মৌলিক
বরিশালের এই লঞ্চ জার্নিটা চমৎকার। বিকেলে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে রওয়ানা দেওয়া। তারপর সারারাত নদীর বুকে। আকাশে জোছনা থাকলে তো কথাই নেই। অনেক রাত পর্যন্ত নদীর পানিতে জোছনার লুটোপুটি দেখে কেবিনে টানা ঘুম। ভোরে গন্তব্যে। এবারের ছুটিটা বরিশালে আরিফের ওখানে কাটাবো ঠিক করেছি। কাল ওকে গিয়ে একটা সারপ্রাইজ দেব। আমার কেবিনের রেলিং ঘেরা জায়গাটাতে চেয়ারে আরাম করে বসছি। লঞ্চ ছাড়তে আরও দেরি। কেবিন অঞ্চলটা নিরিবিলি হয়েও ডেকের দিকে যাত্রীদের প্রচন্ড ভিড়। তাদের অবিরাম হৈ-হুল্লোড় শোনা যাচ্ছে। জার্নির চমৎকার মুডটা ঠিক আসছে না। সামনে তাকিয়ে ঘাটের ঐ অজস্র মানুষের কালো কালো মাথা আর কুলিদের বস্তা টানার দৃশ্য দেখতেও ভালো লাগছে না। মনটা একটু অন্যদিকে শিফট করা দরকার। আজকের পেপারটার ওপর এলোমেলো চোখ বোলাতে লাগলাম। এক জায়গায় দেখলাম কোনো এক সংগঠন জরিপ চালিয়ে দেখেছে, পৃথিবীতে সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় প্রথম রয়েছে বাইবেল, দ্বিতীয় লেলিনের রচনাবলি, তৃতীয় আগাথা ক্রিস্টির গোয়েন্দা কাহিনী। মানুষ একটা অদ্ভুত প্রাণী। তার পছন্দের কোনো মাথামুণ্ডু নেই।
এ সময় ভোঁ শব্দে লঞ্চ ছাড়লো। এই ভোঁ শব্দটার মধ্যে বেশ একটা বিষণ্ণতা আছে। দারুণ সুন্দর বাতাস শুরু হলো। এতক্ষণ গরমে বেশ ঘেমে উঠেছিলাম। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে কিছুক্ষণ শরীরে ঠান্ডা বাতাস লাগালাম। একসময় ভাবলাম একতলা আর দোতলার ডেকগুলো একটু ঘুরে আসি। কিন্তু ওখানে কি দেখার আছে? কে জানে সম্ভবত মানুষ দেখার মধ্যেই একটা মজা আছে। ডেক-এ হাটবার জায়গা নেই। পোটলাপুঁটলি নিয়ে যে যার জায়গা দখল করে নিয়েছে একদল গোল হয়ে বসে গেছে তাস নিয়ে, লম্বা হয়ে শুয়ে এখনই ঘুম দেবার চেষ্টা করছে কেউ, বিস্তর কথা বলে চলেছে কেউ কেউ, রেলিং-এ হেলান দিয়ে ফুরফুরে বাতাসে একজন একটা বই পড়ছে, নামটা দেখা যাচ্ছে ‘হাজার নায়িকার ভিড়ে’। বাকিরা ভাবলেশহীন ঝিমাচ্ছে। এক কোণায় শাড়ি দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে, সেখানে মহিলারা। চারদিকের এই ভিড়ের মধ্যে বেশ একটা দ্বীপের মতো অন্দরমহল তৈরি হয়েছে। মনে পড়ল লঞ্চের ডেকের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে। কিন্তু ডেকের ঐ ভিড় বেশিক্ষণ পছন্দ হলো না। ফিরে এসে আবার বসলাম কেবিনের সামনের চেয়ারটাতে। একটা ছোকরা এসে বলল, ‘ম্যাগাজিন লাগবো স্যার?’ অধিকাংশ পত্রিকার প্রচ্ছদেই দেখলাম যৌন উত্তেজক ছবি। এর মধ্যেই ভদ্রগোছের একটা পত্রিকা পাওয়া গেল। নতুন একটা সাপ্তাহিক। এতে কবিতা, ভ্রমণ, ফ্যাশান, নায়িকার সুখ-দুঃখ সবই আছে। জার্নির মধ্যে এ পত্রিকাটা চলতে পারে। কিনে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলাম। লঞ্চ তীরের খুব কাছ দিয়ে যাচ্ছে। সামনে বিস্তীর্ণ ধানখেত। বাঃ, চমৎকার ধান হয়েছে তো এবার। আশ্চর্য সবুজ। নাকি প্রতি বছরই এমন ধান হয়। আচ্ছা, ধান গাছ, কতটুকু লম্বা হয়? দুই ফুট না তিন ফুট? জানি না তো। ধানখেতের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য এর উচ্চতা জানার কোন দরকার আছে কি? রবীন্দ্রনাথ যে লিখেছেন ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা’, তিনি কি জানতেন ধান গাছের হাইট? হয়তো জানতেন। কৃষির ওপর তার তো আবার বিশেষ আগ্রহ ছিল। ছেলেকে