জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি
মীজানুর রহমানের বই
মীজানুর রহমান বিরল প্রকৃতির সুলেখক ছিলেন। কিন্তু তাঁর নাম ও লেখার সঙ্গে পরিচয় আছে এমন মানুষের সংখ্যা বেশ অল্প বলে আমার ধারণা। এই অল্প সংখ্যক মানুষের কাছেও তাঁর পরিচয় যতটা লেখক হিসেবে, তার চেয়ে বেশি সম্পাদক হিসেবে। কেউ যখন তাঁর কথা উল্লেখ করেন, তখন তা করেন ‘ত্রৈমাসিকের সম্পাদক’ বলে। কেউ কেউ তাঁকে স্মরণ করেন ‘ত্রৈমাসিকের মীজান সাহেব’ হিসেবে। শিল্প-সাহিত্য, সংগীত ইত্যাদি বিচিত্র বিষয়ের যে পত্রিকাটি তিনি ঢাকা থেকে সম্পাদনা করতেন, তার নাম মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা।
পত্রিকাটি তাঁকে কিছু মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র করে তুলেছিল। কয়েকটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের মধ্য দিয়ে দুই বাংলার লিটল ম্যাগাজিনের জগতে মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা বিশিষ্টতা অর্জন করেছিল। তাঁর প্রিয় কজন ব্যক্তিকে নিয়ে তিনি মোটা মোটা কয়েকটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। যেমন: কৃষ্ণদয়াল বসু সংখ্যা, কামরুল হাসান সংখ্যা, রশিদ চৌধুরী সংখ্যা, শামসুর রাহমান সংখ্যা, বিদ্যাসাগর সংখ্যা। একক বিষয়ভিত্তিক কয়েকটি বিশেষ সংখ্যাও তিনি প্রকাশ করেছিলেন। যেমন: বৃক্ষ সংখ্যা, পক্ষী সংখ্যা, বৃক্ষ ও পরিবেশ সংখ্যা, নদী সংখ্যা, দুই খণ্ডে গণিত সংখ্যা।
শত শত পৃষ্ঠার একেকটি বিশেষ সংখ্যা তিনি সম্পাদনা করতেন সম্পূর্ণ একা। তাঁর কোনো সহকারী সম্পাদক ছিল না, প্রুফ রিডার ছিল না, অংকনশিল্পী-অঙ্গসজ্জাশিল্পী ছিল না। প্রচ্ছদপট বাদে পত্রিকার ভেতরের সব অলংকরণও তিনি নিজেই করতেন। আজীবন ভগ্নস্বাস্থ্য কিন্তু অক্লান্ত পরিশ্রমী এই মানুষটি যেটুকু লিখেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি লিখতে উৎসাহিত করেছেন, পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। নিজে লেখক হওয়ার ফুরসত পাননি, অন্যদের লেখক হওয়ার পথ সুগম ও প্রশস্ত করার চেষ্টা করেছেন। অন্যদের দিয়ে লিখিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তাঁর অদম্য, অক্লান্ত তৎপরতার কথা তাঁর সমসাময়িক কালের লেখকেরা জানেন। লিখতে বসানো ও লেখা আদায় করার প্রক্রিয়ায় তিনি অনেক অলস লেখককে নানাভাবে ‘পীড়ন’ করেছেন। অনেকের অপটু, অপাঠ্য লেখা তিনি সম্পূর্ণ নতুন করে লিখেছেন।
একাই একটি পত্রিকা সম্পাদনার সব কাজ করা এবং সম্ভবত আরও নানা অজ্ঞাত কারণে তাঁর নিজের লেখার পরিমাণ বেশি নয়। কিংবা হয়তো তিনি নিজেই নিজের ভেতরের লেখকসত্তার পূর্ণ পরিচয় পাননি। ‘ত্রৈমাসিকের সম্পাদক’ হিসেবে তাঁর পরিচয় তাঁর লেখক পরিচয় ঢেকে দিয়েছে।
এ বছর একুশের বইমেলায় প্রকাশনা সংস্থা মাওলা ব্রাদার্স তাঁর রচনাসমগ্রের প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেছে।
২.
মীজানুর রহমানের জন্ম ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের ৬ ফালগুন (১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি) বুধবার, বেলা চারটায়, এই উপমহাদেশের শিক্ষাদীক্ষায় ও বরেণ্য গুণীজনসমৃদ্ধ অভ্যগ্র জনপদ বিক্রমপুরের চতুষ্পাঠী তথা টোল-অধ্যুষিত ইছামতী-তীরস্থ নিভৃত বামুনপল্লী টোল-বাসাইলের এক উদার ধর্মশীল সুফি ভাবাপন্ন জ্ঞানপিপাসু পীরালী পীর পরিবারে। এঁদের যৌথ পদবি খন্দকার ও মুনশি, অর্থাৎ মূলত কর্মকর্তা ও শিক্ষকতাই এঁদের পথচলার কড়ি। সরকারি পদ থেকে অবসরপ্রাপ্ত একদা বড়লাট লর্ড কার্জনের (১৮৫৯-১৯২৫) স্বল্পকালীন খাশ মুনশি ওঁর দাদু খন্দকার ফজলুল করিমের (১৮৬১-১৯৪১) তাবে রয়েছে অবসরোত্তর ২১ বছরের শিক্ষকতার রেকর্ড। কিন্তু মীজানুর রহমানের কোনো রেকর্ড নেই এক ওই ১৪ বছর বয়সে সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়া ছাড়া।
‘কিন্তু জন্মটাই শুধু সবুজের ঘ্রাণে মাখা বিক্রমপুরে; চল্লিশ দিন পেরুলো কি কলকাতা থেকে গা-তোলার এত্তেলা এল। যাই যাই করে তিন মাস পেরিয়ে গেল। চার মাসে পড়তেই ননুয়া গায়ে রঙিন আঙিয়া পরিয়ে মা চললেন ভাগীরথী-তীরের কলকাতায় থানে, বাবার কর্মস্থলে। সেই থেকে ভাগীরথী-তীরের ওই মহানগরে টানা সতেরো বছর। জ্ঞান-চক্ষু খোলার ঢের পরে করিস চার্চ স্ট্রিটের নড়বড়ে নোনাধরা প্রাচীন মিশনারি বিদ্যালয় চ্যাপেল গার্লস স্কুলে প্রাথমিক পাঠ চুকিয়ে সিধে কিংবদন্তির মিত্র ইন্সটিটিউশন (মেইন)-এ।’
