:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
স্বাক্ষর শতাব্দ

অনুবাদক, সাহিত্য সমালোচক

কমলা রকেট : গল্পগুলো আমাদের

কমলা রকেট : গল্পগুলো আমাদের

কমলা রকেট! বাংলাদেশের সিনেমা। পরিচালক নূর ইমরান মিঠুর আগে কোনো কিছু দেখিনি, কিন্তু এই প্রথম চেষ্টাটা দারুণভাবে সফল মনে হলো। বাংলাদেশী সিনেমা, এই মুহুর্তে হলে চলছে। বাংলাদেশের সিনেমা কোন দিক দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রাখে, এটা পরিচালক খুব চমৎকার দেখিয়ে দিয়েছেন। এরকমই হবার কথা ছিল বোধ হয় বাংলাদেশের সিনেমার! আমাদের গল্পগুলো এমন করে কয়জন বলতে পারে বা পেরেছে? শাহাদুজ্জামানের গল্প, চিত্রনাট্যেও তার অবদান আছে।

গল্পটা কিসের? এরকম একটা গল্প মনে হয় আমাদের চারপাশে সবসময় ঘটে চলেছে। রকেট একটা লঞ্চের নাম। আমরা এই লঞ্চের প্রথম শ্রেণিতে করে বেড়াতে যেতে চাই, মংলা-সুন্দরবন-খুলনায়। ‘যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের, মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা এই জেনে’ আমরা যেতে চাই আমাদের অলস সময়ের বিলাসে। কিন্তু যদি দেখা হয়ে যায়? আশেপাশের জীবন ও মৃত্যুগুলিকে আমরা দেখেও দেখি না। এই সিনেমার শেষ দৃশ্যটা সিনেমার ইতিহাসে ক্লাসিক হয়ে থাকবে তাতে খুব সন্দেহ নেই। সেই দৃশ্যটাই আমরা এড়িয়ে যেতে চাই। রকেট যাত্রায় যেটা ঘটে যাওয়াটা আবার খুব অস্বাভাবিক নাটকীয় কিছু নয়। এইখানেই গল্পের, চিত্রনাট্যের দারুণ মুন্সীয়ানা।

‘কমলা রকেট’ ছবির একটি দৃশ্য।

গল্পে একটা লাশ আছে, কিন্তু লাশটাকে আমরা দেখতে পাই না, পরিচালক আমাদের দেখান না। কিন্তু লাশটা সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রয়ে যায় এবং ক্লাইম্যাক্স পর্যন্ত আমাদের হাজির করে। এরকম লাশ আমরা কি আসলেই দেখতে পাই? তাজরীন বা রানা প্লাজার কথা মনে করে দেখি। অতগুলি পোড়া লাশ, ইটের স্তুপের নিচে চাপা পড়া লাশ। আমরা কি আসলেই দেখেছি? তৌকির আহমেদের ‘অজ্ঞাতনামা’ সিনেমায়ও একটা লাশ আছে। সে লাশটি পঁচে যেতে যেতে আমাদের কে বিদ্যমান ব্যাবস্থার মধ্যকার এবসার্ডটিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে। তৌকির এখানেও আছেন, একটি কেন্দ্রীয় চরিত্রে, অভিনেতা হিসেবে।

গল্পে একটা লাশ আছে, কিন্তু লাশটাকে আমরা দেখতে পাই না, পরিচালক আমাদের দেখান না। কিন্তু লাশটা সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রয়ে যায় এবং ক্লাইম্যাক্স পর্যন্ত আমাদের হাজির করে। এরকম লাশ আমরা কি আসলেই দেখতে পাই? তাজরীন বা রানা প্লাজার কথা মনে করে দেখি। অতগুলি পোড়া লাশ, ইটের স্তুপের নিচে চাপা পড়া লাশ। আমরা কি আসলেই দেখেছি?

