মশিউল আলমের টাইম মেশিন
মশিউল আলমের লেখার সাথে পরিচয় ঠিক যখন মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই আর পড়ছি না, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ পাইলে গিলে নিচ্ছি। মে বি ২০০২ সাল। মাসুদ জাকারিয়া ও রিফাত হাসানের বাসায় অনেকগুলা বইয়ের মধ্যে আবিষ্কার করি ‘২০৯৯’। ওরা বলল, এটা বেশ মজার বই।
বাসায় নিয়া এসে পড়া শুরু করলাম। আরে মজার বই তো! এটা এমন একটা সময়কে (শ খানেক বছর পর) নিয়া লেখা, যখন নর-নারীর সম্পর্কের মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পুনরুৎপাদনকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়। বরং পুরুষ-পুরুষে বা নারী-নারীতে প্রেমই স্বাভাবিক। আর মানবশিশু? তার জন্ম হয় কারখানায়। দরকারমতো অর্ডার দেওয়ার ব্যাপার। ওই সময়ে দুই তরুণ-তরুণী প্রেমে পড়ে। এ নিয়ে তাদের নানান হেনস্তার শিকার হইতে হয়।
বইটির শেষটা খুবই অদ্ভুত মনে হইছিল। সমাজ-লোকলজ্জার ভয় ও চাপে সন্তানসম্ভবা তরুণীকে নিয়ে ওই তরুণ একটা দ্বীপের মতো জায়গায় চলে যায়। সেখানে কিছু ট্রাইব থাকে, যারা নারী-পুরুষ মিলে সন্তান জন্ম দেয়। গল্পের নায়িকা মা হওয়ার পর একজন ইমাম এসে কানের কাছে আজান দেয়।
মনে হইছিল এটা একটা সায়েন্স ফিকশন। মানে এইভাবে মানুষরে দেখা, যান্ত্রিকভাবে উৎপাদিত হওয়া মিলা এ ধারণা আসল। তার বাইরেও হয়তো একটা অর্থ পাইতে পারতাম। প্রযুক্তি, বিরাজনীতির গর্ব আর সবকিছুরে ধরেবেঁধে এক করতে চাওয়াচাওয়িতে মানুষ কোথায় যাইতেছে তার একটা অনুমান আকারে ভাবা যাইত। হয়তো। এর চেয়ে বড় কথা হলো, ফ্যান্টাসির আকারে হইলেও দুনিয়া কীভাবে ফ্যাংশন করছে, করতে যাইতে পারে, তা নিয়া লেখকের একটা চিন্তা আছে। অর্থাৎ বৃহত্তর জায়গা থেকে সমাজকে দেখতে চাওয়া। তখন লেখকের রাজনৈতিক ওরিয়েন্টশন বা অন্য ব্যাপার নিয়া জানতাম না বা এমন ভাবনা মাথায় আসে নাই। এখন মনে হয় এভাবেও দেখা যাইতে পারে।
এটা এমন একটা সময়কে (শ খানেক বছর পর) নিয়া লেখা, যখন নর-নারীর সম্পর্কের মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পুনরুৎপাদনকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়। বরং পুরুষ-পুরুষে বা নারী-নারীতে প্রেমই স্বাভাবিক। আর মানবশিশু? তার জন্ম হয় কারখানায়। দরকারমতো অর্ডার দেওয়ার ব্যাপার। ওই সময়ে দুই তরুণ-তরুণী প্রেমে পড়ে। এ নিয়ে তাদের নানান হেনস্তার শিকার হইতে হয়।
এবং গল্পের শেষটায় ধর্ম টিকে থাকার যে ধারণা দেয়, তা আকর্ষণীয়। ওই সময় ঠাট্টাই মনে হইছিল। আবার মনে হইতে পারে নতুন বিপ্লবের ডাক এখান থেকেও আসতে পারে। ধর্ম যে ইনসাফের কথা বলে! তার আবেদন ফুরাইয়া যায় নাই। বরং অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে মানবিক ব্যাপারগুলা নাই হয়ে যাচ্ছে বেমালুম। আসলেই কি!
এ ছাড়া যৌনতা নিয়ে সামষ্টিক দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজের রীতি বেঁধে দেওয়াও তো একটা রাজনৈতিক ব্যাপার। এর মাধ্যমে গ্রহণ-বর্জন, উচিত-অনুচিতের ধারণা থেকে বুঝে নিতে পারেন সেই সমাজ বা মানুষগুলা কেমনে চলছে।
মশিউল আলমের সঙ্গে পরিচয় হইছিল এই বইমেলায়। তখন বলছিলাম ওনার বই পড়ছি। তখন উনি জিগ্যাসা করেন, কোন বই পড়ছি? ‘২০৯৯’-এর নাম বলতে অবাক হন। এটার কথা নাকি কেউ মনে রাখে নাই! আর বললেন, এটা সায়েন্স ফিকশন ছিল না!
তো পুরনো দিনে ফিরা যায়। মাসুদ আর রিফাতরে দেখছি ‘তনুশ্রীর সঙ্গে দ্বিতীয় রাত’ নিয়ে কথা বলতে। এই বই আমি পড়ি নাই, বলাবলির কারণ ধরতেও পারি নাই। কখনোই না।
মে বি কারেন্ট বুক সেন্টারে গেছিলাম। খুঁজতেছিলাম মশিউল আলমের কোনো বই আছে কি না! পাইলাম গল্পের বই, নাম ‘আবেদালীর মৃত্যুর পর’। ওই বইটা নিয়া ঠিকঠাক মনে নাই। এক বন্ধুরে গিফট করে দিছিলাম। এতটুকু মনে আছে, গ্রামের গল্প ছিল বোধ হয়। আর কাহিনি মুগ্ধ করছিল। হুমায়ূনের বাইরে খানিকটা ছড়াইতেছিলাম বোধ হয়!