‘এরপর চোখের সামনে দিয়ে ঘটে গেল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন ব্ল্যাক-আউটে মোড়া কলকাতা, তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ-লাঞ্ছিত কলকাতার রাস্তাঘাটে দেহাতীদের লাশের পর লাশ, ছেচল্লিশের আগস্টে হতচেতন কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া মহাদাঙ্গার বীভৎস রূপ, আর সব শেষে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো মুখ ব্যাদান করে সামনে এসে দাঁড়াল মূর্তিমান ভারত-বিভাগ তথা বঙ্গ-বিভাগ।’
‘কাকা তাঁর কাচড়াপাড়ার ডেরা তুলে, বাবা দমদম গোরাবাজারে কেনা এক রত্তি জমি বিকিয়ে দিয়ে কলকাতার পাট চুকিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট শেয়ালদা ত্যাগ করলেন। হতবুদ্ধি শরণার্থীর দলটি প্রথমে নারায়ণগঞ্জ, তারপর ১৯৪৮-এর পয়লা জানুয়ারি বুড়িগঙ্গা-বিধৌত ঢাকায়। সঙ্গে এল সেকালের রেওয়াজ অনুযায়ী মুয়াজ্জিন শীর্ষক আরবি শব্দের মোড়কে মোড়া হাতে লেখা কাগজটি (যা পরে ১৯৪৮-এ উর্দুর চোখ রাঙানিকে তুচ্ছ করে ঝংকৃত হয় মুদ্রিত আকারে ঝংকার (১৯৪৯, ফেব্রুয়ারি) নামে।’
‘সেই থেকে বাকল্যান্ড বাঁধের হাওয়া খাচ্ছেন।’
নিজের সম্পর্কে মীজানুর রহমানের লেখা থেকে উদ্ধৃত করলাম এটা দেখানোর জন্য যে তিনি এক বিরল গদ্যশৈলীর অধিকারী লেখক ছিলেন। তাঁর লেখা পড়তে গিয়ে এই বিশিষ্টতাই সব কিছুর আগে নজর কাড়ে। পূর্ব বাংলার আর কোনো লেখকের গদ্য এমন নয়। জীবনের প্রথম ১৬ বছর কলকাতায় কেটেছে বলে তাঁর ভাষাকে পশ্চিম বাংলার লেখ্য ভাষা বলেই মনে হয় বটে, কিন্তু পশ্চিম বাংলার লেখকদের মধ্যেও তাঁর গদ্যশৈলীর স্বাতন্ত্র্য খুব স্পষ্ট: সেখানকার আর দশজন লেখকের লেখার সঙ্গে মীজানুর রহমানের লেখা একাকার হয়ে যায় না, বিরল স্বাতন্ত্র্য নিয়ে পৃথকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
শত শত পৃষ্ঠার একেকটি বিশেষ সংখ্যা তিনি সম্পাদনা করতেন সম্পূর্ণ একা। তাঁর কোনো সহকারী সম্পাদক ছিল না, প্রুফ রিডার ছিল না, অংকনশিল্পী-অঙ্গসজ্জাশিল্পী ছিল না। প্রচ্ছদপট বাদে পত্রিকার ভেতরের সব অলংকরণও তিনি নিজেই করতেন। আজীবন ভগ্নস্বাস্থ্য কিন্তু অক্লান্ত পরিশ্রমী এই মানুষটি যেটুকু লিখেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি লিখতে উৎসাহিত করেছেন, পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। নিজে লেখক হওয়ার ফুরসত পাননি, অন্যদের লেখক হওয়ার পথ সুগম ও প্রশস্ত করার চেষ্টা করেছেন।
তাঁর গদ্য সতেজ, সরস, বুদ্ধিদীপ্ত; অনায়াসে পাঠকের মনে সংবেদন জাগায়। তাঁর বর্ণনাশৈলীর গুণে দীর্ঘ ৬০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া মহানগর জীবন্ত হয়ে ফিরে আসে; গত শতকের তিরিশ ও চল্লিশের দশকের কলাকাতা তার সব ধ্বনি গন্ধ বর্ণ রূপ নিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে। বর্ণনা প্রাঞ্জল, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ‘ছবি লেখা’র মুন্সিয়ানা মীজানুর রহমানের বইগুলোর পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। তিনি গল্প-উপন্যাস লেখেননি, কিন্তু বর্ণনার দক্ষতা তাঁকে কথাশিল্পীর স্তরে উন্নীত করে। তিনি তীক্ষ্ণ ও গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তির অধিকারী ছিলেন। তাঁর এই ক্ষমতার স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে চারপাশের দৃশ্যমান জগতের খুঁটিনাটি বর্ণনায়। কমলালয়া কলকাতা বইয়ের একটি জায়গায় তিনি কিশোরবেলার স্মৃতি থেকে কয়েকটি পোষা কবুতর ওড়ার বিবরণ দিচ্ছেন:
‘তারপর গোরা দুহাত উঁচিয়ে যা-বে-যা-আ-আ আ… এমন গগনবিদারী হাঁক হাঁকত যে একযোগে ডানা ঝাপটে পায়রা অর্থাৎ কবুতরগুলো নিমেষে আকাশে, ওপরে আরও ওপরে ঘুরে ডিগবাজি খেতে খেতে লক্কা এবং সিধে ওপরে উঠতে উঠতে গেরোবাজ ক্রমে বিন্দু হয়ে যায়…এবার সমান্তরাল সুমুখে ধায়…আমাদের ছাত থেকে আমি, গোরাদের ছাত থেকে গোরা, চোখ দূরবীণ হয়ে যায়।’
‘আচম্বিতে গোরার দু’আঙুলের তরঙ্গায়িত মিষ্টি চিকন শিসের ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে ইথারের পরতে পরতে…গেরোবাজ ও লক্কার দলটি দলছুট রকেটের গতিতে নিচে নেমে আসতে থাকে…ওদিকে গোলাও নামে ঘুরতে ঘুরতে, পেছনে লোটন। আবার শিস, ভিন্ন সুরে, ঋজু, একটানা, অলক্লিয়ারের মতো। সবাই-গেরোবাজ, লক্কা, গোলা ও লোটন নিচে নামায় ক্ষান্ত দিয়ে তীরবেগে আবার ঊর্ধ্বে ওঠে, ওঠে…বিন্দু হয়ে যায়…বলাকার মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ সুমুখে ধায়, অতঃপর নাই হয়ে যায়! ধন্দ নয়, সত্যি সত্যি বেলা শেষের গাঢ় নীলিমায় ওরা হারিয়ে যায়! পরক্ষণেই কর্ণভেদী শিস। প্রথমে কিছু চোখে ভাসে না। আস্তে ধীরে ওই তো আসে ঝাঁক বেঁধে, আসে সুবোধ সুশীলের মতো, আসে হাঙরের সুচলো গতিতে…এসেই আবার গোত্তা!’
