবিকার সন্ধানে মুম্বাইতে চলে গিয়েছিলেন। পরিবারের সাথে এই বিচ্ছেদ তাকে সারাজীবন বেদনাবিদ্ধ করেছে।
তরুণ বয়সে একবার এক মন্দিরের সামনে দিয়ে যাবার সময় শুনতে পেলেন এক গায়ক সুরদাসের ভজন গাইছে। রাধা তার সখিদের কাছে কৃষ্ণবিরহে তার মনোবেদনা ব্যক্ত করছিলেন। মানুষের মধ্যকার নিবিড় প্রেমবন্ধন বিষয়ক এই পদ শুনে ফাজলি অনু্প্রাণিত বোধ করেন। তিনিও কবিতা লিখবেন, এই ইচ্ছা জাগে তার মনে।
এইসময় তিনি মির্জা গালিব ও মির তকি মিরের কবিতার সারবস্তু ভালো করে আত্মস্থ করেন। মিরা বাই ও কবিরের ভজনের ভাব তাকে মুগ্ধ করে। টি এস এলিয়টের কবিতা, গোগল ও চেখভের কথাসাহিত্য তার সাহিত্যবোধকে সমৃদ্ধ করে।
ধর্মযুগ ও ব্লিৎস পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতে থাকে। তার কাব্যশৈলী সিনেমানির্মাতা এবং হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যের লেখকদের আকৃষ্ট করে। বিভিন্ন মুশায়েরায় কবিতা পড়বার আমন্ত্রণ পেতে থাকেন। তার গজল, নজম ও দোহায় মৌখিক ভাষা ও ভঙ্গি ব্যবহার করেন তিনি। কঠিন বা জটিল শব্দ ও শৈলী এড়িয়ে সহজ ও সাবলীল করে তোলেন তার কবিতা। এইটা তার কবিতাকে খুব জনপ্রিয় করে তোলে। সিনেমায় তার লেখা গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
এর মধ্যে এক ঘটনা ঘটে। তার সমকালীন ষাট দশকের কবিদের নিয়ে তিনি সমালোচনামূলক লেখা লেখেন। এর ফলে তুমুল প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সাহির লুধিয়ানভি, আলি সরদার জাফরি ও কাইফি আজমি’র মতো কবিরা খুব ক্ষেপে যান তার উপর।
১৯৬৯ সালে তার কবিতার বই প্রথম প্রকাশিত হয়। শৈশবের স্মৃতিকাতর বিষয়আশয়ের চিত্রকল্পে সমৃদ্ধ তার কবিতা। জীবনের দ্বন্দ্বসঙ্ঘাত, উদ্দেশ্য সন্ধান, মানব সম্পর্কের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, বলা ও করার মধ্যে বৈপরীত্য, হারিয়ে যাওয়া বিষয়ের জন্য বেদনা, ধর্মের সারবস্তু ও তার প্রচলিত রূপের বৈপরীত্য — এইসবই তার কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু।
নিদা ফাজলির কবিতায় মনের নানারকম ভাব ফুটে উঠেছে। তিনি মনে করেন অন্তরপ্রেরণা ও সৃষ্টিশীল অনুভূতিই কবিতার উৎস। চিত্রকর কিংবা বাদকের মতোই কবিরও অনুভূতি। অন্যদিকে সিনেমার জন্য গান লেখা খানিকটা যান্ত্রিক ব্যাপার, যা চিত্রনাট্য ও পরিচালকের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে হয়। তিনি অবশ্য জীবিকার প্রয়োজনে সিনেমাগীতি রচনার কাজটিকেই গ্রহণ করেছিলেন।
