:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
ইহতিশাম আহমদ

পরিচালক, সমালোচক

শুটিং বিড়ম্বনা (পর্ব-১)
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

চলচ্চিত্রিক মানসিকতা–৭

শুটিং বিড়ম্বনা (পর্ব-১)

মনের ক্ষমতা (পর্ব-২)-এর পর থেকে-

তখনও আমি শুধুই সিনেমার দর্শক, তবে সিনেমাকে বোঝার বাতিকটা পুরো মাত্রায় রয়েছে। জানলাম চলচ্চিত্র নির্মাণের পুরো প্রক্রিয়াটাকে নাকি মোট তিন ভাগে ভাগ করা হয়। প্রি-প্রোডাকশন (Pre-Production), প্রোডাকশন (Production) এবং পোস্ট প্রোডাকশন (Post-Production)। একটু অবাক হয়েছিলাম। আমি ছাত্র ভাল নই, সে কথা জানি। কিন্তু খুব ছোট বেলা থেকে বিটিভিতে ইংরেজি সিনেমা আর সিরিয়াল দেখে দেখে ইংরেজিটা ভালোই বুঝি।

অভিধানগত ভাবে প্রোডাকশন মানে হল উৎপাদন বা প্রযোজনা। তাই যদি হয়, তবে পুরো সিনেমাটাই তো একটি উৎপাদন বা প্রযোজনা। বিভিন্ন সিনেমার শেষে তো দেখি লেখাও থাকে- একটি অমুক প্রযোজনা বা ইটস এ তমুক প্রোডাকশন। তাহলে পোস্ট প্রোডাকশন বিষয়টা কি? প্রি-প্রোডাকশন বিষয়টা না হয় বুঝলাম সিনেমাটা র্নিমাণের আগের প্রস্তুতি।

আমার জন্যে তখনও চমক বাকি ছিল। সিনেমা বানানোর সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে শুটিং শুরু করার আগ পর্যন্ত যত আয়োজন আছে, যেমন, স্ক্রীপ্ট লেখা, অভিনয় শিল্পী ঠিক করা, রিহার্সেল, লোকেশন বাছাই, লাইট ক্যামেরা গাড়ি এই সব রিকুজিশন করা ইত্যাদি সবই প্রি-প্রোডাকশনের আওতাভুক্ত। আর পোস্ট প্রোডাকশন হল- এডিটিং, ডাবিং, মিউজিক, কালার গ্রেডিং, ফলি ইত্যাদি। এই দুইয়ের মাঝে যে কাজটি বাকি থেকে যাচ্ছে, অর্থাৎ শুটিং, সেটাকেই নাকি বলা হচ্ছে প্রোডাকশন।

সাধারণ মানুষদের জন্যে বিষয়টা নিঃসন্দেহে বিভ্রান্তিকর। এক জায়গায় পুরো সিনেমাটাকে বলা হচ্ছে প্রোডাকশন, সিনেমার শেষে ঘটা করে সেটা লিখেও দেয়া হচ্ছে। আবার শুধু শুটিংকেও বলা হচ্ছে প্রোডাকশন। এ কেমন কথা?

বিষয়টাকে একটু ঘুরিয়ে ব্যাখ্যা করি। যারা স্কুল জীবনে সাইন্সের ছাত্র ছিলেন তারা নিশ্চয় জানেন যে ভর আর ওজন এক জিনিস নয়। ভরের সাথে যখন মধ্যাকর্ষণ শক্তির মান যুক্ত হয় তখন সেটাকে ওজন বলা হয়। সুতরাং এক কেজি ওজনের ব্রয়লার মুরগী দাও অথবা আমার ওজন ৬০ কেজি, এই কথাগুলো সব সময় সঠিক নয়। অন্ততঃ সাংসারিক জীবনে সঠিক হলেও সাইন্স ল্যাবে সেটা বেশ বড় রকমের একটি ভুল। অর্থাৎ আমাদের আটপৌরে ভাষা আর সাইন্সের ভাষা সব সময় এক নয়। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও বিষয়টা সত্য।

ক্যাপ্টেন অফ দা শিপ হিসাবে একটি চলচ্চিত্রের ভালো বা মন্দ কোন কিছুর দায়ই একজন পরিচালক এড়াতে পারে না, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাস্তব জীবনে কখনও কোন পরিচালককে আমি তার নিজের দোষ স্বীকার করতে দেখিনি। তাদের ভাষ্যমতে, সব দোষ হয় অভিনেতার নয়ত ক্যামেরাম্যানের নয়ত প্রডিউসারের নয়ত পাশের বাড়ির কালো কুকুরটার অথবা তাল গাছে বাসা বাঁধা বাবুই পাখিটার, কিন্তু কোন ভাবেই নিজের নয়।

