বাংলা কবিতার ভবিতব্য
জীবনের বেশির ভাগ সময় আমার রোগ-ব্যাধি-ক্যানসার, ছাত্র, পরীক্ষা ইত্যাকার গা-গুলানো অসংস্কৃত কর্মযজ্ঞে নিজেকে মশগুল রাখতে হয়। আমিও আজ ধীরে ধীরে অসংস্কৃতদের দলে ভিড়ে যাচ্ছি যেন! বিশুদ্ধ সাহিত্য-সঙ্গ এখন আমার জন্য দুর্লভ। সেই প্রবল যৌবনে যখন কবিতা কবিতা করে আমার সারাটা সময় অগস্ত্য যাচ্ছিল বলে অনেকে মনে করত, সেই সময়টা ফিরে পাওয়ার জন্য মনে মনে সময়ের কাছে কত আকুতি যে করেছি…।
সবুজ হোটেল ঘিরে যে উন্মাতাল আড্ডা আমরা সে যুগে দিয়েছিলাম, তার কিছু কিছু চিহ্ন হয়তো আপনারা খুঁজে পাবেন ইতিহাসের সিন্দুক থেকে ‘লিরিক’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন উন্মোচন করলে। আমার কবিতাচর্চায় ‘লিরিক’ যেন এক অবশ্যম্ভাবী নাম। আজ বাংলাভাষী যেকোনো সাহিত্যকর্মীই এই নামটির সাথে পরিচিত। ‘লিরিক’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা প্রথম সর্বভারতীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলনে পুরস্কৃত হয়েছিল। এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ‘লিরিক’ ফটোকপি করে নিয়ে পড়ছে। আর এই ‘লিরিকে’র মাধ্যমেই আমরা বাংলাজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম ‘উত্তর আধুনিক কবিতা’র জোয়ার। আপনারা এই দর্শনের সাথে অবশ্যই পরিচিত, কেউ কেউ এ নিয়ে কাজ করার আগ্রহও দেখিয়েছেন। অথচ সেই নব্বইয়ের দশকের সূচনালগ্নে যখন বাংলাদেশের একটা প্রান্তিক শহর থেকে এই কাব্যচিন্তা বিকাশ লাভ করতে থাকে, তখন অনেক বিরোধিতা আর অপপ্রচারে আমাদের হৃদয় বিষণ্ন হয়েছিল।
তবে আমাদের এই উপলব্ধি ছিল যে কালের গায়ে সামান্য হলেও যে আঁচড়টি দেওয়ার চেষ্টা আমরা করেছি, তা অবশ্যই একদিন স্নিগ্ধতা পাবে। অবক্ষয়ী আধুনিকতার যে ভাষা বাংলা কবিতাকে আকীর্ণ করার প্রয়াস পেয়েছিল আশির দশকের প্রথম দিকে, বাংলা কবিতা আজ অবশ্যই সেখান থেকে উত্তরণ লাভ করেছে। আমি নব্বইয়ের শেষ দিকের এবং শূন্য দশকের অনেকগুলো কবিতা পাঠ করে বিস্ময়ের সাথে অনুভব করি, বাংলা কবিতা অন্তর্লোকের এক অদ্ভুত মায়াবী জগতে ঢুকে পড়েছে। এই মায়াজগতের কবিতা বাংলা কবিতার ইতিহাসে এর আগে কখনো আসেনি। অনেকে এর ভেতরে মরীচিকায় হাতড়ে মরলেও অসাধারণ অনেক কবিতার জন্ম লাভ করেছে।
আজ বাংলা কবিতা ঢাকা বা কলকাতাকেন্দ্রিক কোনো ব্যাপার নয়। আজ বাংলাজুড়েই যেন সৃষ্টি হচ্ছে কবিতার নকশিকাঁথা। উত্তর ঔপনিবেশিক স্বাধীন বাংলাদেশের পটভূমিতে মননের ইউরোকেন্দ্রিকতা ভাঙার যে জোরালো চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তারই বহিঃপ্রকাশ আজ আমাদের কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। আজ কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, সিলেট, সুনামগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রংপুর থেকে শুরু করে সারা বাংলার সকল প্রত্যন্ত অঞ্চলে তরুণদের কলমে ঝরনাধারার মতো প্রবাহিত হচ্ছে নতুন কাব্যধারা। অনেকে আজ এর পেছনের তত্ত্ব বা দর্শন না জেনে বা না বুঝেও এর অপার সমুদ্রে অবগাহন করছেন। আজকের কাব্যভাষা, শব্দচয়ন কিংবা উপমা ব্যবহারেও যে নতুন মাত্রিকতার ছোঁয়া লেগেছে, তাকে উপলব্ধি করলেই আমরা দেখব, কবিতা অনেক বেশি মাটিলগ্ন, ইতিহাসচেতনা সমৃদ্ধ, লোকসংস্কৃতি-সংশ্লিষ্ট হয়ে উঠেছে। কবিতায় আন্তর্বয়ন ও বিনির্মাণের আবহ কবিতাকে মধুর ও বর্ণিল করে তুলছে।