পড়ালেন এগ্রিকালচার। বিস্তৃত ধানখেতের ওপারে আকাশ। আকাশের ওপারেও আকাশ। বাতাসের ওপারে বাতাস। বিকেলের সূর্যটা ডিমের কুসুমের মতো আকাশে ফুটে আছে। মাটিতে সবুজ, আকাশে লাল। দারুণ লাগছে দেখতে। একটু পরেই সূর্যটা ডুবে যাবে। আফ্রিকার জুলু উপজাতির মধ্যে সূর্য নিয়ে মজার একটা মিথ আছে। তারা বিশ্বাস করতো প্রতিদিন সকালে একটা অদৃশ্য রাজহাঁস আকাশে একটা করে ডিম পাড়ে, সেই ডিম সারাদিন আকাশের মাঠে এপার থেকে ওপারে গড়িয়ে যায় আর রাত হলেই দেবতা ডিমটাকে ভেঙ্গে ফেলেন, তখন ডিমের কুসুমটা হয় চাঁদ আর ভেঙ্গে যাওয়া খোসাগুলো হয় তারা।
আমার পাশের কেবিন থেকে এ সময় একজন মহিলা বেরুলেন। তার পেছনে পেছনে একটা মেয়ে। আমার চিন্তা ভাবনা মুহূর্তে থেমে গেল। স্প্রিং দেওয়া খেলনা পুতুলের মতো ঘাড়টা আমার বার বার ঘুরে যেতে লাগল মেয়েটার দিকে। মেয়েটা চমৎকার। অর্থাৎ সুন্দর একটা মুখের নিচে টইটম্বুর একটা দেহ। মেয়েটার দিকে এভাবে শুধু তাকানো ঠিক ভালো দেখাচ্ছে না। আমি একটা রোটেশন তৈরি করলাম। প্রথমে ধানখেতে, তারপর আকাশ, তারপর নদী, শেষে মেয়ে। আবার নদী, ধানখেত, আকাশ, মেয়ে এভাবে দেখতে লাগলাম।
আমার পাশের কেবিন থেকে এ সময় একজন মহিলা বেরুলেন। তার পেছনে পেছনে একটা মেয়ে। আমার চিন্তা ভাবনা মুহূর্তে থেমে গেল। স্প্রিং দেওয়া খেলনা পুতুলের মতো ঘাড়টা আমার বার বার ঘুরে যেতে লাগল মেয়েটার দিকে। মেয়েটা চমৎকার। অর্থাৎ সুন্দর একটা মুখের নিচে টইটম্বুর একটা দেহ। মেয়েটার দিকে এভাবে শুধু তাকানো ঠিক ভালো দেখাচ্ছে না। আমি একটা রোটেশন তৈরি করলাম। প্রথমে ধানখেতে, তারপর আকাশ, তারপর নদী, শেষে মেয়ে। আবার নদী, ধানখেত, আকাশ, মেয়ে এভাবে দেখতে লাগলাম। আমি তো মেয়েটার কোন বিশেষ অঞ্চলের দিকে চোখ রাখিনি তবু দেখি মেয়েটা কেবল তার ওড়না ঠিকঠাক করে চারিদিকে ঢাকবার চেষ্টা করছে। যেন ঢাকলেই আমি আর জানতে পারলাম না ওড়নার আড়ালে কি লুকিয়ে আছে। শরৎ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাটা মনে পড়ল- ‘যুবতী যেন ভারবাহী পশু, বেচারা সারাদিন সারারাত বয়ে বেড়ায় তার স্তন দুটি’। লাইনটা কি মেয়েদের জন্য একটু অবমাননাকর? অবশ্য পরের লাইনগুলো শোনা উচিত-
‘অথচ জানে না ওরা আনন্দেরই মফস্বল।
যতক্ষণ না,
একটা ধারালো মানুষের ছায়া পড়ে তার উপর।
সে তার একটাকে আলতো করে ধরে ফুলদানির মত,
অন্যটিকে,
আঙ্গুলের জিভ কিম্বা জিভের আঙ্গুল দিয়ে মৃদু মৃদু বাজায়।
না, দেখতে পাচ্ছি চিন্তাভাবনা একটু বেলাইনে চলে যাচ্ছে। মেয়েটার দিকে আর তাকাবো না ঠিক করলাম।
সূর্য ডুবে গেছে। আঁধার হয়ে আসছে। তীরে একটা গরু দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে। ওটা এখনও বাড়ি ফেরে না কেন? নাকি সন্ধ্যার বিষণ্ণতা উপভোগ করছে। ভদ্রমহিলা এবং যুবতী তাদের কেবিনে চলে গেলেন। আমি বসেই রইলাম। রাত এলো। তারপর যেমন হয়, চাঁদ আসে একলাটি, নক্ষত্রেরা দল বেঁধে আসে।’ বহুদিন আকাশে তারা দেখা হয় না। লঞ্চের একটানা শব্দ আর ঝিলমিল নদীর আবহে আমি আকাশের তারা দেখতে লাগলাম। প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো সপ্তর্ষিমন্ডলটাকে চিনি। অন্য তারাগুলোও কী আশ্চর্য স্পষ্ট! এতগুলো গ্রহ-নক্ষত্র তার কোনোটাতেই কি কোনো প্রাণী নেই? নিশ্চয়ই আছে। আচ্ছা, ওরাও কি দাস, সামন্ত, পুঁজিবাদ পেরিয়ে সমাজতন্ত্রে পৌঁছেছে? ওদের সোভিয়েত ইউনিয়নও কি ভেঙ্গে গেছে?