তার প্রিয় কবি কবিরের মতো তিনি সহজ ও সরাসরি ভাষায় কবিতা লেখেন। তার কবিতা তার অভিজ্ঞতার প্রকাশ, নিছক শব্দের খেলা নয়। নিদা ফাজলির কবিতা অন্তরের ঐশ্বর্যে পূর্ণ। দেশভাগের ক্ষতচিহ্ন তার কবিতায় পাওয়া যায়। তার কবিতার ভাষা হিন্দি আর উর্দুর মিশ্রণ। ফলে প্রতীকীভাবে এটি ভারত-পাকিস্তানের ঐক্যের প্রতীক।
নিদা ফাজলি সুফি ভাবধারাকে অনুসরণ করতেন। তিনি পছন্দ করতেন কবির ও আমির খসরুর রচনা। কারণ এই ভাবধারা ঈশ্বরকে উপাসনালয়ে নয় বরং মানব হৃদয়ে উপস্থিত দেখে, এই ধারা সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রবাদের বাইরে অবস্থান নেয়।
চমৎকার অনুভূতিশীল মানুষ ছিলেন নিদা ফাজলি। একবার জানুয়ারি মাসের রাতে গোরখপুরে ওয়াসিম বারেলভি আর নিদা ফাজলি কবিতা পড়তে মঞ্চে উঠেছেন। বারেলভি অনুযোগ করলেন যে ঘন কুয়াশায় দর্শক-শ্রোতাদের চেহারা দেখা যাচ্ছে না। ফাজলি মন্তব্য করলেন, তাদের কবিতার আলো জ্বললেই দর্শকদের মুখ আলোকিত হয়ে উঠবে।
নিদা ফাজলি ২০১৬ সালে প্রয়াত হন। তার মৃত্যুর পরে তার সমকালীন আরেক বিখ্যাত কবি ওয়াসিম বারেলভি বলেন, ‘তার কবিতার মাঝে একটি পুণ্যবান মানব হৃদয় ধ্বনিত হয়। তার উদ্দীপনাময় রচনাবলি বেঁচে থাকবে’।
১.
তাকে বোঝাতে পারি নাই আমার মনের দশা,
সেও অনুমান করতে পারে নাই আমার নীরবতার ভেদ।
২.
মিথ্যা সীমানা সব, দেশভাগ সমস্তই ধোঁকা;
দিল্লি হতে লাহোর পর্যন্ত সবখানে নিম তিতা।
৩.
হিন্দুরা করছে ভালো, মুসলমানেরাও সে রকমই;
কেবল মানুষ সবখানে ভোগে দুঃখ-যাতনায়।
৪.
সুফির আহ্বান ভালো, পণ্ডিতের জ্ঞানও;
আসল সত্য থাকে অভিজ্ঞতায়।
৫.
মানচিত্র হাতে জাগে শিশুর বিস্ময় :
কীভাবে খেয়েছে উই পুরো হিন্দুস্তান!
৬.
তুমি আর আমি দুজনেই ট্রেনের যাত্রী, যেটি চলছে আর থামছে;
যার-যার গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে আমরা একত্রেই আছি।
৭.
প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে অনেক-অনেক মানুষ রয়েছে,
তাদের মধ্যে যাকে দেখতে চাও তাকে বার বার দেখ।
৮.
সবদিকে সবখানে অগুনতি মানুষ
সঙ্গহীনতায় ভোগে তবুও মানুষ।
৯.
বাগানে যখন যাবে মেনো এ আদব,
ফুল হতে প্রজাপতি তাড়িয়ে দিও না।
১০.
বাড়ি থেকে মসজিদ অনেক দূরে, আসো এক কাজ করি,
কান্নারত একটা শিশুকে হাসাই।
১১.
মসজিদ তাদের জন্য যারা নামাজ পড়ে,
নিজের ঘরের কোথাও খোদাকে রাখো।
১২.
সব মিথ্যাই বইয়ের মধ্যে লেখা আছে,
তোমার সত্য তোমার আজাবের মধ্যে আছে।
১৩.
ভিতরে রাখা মূর্তিকে ঘি, পুরি, মিষ্টান্ন নিবেদন করা হয়,
মন্দিরের বাইরে ঈশ্বর ভিক্ষা মাগে।