অবক্ষয়ী আধুনিকতার যে ভাষা বাংলা কবিতাকে আকীর্ণ করার প্রয়াস পেয়েছিল আশির দশকের প্রথম দিকে, বাংলা কবিতা আজ অবশ্যই সেখান থেকে উত্তরণ লাভ করেছে। আমি নব্বইয়ের শেষ দিকের এবং শূন্য দশকের অনেকগুলো কবিতা পাঠ করে বিস্ময়ের সাথে অনুভব করি, বাংলা কবিতা অন্তর্লোকের এক অদ্ভুত মায়াবী জগতে ঢুকে পড়েছে। এই মায়াজগতের কবিতা বাংলা কবিতার ইতিহাসে এর আগে কখনো আসেনি।
অবক্ষয়ী আধুনিকতার যে ভাষা বাংলা কবিতাকে আকীর্ণ করার প্রয়াস পেয়েছিল আশির দশকের প্রথম দিকে, বাংলা কবিতা আজ অবশ্যই সেখান থেকে উত্তরণ লাভ করেছে। আমি নব্বইয়ের শেষ দিকের এবং শূন্য দশকের অনেকগুলো কবিতা পাঠ করে বিস্ময়ের সাথে অনুভব করি, বাংলা কবিতা অন্তর্লোকের এক অদ্ভুত মায়াবী জগতে ঢুকে পড়েছে। এই মায়াজগতের কবিতা বাংলা কবিতার ইতিহাসে এর আগে কখনো আসেনি।
কিন্তু অবাক বিস্ময়ে এ-ও ভেবেছি, কেউ যেন একক সৌরভে জ্বলে উঠছে না। কবিতার ইউরোকেন্দ্রিক ভঙ্গিমা থেকে আর কেন্দ্রমুখিনতা থেকে উত্তরণ লাভ করলেও অনেকেই আত্মশ্লাঘার ঘোর অমাতে ঘুরপাক খাচ্ছেন। কূপমণ্ডূকতায়ও অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন বৈকি! আবার এই কথাও মনে এসেছে, এই কবিতা সামষ্টিকতার বহিঃপ্রকাশ বলেই একক সৌরভ এখানে মেলে না হয়তোবা। বুনো ফুলের গন্ধে যখন গ্রামের বনাঞ্চলের প্রত্যন্ত প্রান্তরে বাতাস মাতোয়ারা হয়ে ওঠে, তখন ঠিক কোনো একটা ফুলকে এর জন্য কৃতিত্ব যেন দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।
তবে আমার মনে হয়, এখন সময় এসেছে উত্তর আধুনিকতা বা এই সময়ে চলমান কবিতাকে পুনর্মূল্যায়ন করার, আবার ভাবতে হবে কবিতাকে আমরা সাধারণের কতটা নৈকট্য দিতে সক্ষম হয়েছি? কতটা বোধের নিকটে এসেছে পাশেই বসে থাকা আরেক কবির, কিংবা বোদ্ধা পাঠকের? সময় এসেছে সমকালীন বিশ্বসাহিত্য পাঠের, অনুবাদের, আর এর গতিধারাকে চিহ্নিত করে আমাদের কাব্যভুবনকে আরও নতুন করে সাজিয়ে তোলার। আর এই সব কাজের জন্য তুখোড় তরুণদের ভীষণ প্রয়োজন কবিতার নাটমন্দিরে।
আসলে নন্দনতত্ত্বের জন্ম শিল্পের জন্মের সাথে সাথেই। আমাদের এই বঙ্গীয় কিংবা বৃহদর্থে ভারতবর্ষীয় শিল্পেরও একটা নির্দিষ্ট নন্দনতাত্ত্বিক বিকাশ আমরা সুদীর্ঘ কাল থেকে লক্ষ করে আসছি। তবে প্রাচীনকাল থেকে এই সব নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাপার তেমন গোছানো ছিল না। তবে শিল্পের বিকাশ আর সমাজের বিকাশ অনেকটা সমমাত্রায় ঘটে এসেছে। কিন্তু তাকে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস আমরা দেখতে পাই অনেক পরে। যে সময়ে মানুষের বিকাশ একটা সংঘাতময় পরিস্থিতিতে রূপ লাভ করে, তখন মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে, আর এই বিচ্ছিন্নায়ন প্রক্রিয়ার সাথে সাথে শিল্পের বিকাশও ভিন্ন মাত্রা লাভ করে।