কলকাতা ও ঢাকা উভয় শহরের পথঘাট, অলিগলি, পাড়া-মহল্লার ভূগোল ছিল তাঁর নখদর্পনে; বিশেষত গত শতকের তিরিশ ও চল্লিশের দশকের কলকাতার যে চিত্রময় বর্ণনা তাঁর বইতে রয়েছে, তা থেকে ওই নগরীর ভূগোল সম্পর্কে তাঁর জানাশোনার পরিধি ও গভীরতা টের পাওয়া যায়। উভয় নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার নানা বিচিত্র জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা, রীতি-আচার, পালা-পার্বন ও মুখের ভাষা সম্পর্কেও তাঁর যে বেশ ভালো ধারণা ছিল, তারও প্রমাণ মিলবে তাঁর লেখায়।
কিন্তু কোনো বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা ও জ্ঞান থাকলেই যে তা নিয়ে বিশদভাবে লেখা যায় তা নয়। সে জন্য লেখার দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। মীজানুর রহমানের সেই দক্ষতা ছিল এবং সেটাই তাঁর প্রধান গুণ বলে আমি মনে করি। তিনি যত বড় সম্পাদক ছিলেন, তার চেয়ে অনেক বড় লেখক ছিলেন।
৩.
মীজানুর রহমান জীবদ্দশায় নিজের লেখা তিনটি বই প্রকাশ করেছেন। কমলালয়া কলকাতা ও কৃষ্ণ ষোলোই সম্পর্কে তাঁর পাঠকদের ধারণা আছে। অন্য বইটির নাম রক্তপিছল কাশ্মীর, এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ, ঢাকার দিদার পাবলিশিং হাউজ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। ‘একটি রাজনৈতিক সমীক্ষা’ হিসেবে লেখা বইটি সম্ভবত ফরমায়েশি ছিল। মীজানুর রহমানের লেখাপত্রে এ বইয়ের উল্লেখ তেমন পাওয়া যায় না।
মীজানুর রহমানের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা খুব কম হলেও তাঁর মোট লেখার সংখ্যা খুব কম হবে না বলে আমার ধারণা। তিনি তাঁর পত্রিকার ৮১টি খণ্ডের প্রতিটিতে সম্পাদকের কড়চা নামে যে সম্পাদকীয় লিখেছেন, সেগুলো একত্র করলে পৃষ্ঠাসংখ্যায় অনেক হবে। সম্পাদকীয় ছাড়াও অনেক নিবন্ধ, প্রবন্ধ, আলোচনা, স্মৃতিকথা ইত্যাদি তিনি নিজের পত্রিকায় লিখেছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর অনেক লেখা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বলে ধারণা করা যায়।
তিনি বিভিন্ন সময়ে ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকায় অনেক বিষয়ে অনেক নিবন্ধ-প্রবন্ধ লিখেছেন। ঢাকা বিষয়ক লেখাগুলো একত্র করে ঢাকা পুরাণ নামে একটি বই প্রকাশ করা হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পরে। বইটির ভূমিকা লিখেছেন তাঁর আর্ট স্কুলের অন্যতম সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। সেই ভূমিকাটি এই গ্রন্থে সংযুক্ত আছে। তাঁর রচনাসমগ্রের এই প্রথম খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হলো তিনটি বই: কমলালয়া কলকাতা, কৃষ্ণ ষোলই ও ঢাকা পুরাণ। বিষয়বস্তু খুবই ভিন্ন রকমের বলে মীজানুর রহমানের রচনাসমগ্রের এই প্রথম খণ্ডে রক্তপিছল কাশ্মীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
মীজানুর রহমানরে রচনাসমগ্রের প্রথম বই কমলালয়া কলকাতা বাংলাদেশে যতটা পরিচিত, তার চেয়ে বেশি পরিচিত ও সমাদৃত পশ্চিমবঙ্গে। কারণ সহজবোধ্য: কলকাতা নিয়ে এমন তথ্যবহুল, আবেগময়, মনোমুগ্ধকর লেখা অত্যন্ত বিরল। এ বইয়ের ‘রকমারি কলকাতা’ শীর্ষক অধ্যায়টি বই প্রকাশের আগে ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসের পত্রিকা ভারত বিচিত্রায় ছাপা হয়েছিল। সেটি পড়ে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত অভিভূত হয়ে লিখেছিলেন, ‘লেখাটিতে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের বৈঠকখানার পাটোয়ার বাগানে তাঁদের [মীজানুর রহমানদের] বাড়ি আর তার আশপাশের রাস্তাঘাট, হারিয়ে-যাওয়া নানান ফিরিওয়ালাদের হাঁক, রাস্তার খেলা ইত্যাদি নিয়ে ভারি মনোজ্ঞভাবে তাঁর বাল্যের চোখ দিয়ে দেখা নানা খুঁটিনাটির কথা পড়ে আমি অভিভূত হই। আমার আনন্দ আরও বহু গুণ বাড়ে যখন আমি জানলাম যে তিনি তিরিশের দশক থেকে ১৯৪৭ সনের দেশ বিভাগ পর্যন্ত তাঁর সেই পুরোনো কলকাতার দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা-কাহিনি নিয়ে তাঁর মমত্বপূর্ণ স্মৃতিকথা লিখবেন।’
