:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
মোহাম্মদ আলী হায়দার

নির্দেশক

বটতলার এক দশকের পথচলা

বটতলার এক দশকের পথচলা

২৭ আগস্ট ১১ বছরে পা রেখেছে নাট্যদল ‘বটতলা’। আগামী ১ সেপ্টেম্বর, শনিবার সন্ধ্যা ৬ টায় বেইলি রোডের মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন করবে দলটি। এক দশকে দলের কর্মকাণ্ড, নিজেদের নাটক ও মঞ্চনাটকের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন বটতলার শিল্পনির্দেশক মোহাম্মদ আলী হায়দার।  


২০০৮ সালে ২৭ আগস্ট কিছু স্বপ্নবান তরুণ এক হয় একটি নাটকের দল নির্মাণে। প্রথমেই বিপাকে পড়ে কী হবে দলের নাম। অনেকগুলো নাম ঠিক করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বর্তমানে আমেরিকার গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আজফার হোসেন নাম ঠিক করে দেন ‘বটতলা’। সবার পছন্দ হয় এই নাম। লেখক ও শিল্পী আসলাম লিটন এঁকে দেন লোগো কিন্তু কী হবে এই দলের উদ্দেশ্য, কী হবে কর্মপন্থা, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনার পর সবাই একমত হন, বটতলা হবে একটি উন্মুক্ত নাট্য প্রয়োগের স্থান। এখানে যেকোনো দলের যে কেউ এসে অভিনয়, নির্দেশনা, ডিজাইন, কর্মশালা, সেমিনার যে যা করতে চান, এসে করতে পারেন। এ জন্য কাউকে এর সদস্য হতে হবে না। সবাই তাঁর সৃষ্টিশীলতার জায়গা থেকে নিজের মতো করে নির্মাণ করবেন নতুন অনেক কিছু। কিন্তু এই যজ্ঞটি তো সামনে নিয়ে যেতে হলে একটা টিমকে দায়িত্ব দিতে হবে।

তিনজনের একটি কমিটি করা হলো। মিজানুর রহমান দায়িত্ব নিলেন দল পরিচালনার। কী নাটক নির্মিত হবে? তখন দেশে সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় চলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। কঠিন সময়। প্রধান দুই দলের দুই নেত্রী সাবজেলে কারারুদ্ধ। সরকারের এক উপদেষ্টা র‌্যাংগস ভবন ভেঙে নির্মাণ করবেন রাস্তা। ভাঙা শুরু হলো র‌্যাংগস ভবন। কিন্তু ভবন ভাঙায় তাড়াহুড়া ও দক্ষতার অভাবে ভাঙার সময় নিহত হন কয়েকজন শ্রমিক। ভাঙার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু একজন শ্রমিক মৃত লাশ হয়ে ঝুলে থাকেন ভাঙা দালানের লোহার রডে। ৭ দিন ঝুলে ছিলেন নিহত শ্রমিক রুহুল আমিন র‌্যাংগস ভবনের ভাঙা দালানে। উদ্ধার করার কোনো আয়োজন নেই, শ্রমিকের লাশ তো, এর কি কোনো দাম আছে? রুহুল আমিনের স্বজনেরা বিজয় সরণিতে বসে থাকেন নির্নিমেষ ৭ দিন। নির্লিপ্ত, অসার তাদের দেহবল্লব। কোনো আশা নেই। লাশটি কার, কাছ থেকে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

প্রথম নাটক নির্মিত হয় ‘একজন রুহুল আমিন’। পথে পথে চলতে থাকে এর প্রদর্শন। তত দিনে পচে-গলে নেমে গেছে রুহুল আমিনের লাশ।  তাঁর পাশেই যে প্রধান তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয়। ওই রাস্তা দিয়ে মানুষ নাক চেপে যায় লাশের গন্ধ দূর করতে। কিন্তু বটতলা রুহুল আমিনকে ভোলে না। ঢাকাসহ আশপাশের জেলায় এই নাটকের প্রদর্শনী করে নাট্য দর্শকদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে তিন মাসের জন্য আসা সরকার যদি দীর্ঘ দুই বছর থাকে, তাহলে দেশের সব জনগণই একসময় ঝুলবে রুহুল আমিনের মতো লাশ হয়ে।