মূলত এমনতর সমস্যার সূচনা বা সূত্রপাত প্রথমে ঘটে ইউরোপে। ইউরোপের সমাজ ব্যবস্থার যে দুরূহ পরিস্থিতি ধীরে ধীরে তাদের সমাজ বিপ্লবের দিকে নিয়ে যায়, তার সাথে অর্থনীতির বিকাশের ধাক্কাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তারই ফল শিল্পবিপ্লব। সেই থেকেই মানুষ কৃষিনির্ভর সমাজবদ্ধ জীবনকে অতিক্রম করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শ্রমনির্ভর জীবনে পা রাখে এবং তারপর থেকেই বিচ্ছিন্নতাবোধ মানুষকে আক্রান্ত করে। এই সময়ে মানুষ নিজেকে নিয়ে অনেক বেশি করে ভাবতে শেখে। এই সময়ের সমস্ত চরিত্রলক্ষণকে একটা নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আধুনিকতা’। মানুষ এই সময়ের মধ্যে শ্বাস নিতে নিতে এই পরিবেশকেই চূড়ান্ত ও অভীষ্ট ভেবে পরিতৃপ্তি লাভ করতে থাকে। আর ফেলে আসা অতীতকে বিশ্লেষণ করার জন্য আদিম সমাজ, প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ইত্যাকার সংজ্ঞায় অভিহিত করে। কিন্তু মানবেতিহাসের উৎকৃষ্টতম সৃষ্টিগুলো সব এই প্রাচীন বা মধ্যযুগে ঘটে গেছে, তা কি অবলীলায় ভুলে বসতে পারে! পিরামিড কবে তৈরি হয়েছে? কিংবা অজন্তা-ইলোরার ভাস্কর্য? রামায়ণ-মহাভারত কবে রচিত হয়েছে? কিংবা ইলিয়াড-ওডেসি?
যা-ই হোক, ইউরোপের মতো শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়া হয়তোবা আমাদেরও আকীর্ণ করত, উমিচাঁদ, জগৎশেঠরা সেই দিকেই এগোচ্ছিলেন। সিরাজের সামন্ত অত্যাচার থেকে ক্ষমতা ব্যবসায়ী শ্রেণির হাতে নিয়ে আসার উদ্যোগ তারা নিয়েছিলেন। কিন্তু ভুল পথে। ক্লাইভের সাহায্য নিয়ে শিল্পবিপ্লবের সমূহ সম্ভাবনাকে ধূলিসাৎ করে ভারতবর্ষকে ঠেলে দেওয়া হলো অনিশ্চিত ঔপনিবেশিকতার দিকে। তাই আমাদের সমাজ অত্যাচার আর নিগ্রহের বেড়াজালে পাক খেতে খেতে যখন বিকাশ-বিপন্ন হয়ে আবার সামন্ত ধাঁচের উপনিবেশে পরিণত, তখন ইউরোপীয় সমাজ ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজ বিকাশের মধ্য দিয়ে পরিণত হতে হতে একটা কাঠামো লাভ করে। এই কাঠামোরই নাম আধুনিকতা। এখানেও প্রয়োজন হয়ে পড়ে রেনেসাঁসের। ইতিহাসের উপাদানকে কাজে লাগিয়ে এই রেনেসাঁর বিকাশ। মূলত রোমান্টিসিজমই এর শ্রেষ্ঠ পরিণতি। আমাদের রবীন্দ্রনাথের কর্মযজ্ঞ এই রোমান্টিক ধারারই শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি।
তাই আমাদের সমাজ অত্যাচার আর নিগ্রহের বেড়াজালে পাক খেতে খেতে যখন বিকাশ-বিপন্ন হয়ে আবার সামন্ত ধাঁচের উপনিবেশে পরিণত, তখন ইউরোপীয় সমাজ ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজ বিকাশের মধ্য দিয়ে পরিণত হতে হতে একটা কাঠামো লাভ করে। এই কাঠামোরই নাম আধুনিকতা। এখানেও প্রয়োজন হয়ে পড়ে রেনেসাঁসের। ইতিহাসের উপাদানকে কাজে লাগিয়ে এই রেনেসাঁর বিকাশ।