রাধাপ্রসাদ গুপ্ত যে মমত্বের কথা লিখেছেন, কলকাতার সঙ্গে মীজানুর রহমানের সম্পর্কের মূল ব্যাপারটাই তাই। ৪ মাস বয়স থেকে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর কলকাতায় কেটেছে। জন্মভিটা বিক্রমপুরের টোল-বাসাইল গ্রামে কালেভদ্রেও বেড়াতে আসতেন কি না জানা যায় না। নিজেকে তিনি কলকাতারই সন্তান ভাবতেন; নিজেই লিখে গেছেন, ‘জন্মটাই শুধু সবুজের ঘ্রাণে মাখা বিক্রমপুরে।’ সুতরাং কলকাতা নিয়ে তাঁর লেখা যে গভীর মমতায় ভরা থাকবে এ কথা বলাই বাহুল্য। যা বিশেষভাবে লক্ষ করার বিষয় তা হলো গভীর বেদনা: মীজানুর রহমানের পরিবারকে প্রায় রাতারাতি ওই প্রিয় মহানগর ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে, যখন তাঁর বয়স ১৬ বছর, ভারত বিভক্ত হয়। তার পরের কাহিনি এখন সবাই জানে। মীজানুর রহমান সপরিবার কলকাতা ছেড়ে চলে আসার বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ কমলালয়া কলকাতা বইয়ের শেষ অংশে দিয়েছেন। এ বিষয়ে আরও বিশদ বিবরণ রয়েছে তাঁর কৃষ্ণ ষোলোই বইতে।
কমলালয়া কলকাতা মীজানুর রহমানের কিশোরবেলায় দেখা কলকাতা মহানগরীর নিবিড় অন্তরঙ্গ ছবি। কিন্তু তিনি যখন বইটি লেখা শুরু করেন, তখন তাঁর বয়স ৫৫ বছর। ফলে দৃষ্টিটা পেছন ফেরা, সব স্মৃতিকথা এভাবেই লেখা হয়। তবে মীজানুর রহমান তাঁর ছেলেবেলার স্মৃতির রাজ্যে এমন অবলীলায় অবগাহন করতে পেরেছেন যে, তাঁর লেখায় সেই সময়টি প্রায় অবিকৃতরূপে বিশদ খুঁটিনাটিসহ ফুটে উঠেছে। তাঁর প্রাঞ্জল বর্ণনায় মৃত অতীত প্রাণ ফিরে পেয়েছে; বিশ শতকের তিরিশ-চল্লিশের দশকের কলকাতা মহানগরীর শঙ্খরব শোনা যাচ্ছে; তার রাস্তাঘাট, অলিগলি, দোকানপাট, পাড়া-মহল্লা ও মানুষ জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
মীজানুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রকৃতিবিদ ও লেখক দ্বিজেন শর্মা কমলালয়া কলকাতা সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘একজন সংবেদী মানুষের পক্ষে তার কৈশোরের স্মৃতিভুবন হারানোর মতো বড় ক্ষতি আর কিছু নেই। দেশভাগ বাঙালির একটা বড় অংশেরই স্মৃতিভুবন ধ্বংস করে দিয়েছে, বলা বাহুল্য দুই বঙ্গেরই। মীজানের লেখায় ব্যবহৃত শব্দাবলি, অভিব্যক্তির ধরন, এমনকি দৃষ্টিকোণেও কলকাতার নাগরিক প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট, আর এগুলো তো আসলে গভীরতর এক বাস্তবতার সামান্য বহিঃপ্রকাশ মাত্র, যেন হিমশৈলের আগা, নিচের সিংহভাগের হদিস খোদ মানুষটিও জানে না।
মীজানুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রকৃতিবিদ ও লেখক দ্বিজেন শর্মা কমলালয়া কলকাতা সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘একজন সংবেদী মানুষের পক্ষে তার কৈশোরের স্মৃতিভুবন হারানোর মতো বড় ক্ষতি আর কিছু নেই। দেশভাগ বাঙালির একটা বড় অংশেরই স্মৃতিভুবন ধ্বংস করে দিয়েছে, বলা বাহুল্য দুই বঙ্গেরই। মীজানের লেখায় ব্যবহৃত শব্দাবলি, অভিব্যক্তির ধরন, এমনকি দৃষ্টিকোণেও কলকাতার নাগরিক প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট, আর এগুলো তো আসলে গভীরতর এক বাস্তবতার সামান্য বহিঃপ্রকাশ মাত্র, যেন হিমশৈলের আগা, নিচের সিংহভাগের হদিস খোদ মানুষটিও জানে না। সৃষ্টিশীলতার জগৎ একাধারে জটিল ও ততোধিক নাজুক। তাই মীজানুর রহমানের কমলালয়া কলকাতা আসলেই শুধু স্মৃতিচারণ নয়, আপন ভুবনচ্যুতির রোদনও।’
