:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

কবি, চিত্রশিল্পী

মুর্তজা বশীর: আলট্রামেরিন আকাশের সুতীব্র এক চিল
কোলাজ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

মুর্তজা বশীর: আলট্রামেরিন আকাশের সুতীব্র এক চিল

মুর্তজা বশীর ছিলেন দেশের বলতে গেলে শেষ তীব্র, সাহসী ও অ্যাক্টিভিস্ট পেইন্টার, আর্টিস্ট। তার পরে চিত্রশিল্পীদের মধ্যে নিজের শিরদাঁড়ায় অবিচল দাঁড়িয়ে থাকা আর তেমন কাউকে দেখছি না এই মুহূর্তে। তাকে আমার মনে হতো আলট্রামেরিন আকাশে এক সুতীব্র শাদা চিল উড়ে বেড়াচ্ছে তীব্র নীলের সঙ্গে শাদা মেঘের মতো এক দুরন্ত বৈপরীত্য তৈরি করে। কখনো মনে হতো তীব্র জলস্রোতের বিপরীতে সাঁতরে চলা এক উদ্দাম হাঙর।

ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু কৈশোরেই, মানে হাই ইশকুলে থাকতেই। আর পার্টি অফিসে ঝুলানোর জন্যে কার্ল মার্ক্স, লেলিন, এঙ্গেল্স ইত্যাদির প্রতিকৃতি আঁকার মাধ্যমে তার আঁকাআঁকি শুরু। মানুষের অধিকার আদায়ে তার আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস দীর্ঘ। শুধু একটুখানি বলি, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম-সহ দেশের বড় বড় সব আন্দোলনের সঙ্গে তিনি ছিলেন। তিনি প্রথম জেল খেটেছেন তার মাত্র ১৮ বছর বয়সে, ৬ মাসের জেল হয়েছিলো। স্যার বলেছিলেন গ্রেফতার হওয়ার ঘটনাটা। এটা তার আর্ট কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে ঘটনা। তখন ময়মনসিংহে এবং পশ্চিমবঙ্গের কাকদ্বীপে তীব্র আন্দোলন চলছে। নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি। স্যারের জবানিতে অনেকটা এই রকম ছিলো, ‘সেই আন্দোলনের জন্যে পোস্টারগুলো আমি এঁকেছিলাম। পোস্টারে ছিল ময়মনসিংহের ম্যাপ আর হাতুড়ি-কাস্তে। পোস্টার সব লাগিয়ে সর্বশেষটা যখন লাগাতে যাই, ওটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। আমি একটু বোকা ছিলাম কারণ যে পোস্টার কিছুক্ষণ পরেই পুলিশ ছিঁড়ে ফেলবে আমি ওটাকে জোড়া লাগাতে গেলাম। তো ওটা জোড়া লাগাতে গিয়ে ধরা পড়লাম। পুলিশ মারল। জেলে গেলাম। তখন তো রাজনৈতিক বন্দী বলে কাউকে স্বীকার করা হয় না। কিছু সিকিউরিটি প্রিজনার আছে। আমি ছিলাম তৃতীয় শ্রেণির, খেতে পেতাম তৃতীয় শ্রেণির খাবার। আমার সঙ্গে তখন আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেণির প্রিজনার। তিনি পাউরুটি এবং চা পেতেন। সেখান থেকে তিনি আমাকে এক টুকরো পাউরুটি আর চায়ের ভাগ দিতেন। আমরা ছিলাম ১৪ নম্বর সেলে। সেলের নামটা খুব সুন্দর ছিলো—শকুন্তলা ফটক’।

