ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ পাকিস্তানের খ্যাতনামা উর্দুভাষী কবি। পাঞ্জাবে জন্ম তার ১৯১১ সালে। আদর্শগতভাবে তিনি ছিলেন মার্কসবাদী। তার অভিজ্ঞতা ছিল ব্যাপক। শিক্ষক, সেনা কর্মকর্তা, সাংবাদিক, ট্রেড ইউনিয়ন কর্তা, রেডিও-টিভির সম্প্রচারক ইত্যাদি বিবিধ পেশাকর্মে জড়িত ছিলেন তিনি।
বাল্যকালে মাদরাসায় পড়েছেন। ধর্মীয় মূলনীতিগুলোর পাঠ নেওয়া ছাড়াও আরবি, ফারসি, উর্দু ভাষাগুলো শেখা হয় তার। পরবর্তীতে আরবি ভাষায় অনার্স ও ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাশ করেন তিনি। ছাত্রজীবনে এম এন রায় ও মুজাফফর আহমেদ এর সান্নিধ্যে আসেন তিনি, যারা তার কমিউনিস্ট হবার পেছনে উদ্দীপক।
তার স্ত্রী এলিস ফয়েজ পূর্বে ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক, ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ৪৭ এ তিনি পাকিস্তানি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। পাকিস্তানি কমিউনিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি।
ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ প্রথমে কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৩৬ সাল থেকে প্রগতি লেখক সংঘে সাধারণ সম্পাদকের পদে যোগ দেন সাজ্জাদ জহিরের আহ্বানে। সাজ্জাদ জহির এবং মুলক রাজ আনন্দ ১৯৩৫ সালের গোড়ার দিকে লন্ডনে ‘ভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘ’ নামে একটি সাহিত্য সভা গঠন করেন। পরের বছর ১০ এপ্রিল সাজ্জাদ জহিরের নেতৃত্বে লক্ষ্ণৌতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ’ এবং জুলাই মাসে পৃথকভাবে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘ’। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৩৯ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় প্রগতি লেখক সংঘ।
১৯৪১ সালে ফয়েজের প্রথম কাব্য সংকলন প্রকাশিত হয়। জীবদ্দশায় মোট আটটি পুস্তক প্রকাশ করেন তিনি।
রুশ কবি ইভগেনি ইয়েফতুশেংকোর সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুতা ছিল ফয়েজের। ফয়েজের কবিতা জনপ্রিয় হয়। নিজ দেশ ছাড়িয়ে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নে তার রচনা পাঠকপ্রিয়। ফয়েজ ছিলেন মানবতাবাদী ও প্রতিবাদী। সারা জীবন তিনি তার কবিতায় নিপীড়ন ও কর্তৃত্ববাদের বিরোধিতা করেছেন। ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নানারকম ভীতি-হুমকি এলেও তা পরোয়া করেন নাই। ইকবাল ও গালিব দ্বারা প্রভাবিত হলেও ফয়েজের কবিতা পাশ্চাত্য সাহিত্যের আলো-বাতাসে স্নিগ্ধ। উর্দু কবিতায় সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা তিনিই ব্যাপকভাবে অনুশীলন করেন। উর্দু গজলের ভাবধারার প্রভাব তার কবিতায় অহিংস ও শান্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এনে দেয়।
তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস করতেন, বৈশ্বিক গ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজে আস্থা ছিল তার।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ এ অঞ্চলে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য জনসমর্থন পাবার উদ্দেশে শোভাযাত্রার আয়োজন করেন এবং দেশপ্রেমাত্মক কবিতা ও গান লেখেন।
দেশি-বিদেশি অনেক পুরস্কার লাভ করেন তিনি। লেনিন শান্তি পুরস্কার পান ও নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। ১৯৮৪ সালে প্রয়াত হন তিনি। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক নিশান-ই ইমতিয়াজ লাভ করেন তিনি মৃত্যুর পরে। কিন্তু এইসব পদক-পুরস্কারের চাইতে তার জীবন, কর্মধারা ও আদর্শ এবং রচনাবলি অনেক অনেক বেশি মূল্যবান।
ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কিছু শের বা দুই পংক্তির কবিতা বা কাপলেটের ভাষান্তর দিচ্ছি। এগুলোর অনেকগুলো অবশ্য আত্মগত ধরনের বিষয়সম্বলিত। কবি তো তার নিজের আবেগ-অনুভূতি ও কাব্যপ্রথা নিয়েও কাজ করেন। আবার কোনো-কোনোটিতে তার ভিন্ন ভাব ও ভাবনা ঠিকই অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছে।
ভূমিকা ও ভাষান্তর: সৈয়দ তারিক
১. তোমার মুখশ্রী জীবনে বসন্ত এনে দেয়,
তোমার দুটি চোখ ছাড়া দুনিয়ায় আর কী-বা আছে?
২.
দুনিয়ায় প্রেম ছাড়াও আরও দুঃখ আছে,
দুনিয়ায় আলিঙ্গন ছাড়াও আরও আনন্দ আছে।
৩.
হায়! আমার চোখ এখনও উঁকি দেয়, আমি কী করব?
হায়! তোমার সৌন্দর্য এখনও মনমাতানো, আমি কী করব?
৪.
আমি প্রচারক নই, নেতা নই, কমরেড নই, সাংবাদিকও নই;
আমি এমন ধরনের পরামর্শ দেব না, যে বিষয়ে আমি জানি না।
৫.
আমার ভাগ্য নিয়ে খেলা-করা ওহে খেলোয়াড়,
আমাকে ভাগ্য সম্পর্কে অজ্ঞ বানিয়ে দাও।
৬.
কোথায় যাব সেটা এখন আমার ব্যাপার,
আমার পথকে পথপ্রদর্শকের থেকে আলাদা বানিয়ে ফেলেছি।
৭.
আসছে সে, আসবে, পথেই আছে সে;
সারাটা রাত আমি জেগে ছিলাম আমার দিনের অপেক্ষায়।
৮.
জীবনটা গরিব লোকের জামা,
এতে একের পর এক বেদনার তালি লাগানো হয়।
৯.
দোজখে গিয়ে কেউ কাঙ্ক্ষিত শরাব পেতেও পারে, না পেতেও পারে;
কিন্তু সে অন্তত মোল্লার হাত থেকে রেহাই পাবে।
১০.
প্রেমরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে আছি, তুমি সারাচ্ছ না কেন?
কেমন বৈদ্য তুমি? আমাকে সারাও, আমি মিনতি করছি।
১১.
আমি অলস, আমি ফরহাদ নই;
মৃতের এই শহরে আমি ছাড়া আর কে আছে?
১২.
দেখবার মতো আমার আর কিছুই কি আছে?
তোমার সাথে প্রেমের অভিজ্ঞতাই তো আমার আছে।
১৩.
আমরা কলম ও ফলকের যত্ন করে যাব,
হৃদয়ের বেদনার কথা লিখব আমরা, সেগুলোকে প্রতিরোধ করে যাব।
১৪.
বন্ধু হে, যদিও এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
তবু, প্রিয়তমের সাথে মিলন কেবলই একটা আকাঙ্ক্ষার ব্যাপার নয়।
১৫.
মরুভূমির নির্জনতায় বালু ও ছাই থেকে দূরে
জুঁই ও গোলাপ ফুটে ওঠে তোমার ছোঁয়ায়।
১৬.
আমার হৃদয় এখনও আশা হারায় নাই, অসফল হয়েছে শুধু;
দুঃখের সন্ধ্যা দীর্ঘ হতে পারে, কিন্তু সে তো কেবল সন্ধ্যাই।