এর প্রতিবাদে বটতলার নাট্যকার সামিনা লুৎফা নিত্রা একটি গল্প লিখেন ফেসবুকে। গল্পটি পড়ে উজ্জীবিত হন বটতলার আরেক কর্মী ব্রাত্য আমিন, দিয়ে দেন নাট্যরূপ ও নির্দেশনা। প্রথম নাটক নির্মিত হয় ‘একজন রুহুল আমিন’। পথে পথে চলতে থাকে এর প্রদর্শন। তত দিনে পচে-গলে নেমে গেছে রুহুল আমিনের লাশ।  তাঁর পাশেই যে প্রধান তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয়। ওই রাস্তা দিয়ে মানুষ নাক চেপে যায় লাশের গন্ধ দূর করতে। কিন্তু বটতলা রুহুল আমিনকে ভোলে না। ঢাকাসহ আশপাশের জেলায় এই নাটকের প্রদর্শনী করে নাট্য দর্শকদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে তিন মাসের জন্য আসা সরকার যদি দীর্ঘ দুই বছর থাকে, তাহলে দেশের সব জনগণই একসময় ঝুলবে রুহুল আমিনের মতো লাশ হয়ে। বটতলা তার প্রথম প্রযোজনা দিয়েই চিনে নিয়েছে তার পথ, গহনে প্রবিষ্ট মূল, পল্লবিত আসমানে, গাই গান মানবের। বুঝে নেয় মঞ্চে-পথে জোরালো আওয়াজ তুলতে হবে নিপীড়নকারীর বিরুদ্ধে, নিপীড়িতের পক্ষে।

একফ্রেমে নাট্যদল ‘বটতলা’।

দ্বিতীয় নাটক নির্মিত হয় একটা গ্রামীণ মেলাকে কেন্দ্র করে ‘ধামাইল’। চন্দন পালের রচনা ও রাফী সুমনের নির্দেশনায়। গ্রামীণ মেলায় চিরায়ত নিয়মে পালাগান করতে দেবে না মৌলবাদী গোষ্ঠী, হুংকার দেয় যেকোনো কিছুর বিনিময়ে তা রুখবার। ধামাইল নাটকে উঠে আসে জীবনের জয়গান, মানুষের প্রাণের মেলা কেউ বন্ধ করতে পারবে না, এই তো আমাদের বাংলা। এরপর বটতলা নিয়ে আসে এই মাটির জ্ঞানকাণ্ড, আমাদের এই মাটির জ্ঞানভান্ডার লীলাবতী জ্যোতিষীকে নিয়ে ‘খনা’ নাটকটি। এই নাটকের মাধ্যমে বটতলা মঞ্চে সবার দৃষ্টি কাড়ে। পুরুষতান্ত্রিকতা কীভাবে মিলেমিশে এক হয়ে নারীর জ্ঞানকে অসম্মান করে নারীকে টপকে যেতে দেয় না, তার সীমারেখা ‘খনা’ আখ্যান। সামিনা লুৎফা নিত্রার রচনায় নাটকটি পরিচালনা করেন মোহাম্মদ আলী হায়দার।  ‘খনা’ সারা দেশের নাট্যকর্মী-দর্শকের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে, যা দেশ ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় পাশের দেশ ভারতে।

এই ১০ বছরের পথপরিক্রমা একেবারেই মসৃণ ছিল না বটতলার জন্য। পথে পথে দমন-পীড়ন আর কটুকাটব্য শুনে কেটেছে বহু মাস-বছর। প্রতিদিন নতুন পরীক্ষা, নতুন দুঃসাহস আর নতুন দুর্নাম। ২০১৬ সালের জুন মাসে একটি নাটকের দলকে শিল্পকলায় ‘নাটক ও সুন্দরবন নিয়ে বাহাস করতে না দেওয়ার’ প্রতিবাদ করার জন্য ১৮ মাস শিল্পকলা একাডেমি অজ্ঞাত কারণে বটতলাকে করেছিল হলবঞ্চিত।