‘আর্টিস্টের কাজ হলো শোষিত জনগণের ভাব ও দুর্দশাকে এমনভাবে চিত্রের মাঝে ফুটিয়ে তোলা, যা সমাজে নবদিগন্ত সৃষ্টি করতে পারে।’ এইসব কথা কৈশোরে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা, কমিউনিস্ট বিপ্লবী ভবানী সেন তার খাতায় লিখে দিয়েছিলেন, অটোগ্রাফের সঙ্গে। এই কথাকেই তিনি শেষ পর্যন্ত নির্দেশনা মনে করতেন বলে আমাকে বলেছিলেন। তিনি বলতে গেলে পার্টির নির্দেশেই আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তার মানে এই নয় যে তার পিতা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত মেনে নিতে পারেননি। অনেকে তাইই মনে করতেন। এবং অনেকর অনেক লেখাপত্রে বিষয়টা উল্লেখ আছে। বশীর স্যার আমাকে বলেছিলেন আসল সত্যটা যে তার বাবা বিষয়টা মেনে নিতে পারেননি ঠিক, কারণ তিনি চাইতেন ছেলে আলীগড়ে পড়ুক। কিন্তু পরে মেনে নিয়েছিলেন। আর্টের বইপত্রও কিনে দিয়েছিলেন। এমননি করাচিতে তার প্রদর্শনীও দেখতে গিয়েছিলেন।

স্যার আমাকে বলেছেন তিনি অভিজ্ঞতার জন্যে অনেককিছুই করেছেন। কারণ শিল্পীর জীবনে অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই। তিনি সচ্ছল পিতার সন্তান হয়েও বাবার কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিতেন না। অভিজ্ঞতা ও পেট চালানোর জন্য এমনি কি একবার তিনি ভিক্ষাও করেছিলেন, খুব সম্ভবত করাচিতে গিয়ে এই কাজ করার কথা বলেছিলেন। কী করেন নাই তিনি? ছবি এঁকেছেন, ভাস্কর্য করেছেন, কবিতা লিখেছেন, গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, লিখেছেন সিনেমার চিত্রনাট্য।

বশীর স্যারের মনিপুরি পাড়ার বাসায় আমাকে প্রথম নিয়ে গিয়েছিলেন হাসনাতভাই মানে চাকরিসূত্রে আমার বস কালি ও কলমের সম্পাদক আবুল হাসনাত, কবি মাহমুদ আল জামান। বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে বশীর স্যারের আত্মজীবনী আমরা বের করেছিলাম। তারপর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-এর চিঠিপত্র, বশীর স্যারের আত্মজৈবনিক দুটো বক্তৃতা থেকে একটা বই, তার শান্তি-নিকেতনের দিনলিপির দুটো খাতা থেকেও একটা বই করার প্রক্রিয়া চলছিলো। সেই সূত্রে দায়িত্বটা পড়েছিলো আমার উপর। খুব অল্পদিনই দেখা হয়েছে আমাদের। কিন্তু কেন জানি না আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। হয়ত তার কথা আমি বুঝতে পারতাম আর মনোযোগ দিয়ে শুনতাম, এটাও একটা কারণ হতে পারে। তার প্রতি আমার এক ধরনের ভালোবাসা আর মায়া তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। এত বড় একজন মানুষ আমার মতো তুচ্ছ একজন নির্ঝরের সঙ্গে কথা বলছেন, এটা ছিলো আমার কাছে বিস্ময়েরর।

স্যার আমাকে বলেছেন তিনি অভিজ্ঞতার জন্যে অনেককিছুই করেছেন। কারণ শিল্পীর জীবনে অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই। তিনি সচ্ছল পিতার সন্তান হয়েও বাবার কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিতেন না। অভিজ্ঞতা ও পেট চালানোর জন্য এমনি কি একবার তিনি ভিক্ষাও করেছিলেন, খুব সম্ভবত করাচিতে গিয়ে এই কাজ করার কথা বলেছিলেন। কী করেন নাই তিনি? ছবি এঁকেছেন, ভাস্কর্য করেছেন, কবিতা লিখেছেন, গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, লিখেছেন সিনেমার চিত্রনাট্য।