‘রাইতে ভাত খাবেন স্যার?’ বেয়ারা জিগ্যেস করল। ঘড়িতে তাকিয়ে অবাক হলাম। রাত তো বেশ হয়েছে ইতিমধ্যে। বিরক্ত হলাম। বললাম, ‘তোমাদের ভাত আর তরকারি খেলে সকালে স্যালাইনের প্যাকেট নিয়ে দৌড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না।’ লঞ্চে কিছু খাব না ঠিক করে এসেছি। আসবার সময় ব্যাগে একটা বিফ বার্গার নিয়ে এসেছিলাম। কেবিনে গিয়ে ওটাই খেলাম। খেয়ে তেমন পেট ভরল না। একটু পরে খানিকটা ঝিমুনি এলো। কেবিনের দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। লঞ্চের বিছানাগুলো খুবই চাপা। শুলে মনে হবে কফিনে শুয়ে আছি। জানালা দিয়ে নদীর ঠান্ডা বাতাস আসছে। ব্যাগ থেকে ওয়াকম্যানটা বের করলাম, এয়ারফোন লাগালাম কানে। বাতি নিভিয়ে চালিয়ে দিলাম শচীনদেব। বাজতে লাগল- ‘কাঁদিব না ফাগুন গেলে, বিদায় দিব তারে মণিদীপ জ্বেলে…’
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কে জানে। ঘুম ভাংতে বিছানায় শুয়েই টের পেলাম লঞ্চ থেমে আছে। তাহলে ঘাট এসে গেছে? কেবিনের দরজা খুললাম। দেখি বাইরে রোদ উঠেছে বেশ। কিন্তু একী, কোথায় ঘাট? লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে নদীর ঠিক মাঝখানে। দুপাশের তীর বেশ দূর, সেখানে ছবির মতো গ্রামের তালগাছ। ঘটনা কি? জানা গেল সাথে সাথেই। রাতের বেলাতেই লঞ্চ এখানে চরে আটকে গেছে। সারারাত অনেক চেষ্টা হয়েছে লঞ্চটাকে নাড়াবাড়। চেষ্টা বৃথা গেছে। সুতরাং সবাই হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। সারাদিন পর সেই বিকেলে যখন জোয়ার আসবে তখনই শুধু লঞ্চটা চলবার মতো পানি পাবে। সুতরাং আজ সারাদিন এই মাঝ নদীতে লঞ্চের ওপর কাটাতে হবে। পরিস্থিতিটা শুনলাম। কিছু না ভেবে আগে ঢুকলাম বাথরুমে, মুখটুখ ধুয়ে যাবতীয় কাজ শেষে ফ্রেস হয়ে বেরুলাম। উঠলাম গিয়ে লঞ্চের ছাদে। এবার দুপাশ দেখলাম ভালো করে। সত্যিই লঞ্চটা আটকেছে নদীর একেবারে মাঝখানেই। দুপার বেশ দূরে। চরটাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে পানির নিচে। লঞ্চটা এখানে এলো কী করে? ব্যাটা সারেং কি ঘুমাচ্ছিল? তাহলে লঞ্চটা সত্যিই নড়ছে না সারাদিন? আশপাশের লোকজন বলল, রাতে চেষ্টা কম হয়নি। অনেক লোক ঐ রাতের বেলা চরের মধ্যে নেমে ছোট্ট এই লঞ্চটাকে ঠেলবারও চেষ্টা করেছে। রাতে এত কান্ড কিছুই টের পেলাম না? তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? আজকে আর মাটিতে পা রাখা হচ্ছে না। এদেশে সবকিছুই বড় আনসারটেইন হয়ে গেছে। মেজাজ বিগড়ে গেল। ছাদ থেকে নেমে এলাম। বেয়ারা বলল, ‘নাস্তা খাবেন স্যার?’ খাবারটাবারের কথা এখন মাথায় নেই। তার কথার উত্তর না দিয়ে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম নদীর দিকে। অন্যকথা ভাবছি। পাশ দিয়ে অন্য কোন লঞ্চ গেলে সেটাকে ডেকে আমরা সবাই উঠে যেতে পারি না? জানতে চাইলাম বেয়ারার কাছে। ও জানালো, এ সময় এদিকে কোন লঞ্চই চলাচল করবে না। আসবে সেই রাতে। সে আবার নাস্তার কথা বলল। ‘লঞ্চের কোন কিছুই খাব না, সেটা তো বলেই দিয়েছি। তুমি বরং ভালো করে কাপটাপ ধুয়ে এক কাপ চা নিয়ে এসো।’ চা এলো কিছুক্ষণ পর। চায়ের ধোঁয়া দেখতে দেখতে ভাবলাম, বোঝা যাচ্ছে আজকের দিনটা এই লঞ্চে পড়ে থাকা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। সুতরাং মেজাজ গরম করে কি লাভ? মাথাটা বরং ঠান্ডা রাখি। নদীর মাঝখানে এভাবে দিন কাটানো মন্দ কি? শখ করে তো আর এ সুযোগ পাওয়া যাবে না। বাদ দিলাম ঘাটের চিন্তা। আজকে যে আসছি আরিফ তো সেটা জানে না, সুতরাং দুশ্চিন্তার কোনো ব্যাপার নেই ওদিকে।