২০১২ সালে তাজরীন গার্মেন্টসে পুড়ে নিহত হয় শতাধিক পোশাকশ্রমিক। বটতলা তখন ভাবতে থাকে কীভাবে এর প্রতিবাদ করা যায়।  ‘জতুগৃহ’ নাটক লিখে ফেললেন সামিনা লুৎফা নিত্রা, নির্দেশনা দিলেন মোহাম্মদ আলী হায়দার। এটি পথেঘাটে, শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের মাঝে বেশ ঝড় তোলে, নাটক দেখে আবাগে আপ্লুত হন শ্রমিকেরা, পাশাপাশি এই সব পোশাকশিল্পে মালিকদের অনাচারের বিরুদ্ধে নতুন দীক্ষা নেন। বটতলা অনেক শ্রমিক সংগঠনের আমন্ত্রণে সারা বাংলাদেশে এই নাটক করে বেড়ায়। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির সময় রাস্তায় প্রতিবাদে নামে বটতলা। গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সামনে এই প্রতিবাদী নাটক করে চক্ষুশূল হয় গার্মেন্টস মালিকদের, সাথে পুলিশদের। বটতলার শিল্পীরা আক্রান্ত হন গার্মেন্টস মালিকদের লাঠিয়াল বাহিনী ও পুলিশ দ্বারা।  ২০১৪ সালে তোবা গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা বেতন-বোনাসের দাবিতে অনশন শুরু করেন। বটতলার শিল্পীরা তোবা গার্মেন্টসের সামনে প্রতিবাদ করেন, ‘জতুগৃহ’ নাটকটি করতে চান। কিন্তু আবারও পুলিশের লাঠি ও সরকারি লাঠিয়াল বাহিনীর হাতে আঘাত পান বটতলার শিল্পীরা।

‘খনা’ নাটকের একটি দৃশ্য।

২০১৪ সালের শেষের দিকে বটতলা আফ্রিকান রাজনৈতিক নাটক ‘দ্য ট্রায়াল অব মাল্লমা ইলিয়া’ মঞ্চে আনে।  মুহাম্মদ বিন আবদেল্লার এই নাটকটি বাংলা অনুবাদ করেন সৌম্য সরকার ও নির্দেশনা দেন মোহাম্মদ আলী হায়দার। এই নাটকের রিসার্চ করতে গিয়ে দেশের ইতিহাসের কিছু বই পড়ে বটতলা পেয়ে যায় তার পরবর্তী মঞ্চনাটক ‘ক্রাচের কর্নেল’। কিন্তু ২০১৫ থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ নড়েচড়ে বসলে বটতলা সুন্দরবন নিয়ে নাটক নির্মাণে ব্রতী হয়।  কার্ত্তিক নায়ারের ‘দ্য হানি হান্টার’-এর বঙ্গানুবাদ করেন কবি শামীম আযাদ ‘মধুশিকারী’ নামে। এই গল্পটিকে পালার ঢঙে নতুনভাবে নির্মাণ করেন মোহাম্মদ আলী হায়দার। নাটকটিতে সুন্দরবন রক্ষার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে। পাশাপাশি রাজপথে প্রদর্শনের জন্য বটতলা ইম্প্রভাইস নাটক ‘সুন্দরবন কথা’ নির্মাণ করে, যা প্রদর্শিত হয় দেশের বিভিন্ন জায়গায়।

২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির সময় রাস্তায় প্রতিবাদে নামে বটতলা। গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সামনে এই প্রতিবাদী নাটক করে চক্ষুশূল হয় গার্মেন্টস মালিকদের, সাথে পুলিশদের। বটতলার শিল্পীরা আক্রান্ত হন গার্মেন্টস মালিকদের লাঠিয়াল বাহিনী ও পুলিশ দ্বারা।