এরপর মশিউল আলমের কোনো গল্প পড়ি নাই অনেক দিন। পরে ওনার তিনটা বই কিনছিলাম। একটা বোধ হয় স্টেশনরোডের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে। ‘সক্রেটিসের আগে’, ‘প্লেটোর ইউটোপিয়া ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’, ‘অ্যারিস্টটলের পলিটিকস ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’। এগুলো মূলত বার্ট্রার্ন্ড রাসেলের ‘হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি’র কয়েকটা অধ্যায়ের অনুবাদ। ক্লাসনোটের জন্য কাজে লাগছিল। বাংলাদেশের অন্যান্য অনুবাদ থেকে সহজ ছিল। দেখা যাইতেছে, দর্শনের ইতিহাসের প্রথম দিকে রাষ্ট্র, পলিটিকস ব্যাপারগুলো নিয়া কেমন কইরা ভাবা হইছে—এটা নিয়া উনি অন্যদের কনসার্ন করতে চাইতেছেন। এ কারণেই বোধ হয় অনুবাদ করছেন। এমনটা হতে পারে, না-ও পারে।
এর পরের ঘটনাগুলা তেমন মনে নাই। মানে ক্রমানুসারে। চেখভ, গোর্কির ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’জাতীয় সংকলনে সম্পাদক হিসেবে পাইলাম ওনারে। ‘পাকিস্তান’ নামক একটা গল্প নিয়ে শোরগোল উঠছিল গণজাগরণের সময়। গল্পটা পড়ে অবাক হয়ে গেছিলাম। এ ধরনের একটা লেখা বাংলাদেশে অবশ্যই রিস্কি। পষ্ট রাজনৈতিক বোঝাপড়া বা প্রজ্ঞার ছাপ না থাকলে লেখা সম্ভব না। একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাইনারি কালচারের সঙ্গে একটা ছেদও বটে।
আমার আফসোস হইতেছে ‘দ্বিতীয় খুনের কাহিনি’ আগে পড়ি নাই ক্যান? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের খুনোখুনির ইতিহাস এত প্রাঞ্জল, পষ্ট, নানা ধরনের বক্তব্যকে এক সুতোয় গাঁথার প্রয়াস বোধ করি অন্য কোনো উপন্যাসে হয় নাই। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এই রচনা। তবে মূল চরিত্র বোধ হয় জেনারেল মঞ্জুর, যাকে বলা হচ্ছে ট্র্যাজেডির নায়ক। আর দূরদর্শী ভিলেন আকারে পাচ্ছি এরশাদকে।
ইদানীং পড়তেছি ‘দ্বিতীয় খুনের কাহিনি’। টানা মাথাব্যথার কারণে শেষ করতে পারি নাই। বাট ইতিমধ্যে মশিউল আলমকে নিয়ে আড্ডার আয়োজন করছে রাইটার্স ক্যাম্প। তার আগে কিছু বলার ইচ্ছা হইলো আরকি!
আমার আফসোস হইতেছে ‘দ্বিতীয় খুনের কাহিনি’ আগে পড়ি নাই ক্যান? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের খুনোখুনির ইতিহাস এত প্রাঞ্জল, পষ্ট, নানা ধরনের বক্তব্যকে এক সুতোয় গাঁথার প্রয়াস বোধ করি অন্য কোনো উপন্যাসে হয় নাই। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এই রচনা। তবে মূল চরিত্র বোধ হয় জেনারেল মঞ্জুর, যাকে বলা হচ্ছে ট্র্যাজেডির নায়ক। আর দূরদর্শী ভিলেন আকারে পাচ্ছি এরশাদকে।
নানা বিচারে বইটাকে নিরপেক্ষ জায়গা থেকে দেখা যায়। জিয়াকে নিয়ে অবজারভেশন এখনকার সময় বিচারে কৌতূহলজনক। যেহেতু ৯০ পৃষ্ঠা বাকি আছে, পুরো কথা বলা যাচ্ছে না। তবে ‘চোখে বা কানে লাগছে’ যে বিষয়টা—২৫ মার্চ রাতে জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়া কোনো কিছু পাইলাম না। সম্ভবত আমাদের রাজনৈতিক অসহনশীলতা, কুৎসাকে বুদ্ধিজীবিতার নামে জায়েজ করা, আদালত দিয়া ইতিহাস নির্ধারণের কালচাল এর কারণ।
আর ‘চোখে বা কানে লাগছে’ ব্যাপারটা হলো, উপন্যাসের দৃশ্যগুলা এতই সুসজ্জিত যে দেখতে পাওয়া যায়, সংলাপগুলা এতই বাস্তব যে শুনতে পাওয়া যায়। এটা দারুণ একটা ঘটনা। হয়তো পুরো বই পইড়া আরো কথা বলা যাবে। আপাতত এটুকু থাক। আর হ্যাঁ, এই বই নিয়া দারুণ একটা সিনেমা হতে পারে।
এ লেখার শিরোনাম কেন ‘মশিউল আলমের টাইম মেশিন’? ওনার লেখায় অতীতের ও ভবিষ্যতের পরিভ্রমণ করছি। এই সিম্পল কারণে। আর সেখানে তিনি মানুষের নিয়তির অনুসন্ধান করছেন। আমিও করলাম তার সাথে!