মীজানুর রহমানের আরেকটি অসাধারণ বই কৃষ্ণ ষোলোই। তিনি এ বইয়ের উপ-শিরোনাম দিয়েছেন কলকাতার মহাদাঙ্গার চাক্ষুষ বিবরণ। এটা সেই কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যা ‘ক্যালকাটা কিলিং’ নামে পরিচিত। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মুসলিম লিগের ডাকা ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে দাঙ্গাটি শুরু হয়েছিল। মানিকতলার যে জায়গায় দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটেছিল, ১৫ বছরের কিশোর মীজানুর ঘটনাক্রমে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেই মুহূর্ত থেকে পরবর্তী কয়েক দিন ধরে যে রক্তপাত চলেছিল, তিনি তার চাক্ষুষ বিবরণ লিখে রেখেছিলেন একটি খাতায়; শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘গৃহযুদ্ধে কি দেখিলাম’।
সেই খাতাটি এবং সেই সময়ের বাংলা ও ইংরেজি পত্রপত্রিকা এবং আরও কিছু বইপত্রের সহযোগিতায় তিনি কৃষ্ণ ষোলোই বইটি রচনা করেছেন।
ভারত-বিভাগ নিয়ে অনেক বইপত্র লেখা হয়েছে; ওই বড় ঘটনার অনুষঙ্গ হিসেবে ১৯৪৭ সালের আগস্টের কলকাতার সেই দাঙ্গা সম্পর্কেও লেখালেখি আছে। কিন্তু এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ বই লেখা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সে অর্থেই কৃষ্ণ ষোলোই এক অসাধারণ বই। চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার বিবরণ তাৎক্ষণিকভাব লিখে রাখা এবং পরে তা বই লেখার সময় ব্যবহার করার ফলে এর দালিলিক গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
সাম্প্রদায়িক বিষয়ে লেখার ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা ও পক্ষপাতহীনতার নীতি অনুসরণ করা দুরূহ হয়ে পড়ে, কিন্তু মীজানুর রহমানের এ বইতে সেই নীতিই অনুসৃত হয়েছে। লেখক যে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি থেকে মুক্ত একজন মানুষ, তার স্বাক্ষর এ বইয়ের পাতায় পাতায় রয়েছে।
তাঁর পক্ষপাতহীনতার দৃষ্টান্ত হিসেবে দুটি ঘটনার বিবরণ লক্ষ করা যাক:
“আমার এও মনে পড়ে, বাবার অনেক বন্ধুর এক বন্ধু বিখ্যাত নটবর জহর গাঙ্গুলীর কথা। জহরবাবু ছিলেন মোহনবাগানের পাঁড় সদস্য, বাবা জায়ান্টকিলার এরিয়ান্স ক্লাবের, আর নিজ আপিস ট্রপিক্যাল স্কুল ক্লাবের তো ছিলেন প্রাণপুরুষ। একবার হলো কী, জহরবাবু অভিনীত এক নাটক দেখে নাট্যভারতী থেকে শো ভাঙার পর বাবা অপেক্ষামান লাস্ট শো-এর বাসে বাড়ি ফিরেছিলেন। অসম্ভব ভিড়ের মাঝে হঠাৎ বাবাকে উদ্দেশ্য করে ‘পকেটমার’ বলে মহা হুজ্জোতি কা-! অসহায় বাবা আমার যত কাকুতি-মিনতি করেন কোনো ফলোদয় নেই। উচক্কা হেঁড়ে গলার ‘কে র্যা? কোন্ স্লা?’ রাম হাঁক এবং তারপরেই ‘এ কী, রহমানদা আপনি! বলে জামার আস্তিন গুটিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যান বাবাকে জাপ্টে-ধরা ষণ্ডা গোছের লোকগুলোর দিকে। ওরা ঝটিতি বাস থেকে সটকে পড়ল।
‘অত ঘাবড়ালে চলে? দিয়েছিল তো রদ্দা মেরে। তো দেখুন পকেট ঠিক আছে তো?’ বাবা নিজের পকেটের আন্দাজ নিয়ে মাথা হেলালে বাবাকে পাশে বসিয়ে জহর গাঙ্গুলী মুচকি মুচকি হাসেন।
“আবার এর উল্টো অভিজ্ঞতাও রয়েছে বাবার। ওঁর মুখেই শোনা। অফিস ছুটির পর গড়ের মাঠমুখো ট্রামে যাচ্ছিলেন। ফুটবোর্ডে বিকেলের ভিড়ে বাবা। একটা স্টপেজে ওই ভিড়ের মাঝে এক বৃদ্ধ ট্রামে চাপলেন, পেছনে কন্যা। ততক্ষণে টুনানুং টুনানুং শব্দে মারত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। বৃদ্ধ ভদ্রলোক অসংখ্য ধন্যবাদ জানালেন এবং এক সময় সিট পেলে নিজেরা বসলেন এবং বাবাকেও বসিয়ে তাঁদের বাসায় চায়ের নেমন্তন্ন করলেন। কথায় কথায় বাবার নাম জিজ্ঞেস করায় বাবা তাঁর নাম দু’তিনবার উচ্চারণ করার পরও খদ্দরের ধুতি ও পাঞ্জাবি পরিহিত গৌরকান্তি যুবকের দিকে ফ্যাকাসে মুখে তাকান। নির্বাক বৃদ্ধ। অবিশ্বাস, তিরস্কার ও ঘৃণা চোখে, কপালের কুঞ্চিত বলিরেখায় এবং একসময় গন্তব্যস্থলে পৌছুলে ‘আয় রে মা’ বলে বাবার দিকে আর দৃকপাত না করে বোধকরি গোবর জলের তৃষ্ণায় তড়িঘড়ি নেবে পড়লেন!”
কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় হিন্দু-মুসলমানের খুনোখুনির মধ্যে মীজানুর রহমানদের পরিবারটি বাস করছিল একটি হিন্দু অধ্যুষিত গড়পাড় এলাকায়। সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও ব্যায়ামবিদ বিষ্ণুচরণ ঘোষের বাড়ি ছিল ওই এলাকায়। মীজানুর রহমানদের পরিবারকে হিন্দু দাঙ্গাবাজদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন বিষ্ণুচরণ ঘোষ। লেখক গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর মায়ের বয়ানে সেই বিবরণও লিখেছেন:
“তোরা সকালে গেলি, লাহাদের দোকানের সুমুখে দেহাতি মুসলমান লোকটাকে ছাতাপেটা ইটপেটা করে থেতলে মারলে, তা নিজেদের চোখে দেখেও গেলি। বিবেকানন্দের মোড়ে নিজেও মার খেলি, তবু আমার মানা শুনলিনে। কী, না, বড় মাপের শান্তিমিছিল যখন গেল, ‘হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই’ রব তুলেই গেল, সব ঠিকঠাক, যাওয়া যায় এবার। কিন্তু জানিস খোকা, মিছিল গেল, তোরাও গেলি, হঠাৎ সব কেমন ফাঁকা ঠেকল আমার, সুনসান ভাবটা কেমন যেন গা ছম্ছম্ করা, ভয়ে সেঁধিয়ে গেলুম রে।
‘তারপর ধর, থেকে থেকে বন্দে মাতরম জিকির আছে না! মানুষের মুখ থেকে বেরুনো কোনো শব্দ যে এত ভয়ংকর হতে পারে তা তো জানা ছিল না রে খোকা! তোদের বাবার চিন্তা, ভূত-ভবিষ্যতের চিন্তা সব গুলিয়ে গেল যখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নাবল; ওই তোরা যেখানে ফুটবল খেলিস, সূর্যের শেষ আলোটা যখন ওর সবুজ গা থেকে পালাল, বুঝলি, বুকটা যেন ধক্ করে উঠল! আমি সময়ের বিবেচনা না করেই থেকে মাগরেবে গেলাম। নামাজ শেষে তোদের কল্যাণ চেয়ে হাত ওঠালাম খোদার দরগায়।
‘না, তবুও তোরা ফিরলিনে। এশার নামাজের সুরাগুলো তোর ওই বন্দে মাতরমের হায়দারি হাঁকে কেবলই ভুল হতে লাগল। আমার চোখের পানি হাতের চেটোয়, জায়নামাজে…তোদের ভাইবোনেরা ভরসন্ধেতেই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, নিচের তলার চৌধুরীগিন্নি, ওদের মেয়ে ফুর্তি, নওয়াব মিয়া ভরসা দিয়ে নেমে গেল, আমি ওই মহা বিপদের মাঝে কোরান শরিফের পাতা উলটে চাঙা হওয়ার চেষ্টা করলুম। যিনি বিপদ দেন, তিনি তো বিপদ থেকে উদ্ধারও করেন।
‘কিন্তু, ও কী! আমাদের বাড়ির নিচে এত শোরগোল কেন! ‘স্লা, নেড়ে কুত্তারা নেবে আয়, ভেবেচিস তোদের সুয়ারহাড্ডি এসে রক্ষে করবে, সে আশায় গুঁড়ে বালি। বানচোতদের একটাকেও আস্তা রাখা হবে না। বল রে ভাই, বন্দে মাতরম! এইসব জান-সেঁধনো কথাবার্তা শুনে আমি তোদের ভাইবোনদের আঁকড়ে ধরে কাঁপতে থাকি। কিন্তু হঠাৎ করে বাজখাই গলার হাঁকডাকে হই-হল্লা সব খতম! কান পাতলুম, রাস্তার ধারের জানালার পাট সামান্য খুলে নিচে তাকালুম। ও মা! গলির আলোয় বন্দুক হাতে তোদের বিষ্টু কাকাকে দেখতে ভুল হলো না। ওইটুকু এক রত্তি লোক, কিন্তু জানিস খোকন, সে কী তেজ! দাঁড়ানোর সে কী ভঙ্গি, হাত নাড়ানোয় যেন রাজার হুকুম! কী বলছিল জানিস? বলছিল : এ বাড়রি ভেতর ঢুকেচ কী মরেচ। আর ধরো যদি ঢুকলেই, এই আমার লাশের ওপর দিয়েই তা ঘটবে। এখন কেটে পড় তো বাছাধনেরা।’
‘তা কেটে পড়ল, কোথা দিয়ে যে কী হয়ে গেল, আমাদের লাশ বানাবার ফিকিরে আসা গুণ্ডাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো চলে গেল! দু-একজন তর্ক জুড়তে বসেছিল ঠিক, কিন্তু বিষ্টুবাবুর ওই ভস্ম করে দেয়া তেজ সব যেন ভেস্তে দিলে। তেতলায় উঠে আমাকে বললেন, ‘বৌদি, দেখলেন তা সব। বিপদ এখন ঘাড়ে। তবে আমি যদ্দিন বেঁচে আছি কুছ পরোয়া নেই। তবু সাবধানের মার নেই তো, আমি দোতলায় চৌধুরী সাহেবকে আমার বন্দুকটা দিয়ে গেলাম। আর শুনুন, জামাকাপড় বাইরে শুকোতে দেবেন না। আর কোরান একান্তই যদি পড়েন, মনে মনে, কিছুতেই শব্দ করে নয়। জানালাপাট সব বন্ধ! এ বাড়িতে মুসলমান কেন, কেউই নেই, এই ভাবটা যেন থাকে। ওরা আবার আসতে পারে, খুব সাবধান।
‘সত্যি সত্যি, ওই গুণ্ডাগুলো আরও দু’বার এসেছিল। তোদের বিষ্টু কাকা প্রতিবার একা ঠেকিয়েছে। আর কারু সম্পর্কে বলতে পারব না, তবে বিষ্টুবাবু যে বেহেশতে যাবেন, এ আমি হলপ করে বলতে পারি রে খোকন।
‘তবে কী জানিস বাবা, একটা খটকা থেকে গেল। ওই যে, ওরা, খুনেরা যে মা কালীর দিব্বি দিয়ে ভয় দেখিয়ে গেল তোদের বিষ্টু কাকাকে, তোর জান নিয়ে ছাড়ব। নেড়েদের জান বাঁচালি, তোদের জান কে বাঁচায় দেখে লিব। তোর না পারি, তোর ছেলে লিব। এ তো বড় ভালো ঠেকছে না রে!’