ডেকের দিকে গেলাম। লোকজনের হাঁটাচলা বেড়ে গেছে। দিনের বেলা তো আর শুয়ে থাকা যায় না? সবার হাঁটাচলা থেকে বোঝা যায়, সবাই উদ্দেশ্যহীনতায় ভুগছে। এখন তাদের কী করনীয়? কীভাবে সময়টা কাটাবে? কিন্তু শূন্যতা তো মানুষের বরদাশত হয় না, সময় কাটানোর একটা উপায় সে বের করে নেবেই। তাসের দল বসে যাবে তাস নিয়ে, বেশকিছু পত্রপত্রিকা বিক্রি হবে, তাতে ডুব দেবে কয়েকজন, একদল সারাদিন গবেষনা করবে কি করে লঞ্চটা এখানে আটকালো, তাই নিয়ে, সেখান থেকে চলে যাবে তাদের জানা বিভিন্ন দুর্ঘটনার ইতিহাস বর্ননায়। মহিলাদের সময় কাটবে শিশুর মল-মূত্র এবং দুধ নিয়ে। যুবক-যুবতীদের কাটবে অন্তহীন স্বপ্ন দেখতে দেখতে, নদীর দিকে তাকিয়ে কজন বিরক্ত হয়ে ভাবতে থাকবে আজ কার কী ক্ষতি হলো, নতুন অনেকের সাথেই আজ পরিচয় ঘটবে সবার, তারা পরস্পর বর্ননা করবে তাদের কৃতিত্ব অথবা ব্যর্থতার কথা। কিন্তু আমি কি করে সময় কাটাই? নতুন কারও সাথে পরিচিত হয়ে আলাপ জুড়বার স্পৃহা আমার নেই। মানুষকে বরং খানিকটা দূরত্ব থেকে দেখতেই আমার ভালো লাগে। কিন্তু মানুষ আর কতক্ষণ দেখবো? তার চেয়ে কেবিনে গিয়ে কিছু পড়াশুনার চেষ্টা করা যাক। সময়টা কাজে লাগবে। গতকালের পত্রিকাটা নিয়ে শুয়ে পড়লাম কেবিনের সরু বিছানায়। পত্রিকায় ডারউইনের গ্যালাপাগোস দ্বীপের ওপর চমৎকার একটা আর্টিকেল আছে, ওটা পড়লাম মনোযোগ দিয়ে। বিশাল আকারের কাছিমের ছবিগুলো দেখলাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সময় বেশ কাটল অনেকক্ষণ।
আবার কেবিনর বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বেশ কড়া রোদ উঠেছে। দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেল। সেই যুবতী রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকাবো না ঠিক করলাম। নদীর মাঝখানে লঞ্চটা একটু কাত হয়ে স্থবির দাঁড়িয়ে আছে। একটা পালতোলা জাহাজ সমুদ্রের মাঝখানে বাতাসবিহীন অবস্থায় থমকে আছে, এই নিয়ে কার যেন একটা বিখ্যাত কবিতা আছে? সম্ভবত কোলরিজের। এ সময় দেখলাম কতগুলো ছেলে লুঙ্গি কাছা মেরে ঐ চরে নেমে গেছে। পানি খুব বেশি নেই। তারা চরের পানি ভেঙ্গে হাটছে, ফুর্তি করছে, কেউ কেউ নদীতে সাঁতার দেওয়াও শুরু করেছে। আমার মনে হঠাৎ উঁকি দিল আমার ব্যাগের মধ্যে গুঁজে রাখা হাফপ্যান্টটার কথা। ভাবলাম ওটা পরে নদীতে নেমে গেলে কেমন হয়? কেবিনে ঢুকে শার্ট খুলে হাফপ্যান্ট পরে বীরদর্পে নেমে গেলাম চরে। কোথাও গোড়ালি পানি, কোথাও হাঁটু। হাঁটতে দারুণ লাগছে। এক সময় সাঁতার শুরু করলাম। ঐ দুপুর রোদে মাঝ নদীতে সাঁতার আপন মনে একা একা উপভোগ করলাম অনেকক্ষণ। এক সময় উঠে এলাম। শরীর মুছলাম, মুখে ক্রিম লাগালাম, নতুন কেনা ঘিয়ে রঙ্গের পাঞ্জাবীটা পরে বাইরে চেয়ারে এসে বসলাম। খুব ফ্রেশ লাগছে। ভালোই একটা অভিজ্ঞতা হলো। এভাবে জলমগ্ন চরের উপর হাঁটা, মধ্যনদীতে সাঁতার। তবে এতক্ষণ সাঁতার কেটে বেশ ক্লান্ত লাগছে।