এর মাঝে ২০১৪ সালের পয়লা এপ্রিল টিএসসিতে ঘটে যায় নারী নির্যাতনের ঘটনা।  বটতলা এই নারী নির্যাতনের প্রতিবাদস্বরূপ ইম্প্রভাইজেশনাল নাটক নির্মাণ করে ‘আর নয় চুপ থাকা’। এই নাটকটিও ব্যাপক আলোড়ন তোলে। ২০১৬ সালে বটতলা নির্মাণ করে শাহাদুজ্জামানের উপন্যাস ‘ক্রাচের কর্নেল’ অবলম্বনে মঞ্চনাটক। বাংলাদেশের একটি অজানা অধ্যায়, যা ইতিহাসে স্থান পায় খুব কম, কর্নেল তাহেরের জীবন। সাথে চলে আসে মুক্তিযুদ্ধ, এর পরবর্তী বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও কর্নেল তাহেরের ফাঁসি। নাটকটি নতুন প্রজন্ম দারুণভাবে গ্রহণ করেন, এটি ইতিহাসের এক ভিন্ন পাঠ, যা প্রতি মুহূর্তে আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করে। ঢাকার মঞ্চের জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে বর্তমানে ‘ক্রাচের কর্নেল’ একটি। ২০১৭ সালে বটতলা মঞ্চে আনে সুকুমার রায়ের হেসরাম হুসিয়ারর ডায়েরি অবলম্বনে নাটক ‘বন্নথেরিয়াম’। নাটকটির নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দেন ইভান রিয়াজ। ১০ বছরে বটতলা নামিয়েছে  ১০টি নাটক।

‘ক্রাচের কর্নেল’ নাটকের একটি দৃশ্য।

পাশাপাশি ২০১৪ সালে ‘ছড়াই স্বপ্নবীজ আকাশতলে’ ও ২০১৬ সালে ‘ধরিত্রী ও মানব হত্যার বিরুদ্ধে মুক্তির উৎসবে’ শিরোনামে আয়োজন করে ‘বটতলা রঙ্গমেলা’। এই উৎসব দুটি নতুন নাটকের নাট্যোৎসব। বাংলাদেশের দল ছাড়াও এই উৎসবে আমেরিকা, ইরান ও ভারতের নাটকের দল অংশগ্রহণ করে। ‘বটতলা রঙ্গমেলা’ বাংলাদেশের থিয়েটার কর্মী, দর্শক ও নাট্যামোদীদের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন ফেলেছে। এই দুটি উৎসবে বটতলা আজীবন সম্মাননা দেয় ফেরদৌসী মজুমদার ও আলী যাকেরকে। ২০১৬ সালের উৎসবে ৮ বিভাগের ৮ জনকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয় তাদের থিয়েটারে অবদানের জন্য। প্রতি দুই বছর অন্তর বটতলা নিজেদের নাট্যকর্মীকে ‘নাদিম স্মৃতি শ্রেষ্ঠ নাট্যকর্মী পদক’ প্রদান করে। এই পদক পান বটতলার একজন নিষ্ঠাবান কর্মী, যিনি বটতলার কর্মীদের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন।  এ পদক প্রদানের কারণ বটতলা অন্তঃশক্তি বিকাশকে উদ্‌যাপন করতে চায়। ২০১৪ সালে পদকটি পান ইমরান খান মুন্না ও ২০১৬ সালে মিজানুর রহমান।

এই ১০ বছরের পথপরিক্রমা একেবারেই মসৃণ ছিল না বটতলার জন্য। পথে পথে দমন-পীড়ন আর কটুকাটব্য শুনে কেটেছে বহু মাস-বছর। প্রতিদিন নতুন পরীক্ষা, নতুন দুঃসাহস আর নতুন দুর্নাম। ২০১৬ সালের জুন মাসে একটি নাটকের দলকে শিল্পকলায় ‘নাটক ও সুন্দরবন নিয়ে বাহাস করতে না দেওয়ার’ প্রতিবাদ করার জন্য ১৮ মাস শিল্পকলা একাডেমি অজ্ঞাত কারণে বটতলাকে করেছিল হলবঞ্চিত। বিকল্প মঞ্চ হিসেবে মহিলা সমিতি মিলনায়তনকে বেছে নেয় বটতলা। যদিও এই ১৮ মাসে বটতলা ৪০টির অধিক প্রদর্শনী করেছিল দেশে-বিদেশে, শিল্পকলার হল ছাড়াই। পরিশেষে বলতে চাই, বটতলা এক খোলা হাওয়ার ডাক। এটা বাংলাদেশের যেকোনো শিল্পীর জন্য উন্মুক্ত স্থান থিয়েটারের নতুন রাস্তা মাতাওয়ের জন্য।  আপনাকে আমন্ত্রণ।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.