:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
সাদিয়া সুলতানা

গল্পকার

নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের ‘ফুলের অসুখ’ পাঠ প্রসঙ্গে
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের ‘ফুলের অসুখ’ পাঠ প্রসঙ্গে

একজন লেখকের নিজস্ব স্বর তৈরি হতে কি তার পুরো একটা জীবন লেগে যায়? নাকি প্রথম লেখা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার স্বতন্ত্র লেখনশৈলী? কারো কারো ক্ষেত্রে হয়তো প্রথমটি ঘটে। আবার কারো কারো স্বল্প সংখ্যক লেখাই হয়তো রাখতে পারে তার স্বকীয়তার উজ্জ্বল ছাপ।
লেখক নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের ক্ষেত্রে তার শুরুর লেখাগুলোতেই যেন স্পষ্টতর হয়েছে তার নিজস্ব গদ্যভঙ্গি। দিন দিন আরও স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখে চলছেন তিনি। কেবল কবিতা নয়; গল্প, মুক্তগদ্য, প্রবন্ধ, সম্পাদনার কাজেও ক্রমশ তিনি হয়ে উঠছেন অনন্য।

অসুখে আক্রান্ত পৃথিবীর এইসব অবরুদ্ধ দিনে পাঠ করেছি নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের গল্পগ্রন্থ ‘ফুলের অসুখ’
‘ফুলের অসুখ’ গল্পগ্রন্থে আটটি গল্প আছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একমনে একটানা পড়ে গেলে মনে হবে ৯৫ পৃষ্ঠার বইটি বুঝি বা একটিই গল্প, কারণ বইটির সব গল্পই ফুলের বিবিধ অসুখ নিয়ে। এই ফুল কখনো পৃথিবী, কখনো দেশ, কখনো মা, কখনো প্রেমিকা কখনো বা আমরা নিজেই।

‘ফুলের অসুখ’ বইয়ের প্রথম গল্প বীজ। ‘বীজ’ গল্পে নির্ঝর নৈঃশব্দ্য লিখে যাচ্ছেন, “মাকে স্বপ্নে দেখে ঘুম ভাঙলে সারাদিন কেমন করে যেন বুক কাঁপে। আজ ভোররাতে দেখলাম একটা মাঠের মাঝখানে একটা অনেক উঁচা আকাশঢাকা গাছের নিচে মা বসে আছে।” গল্পপাঠ শুরু করতেই মাকে স্বপ্নে দেখার অনুভবের মতো বুকের ভেতরে হুহু করতে থাকে। মা যেন হাতের তালুতে গুঁজে দেন গমের দানার মতো পেটকাটা, লাল রঙের একটা বীজ। ঘুম ভেঙে গেলে মুঠো থেকে বীজটা উধাও হয়ে গেলেও বুকের শূন্য খাঁচায় মাকে হারানোর হাহাকারটুকু লেপটে থাকে।
নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের লেখায় থাকে হাহাকারের হুহুপাখি, ঘুমগাছের বন, কাশবন, সূর্যফুল, রাত্রি নামের মা আর ডুমুরের ফুল।
‘বীজ’ গল্পের গল্পকথকের নানির ডুমুরের ফুল দেখা, ডুমুর গাছের পেটফোলা অংশের ভেতর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসা, মায়ের জন্ম-এসব কিছুই যেন আশ্চর্য এক ঘোরের ভেতরে ঘটে। একসময় সেই ঘোর সত্যি হয়ে যায় আর একদিন সত্যি সত্যি একান্নটা ঘুমগাছ বিক্রি হয়ে যায়, মায়ের কবরের ওপরে জন্ম নেয় ঘুমগাছের চারা।

‘ফুলের অসুখ’ গল্পগ্রন্থে আটটি গল্প আছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একমনে একটানা পড়ে গেলে মনে হবে ৯৫ পৃষ্ঠার বইটি বুঝি বা একটিই গল্প, কারণ বইটির সব গল্পই ফুলের বিবিধ অসুখ নিয়ে। এই ফুল কখনো পৃথিবী, কখনো দেশ, কখনো মা, কখনো প্রেমিকা কখনো বা আমরা নিজেই।