রকেট কি একটা রূপক? আশ্চর্যজনক হলেও উত্তর হলো ‘না’। সিনেমায় দেখি, এক দম্পতি রকেটের উপর থেকে আশে পাশের চমৎকার দৃশ্যাবলী উপভোগ করছে। সামনে আরো সুন্দর দৃশ্য আছে, এমন প্রত্যাশা করে বউটা খুব আদুরে হয়ে যাচ্ছে। চমৎকার চিত্রগ্রহণ। সদরঘাটে লঞ্চ ছাড়া থেকে আরম্ভ করে যতদূর এগিয়েছে, এই রোমান্টিক যানটির প্রেমে পড়ে যাই আমরা। এর প্রথম শ্রেণিতে কেবিনে শুয়ে শুয়ে আমাদের ‘ভালো লাগে বিটলস, ডিলান আর বেটোফেন শুনতে’ (মহীনের ঘোড়াগুলি)। ডেক বা অন্য শ্রেণিতে যারা আছেন? তাদের সাথেও আমাদের দেখা হয়ে যায়। এমনকি এই নদী-গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় যখন দেখি ‘ওরা’ বা ‘ওদের’কে, এই অপর, আমাদের শ্রেণি অবস্থানের অন্য দিকের মানুষগুলি গোচরে আসে, তখন ‘কোথায় রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ তবুও’। এখানেই আমরা তৃপ্ত থাকতে চাই। আমরা এই বিষাদটুকুকে মহিমান্বিত করে তুলতে ওস্তাদ।

এই বিষাদটি সবসময় অনিবার্য হয়ে ধরা দেয় না আমাদের জীবনে। কোন সংকটের সম্মুখীন করে না। রানা প্লাজা–তাজরীন, কিংবা অজ্ঞাতনামার লাশের জন্য এই বিষাদটুকু আমাদের জীবন ধারণে রসের যোগান দেয়। বিবেকের মলম হয়ে কাজ করে। কিন্তু রকেটে পরিচালক আমাদেরকে একটা সংকটের মুখোমুখি করান। আবার সেটা খুব স্বাভাবিক একটা সংকট। রকেট চড়ে আটকা পড়ে, সেখান থেকে রসদে টান পড়ে। এমন কোনো তীব্র নাটকীয় কিছু নয়। তবু সেখান থেকেই লাশটা অনিবার্য হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে আমাদেরকে ক্লাইম্যাক্সের দিকে ঠেলে দিতে থাকে। আমরা আরো কাছে আসতে থাকি ‘ওদের’। কিন্তু সবগুলি চরিত্র ক্লাইম্যাক্সের দিকে আগায়  না। শেষ দৃশ্যটা পরিচালক এমন জায়গায় এনে শেষ করেন, আমাদের আর কিছু করার থাকে না। ঐ বিষাদটুকুর অনিবার্যতা আমরা কেউ কেউ অনুধাবন করতে থাকি আরো তীব্রভাবে।

‘কমলা রকেট’ ছবির দৃশ্যে জয় রাজ ও মোশাররফ করিম।

মোশাররফ করিমের চরিত্রটি অনন্য। সবখানেই আছেন, রকেটের উপরতলা থেকে ডেক পর্যন্ত যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছেন। রকেট যেমন বয়ে চলছে সবাইকে নিয়ে, তার চরিত্রটিও যেন তাই। অর্ধমৃত সার্কাস, স্ত্রীর শোকে মুহ্যমান স্বামী, সদ্য দুর্ঘটনা কবলিত ব্যবসায়ী, সবার কাজে লাগছেন, ‘কবি ও কবিরাজ’। লাশের গন্ধ ভোলাতে আতরের যোগানও দিচ্ছেন।

সংগীত আয়োজন বেশ চমৎকার। সিনেমার নেপথ্যে শব্দের ব্যাবহার এর শক্তিশালী চিত্রনাট্যকে দারুণভাবে সহায়তা করেছে। বিশেষ করে ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্যগুলিতে। তৌকিরের স্বপ্নদৃশ্যটি দারুণ চেষ্টা। চিত্রগ্রহণে দক্ষতার কথা আবারো না বললেই নয়।

চিত্রনাট্য দুর্দান্ত। শুরু থেকেই আমাদের অল্প অল্প তৈরি করে শেষ দৃশ্যটির জন্য। মেলোড্রামা নেই। লাশটিকে লাশের অধিক করুণ করে তোলে না। বেশ কিছু ছোট ছোট শট, সেগুলি দিয়ে রকেটের মানুষগুলিকে চেনাতে থাকে। একজন নারীকে আমরা দেখি বেশ কয়েকবার। তার অগোছালো কেশবিন্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে আমরা যেন চিনে ফেলি, উন্মাদিনীটিকে। অথচ শেষ দৃশ্যের আগে তাকেই দেখি নিশ্চিন্তে খাদ্য গ্রহণ করছে।

সিনেমাটা দেখার পর পর হাততালি দিতে ইচ্ছে করলো, দিলামও। ছবিটা দেখতে গিয়েছিলাম মা এবং স্ত্রীর সাথে। পরিচালক নূর ইমরান মিঠু সামনে আরো চমৎকার কিছু উপহার দিতে যাচ্ছেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.