প্রসঙ্গঃ সার্কাস সার্কাস
এ নাট্যের পটভূমি ভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া অভিন্ন চরিত্রের ঘটনাযুগল। দক্ষিণবঙ্গের বিখ্যাত সার্কাস দল লক্ষণ দাসের সার্কাস। সাং- উত্তর বিজয়পুর, পোঃ- গৌরনদী, জিং- বরিশাল। দলের কর্ণধার লক্ষণ দাস ঐ ছোট্ট বিজয়পুর জনপদ ছাড়িয়ে তাঁর সুনাম দশ দিক ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন মেধা, কর্ম আর দক্ষতার চোখ ধাঁধানো জৌলুসে। এক দিকে তাঁর উত্থান আর এক দিকে মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্ত পর্যায়ে পাক বাহিনী তছনছ করে দিচ্ছে একের পর এক লোকালয়। চারিদিকে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। লক্ষণ দাস রক্ষা পেলেন না। এক প্রত্যুষে পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে শহীদ হলেন লক্ষণ দাস। তার বসতবাড়ি, সার্কাসের সরঞ্জামাদি ভষ্মীভূত হলো। রক্ষা পেল না জীব-জানোয়ারগুলো পর্যন্ত। এমন কিংবদন্তী আছে লক্ষণ দাস আর তাঁর হাতি প্রাণের ভয়ে দৌড়ায়, পেছন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে বিঁধতে থাকে হাতির গায়ে-পায়ে-মাথায়। হাতি লুটিয়ে পড়লে লক্ষণ দাসের গায়ে গুলি লাগে। মৃত্যুর শেষ সীমায় প্রাণীটি প্রভু লক্ষণ দাসকে আড়াল করে রেখেছিল তার শরীর দিয়ে। লক্ষণ দাসের হত্যাকাণ্ড সে সময়ের আর দশটা লৌকিক ঘটনার মতো হলেও দিনে দিনে এক অলৌকিক প্রলেপ পেয়েছে দক্ষিণবঙ্গের জনপদে।
একদিন গভীর রাতে অতর্কিতে নারায়ে তকবির ধ্বনি শোনা যায়। একদল মানুষ জেহাদী জোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত সার্কাস দলের প্যান্ডেলে। মুহূর্তে সর্বত্র আগুন ধরে যায়। দাউ দাউ করে জ্বলে খাঁচায় বন্দি জীব-জানোয়ার, খেলোয়ার, ক্লাউন, লাঞ্ছিত হয় মেয়েরা রাতভর।
অপর ঘটনা আশির দশকের মধ্যভাগে ‘সোনার বাংলা সার্কাস’ নামের একটি হত দরিদ্র দল যায় সমুদ্র তীরবর্তী শহর কক্সবাজারে। মাসাধিক কালের জন্য তাদের প্রদর্শনী হওয়ার কথা। শুরুতেই ক্ষীণ স্বরে কিছু মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন বাধ সাধে অসামাজিক কার্যকলাপের দোহাই দিয়ে। এই ক্ষীণ সতর্কীকরণ মধ্যস্থতাকারীদের আর্থিক চাঁদা দেবার শর্তে সুরাহা হয়, কিন্তু সার্কাস দল টাকার অংকটি বড় হবার কারণে তা দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং যথারীতি তাদের প্রদর্শনী চলতে থাকে।
একদিন গভীর রাতে অতর্কিতে নারায়ে তকবির ধ্বনি শোনা যায়। একদল মানুষ জেহাদী জোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত সার্কাস দলের প্যান্ডেলে। মুহূর্তে সর্বত্র আগুন ধরে যায়। দাউ দাউ করে জ্বলে খাঁচায় বন্দি জীব-জানোয়ার, খেলোয়ার, ক্লাউন, লাঞ্ছিত হয় মেয়েরা রাতভর। ভোর হয়। ইতিস্তত বিক্ষিপ্ত পড়ে থাকে আহত-হত জীব-জানোয়ার মানুষ। আগুনের শেষ চিহ্ন, ধোঁয়ার কুণ্ডলী, আহাজারি আর প্রেক্ষাপটে সূর্যের ম্লান আলোর মধ্যে একে একে আসে আগুন নেভানো গাড়ি, প্রতিরক্ষী, পুলিশ, পাহারাদার, প্রশাসন, সাংবাদিক, মান্যিগন্যিগণ এই বহ্নি উৎসবে।
দুটো বাস্তব ঘটনার প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে প্রাচ্যনাটের হাতে ‘সার্কাস সার্কাস’ নাট্যের জন্ম। সার্কাস সার্কাস নাটক। সার্কাস নয়, ইতিহাসও নয়।
এই নাট্যের কাহিনী এমনতর- ‘দি গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’ এককালে নামডাক ছিল প্রতিষ্ঠাতা লক্ষণ দাসের কারণে। তাঁর ভাই সাধন দাস কষ্টে শিষ্টে দলটিকে চালাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধে যে দলটি নিঃস্ব হয়েছিল তাকে আবার একটু একটু করে সংগঠিত করে বিভিন্ন অঞ্চলে সার্কাস প্রদর্শনের ধারাবাহিকতায় একটি আমন্ত্রণে দলবল নিয়ে সাধন দাস এসেছেন নবগ্রাম। দলে সমস্যার অন্ত নেই। খেলোয়াড়েরা সবাই পারদর্শী এমনটা বলা যাবে না। খেলোয়াড়দের মধ্যকার ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েনে সবাই তটস্থ। শুরুতে কিছু মৌলবাদী সংগঠন সার্কাস প্রদর্শনে বাধ সাধে ধর্মের- সামাজিকতার দোহাই দিয়ে। সাধন দাস বিপাকে পড়ে যান কিন্তু পূর্ব শিক্ষা তাকে যেমন করেছে সংশয়ী তেমনি আবার করেছে নিঃশংকচিত্ত। মুখোমুখি হয়ে যায় দুটো পক্ষ। এর মাঝে বিভিন্ন দিক থেকে আসতে থাকে একের পর এক সাবধান বাণী, চারিদিকে সবাই যেন তাকে ভয় দেখায়। এমনকি দলের খেলোয়াড়রা পর্যন্ত। দলের একটি মেয়ে নিখোঁজ হয়। মা বাঘটি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে যেন। যাদের কথায় সার্কাস দলটি প্রত্যয় পাবে আশা করে, তারা শুধু কথার আশ্বাসে ভোলায়। এমনি এক অনিশ্চয়তার মাঝখানে মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনগুলো একত্র হয়ে গভীর রাতে হামলা চালায়। আগুন ধরিয়ে দেয় প্যান্ডেলে। একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে তিন জন খেলোয়াড়। আগুনে পুড়ে মারা যায় জীব-জানোয়ার, ভষ্মীভূত হয় ‘দি গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’র সমুদয় সম্পদ। সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মাঝেও কেউ একজন খুঁজে ফেরে সন্তানসম্ভাবা বাঘটিকে। পুরো উপাখ্যানটি একটি নিকট অতীত কালে ঘটে যাওয়া ঘটনা।
০৭.০৩.১৯৯৮