‘শশী’ গল্পে কুসুমকুমার কাঁচা রক্তের রং আর গন্ধ নিয়ে বইমেলায় ঢুকে পড়ে। এই রক্ত অভিজিৎ রায়ের রক্ত। হুমায়ুন আজাদের রক্ত। এই রক্তের রং কেউ দেখতে পায় না। এই রক্তের গন্ধ কেউ টের পায় না। এই রক্তের ভার কুসুমকুমার একাই বহন করে, নিজের রক্তের ভেতর।

কুসুমকুমার শশীকে দেওয়া কথা রাখতে পারে না, সারারাত জেগে দেয়ালে কবিতা লেখে, ‘ঘুম ঘুম চোখে দাও সূর্যস্নান, ভবঘুরে পায়ে দাও মুক্তির শান…’। কুসুমকুমারকে একদিন পুলিশে ধরে নিয়ে যায়, তার ডান হাতের আঙুল কেটে নেয়। কাটা আঙুলের ঘা শুকিয়ে গেলে সে আবার অন্ধকারের বিপক্ষে শহরের দেয়ালে কবিতা লেখে।
‘শশী’ গল্পটি কবিতায় মোড়া। যেই কবিতায় লেগে আছে রক্তের রং। আর ঘা শুকানো কাটা আঙুল দিয়ে সেই রক্তের রঙে লিখে চলে কুসুমকুমারেরা।

‘পরী’ গল্পের পরীর চোখের ভেতরে পৃথিবীর সকল বিষাদ কুয়াশায় মোড়া সমুদ্র হয়ে আছে। এই বিষাদ সমুদ্রের কাছে কেমন করে যেন বকুলের সমুদ্র ফুরিয়ে যায়, ছেলেটি জানে না। তাই মেয়েটির পিঠের দুইপাশে হাড়ের জায়গায় ছয় ইঞ্চি লম্বাটে শাদা দাগ দেখে ছেলেটি ভাবে, কেউ কি ওর ডানা কেটে নিয়ে গেছে? সত্যিই কি এই মেয়েটি পরী ছিল?

পরীর ডানা কাটার আরেকটি গল্প ‘ডানা’। এই গল্পের প্রথম পাঁচ পর্ব একটু ভিন্ন স্বরে লেখা। এ যেন নির্ঝরের ছন্দে লেখা নয়, পরিচিত ফ্রেমে বাঁধা রেণুকা আর রফিকের দাম্পত্যজীবনের গল্প ‘ডানা।’ যে গল্পে রেণুকা সুতোছেঁড়া লাল ঘুড়ির মতো ভাসতে ভাসতে মাটিতে নামে। ফের দুডানার চিল হয়ে ওড়ে আকাশে। ‘ডানা’ গল্পের ষষ্ঠ পর্বে স্বয়ং গল্পকার আখ্যানের ভেতরের ঢুকে যান আর রেণুকার গল্প এগিয়ে যায় ভিন্ন এক সমাপ্তির দিকে।

ফুলের অসুখ নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য । মূল্য: ২২৫ টাকা । বইমেলা ২০২০
প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী । ছবি: তানভীর আশিক

নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের লেখায় কুসুমকুমারের সঙ্গে বারবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে মা। তাই ‘চিঠি’ গল্পের ‘বৈশাখী কুরিয়ার সার্ভিস’ এ চিঠিপত্র বিলির কাজ করা যুবকটি জ্বরতপ্ত দিনে কাঁথার মধ্যে ঢুকে মায়ের ঘ্রাণ পায়। সে জানে, ‘পার্থিব কোনো ঘ্রাণের সঙ্গে এর তুলনা চলে না, এ ঘ্রাণ অপার্থিব সুন্দর’। ‘চিঠি’ গল্পের শব্দের ভাঁজে ভাঁজে তাই শত শত বিষাদ ছুঁয়ে থাকে।