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ শরীরে নতুন একটা উপসর্গ দেখা দিল। পেটের ভেতরটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল। ব্যথা করে উঠল চিন চিন করে। চিন চিন করে ব্যথা বলতে কী বোঝায় আমি জানি না। কিন্তু পেট আমার চিন চিন করে উঠেছে সেটা বুঝতে পাচ্ছি। ব্যথাটা কমে গেল কিছুক্ষণ পর। খানিক পর আবার শুরু হলো। আমার বুঝতে বাকি রইল না যে আমার খিদা লেগেছে। পাকস্থলীর ঐ আন্তর্জাতিক ভাষা বুঝতে কতক্ষণ লাগে? আমার খিদা লেগেছে। মনে পড়ল সকালে তো নাস্তা খাইনি। গত রাতের খাওয়াটাও বিশেষ সুবিধার হয়নি। বোকামি করেছি, কিছু একটা খেয়ে নেওয়া উচিত ছিল লঞ্চ থেকে। এখন তো মহাঝামেলা হলো। পেটে অদ্ভুত এক ব্যথা শুরু হয়েছে। অনেকক্ষণ নদীর বাতাস লেগেছে গায়ে, নদীর বাতাস ক্ষুধা উদ্রেককারী। তারপর এতসময় ধরে ঐ সাঁতার। খিদা লাগবে না? ঐ সাঁতার দেওয়াটাই হয়েছে স্রেফ একটা ফালতু কাজ। কেন যে সাঁতার দিলাম! তা না হলে খিদেটা এখনই এমন জেঁকে বসত না। অভিজ্ঞতা নেওয়ার ভুত চেপেছিল? ঐ সময় মেয়েটা রেলিংয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওকে আমার ঐ সাঁতারের পারফরমেন্স দেখানোর একটা অবচেতন ইচ্ছে কি কাজ করেছে মনে? হয়তো বা। মেয়েটার ওপর রাগ হলো। কিন্তু তাতে তো খিদে কমছে না। আমি টের পাচ্ছি আমার পাকস্থলীর বেলুনটা চুপসে আছে। পেটের ভেতর একটা ঝাঁকি যেন উঠছে কিছুক্ষণ পর পর। বেয়ারাকে ডেকে যা আছে কিছু খেয়ে নেব নাকি? কিন্তু লঞ্চের কিছু তো আমি খাব না ঠিক করেছি। সিদ্ধান্তটা ভাংবো? লঞ্চ ছাড়া খাবারের তো আর কোনো উৎস নেই। অন্য যাত্রীরা ব্যাপারটা কীভাবে সলভ করছে? অবশ্য তাদের তো তেমন সমস্যা নেই, তারা নিশ্চয়ই সকালে কিছু খেয়েছে, তাছাড়া এখনও তারা নির্বিঘ্নে সবকিছু খাবে। কিন্তু আমি এতো খাই খাই করছি? নাইবা খেলাম আজকে। সারাদিন না খেয়ে কি থেকেছি কখনো? ঠিক মনে পড়ছে না। রোজার সময় অবশ্য না খেয়ে থাকা হয়। কিন্তু রোজা তো তেমন রাখি না। রাখলেও সারাদিন চোখে ভাসে সন্ধ্যার ভরা ইফতারির প্লেট। কিন্তু এখন এই বন্দী লঞ্চে উপায়টা হবে কি? বরং খাওয়ার চিন্তা সম্পূর্ণ বাদ দিই। দুপাশে বিস্তীর্ণ নদী, মাঝে আটকে-পড়া আমাদের লঞ্চ, তার রেলিং ধরে আমি কাটিয়ে দিলাম একটা দিন, অভুক্ত। মন্দ কি? বেশ গল্প করা যাবে পরে।
তাহলে আমি কি ট্র্যাপে পড়ে গেলাম? ক্ষুদে একটা ছেলের গলায় গামছা দিয়ে টিনের বাক্স ঝোলানো। ওতে কি চানাচুর? ছেলেটাকে ডাক দিলাম। আমার দিকে ফিক করে হেসে সে বলল, ‘স্যার, চানাচুর তো শেষ। লঞ্চ পানিতে আটকাইয়া গেছে তো, মানুষ কুনুহানে যাইবার পারতাছে না আর খালি চানাচুর খাইতাছে। আমার লগে কুদ্দুসে ডিম আনছিল, হ্যার ডিমও সব শেষ।’
যাক, এখন আমার কাজ হবে খিদের কথা ভুলে থাকা। নদী দেখা যাক। দুপুর গড়িয়ে আসছে। নদীর পানি চিক চিক করছে। চরের বালিতে বাধা পেয়ে নদীর স্রোত বদলে যাচ্ছে। স্রোতে কী যেন একটা ভেসে আসছে। কাছে আসতে দেখি একটা ছেঁড়া বালিশ। তুলো বের হওয়া ছোট একটা বালিশ। কোন বাচ্চার হবে হয়তো। তাকে অনুসরণ করে ভেসে আসছে ওটা কি? হ্যাঁ, চেনা যাচ্ছে, বেশ হৃষ্টপুষ্ট একখন্ড মল। মানুষের মল। মানুষের এনাল ক্যানেলের পরিধি এতোটা হতে পারে? আমার গা গুলিয়ে আসলো। পেটটা মোচড় দিয়ে উঠল আবার। আমি সোজা চলে গেলাম কেবিনে। শুয়ে পড়লাম। পেট চোঁ চোঁ করছে। এই যে পেট একবার চিন চিন, একবার চোঁ চোঁ করে সেই ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। কিন্তু ব্যাপারটা খুব বেশীক্ষণ ইন্টারেস্টিং থাকে না। এখন ঠিক কি করলে ভালো হবে ভাবতে থাকি। ডেকের মানুষগুলোকে আবার দেখে আসলে কেমন হয়? কিন্তু উঠবার কোনো স্পৃহা পাই না। ক্লান্তি শরীর জুড়ে। ক্লান্তি না খিদা? আবার খিদা? আমি গতকালের পেপারটা আবার টেনে নিলাম। কোনো খবরে চোখ বসছে না। ‘বসনিয়ায় আবার বোমাবর্ষণ’ পড়েই মনে হলো, তাতে আমার কি? পৃথিবীর কোনো কিছুতেই যেন আমার কিছু যায় আসে না। বসনিয়া নামটা বেশ। ‘বসনিয়া, বসনিয়া’ আমি বিড়বিড় করে আওড়াতে লাগলাম। অনেকক্ষণ আওড়ালাম। হঠাৎ খেয়াল হলো, আমি এমন পাগলামি করছি কেন? এমন পাগলামি করে মনকে ডাইভার্ট করার মানে কি? সময়টা ভালোভাবে কাটানো দরকার। গান শোনা যাক। ওয়াকম্যানটা লাগালাম কানে। কাল রাতে শচীন দেবের ক্যাসেটের উলটো পিঠটা শোনা হয়নি। লাগিয়ে দিলাম প্লেয়ারে। ‘দূর কোনো পরবাসে…’ বুঁদ হয়ে শোনবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু না ঠিক কানে লাগছে না। শচীনের গলাটা গতকাল তো ঠিক এতটা নাঁকি নাঁকি মনে হয়নি? ক্যাসেট বন্ধ করে দিলাম। অদ্ভুত সমস্যা হলো দেখছি। পেটের ব্যাপারটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। ঝিম মেরে শুয়ে জগতের যে- কোনো একটা কিছু নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কনসেনট্রেশন আসছে না। আচ্ছা কবিতা পড়লে কি কাজ হবে? কাব্য? ব্যাগ থেকে ‘সঞ্চয়িতা’ বের করলাম। রবীন্দ্রনাথের কবিতা কম পড়া হয়, এই ছুটিতে একটু ভালো করে পড়ব ঠিক করেছিলাম। পাতা উল্টালাম- ‘প্রতিদিন বহে মৃদু সমীরণ, একদিনই আসে ঝড়…’ দূর, হবে না। রবীন্দ্রনাথে হবে না। সুকান্তে কি কাজ হতো? কে জানে? ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়?’ কিন্তু সুকান্ত পাবো কই এখন? হু হু করে উঠছে পাকস্থলী। পাকস্থলী যেন বিরল প্রান্তরের মতো খাঁ খাঁ করছে। ভালো কান্ড হলো দেখি! ব্যাপারটা তাহলে এভাবেই জেঁকে বসবে? কোনো মানে হয় না। কেবিনের বাইরে আসলাম। বেয়ারাকে ডেকে গম্ভীরভাবে জিগ্যেস করলাম, ‘খাবার টাবারের কি অবস্থা?’ কেন জিগ্যেস করলাম কে জানে? আমি কি খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি? বেয়ারা বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘ফাস্ট ক্লাস কেবিনের খাবার তো স্যার অনেক আগে শেষ এখন শুধু নিচতালা থার্ড ক্লাস কেন্টিনে খাবার আছে।’ ‘ও তাই।’ এমনি নির্বিকারভাবে বললাম, যেন এসব খবরে আমার কিছু এসে যায় না। এমনিতেই জিজ্ঞাসা করছি। একটু হাসবারও বোধহয় চেষ্টা করলাম। আমার মতো অন্য কারও অবস্থা তো মনে হচ্ছে না। তাহলে আমি কি ট্র্যাপে পড়ে গেলাম? ক্ষুদে একটা ছেলের গলায় গামছা দিয়ে টিনের বাক্স ঝোলানো। ওতে কি চানাচুর? ছেলেটাকে ডাক দিলাম। আমার দিকে ফিক করে হেসে সে বলল, ‘স্যার, চানাচুর তো শেষ। লঞ্চ পানিতে আটকাইয়া গেছে তো, মানুষ কুনুহানে যাইবার পারতাছে না আর খালি চানাচুর খাইতাছে। আমার লগে কুদ্দুসে ডিম আনছিল, হ্যার ডিমও সব শেষ।’
আমি রেলিং- এর পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ি। ছোকরাটার কথা শুনেই আমার পাকস্থলীতে হঠাৎ যেন ছলকে উঠল এসিডের স্রোত, খামচে ধরল পাকস্থলীকে। মনে হল কোনো জন্তু যেন দুই দাঁতে খামছে ধরে আছে পেটের নাড়িকে। কোনো ইদুর, বিছা কিংবা খরগোশ? পাশে তাকাতেই দেখি পাশের কেবিনে সেই মহিলা এবং যুবতী টিফিন ক্যারিয়ার খুলে পরম তৃপ্তিতে পরোটা খাচ্ছে। অসহ্য লাগল দৃশ্যটা। এরা পরোটা পেল কই? বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল কি? তাহলে রাত্রে খেলো কি? আবার তাকালাম আড়চোখে। কি নিপুণভাবে মেয়েটা আঙ্গুলে পরোটা ছিঁড়ছে, ছেঁড়া টুকরোর সাথে আলু ভাজি নিচ্ছে। অসহ্য। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। কিন্তু ঘাড় সেই আগের মতো ঘুরে যাচ্ছে। অথচ এবার আমার চোখ মেয়েটার সুশ্রী কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দিকে যাচ্ছে না, না ঠোঁটে, না চোখে, না স্তনে। আমার চোখে পড়ছে কেবল তার সচল চোয়াল, চিবানোর ভঙ্গি, মুখের ভেতর পরোটার টুকরোগুলো অদৃশ্য হওয়ার দৃশ্যে। এক কাজ করলে কেমন হয়? উনাদের কাছে গিয়ে বলি, ‘দেখুন, ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের খাবার তো শেষ হয়ে গেছে, আমি বোকার মতো খেতেই ভুলে গেছি, আপনাদের যদি এক্সট্রা কিছু…।’ দুর, এভাবে বলা যায় নাকি? জানা নেই, শোনা নেই। কিংবা যদি এভাবে বলি, ‘কি ব্যাপার, একা একাই খাচ্ছেন?’ কিন্তু এভাবে বলার জন্য মুখে যে হাসি আর স্বতঃস্ফূর্ততা দরকার, সেটা এখন আমার পক্ষে আনা অসম্ভব। কিন্তু আমার কি মাথা খারাপ হলো? এসব কী আবোল-তাবোল ভাবছি? সোজা কেবিনে গিয়ে উপুড় হয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। টের পাচ্ছি পেটে এসিডের প্রবাহ। হাইড্রোক্লোরিক এসিডই তো? ওটা কি শেষে আমার পাকস্থলীটাই কুরে কুরে খাবে? যখন থেকে শুনলাম ফার্স্ট ক্লাসে খাবার নেই, চানাচুর নেই, ডিম নেই, এসিডের প্রবাহটা তখন থেকে যেন বাড়তে লাগল। মহা এক অসহায় অবস্থায় পড়ে গেলাম দেখছি। এমন যদি হয় এই নদীর মাঝখান থেকে দিনের পর দিন আমরা আর নড়তে পারছি না, লঞ্চের সবটুকু খাবার শেষ, আমরা না খেতে পেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে যাচ্ছি? এমন হবার যদিও কোনো সম্ভাবনা নেই, তবু এসব চিন্তাই কেবল মাথায় আসছে।
ভাতের থালাটা নিয়ে পাশের ময়লা টেবিলটাতে গিয়ে বসলাম। সামনে দেখি সেই গেঞ্জি, লুঙ্গি পরা, গায়ে ঘামের গন্ধযুক্ত লোকটা। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘সুদা ভাত খাইবেন কেমনে, একটা কাঁচামরিচ লন।’ আমি তার হাত থেকে মরিচটা নিলাম। প্লেটে শাদা ধবধবে ভাত, তাতে ডালের একটু হলুদ আভা, মাঝখানে একফোঁটা গাড় সবুজ কাঁচামরিচ। আমি তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
কেবিন থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচতলার থার্ড ক্লাস ডেকে নামলাম। দেখলাম ভাত খাবার জন্য সবাই লাইনে দাঁড়িয়েছে। চোখে-মুখে একটা নির্বিকার ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করলাম। যেন আমার মুখের সাথে পাকস্থলীর কোনো সম্পর্ক নেই অথবা আমার পাকস্থলীই নেই। কিন্তু আমার খিদা লেগেছে এই নিয়ে আমি এতো বিব্রত কেন? খিদা কি লজ্জার বিষয়? আমার খিদা লেগেছে সেটা অন্যে জানলে অসুবিধা কি? কিন্তু আমার শুধুই মনে হচ্ছে আমি যেন খুব অপ্রতিভ হয়ে পড়ছি। আজীবন ভরা একটা পাকস্থলীর হঠাৎ এমন শূন্য হয়ে যাওয়া যেন দারুণ লজ্জার। চিৎকার, হৈ চৈ হচ্ছে আমার চারদিকে।
আমি দাঁড়িয়ে আছি। কেন চলে যাচ্ছি না, কে জানে? হঠাৎ পাশের লাইনের মধ্য থেকে একজন বয়ষ্ক দাঁড়িওয়ালা লোক আমাকে বলল, ‘ভাইজান, ঢুইকা পড়েন লাইনে। আমার সামনেই জায়গা দিতাছি।’ বিরাট কোন অপরাধ করে একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়েছি, এমন অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। লাইনে ঢুকব বলে এখানে দাঁড়িয়ে আছি, তাই কি ভেবেছে লোকটা? আমার চেহারা কি খুব করুণ হয়ে পড়েছে? লোকটা পাশ থেকে হঠাৎ আমার হাত টেনে বলল, ‘তাড়াতাড়ি ঢুকেন, পিছে খাড়াইলে আর ভাত পাইবেন না। লঞ্চ পৌঁছাইবো কাইলকা ভোরে।’ লোকটা তার সামনে একটু ফাঁক তৈরি করে আমার জন্য জায়গা করে দিল। আশ্চর্য! আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। কোনো কথাই বললাম না। পাশ থেকে হঠাৎ হৈ চৈ শুরু হলো, ‘লাইনের বাইরে থিকা লোক ঢুকে ক্যান? পিছে যান, বাইর হন।’ আমার পেছনের বয়ষ্ক লোকটা প্রতিবাদ করে বলে, ‘না, না, উনি আমারই লোক, এখানেই আছিল, একটু পেসাব করতে গেছিল।’ আমি নীরব রইলাম। এর মধ্য থেকে বের হয়ে যাওয়াও এখন খুব অপমানজনক। পেছন থেকে প্রবল ধাক্কা আসছে। আমি আমার সামনের গেঞ্জি, লুঙ্গিপরা লোকটার কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরে রইলাম। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি। একজন স্বেচ্ছাসেবী আবার লাইন ঠিক রাখার দায়িত্ব নিয়েছে। ঠেলে ঠেলে মানুষের আঁকাবাঁকা লাইন সোজা করছে সে। পেছন থেকে ধাক্কা আসছে কিছুক্ষণ পর পর। আমি বেশ ভীত হয়ে পড়ি, এই বুঝি ধাক্কায় লাইনচ্যুত হয়ে পড়ব। শক্ত করে ধরে থাকি সামনের লোকটাকে। লোকটার গায়ে ঘামের কটু গন্ধ। দমকা বাতাসে সে গন্ধ নাকে লাগে। আমার পেছনে দাড়িওয়ালা লোকটাকে ভালো করে দেখতেই পারলাম না। লোকটা কেন আমার উপকারের জন্য এমন উঠেপড়ে লাগলো? কিন্তু পেছনে তাকানোর উপায় নেই এত ঠাসাঠাসিতে। সামনে তাকিয়ে আছি। লাইনের শেষ মাথায় টেবিলের ওপার থেকে ভাত দিচ্ছে একজন। লাইনের একজন একজন করে সামনে যাচ্ছে, থালা হাতে। সে একটা ঝাঁকার ভেতর রাখা ভাত হাত দিয়ে মুঠো করে তুলে দিচ্ছে, সেই ভাতে, পাশে আরেকজন ঢেলে দিচ্ছে পানির মতো এক চামচ ডাল। আমি ভাতের ঝাঁকাটা দেখতে পাচ্ছি। বেয়ারা তার কালো হাতটা ঢুকিয়ে দিচ্ছে ধবধবে শাদা ভাতে। তুলে দিচ্ছে প্লেটে। এক বুড়ো অনুনয় করছে ‘আর একটু দাও বাপ।’ তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হলো। পেছন থেকে কে একজন বরিশালের কথ্য টানে বলছে, ‘হগলতেরে এতডি কইরা ভাত দেলে হেসে মোরা পাইমু কি, আই?’ ভাত দেবার আগে একজন ভাতের দামটা রেখে দিচ্ছে ঠিকঠাক। আমি ঐ ভাত থেকে বেশ দূরে। দূর থেকে ঝাঁকার ভাতের দিকে তাকিয়ে আছি। ভাতের রঙ এতো শাদা! একজন করে পার হচ্ছে আর ঝাঁকার ভাতের পরিমাণ কমছে। বেয়ারা ছেলেটা চিৎকার করে বলছে, ‘এই ভাতই কিন্তু শেষ।’ লাইন একটু একটু এগোচ্ছে। এই ঘোষণায় আরেক দফা ধাক্কাধাক্কি। হঠাৎ মনে হলো আমার গলা খুব শুকিয়ে গেছে। পানি খাওয়া দরকার। কিন্তু লাইন ছাড়বার তো উপায় নেই। লাইন এগিয়ে যাচ্ছে। আমার সামনে অনেকজন। শাদা ভাত, তাতে বেয়ারার কালো হাত ঢুকছে আর উঠছে। আমার মনে হতে লাগল, আমি টেবিলের কাছে যাওয়া পর্যন্ত যদি ভাত না থাকে? যদি ঠিক আমার বেলায় এসে বলা হয়, ‘শেষ।’ আমি ঘামছি। গলা শুকিয়ে আমার কাঠ। নিঃশ্বাস দ্রুত হচ্ছে। এক সময় আমি টেবিলের কাছে পৌঁছালাম। এবার আমার পালা। না, ভাত আছে। আমার চোখ বিদ্ধ হয়ে আছে ঝাঁকায়, পকেট থেকে ভাতের দাম বের করে দিলাম সম্মোহিতের মতো। প্লেটটা এগিয়ে দিলাম। মুঠোটাকে বড় করে যতটুকু ভাত আঁটে তাই ঝাঁকা থেকে তুলে দিল কালো ছেলেটা, একজন পাশ থেকে চামচ ভরে দিল ডাল।
ভাতের থালাটা নিয়ে পাশের ময়লা টেবিলটাতে গিয়ে বসলাম। সামনে দেখি সেই গেঞ্জি, লুঙ্গি পরা, গায়ে ঘামের গন্ধযুক্ত লোকটা। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘সুদা ভাত খাইবেন কেমনে, একটা কাঁচামরিচ লন।’ আমি তার হাত থেকে মরিচটা নিলাম। প্লেটে শাদা ধবধবে ভাত, তাতে ডালের একটু হলুদ আভা, মাঝখানে একফোঁটা গাড় সবুজ কাঁচামরিচ। আমি তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। এ সময় ভোঁ শব্দে বেজে উঠল লঞ্চের সাইরেন। লঞ্চ একটু দুলে উঠল। তবে কি জোয়ার শুরু হলো? আমি বড় এক গ্রাস ভাত মুখে পুরে দিলাম। ভাতের নলা আমার গলা দিয়ে ধীরে ধীরে নামতে থাকে।
আরও পড়ুন-
● সাইপ্রাস
● কমলা রকেট: নূর ইমরান মিঠুর ক্যানভাসে বাংলাদেশ
● কমলা রকেট: গল্পগুলো আমাদের