সাধারণ ভাবে অবশ্যই পুরো সিনেমাটা একটি প্রোডাকশন বা প্রযোজনা। তাই সিনেমার শেষে ‘একটি অমুক প্রযোজনা’ কথাটি জুড়ে দেয়াও যুক্তিযুক্ত। কিন্তু যারা নির্মাণের সাথে জড়িত তাদের কাছে শুধু মাত্র শুটিংটাই প্রোডাকশন নামে পরিচিত। কারণ, মানেন আর না মানেন শুটিংয়ের সময়ই র্নিধারিত হয়ে যায় আপনার নির্মাণটি সিনেমা হবে নাকি অ-সিনেমা হবে। বিষয়টার বিশদ ব্যাখ্যা জরুরি। কারণ শুটিং সম্বন্ধে অনেকেরই বেশ কিছু মারাত্মক ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, যা আমাদের চলচ্চিত্র বিকাশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের একটি অন্তরায়।

একজন সৃজনশীল মানুষের কাছে তার যে কোন সৃষ্টিই আপন সন্তানের মত। অনেক ক্ষেত্রে তা সন্তানের চেয়েও বেশি। একজন বাবার কখনও গর্ভধারণের অনুভুতি উপলব্ধি করার সুযোগ নেই। কিন্তু একজন সৃজনশীল মানুষ, হোক সে নারী, হোক সে পুরুষ, প্রতিটি সৃষ্টিই তাকে গর্ভধারণের মত অনুভূতি দেয়।

একজন মানব শিশুর জন্মের প্রক্রিয়াটি শুরু হয় ভালোবাসাবাসি থেকে। এক্ষেত্রে অবশ্য বিবাহ বিষয়টি সমাজ ভেদে একটি গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বহীন অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়। তো, সেই ভালোবাসাবাসির মাঝে থাকে অনেক বাছ-বিচার। এর সাথে না ওর সাথে। এ হলে খুব ভালো হয়, কিন্তু তাতে আবার ঐ সমস্যা। সে যদিও সাদামাটা কিন্তু ঐ সমস্যাগুলো তার নেই। এমনি নানান পরিকল্পনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলোচনা পর্যালোচনা। সেই আলোচনা পর্যালোচনায় একাধিক মানুষের যুক্ত হওয়া। এই সব পেরিয়ে তবেই প্রেম এবং গর্ভধারণ। র্দীঘ নয় মাসের গর্ভধারণ।

একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে স্পর্শকারত সময়। নিজের নিরাপত্তা, সন্তানের নিরাপত্তা। একটু এদিক ওদিক হলেই মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে। এই সময় মা যদি অপুষ্টিতে ভোগে, তো তার রেশ সন্তানকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। কোন রেডিয়েশনের কারণে সন্তানের যদি কোন আকার বিকৃতি ঘটে, তো সে সারা জীবন বিকলাঙ্গ হয়েই থাকবে। এবং ভুললে চলবে না যে এসবের কোন যথাযথ নিরাময় আধুনিক বিজ্ঞান এখনও আমাদের জোগান দিতে পারে নাই।

গর্ভকালীন সময়ে একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক যে গঠন র্নিধারিত হবে, প্রকৃত পক্ষে সেটাই ফাইনাল। জন্ম নেবার পরে আপনি তাকে যতই উন্নততর পরিবেশে রাখেন না কেন, কোন লাভ নেই। সন্তানটিকে আপনি নুতন কোন ক্ষতির হাত থেকে অবশ্যই রক্ষা করতে পারবেন। কিন্তু গর্ভাবস্থায় যা ক্ষতি হয়ে গেছে তার চাকাকে আপনি কোন ভাবেই আর উল্টা পথে ঘোরাতে পারবেন না। একই ভাবে শিশুটি যদি সুস্বাস্থ্য নিয়ে জন্মায় তবে খারাপ পরিবেশ বা খারাপ পরিচর্যা ছাড়া তাকে নিয়ে আর চিন্তা করার তেমন কিছুই নেই। বরং একটু যত্ন নিলেই সে চমৎকার একজন মানুষ হিসাবে গড়ে উঠবে।

গর্ভধারণের আগের যত আয়োজন, লাফ ঝাঁপ, হৈ চৈ সবগুলোকে আপনি র্নিদ্বিধায় প্রি-প্রোডাকশন বলতে পারেন। গর্ভধারণের নয় মাস হল প্রোডাকশন- নির্মাণের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ সময়। আর জন্মের পরে শিশিুটিকে কি ভাবে মানুষ করবেন, সেটা পোস্ট প্রোডাকশন।