এই রোমান্টিসিজমের চূড়ান্ত সময়ে অকস্মাৎ দেখতে পাই এক অবিমৃষ্য কুঠারাঘাত – জাত্যভিমান আর উপনিবেশবাদী আক্রমণ। আর তারই ফল দুই-দুইটি বিশ্বযুদ্ধ। এতে সমাজ আর রোমান্টিসিজমের স্বপ্নে বুঁদ থাকতে পারল না, সমাজে দেখা দিতে লাগল হতাশা আর অবক্ষয়। এই অবক্ষয়ী আধুনিকতা যখন ইউরোপের চাঁদকে ঝলসানো রুটি বানিয়ে ছেড়েছে, তখনো বাংলার সমাজ উপনিবেশের বেড়াজালে সামন্ত কাঠামোয় বাঁধা। আর আমাদের সমাজে তখন মাত্র রূপ লাভ করছে জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতার চেতনা। এমন সময়ে আমাদের শিল্প-সাহিত্য কিন্তু নজরুল-পরবর্তী সময়ে যে ‘পোড়োজমি’র সন্ধান করেছিল, তা আমাদের ছিল না। তবু বিশেষ করে আমাদের কবিতা যেন অবক্ষয়ী আধুনিকতার ঘূর্ণিতে ঢুকে পড়ে। কিন্তু আধুনিকতার সংজ্ঞা যারা তৈরি করেছিলেন, তারা মানুষের মনে এমন একটা ধারণা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন যে আধুনিক মানে নতুন। যেকোনো নতুনত্ব মানে আরও আরও আধুনিক। তাহলে আধুনিকতা মানে কি চিরায়ত? কিন্তু আধুনিকতা তো ক্ল্যাসিক নয়। আধুনিকতা মানে নতুনত্ব নয়। আধুনিকতা চিরপ্রবহমান কিছু নয়। যদি তা-ই হতো, তবে আধুনিকতার সূচনাকাল থাকত না। বাংলা কবিতার কালকে আমরা প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ– এইভাবে দেখে এসেছি আশির দশক পর্যন্ত। তাহলে কি চর্যাপদের রচয়িতা তার কালে আধুনিক ছিল না? আমরা কেন সে সময়টাকে প্রাচীন যুগ বলি?
এই থেকে আমরা দুটি সিদ্ধান্তে আসতে পারি। আধুনিকতা দুইভাবে নিরূপণ করা যাবে। এক চরিত্রলক্ষণ, আর দুই নির্ধারিত সময়।
যে সময়ে আমরা লিখতে এসেছিলাম, তখন আশির সূর্য ডোবার সময় উপস্থিত। আমরা তখন লিখতে বসে দেখলাম বাংলা কবিতা যেন অবক্ষয়ী আধুনিকতার জালে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই বিষয়ে আমি আমার ‘উত্তর আধুনিকতা– এ সবুজ করুণ ডাঙ্গায়’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিস্তারিত তুলে ধরেছি। আমরা আবার নতুন করে পাঠ করতে চাইলাম বাংলা কবিতাকে পূর্বাপর, একই সাথে বিশ্বসাহিত্য তো বটেই।
সে সময়টা এমন একটা সময় যখন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন ঘটেছে। তাই আশির দশকে যেমনভাবে সরল সমীকরণ মেলানো হতো, কবিতা আর প্রগতিশীলতার শেষবিন্দু সমাজতান্ত্রিক চেতনা, যা শুভবাদী চিন্তার সাথে একরৈখিকতারও জন্ম দিচ্ছিল, সেখানে এক বিশাল ধাক্কা এসে লাগল। আবার আমাদের দেশেও এক দফা এক দাবির দিন শেষ করে গণতন্ত্রের সূত্রপাত ঘটেছে। তাই সেই সময়টা একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়, যেখান থেকে সমাজ এবং শিল্প নতুন পথে হাঁটার সুযোগ ও সম্ভাবনার জন্ম। সমাজ নেতারা সমাজকে আবার হতাশার জালে জড়িয়ে ফেললেও কিছু গুণগত পরিবর্তন অবশ্যই এসেছে। আর কবিরা সারা দেশের নানান প্রান্তে নানাভাবে কবিতাকে বহুবর্ণিল করে বিকশিত করার প্রয়াস পেয়েছে।
