প্রদোষে প্রাকৃতজন
পথই নিয়তি
রাষ্ট্র আক্রান্ত এবং একই সঙ্গে শাসকের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ মানুষের অস্তিত্বকে যে আমূল নাড়িয়ে দেয় সেটা কোনো নতুন কথা নয়। কিন্তু ধর্ম, স্বপ্ন ও কর্তব্য সম্পর্কে বিবিধ প্রশ্ন চারিয়ে অথচ কোনো নিষ্পত্তি না করে পাঠককে অনন্ত দাহের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন শওকত আলী তাঁর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে।
লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকাল এমনই এক নিরবলম্ব সময়। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রকোপে এবং তান্ত্রিক বৌদ্ধ উপাসনা বা সহজিয়া ধর্মের নামে তথাগত নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা পারস্পরিক মতপার্থক্যে বিবদমান, ফলত বিপন্ন। এই অবস্থায় অন্ত্যজের অবস্থানের সঙ্গে তাদের পার্থক্য রইল না। শুধু তাই নয় তুর্কি আক্রমণ সবে শুরু হয়েছে। তখন অনেক বৌদ্ধ ও অন্ত্যজ মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছে। এমন অবস্থায় বরেন্দ্রভূমির সাধারণ নরনারীর হৃদয়ধর্ম প্রচলিত নীতিবোধের দ্বারা পরিচালিত হতে পারে কি?
শ্যামাঙ্গ মৃৎশিল্পী। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সে মন্দিরগাত্রের মৃৎফলকে ফুটিয়ে তোলে একই গুরুত্বে শ্রীরামচন্দ্র ও জানকীর সঙ্গে শবরী, প্রণয়লিপ্ত ব্যাধ তরুণী ও স্তনদানরত ধীবরমাতার চিত্র। সকলেই শ্যামাঙ্গের কাছে মানুষ। কিন্তু বসুদেব, শ্যামাঙ্গের গুরুদেবের কাছে এ তো চরম অপরাধ। দেবতায় মানবের প্রলেপন এবং একই পংক্তিতে অন্ত্যজের অধিষ্ঠান! ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক বিল্বগ্রামের সামন্ত সুধীমিত্র ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ হবেন কেননা বসুদেবকে তো তিনিই দায়িত্ব দিয়েছেন। বসুদেব প্রিয় শিষ্যের শিল্পকর্ম চরম ঘৃণায় চূর্ণ বিচূর্ণ করে তাকে বিতাড়িত করলেন। অথচ এই বসুদেবই এককালে সোমপুরী মহাবিহারে উৎকীর্ণ জনজীবনের দৃশ্যমালার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন। তাহলে একজন দাসত্বকে বরণ করলেন শিল্পের অপমানকে প্রশ্রয় দিয়ে অন্যজন শিল্পের প্রতি পরম দায়বদ্ধতা থেকে পথে নামলেন। প্রশ্ন এখানে যন্ত্রণা কার বেশি? শিল্পের নাকি মানুষের?
এরপর শ্যামাঙ্গ উজুবট গ্রামে পৌঁছায়। সেখানে লীলাবতীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। লীলাবতী বিবাহিত। কিন্তু স্বামী অভিমন্যু দাস মহাসামন্ত হরিসেনের দলে যোগ দিয়ে ছারখার করে দিচ্ছে জনজীবন। নিষ্কৃতি দেয়না লীলাবতীর পিতৃগৃহ সহ উজুবট গ্রামখানিকেও। সেই ধ্বংসলীলার মধ্যে লীলাবতী ও শ্যামাঙ্গ পরস্পরের হাত ধরে যাত্রা করে অজানার উদ্দেশ্যে।
‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ পড়ার পর মনে হল স্বপ্ন থেকে ক্রোধ থেকে প্রণয় থেকে জ্বালা থেকে মানুষ যে যাত্রা শুরু করে তা সেই মুহূর্তে তার কাছে পরম বলে মনে হয়। আর এই মনে হওয়া না থাকলে কোনোদিন পথ চলার প্রসঙ্গও থাকত না। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ তাই যেন আমাদের আবহমান নিয়তিই।
এই যাত্রা এক আকাল থেকে অন্য আকালের কোলে। সম্পর্কের তো বৈধ নামকরণ প্রয়োজন। লীলাবতী ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে বুঝেছিল যা ধারণ করে তাই ধর্ম। আর সেই ধর্ম প্রকৃত সম্পর্কের জননীও বটে। মাতুল সিদ্ধপা তাকে ও শ্যামাঙ্গকে বিবাহ যেহেতু তাদের সম্ভব নয় সেহেতু যোগব্রত পালনের নির্দেশ দেন এবং যবন কেন্দ্রে প্রয়োজনে আশ্রয়ের পরামর্শও দেন। লীলাবতী দেখেন যবন কেন্দ্রে সাধুপুরুষ আহমেদের আশ্রয়ে পরম আনন্দে একই সঙ্গে আছে কুষ্ঠরোগী, অন্ত্যজ বৌদ্ধ ভিক্ষু সকলে। সকলেই অতি সহজে ধর্মান্তরিত হচ্ছে। উপাসনার রীতি অত্যন্ত সরল। বিগ্রহ নেই, প্রভু ভৃত্যের ভেদ নেই। লীলা যেন অজান্তেই দীক্ষিত হয়ে পড়ে কেননা মানবের আশ্রয় যখন মানব তখন সেই দুষ্কালেও এত শান্তি আর কোথায়!এই তো প্রকৃত ধর্ম।