তিনি আমাকে আগের দিন সকালে ফোন দিয়ে বলতেন, ‘নির্ঝর, তুমি আগামী কাল সকালে ঠিক সাড়ে ১০ টায় চলে আসো।’
ছোটবেলা থেকে আমার স্বভাব হচ্ছে যে-সময়ের কাজ সেই সময়ে করা। ফলে আমি ঠিক সকাল সাড়ে ১০ টায় তার দরজায় গিয়ে বেল বাজাতাম। একজন কাজের মহিলা দরজা খুলে দিতেন। স্যার একা থাকতেন। স্যারের সঙ্গে সাধারণত কথা হতো তার ডাইনিং টেবিলে বসে। স্যারের সঙ্গে কোনো কোনো দিন বিকেল পর্যন্তও কথা হয়েছে। কথা হয়েছে মানে আমি হুঁ হাঁ করেছি, তিনিই কথা বলেছেন। মাঝে মধ্যে টুকটাক কৌতূহল বশে প্রশ্ন করেছি। কয়েক ঘন্টা পর পর তাকে অক্সিজেন নিতে হতো, তখন তার খাটের সামনে চেয়ারে আমি বসতাম। আর তিনি শুয়ে শুয়ে অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে অল্প কথা বলতেন। তারপর আবার ডাইনিং টেবিলে বসতাম। তিনি একই গল্পই আমাকে প্রায়দিন বলতেন। তার জীবনের কথা, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-এর কথা। তার এবং মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-এর অতি ব্যক্তিগত কথাও আমাকে বলতেন কখনো। কেন বলতেন তা জানি না। অন্য কাউকে বলতেন কিনা তাও জানি না। রিপিটেশন আমি তাকে ধরিয়ে দিতাম না। আমার তার কথা শুনতে ভালো লাগতো। তিনি ছিলেন অতি সহজ আর স্পষ্টবাদী মানুষ।

আমার মাস্টার্সের থিসিস ছিলো বশীর স্যারের পেইন্টিং-এর উপর। সেই কথা আমি তাকে কখনোই বলিনি। আমি যে খানিকটা লেখালেখির চেষ্টা করি তাও তাকে বলিনি। তাকে আমি চিনি ছোটবেলা থেকে। যখন থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ কে চিনি তখন থেকে। অবশ্য আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার কয়েকবছর আগে তিনি অবসরে চলে যান, তাই তাকে ডিপার্টমেন্টে পাইনি। একবার তাকে ডিপার্টমেন্টে কী একটা কাজে গিয়েছিলেন সম্ভবত ২০০০ বা ২০০১ সালের দিকে, আমার মনে আছে আমি দেখেছিলাম। তবে তার ভাষ্যমতে তিনি রিটায়ার করেছেন ১৯৯৬ সালে। এরপর তিনি আর কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি। তার কথার স্বরে অভিমান ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি। তার এই কথা শুনে আমি আর কিছু বলিনি। আমার মনে হয়েছিলো, তার ভুলে যাওয়ার হয়ত কোনো ব্যাপার থাকতে পারে। বয়স হলে মানুষের স্মৃতিতে এমন হয়।