আমরা সেই অমোঘ সময়ে শোনাতে চেয়েছি ‘স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃত সমান’। আমরা কবিতার আকাশ থেকে দূর করতে চেয়েছি ‘হাস্য মুখে দাস্য সুখ’-এর অবসাদ। আমরা ইউরোকেন্দ্রিক আধুনিকতার মধ্যে যে অনুকরণ প্রবণতা লক্ষ করেছিলাম, তা থেকে বেরোতে চেয়েছিলাম, আর তার জন্য আমরা কবিতার বিষয়কে মানুষ, নদী, কৃষি তথা সমাজের নৈকট্যে আনার প্রয়াস পেয়েছিলাম। আমাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও লোকজীবনের সাথে কবিতার মেলবন্ধন রচনা করতে চেয়েছিলাম। কবিতাকে আন্তর্বয়ন আর বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে এক নতুন ব্যঞ্জনা দিতে চেয়েছিলাম।
আজ মহাকালিক সাগরতীরে যে অসাধারণ সময়ে আমরা উপনীত হয়েছি, তার অনুভূতি কেবল হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়েই প্রকাশ করা সম্ভব, ভাষায় নয়। আজ বাংলাজুড়ে যে কবিতার কাজ হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে যে অতীন্দ্রিয় অনুভূতি, তা আমাকে করে তুলছে কেবলি স্বপ্নাতুর, আলুথালু। আমাদের কবিতা, এই টগবগে তারুণ্যের কবিতা, বিশ্ব জয় করুক।
সময়ের আঁচড় বড় কঠিন। সে সময়ে যারা আমাদের এই প্রয়াসকে ভর্ৎসনা করেছিলেন, পরে তাদের অনেককে উত্তর আধুনিকতা নিয়ে সভা-সিম্পোজিয়াম করতে দেখেছি। অনেকে এই উত্তর আধুনিকতাকে তাদের সম্পদ হিসেবে কৃতিত্বও দাবি করতে চেয়েছেন। বস্তুত উত্তর আধুনিকতা কী? উত্তর মানে উঁচু, উত্তর মানে উত্তরণ, উত্তর মানে পরবর্তী। তাই উত্তর আধুনিকতা হচ্ছে আধুনিকতা থেকে উত্তরণের এক চিন্তার নাম, যা আধুনিকতাকে অতিক্রম করে পরবর্তী সময়ের চিন্তার সূচনা ঘটাবে। এই চিন্তা মূলত কোনো নির্দিষ্ট ফর্মূলা নয়। এটা হচ্ছে চিন্তার এককেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তির দর্শন। একটা সময় ছিল আমরা সবাই বিশ্বাস করতাম, মানবসমাজ আদিম সমাজ থেকে বিকাশ লাভ করে ধনতন্ত্রে পদার্পণ করেছে, আর তার পরই আসবে সমাজতন্ত্র এবং শেষে চিরশান্তির সাম্যবাদ– যা আমরা মার্ক্স, এঙ্গেলস কি লেনিনের কাছে শিখেছি। কিন্তু সমাজ কোনো একরৈখিক বিষয় নয়। সমাজতন্ত্রিক ব্যবস্থার গলদ ও মনোটোনাস চেতনা থেকে বেরিয়ে আসার সেই অমোঘ সময়ে আমরা সারা বিশ্বে নানান রকম ভাবনায় আকুল হয়েছিলাম। কেউ কেউ একে নিও মার্ক্সিজম নামেও অভিহিত করেছিল। কিন্তু আমরা যারা এই সময়টার সুযোগে কবিতাকে এগিয়ে নিতে চেয়েছি, তারাও নানা রকম চিন্তাভাবনা করেছি। ইউরোপের পোস্ট মডার্নিজম আর আমাদের উত্তর আধুনিকতা এক নয়। ইউরোপ যখন পোস্ট মডার্নিজমের ধারণাকে লালন করে অবান্তরতার দিকে মেটাফিকশনের দিকে ঢুকে পড়ছিল, আমরা তখন মানুষের দিকে, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ঝেড়ে ফেলে সামষ্টিকতার দিকে ঝুঁকেছি। একই সময়ে সামগ্রিক দর্শন হিসেবে উত্তর আধুনিকতা নিয়ে ভারতীয় বাঙালিরাও কাজ করছিলেন, আমাদের সাথে তাদের যোগাযোগ ছিল এবং এখনো আছে। কিন্তু তাদের সাথে আমাদের বেশ কিছু বড়সড় পার্থক্যও কাজের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। আবার বেশ কিছু মিলও ছিল। সবচেয়ে বড় অমিল হচ্ছে, আমাদের স্বাধীন ভূমিতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা করা, আর তাদের প্রদেশিকতার নিগড়।