আসলে যবন সম্পর্কে সাধরণের যে ধারণা তারা নিষ্ঠুর দুর্ধর্ষ তা খানখান হয়ে যায়। স্বয়ং আহমেদ বলেছেন তুর্কি যবনদের বিদ্যা বা ধর্ম কিছুই নেই, তাই তাদের সঙ্গে সহযোগিতার কোনো প্রশ্ন আসে না যদিও তিনি বিশ্বাস করেন মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক হওয়া উচিত মিত্রতার। আসলে বৌদ্ধরা তখন যবনের সাথে মিলিতই হতে চাইছিল।
কিন্তু বিষয় হল ধর্মের নিরিখে মিলনের প্রশ্নই অবাঞ্ছিত। জ্ঞান ও তৎ সঞ্জাত বোধই এটা পারে। শ্যামাঙ্গের প্রকৃত শিল্পের অন্বেষণ শেষ হয় না। সে লীলাকে তার অন্তরে লালিত ঘরের দিশা দেখিয়ে বার হয়ে যায়। লীলা সম্পর্কে সে তখন খানিকটা নিশ্চিত। এক প্রাচীন বিহারে সে আবিষ্কার করে গৌতম পত্নী গোপার মূর্তি। আশ্চর্য হয় অবিকল যেন লীলার মূর্তি। শিল্পীর খোঁজ পায় না। উপলব্ধি করে শিল্পী, শিল্পের উপাদান এবং বিষয় মূলত চিরন্তন। সে শুরু করে মূর্তি তৈরি করা। যেখানে নারীর অনন্ত শক্তিই ফুটে উঠবে। কিন্তু অভিমন্যু দাসের হাতেই তার মৃত্যু হয়। আসলে শুধু অভিমন্যু তাকে উজুবট গ্রামে অগ্নি সংযোগের সময় লীলাবতীর সাথে দেখে ফেলেছিল বলেই নয় শ্যামাঙ্গের মৃত্যু অনিবার্যই।
প্রকৃত শিল্পীর পরমার্থ লাভ কোনোদিনই হয় না। তাও আবার দ্রোহকালে!
শ্যামাঙ্গ শিল্পী। বসন্তদাস বণিক যদিও তার পিতৃপুরুষ ক্ষেত্রকর। লীলাবতীর সখী মায়াবতী তার স্ত্রী। বসন্তদাস বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সপক্ষে। বসন্তদাসের শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ মায়াবতীর পিতৃগৃহের কেউ তাকে সমর্থন করে না। বরং ভিক্ষুদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে তারা শঙ্কিত।কারণ রাজরোষ।ভিক্ষুদের প্রতি মনোযোগী হলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
বসন্তদাস বাণিজ্যে বেরিয়ে ক্রমেই জড়িয়ে পড়ে সময়ের জটিল আবর্তে। মায়াবতীকে সে প্রেমে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু মানব মুক্তির কাছে বসন্তদাস নতজানু। সে আবার উপলব্ধি করেছিল সংসারই সৃজনের আগার। ধর্ম বলো, সঙ্ঘ বলো, রাষ্ট্র বলো সকলই সংসারকে রক্ষা করার জন্য। ক্রমে বিশ্ব সংসার রক্ষায় পা বাড়ায়।
বৌদ্ধ মিত্রানন্দের সাথে ভ্রমণ করতে করতে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বসন্তদাসের মনে নানা প্রশ্ন জাগ্রত হয়। মিত্রানন্দের মানব মুক্তির যুক্তির সাথে তার যুক্তি মেলে না। যেখানে মিত্রানন্দ বিশ্বাস করেন মানুষ নিজ গুণে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে বংশের গুণে নয় সুতরাং শ্রেণি বিচার অবাঞ্ছিত সেখানে বসন্তদাসের প্রশ্ন তথাগতের আমলেও কি চন্ডালেরা নিগৃহীত হয়নি। সমাজ ব্যবস্থাকে মানতে হবে। বায়বীয় ভাবনায় মুক্তি সম্ভব নয়। আসলে বসন্তদাস প্রান্তিক রমণীর আত্মনিবেদন স্বচক্ষে দেখেছে, দেখেছে কিছু অন্ত্যজের বিদ্রোহও। কিন্তু তাতে সমগ্রের লাভ কোথায়! এটা বুঝতে হবে। সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই আত্মিক উন্মোচন প্রয়োজন। বসন্তদাস উপলব্ধি করে ধর্ম বলো, রাষ্ট্র বলো, সঙ্ঘ বলো সকলই সংসার রক্ষার প্রয়োজনে। সংসারই সৃজনের আগার। তাদের পথ আলাদা হয়ে যায়। বসন্তদাস ঘরে ফিরতে উদ্যোগী হয়। আমার মনে হয় বসন্তদাস অস্তিত্ব রক্ষার মূলের প্রতি মনোযোগী যেখানে থেকে যাত্রা করলে মানব মুক্তি একদিন সম্ভব হবে। সেখানে শত্রু কে বড়ো কথা নয়।
শ্যামাঙ্গ ও লীলাবতীর উপাখ্যানের সঙ্গে সঙ্গে বেনি বন্ধনের মতোই গ্রথিত হয়েছে বসন্তদাস ও মায়াবতীর কাহিনি। যদিও মায়াবতী এখানে লীলাবতীর তুলনায় অন্তরালবর্তিনী।
‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ পড়ার পর মনে হল স্বপ্ন থেকে ক্রোধ থেকে প্রণয় থেকে জ্বালা থেকে মানুষ যে যাত্রা শুরু করে তা সেই মুহূর্তে তার কাছে পরম বলে মনে হয়। আর এই মনে হওয়া না থাকলে কোনোদিন পথ চলার প্রসঙ্গও থাকত না। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ তাই যেন আমাদের আবহমান নিয়তিই।