আমি কখনো বশীর স্যারের সাক্ষাৎকার নেয়ার কথা ভাবিনি কিংবা তার পাশে দাঁড়িয়ে ছবিও তুলিনি। তিনি একদিন অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, ‘সবাই আমার সঙ্গে ছবি তুলতে চায়, তুমি কখনো চাও নাই কেন?’
আমি বললাম, ‘স্যার সকলের সব ধরনের সাহস আর যোগ্যতা থাকে না। আমারও নাই। আমার হীনমন্যতা তৈরি হয় বিখ্যাত কারো পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে। নিজেকে তার ভৃত্য বলে মনে হয়।’
আমার কথা শুনে তিনি হেসেছিলেন। আর কিছু বলেননি। আমি দেখতাম তিনি ফোনে লোকজনের সঙ্গে রেগে যাচ্ছেন। কিন্তু আমার সঙ্গে একদিনও রেগে কথা বলেননি। একবার দেশের জনৈক প্রখ্যাত অনুবাদক ও কবির উপর ভয়ানক রেগে গেলেন, এবং বাপান্ত করলেন ফোনেই, আর বললেন ‘খবরদার আমাকে আর কখনোই বশীরভাই বলে ডাকবা না, তুমি আমার বাপের অমূল্য বই ছিঁড়ে ফেলেছো, মনে হচ্ছে আমার গায়ের চামড়া ছিঁড়ে ফেলেছো…’ ইত্যাদি। শহীদুল্লাহ্ তার কাছে এতটাই প্রিয় ছিলো। ঘটনা হলো শহীদুল্লাহ্-এর একটা দুর্লভ বেশ বড় মোটা প্রায় হাজারখানেক পৃষ্ঠার সম্বর্ধনা-গ্রন্থ ফটোকপি করতে নিয়ে গিয়ে বাঁধাই খুলে ফেলেছিলেন তিনি, আর সেটা বাঁধাই না করেই ফেরত দিয়েছিলেন। পরে সেই বইটা আমি বাসায় এনে নিজ হাতে পাতা ধরে ধরে নিখুঁত একটা বাইন্ডিং করে দিয়েছিলাম। আমাকে পছন্দ করার এইটা অবশ্য একটা কারণ হতে পারে।

স্যার আমাকে কয়েকবার অকারণেই ফোন দিয়েছিলেন দেখে অবাক হয়েছিলাম। বলেছিলেন চাপ পড়ে কল চলে গেছে। তিনি মৃত স্ত্রীর অনেক ছবি এঁকেছিলেন, তার সেইসব আঁকা প্রতিকৃতি নিয়ে একটা প্রদর্শনী করেছিলেন সম্ভবত গ্যালারি কায়ায় গত বছর। সেই প্রদর্শনীর নিমন্ত্রণপত্র আমাকে নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু নানা কারণে আমার আর যাওয়া হয়নি সেই প্রদর্শনীতে।

বশীর স্যারের সঙ্গে আমার বেশ কয়েকটা মিল আছে। প্রথম মিল হচ্ছে তিনিও আনন্দের সন্ধান করতেন, আমিও আনন্দেরই সন্ধান করি। স্যারের জন্ম আর আমার জন্ম একই মাসে। তিনি বিখ্যাত পিতার নামে পরিচিত হবেন না বলে নিজের নাম পাল্টে, এবং নামের শেষে উল্লাহ্ বিসর্জন দিয়ে আবুল খায়ের বশীরুল্লাহ্ থেকে হয়েছিলেন মুর্তজা বশীর। আমিও নিজের জন্যে একটা পেন-নেম ঠিক করেছিলাম। তিনিও সরাসরি ক্লাস থ্রিতেই ইশকুলে ভর্তি হয়েছিলেন, আমিও ক্লাস থ্রিতেই ভর্তি হয়েছিলাম। এর আগে অন্য দুইটা ইশকুলে ১/২ মাস টু পড়েছিলাম অবশ্য। আরো বেশকিছু বিষয়গত মিল আছে যা বলা বাহুল্য।

স্যারের সঙ্গে প্রথম আলাপে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘জানো, আমাকে কয়েক ঘণ্টা পর পর অক্সিজেন নিতে হয় ঠিক। কিন্তু ডাক্তার আমাকে বলেছে, আমার ফুসফুস ৩০ বছরের যুবকের মতো পরিস্কার।’
তার মধ্যে কখনো কোনো মৃত্যুচিন্তা দেখিনি। মরে যাবেন, এই কথা তিনি কখনো বলতেন বলে মনে হয় না; অন্তত আমার কাছে বলেননি একদিনও। তাকে দেখেছি প্রাণশক্তি আর উদ্যমে ভরপুর ছিলেন যেন। পিকাসো ৯১ বছর বেঁচেছিলেন। বশীর স্যার চেয়েছিলেন তার চেয়ে এক বছর বেশি বাঁচতে। আর কয়েকটা বছর বেঁচে থাকলেই স্যারের হয়ে যেত ৯২ বছর।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.