প্রি-প্রোডাকশনে গলদ থাকলে বা ভুল লোককে ভালোবাসলে গর্ভাবস্থায় যে সুযোগ সুবিধাটা একান্ত জরুরি, তা থেকে আপনি বঞ্চিত হবেন। হয়ত ভাত (শারীরিক চাহিদা) নিয়ে, নয়ত ভালবাসা (মানসিক চাহিদা) নিয়ে সমস্যায় আপনাকে পড়তেই হবে। যার ফলে আপনার অনাগত শিশুটি হয় শারীরিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে, নয়ত মানসিক ভাবে। সুতরাং মজবুত প্রি-প্রোডাকশন যে খুবই জরুরি, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও সৃষ্টি বা নির্মাণের মূল কাজটুকু ঘটে মূলতঃ নয় মাসের গর্ভাবস্থায়।

শুটিং বিষয়টা প্রকৃতপক্ষে গর্ভধারণের মত। এখানে যা কিছু ঘটবে ওটাই ফাইনাল। সেটাকে আপনি পোস্ট প্রোডাকশনে গিয়ে তেমন একটা পাল্টাতে পারবেন না। অবশ্যই আপনার সযত্ন পরিচর্যার প্রয়োজন রয়েছে একটি অবোধ শিশুকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্যে। কিন্তু শিশুটি, শিশু থেকে কতটা মানুষ হতে পারবে, তার পরিধিটুকু র্নিধারিত হয়ে যায় গর্ভাবস্থায়।

শুটিং বিষয়টা প্রকৃতপক্ষে গর্ভধারণের মত। এখানে যা কিছু ঘটবে ওটাই ফাইনাল। সেটাকে আপনি পোস্ট প্রোডাকশনে গিয়ে তেমন একটা পাল্টাতে পারবেন না। অবশ্যই আপনার সযত্ন পরিচর্যার প্রয়োজন রয়েছে একটি অবোধ শিশুকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্যে। কিন্তু শিশুটি, শিশু থেকে কতটা মানুষ হতে পারবে, তার পরিধিটুকু র্নিধারিত হয়ে যায় গর্ভাবস্থায়। আপনার ফুটেজ বা ডাটা ফাইল যত ভাল হবে, এডিট প্যানেলে তাকে তত সুন্দর করে সাজাবার সুযোগ থাকবে। যদি ফুটেজ খারাপ হয়, তো হাজার চেষ্টা করলেও একটা পর্যায়ের বেশি আপনি তাকে সাজাতে পারবেন না। সেই সাথে সময় বেশি লাগবে, বাজেট বাড়বে।

সুতরাং ভাল শুটিংই যে একটি নির্মাণের বা প্রোডাকশনের আসল ভিত্তি, সেটা বোধ করি বুঝতে আর কারো বাকি নেই। যদি এখনও কেউ না বুঝে থাকেন এবং ভাবতে থাকেন যে, পোস্ট প্রোডাকশনে বসে সব সাইজ করে দেব। এখন আপাততঃ যেভাবে হোক শুটিংটা শেষ করি, তো তার প্রতি আমার গভীর সমবেদনা তোলা রইল।

মোদ্দা কথা হল, একজন দর্শকের চোখে যা প্রোডাকশন (পূর্ণাঙ্গ সিনেমা), একজন নির্মাতার কাছে শুধু মাত্র সেই প্রোডাকশনটির নির্মাণ প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তরটিই (শুটিং) প্রোডাকশন হিসাবে পরিচিত। বলাই বাহুল্য, শুটিং বিষয়টির প্রকৃত গুরুত্ব বোঝানোর জন্যেই এমন নামকরণ।

তো, শুটিং করতে যেয়ে বাংলাদেশের বর্তমান পেক্ষাপটে আমাদের কি কি বিড়ম্বনার স্বীকার হতে হয়, আমার এবারের রচনাটি তা-ই নিয়ে। বলে রাখা ভালো, এর অধিকাংশই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে গৃহীত।

যদিও ক্যাপ্টেন অফ দা শিপ হিসাবে একটি চলচ্চিত্রের ভালো বা মন্দ কোন কিছুর দায়ই একজন পরিচালক এড়াতে পারে না, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাস্তব জীবনে কখনও কোন পরিচালককে আমি তার নিজের দোষ স্বীকার করতে দেখিনি। তাদের ভাষ্যমতে, সব দোষ হয় অভিনেতার নয়ত ক্যামেরাম্যানের নয়ত প্রডিউসারের নয়ত পাশের বাড়ির কালো কুকুরটার অথবা তাল গাছে বাসা বাঁধা বাবুই পাখিটার, কিন্তু কোন ভাবেই নিজের নয়।

যতটা বুঝি আমার এই লেখার পাঠকরা অধিকাংশই তরুণ পরিচালক বা পরিচালক হতে চাওয়া তরুণ, তাই পরিচালকদের কারণে যে সব বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয় সেগুলো না হয় শেষেই উল্লেখ করব। শুরুটা করছি তবে নায়ক-নায়িকা সৃষ্ট বিড়ম্বনা দিয়ে। আশা করছি, পাঠকদের এটা বেশী আকৃষ্ট করবে।

চলবে…

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.