উত্তর আধুনিকতার এই ধারণার বিকাশের ফলে দেশের প্রগতি চিন্তায় যেমন নতুন মোড় নিল, তেমনি কবিতাও হয়ে উঠল বহুবর্ণিল। আগে ধর্মীয় অনুষঙ্গ কিংবা লোককথা বা বচনকে কবিতায় অবহেলা করা হতো, বরং ইউরোপের উপমা এসে ভর করত বাংলা কবিতায়। বিশেষ করে মুসলিম মিথলজি বলতে গেলে চল্লিশ-পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, এ যেন প্রতিক্রিয়াশীলতার নজির। অথচ এই বাংলার অধিকাংশ মানুষের জীবনের সাথে এই সব উপকথা চিন্তা খুব নিবিড়ভাবে জড়িত। উত্তর আধুনিকতা যেন এই শিকলটা ভেঙে দিয়ে কবিতার মধ্যে সাধারণ বাঙালির জীবনকে অনেক বেশি মূর্ত করেছে।
কিন্তু এর বিপদও আছে। যখন উত্তর আধুনিকতার এই বিকাশকে রুদ্ধ করার জন্য অবক্ষয়ী আধুনিকেরা নির্লিপ্ততা দিয়ে এর তেজকে সংহার করতে চেয়েছেন, ঠিক তেমনি মৌলবাদীরাও সুযোগ খুঁজেছে এর ভেতরে ঢুকে পড়ে ফায়দা লুটতে। কিন্তু এই দর্শন, সহজিয়া ধর্মের বিকাশের সাথে লোকচেতনার ও খেটে খাওয়া মানুষের চিন্তা ও স্বপ্নকে লালন করেছে, মৌলবাদ এখানে বাসা বাঁধতে পারেনি।
নব্বইয়ের শেষ দিক থেকে ‘লিরিক’-এর সাথে সংশ্লিষ্ট মধ্যবিত্ত তরুণেরা সবাই রুজি-রোজগারের কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত হলে ‘লিরিক’নির্ভর ধারা কিছুটা বিঘ্নিত হয়। আমরা দীর্ঘ সময় পেশার জটাজালে এমন জড়িয়ে পড়েছি যে এই ধারাটি নিজ নিয়মে বেড়ে উঠলেও পরিচর্যার কাজটি ঠিকভাবে হয়ে ওঠেনি। তাই লক্ষ করছি, ইদানীংকার কবিতায় ভাষা, শব্দ, উপমা সবকিছু লোকসংস্কৃতি ও যাপিত জীবন থেকে নিয়েও কোথাও যেন একটা দেয়াল তুলে রাখছে সাধারণের পাঠ থেকে, সাধারণের বোধ থেকে।
আজ নতুন শতকের মশাল হাতে যারা বাংলা কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, তাদেরই এখন শুরু করতে হবে নতুন চিন্তন। উত্তর আধুনিকতা কোনো ম্যানিফেস্টোর ফসল নয়, এ হচ্ছে আমার আপনার আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ বিকাশের উচ্চারণ। তাই আজ থেকেই হতে পারে নতুন আঙ্গিকে নতুন বিন্যাসে কবিতার বহুবর্ণিল পথচলা। তবে কবিতাকে মুক্ত করে সাধারণ্যের বোধের কাছে, সাধারণ জীবনের কাছে, সামষ্টিকতার কাছে আনার সংগ্রাম আমাদের এগিয়ে নিতে হবে। বাংলা কবিতার অযুত সম্ভাবনার এই আলোকবর্তিকা আজকের তরুণ কবিরা শক্ত হাতে ধরুন।
আজ মহাকালিক সাগরতীরে যে অসাধারণ সময়ে আমরা উপনীত হয়েছি, তার অনুভূতি কেবল হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়েই প্রকাশ করা সম্ভব, ভাষায় নয়। আজ বাংলাজুড়ে যে কবিতার কাজ হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে যে অতীন্দ্রিয় অনুভূতি, তা আমাকে করে তুলছে কেবলি স্বপ্নাতুর, আলুথালু। আমাদের কবিতা, এই টগবগে তারুণ্যের কবিতা, বিশ্ব জয় করুক।
রচনাকাল ২০১৬