‘ফুলের অসুখ’ বইয়ের ষষ্ঠ গল্পটি মূলত গল্প নয়, আবার অন্য ভাবে বললে ১৫ টি ছবির সমন্বয়ে আঁকা আশ্চর্য এক ছবিগল্প এটি। এই ছবিগল্পের শিল্পগুণ আলোচনা করতে এই পাঠক ব্যর্থ হলেও প্রতিটি ছবিই তার দৃষ্টিসন্ধিতে গেঁথে গেছে অব্যর্থ তীরের মতো।

‘তৃষ্ণা’ গল্পে গল্প কোথায় ভাবতে গেলে তুমুলভাবে শব্দবৃষ্টিতে ভেজা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এই গল্পে আসা ‘জারুল পাতার চিঠি’ গানটি কানের কাছে রিমঝিমিয়ে বাজতে থাকে আর ‘এইভাবে তার সঙ্গে আমার, আমার সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। দেখা হলে গান হয়ে যায়। আর আকাশে মেঘ ভেসে যায়’

নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের অন্যান্য গল্পের মতো ‘তৃষ্ণা’ গল্পেও গল্প খুঁজলে কিন্তু ভুল হবে। তবে মনোযোগী পাঠক চাইলেই এক একটি গল্পে অজস্র গল্প খুঁজে পাবে, যেসব গল্প নির্ঝর এঁকেছেন বিমূর্ত সব শিল্পকর্মের মতো। তাই নির্ঝর নৈঃশব্দ্য যখন লেখেন, ‘সকালের অদ্ভুত চরিত্র’, তখন প্রকৃত অর্থে পাঠক অদ্ভুত সকালই খুঁজে পাবেন, যে অদ্ভুত সকালে কদমের বনে কিছু ফুল সূর্যের প্রতিকৃতি হয়ে থাকে।

বইয়ের শেষ গল্প ‘স্বপ্ন’। প্রথম স্বপ্নে আসে একটা অদ্ভুত দ্বিচক্রযান, দ্বিতীয় স্বপ্নে একটা অচেনা ঘর, তৃতীয় স্বপ্নে একটা অচেনা শহরের রাস্তা, চতুর্থ গল্পে আসে নয়নের বন্ধু খিজির। পঞ্চম স্বপ্নটা একটা দুঃস্বপ্ন, শ্রীমতীকে নিয়ে দেখা। এই স্বপ্নে দেখা মেলে সবুজ ঘ্রাণ ভরা পাতা বন, চাঁপাফুল, ডাকপাখি আর যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরের তেজস্ক্রিয়তায় বিপন্ন মানুষের কৃত্রিম শরীর।
অভিনব সমাপ্তির মধ্য দিয়ে ‘স্বপ্ন’ গল্পের স্বপ্নযাত্রা ফুরালে মনে হয় এসব কুসুমকুমারেরই দেখা স্বপ্ন।

কখনো কখনো মনে হয় নির্ঝর নৈঃশব্দ্যই কুসুমকুমার, যার প্রতিটি গল্পের শুরু বা শেষ কিছুই গতানুগতিক না। কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই যেন এই গল্পকার গল্প নির্মাণ করেন যেখানে থাকে না কোনো প্রচলিত ফ্রেম। পরীর ডানায় ভর করে এই গল্পগুলো এগিয়ে চলে, যেসব গল্পে সুনির্দিষ্ট কোনো আখ্যান না থাকলেও থাকে কবিতার অবয়ব। তাই গল্পের সমাপ্তিটা জেনে নিলেও পাঠক নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের গল্পের ভুবনে পুনঃপুন পরিভ্রমণ করতে চান, আটকে থাকতে চান নির্ঝরের আঁকা মনোরম ঘুমগাছের বনে।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.