মায়ের বয়ান শেষ হওয়ার পর লেখক লিখেছেন, ‘মার সংশয় যে একদিন নিদারুণ সত্যি হয়ে দেখা দেবে কে ভাবতে পেরেছিল। মায়ের কাছেই শুনেছি। বিষ্টু বাবুদের ছিল এক সিনেমা হল। বিষ্টুবাবুর ছেলেকে একদিন ওই খুনে গুণ্ডাগুলো, সিনেমা হলে তাঁর ঘরের দরজা বাইরে থেকে শেকল আটকে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দগ্ধে মেরেছিল।
‘বলতে হয়, এই আহুতি কেবল আমাদের পরিবারের উদ্দেশ্যে নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের সুস্থ মানবতার পক্ষে আত্মবিসর্জন।’
রচনাসমগ্রের তৃতীয় বই ঢাকা পুরাণ বাংলাদেশে বেশ আলোচিত। এ বইতে ঢাকা মহানগরের অতীত কালের খুঁটিনাটি অনেকটা কলকাতা কমলালয়ার গদ্যশৈলীতেই বর্ণিত হয়েছে। কলকাতার জন্য লেখকের যেমন মমতা ছিল, তেমনই ঢাকার জন্যও ছিল গভীর ভালোবাসা। ১৬ বছর বয়স থেকে ৭৫ বছর বয়সের পুরো জীবনটাই তিনি অতিবাহিত করেছেন এই মহানগরে।
তখন ঢাকা বলতে ছিল আজকের পুরাণ ঢাকা। সেই পুরাণ ঢাকার অলিগলি তস্য গলি চষে বেড়িয়েছেন তিনি; পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে নিবিড়ভাবে চিনেছেন, জেনেছেন এবং ভালোবেসেছেন এই মহানগরকে। জীবনযাপনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য প্রক্রিয়ায়, সচেতন ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষণ ও অবচেতন অনুভব-উপলব্ধির পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক বইপত্র পড়ার মধ্য দিয়ে তিনি ঢাকা মহানগরীর অতীত-বর্তমান সম্পর্কে যা জেনেছেন, তা আর দশজন বাঙালির সাধারণ জানা নয়।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তারিখেই শেয়ালদা স্টেশন থেকে ‘ঢাকা মেইল’ ট্রেনে কলকাতা ত্যাগ করে মীজানুর রহমানের পরিবার। সে সময় তিনি কলকাতার মিত্র স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। বিশেষ ব্যবস্থায় মিত্র স্কুল থেকে পরীক্ষার খাতা ও প্রশ্নপত্র ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে এনে প্রধান শিক্ষকের অধীনে পরীক্ষা দিয়ে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। পরের বছর প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জগন্নাথ কলেজে কলা বিভাগে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। তাঁর ছবি আঁকায় হাত ছিল, কলকাতায় তিনি হাতে লেখা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, সেটার জন্য সব ছবি তিনি নিজেই আঁকতেন। তা ছাড়া তিনি কার্টুনও আঁকতেন, তাঁর আকা কার্টুন ছাপা হয়েছিল কলকাতার ইত্তেহাদ, আজাদ ও মর্নিং নিউজ পত্রিকায়। চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান মীজানুর রহমানের ছবি আঁকার আগ্রহের কথা জানতেন।
এখানে প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, কামরুল হাসানও ১৯৪০ দশকে কলকাতায় ছিলেন এবং সেখানেই মীজানুর রহমান তাঁকে পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন মীজানুর রহমারে কিশোরবেলার নায়ক। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত শিশু-কিশোর সংগঠন মুকুল ফৌজের সক্রিয় কর্মী ছিলেন কিশোর মীজান। দেশভাগের পর কামরুল হাসান ঢাকায় ফিরে ঢাকা আর্ট স্কুলের (এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট) শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর পরামর্শে মীজানুর রহমান জগন্নাথ কলেজ ছেড়ে ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। তিনি হলেন ওই কলেজের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র; তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তী সময়ে খ্যাতিমান হয়েছিলেন; যেমন, কাইয়ুম চৌধুরী, রশীদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, আলতাফ মাহমুদ, খালেদ চৌধুরী প্রমুখ। তাঁর শিক্ষকদের কামরুল হাসান ছাড়াও ছিলেন জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দিন আহমদ, খাজা শফিক, আনোয়ারুল হক প্রমুখ।
কিন্তু অচিরেই ধরা আবিষ্কৃত হলো যে মীজানুর রহমান বর্ণান্ধ। ফলে চারুকলায় প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা লাভের আশা ছেড়ে তাঁকে আবার ফিরে যেতে হয় জগন্নাথ কলেজে। সেখানেই তিনি কলা বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্বের পড়াশোনা শেষ করেন, স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে আসেন ১৯৫৯ সালে।
এই সময়ের মধ্যে কলকাতার ‘খোকন’ পরিণত হয়েছেন ঢাকার যুবক মীজানুর রহমান; ঢাকা হয়ে উঠেছে তাঁর আপন শহর। তখন ঢাকা বলতে ছিল আজকের পুরাণ ঢাকা। সেই পুরাণ ঢাকার অলিগলি তস্য গলি চষে বেড়িয়েছেন তিনি; পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে নিবিড়ভাবে চিনেছেন, জেনেছেন এবং ভালোবেসেছেন এই মহানগরকে। জীবনযাপনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য প্রক্রিয়ায়, সচেতন ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষণ ও অবচেতন অনুভব-উপলব্ধির পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক বইপত্র পড়ার মধ্য দিয়ে তিনি ঢাকা মহানগরীর অতীত-বর্তমান সম্পর্কে যা জেনেছেন, তা আর দশজন বাঙালির সাধারণ জানা নয়। উপরন্তু সেই জানার ভাষিক উপস্থাপনা অসাধারণ। ঢাকা নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ বইই পাঠের আনন্দ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। মীজানুর রহমানের ঢাকা পুরাণ এই ক্ষেত্রে অদ্বিতীয়: গল্প-উপন্যাসের বাইরে এমন সুখপাঠ্য বই উভয় বাংলায় অত্যন্ত বিরল। কাইয়ুম চৌধুরী লিখেছেন, ‘মীজানুর রহমান আমার অতীতকেও উসকে দিয়েছেন। স্বাদু বাংলায় তাঁর বর্ণনার জাদুকারী প্রভাব এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে উৎসাহ জোগাবে।’
ঢাকা পুরাণ বইটার শুরু কথাই ধরা যাক: “আমাদের বানভাসি ডেরা তখন নারিন্দা এলাকায় ১১৩ নম্বর শরৎগুপ্ত রোড, যার পুরোনো নাম ও নম্বর ১৪৫ দয়াগঞ্জ রোড। নারিন্দা শব্দটি নারায়ণদিয়া শব্দের অপভ্রংশ।
১৯৫০ সালের কথা। তখনো ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ি ও রিকশারই দাপট। আর লোকসংখ্যা রাজধানীর গুণে বেড়ে লাখ পাঁচ-ছয় হবে। কাজেই নারিন্দার মতো ঘিঞ্জি এলাকাতেও তেমন লোকজনের ভিড় ছিল না। সারা দিন রিকশার টুং টাং এবং মেয়েদের স্কুলের সময় ঘোড়ার গাড়ির ছড়ছড়-টগবগ শব্দ ছাড়া একরকম সুনসানই ছিল পরিবেশ। সন্ধে রাত পার হতে না-হতেই গ্রামের মতোই ঝিমিয়ে পড়ত পাড়াটা। আমাদের বাড়ির পুব পাশ ঘেঁষে বয়ে যেত ধোলাই খাল। শুকনো মৌসুমে পানি নেমে যেত একেবারে নিচেয়। তখন ঢাকার যত আবর্জনা মুখ ব্যাদান করে অট্টহাসি করে উঠত আর চেহারাটাও দাঁড়াত কদর্য। কিন্তু বর্ষাকালে জলটলমল ধোলাই খালের আদলই যেত পাল্টে। দূরদূরান্ত থেকে এক মাল্লাই- দোমাল্লাই নৌকো এসে ভিড়ত নারিন্দার পুলের আশপাশে। এসব নৌকোয় বেনেরা নিয়ে আসত মাটির হাঁড়ি, কলসি ও অন্যান্য তৈজসপত্র থেকে শুরু করে ফুটি তথা বাঙ্গি। কাঁঠাল ও লাকড়িবোঝাই নৌকোও ভিড়ত। এ রকম আরও ঘাটে ঘাটে, ধোলাই খাল যত দূর বয়ে গেছে। মালবোঝাই নৌকো এসে ঢাকার দৈনন্দিন চাহিদার অনেকটাই মেটাত। পাইকারি ক্রেতাদের দরাদরি হাঁকাহাঁকি খুব চলত। এর মধ্যে কিছু খুচরো কারবারও ফাঁকফেঅকরে ঘটত। রাতের বেলা নৌকোর ছইয়ের ভেতর থেকে হারিকেনের আলোয় কর্মক্লান্ত মাঝি ও বেনেরা যখন খেতে বসত, তখন তাদের টুকরো কথা এবং খাওয়া শেষে অবসরের গান ভেসে আসত আমাদের বাড়ির দোলাইর পাড়ঘেঁষা কলাবাগানের ভেতর দিয়ে। আর মনে হতো খালের নিস্তরঙ্গ পানির ওপর হারিকেনের মৃদু আলোটা যেন লম্বা হয়ে ঘুমুচ্ছে।
“কিন্তু গোবেচারা এই ধোলাই খাল কখনো কখনো ফুুঁসে উঠত দুকূল ছাপিয়ে। একবার, ১৯৫৪ কি ‘৫৫ হবে, ভারি বন্যা হলো। প্রথমে তো চাঁদাড়ে পানি এল, কলাবাগান থই থই! তারপর ক্রমে বাড়ির আঙিনায়। আঙিনা ছেড়ে রাস্তায় উঠে এল পানি। মা একদিন খুব সকালে আমাদের বাংলোবাড়ির চার ফুট উঁচু বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে উঠেন : ‘হায় আল্লাহ, অ্যাত্তো পানি! চাদ্দিকে পানি!’
‘তাইতে আমরা, বাড়ির ছোটরা ঘুম থেকে মুছতে মুছতে উঠে বাড়িটাকে পানির ওপর বাসতে দেখ প্রথমে তো চোখ ছানাবড়া! তারপরই নৃত্য আর কত না কলরব!’”
কোথাও পড়েছিলাম, ভালো বইয়ের ভূমিকা লেখার চেষ্টা বৃথা। কারণ ভূমিকা যত বিশদই হোক না কেন, তা কখনো মূল বইটি পাঠের আনন্দ পাইয়ে দিতে পারে না। তাই পাঠককে প্রলুব্ধ করতে ভূমিকা লেখককে বইটি থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করতে হয়। কিন্তু তাতেও বিশেষ কোনো কাজ হয় না। শেষমেশ ভূমিকা লেখককে বলতেই হয়: প্রিয় পাঠক, এই বইটির পরিপূর্ণ রসাস্বাদনের জন্য আপনাকে খোদ বইটিই পড়তে হবে, এই ভূমিকা তার বিকল্প নয়।
মীজানুর রহমানের রচনা সমগ্রের তিনটি বই-ই আত্মজৈনিক, কিন্তু কোনোটাই শুধু নিজেকে নিয়ে নয়। আবার কলকাতা ও ঢাকার গল্পও শুধু দুই মহানগরের গল্পই নয়, পুরো জাতির গল্প।
আজ ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁর ৮৮তম জন্মদিন। তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।