:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
ইহতিশাম আহমদ

পরিচালক, সমালোচক

মনের ক্ষমতা (পর্ব-১)
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

চলচ্চিত্রিক মানসিকতা-৬

মনের ক্ষমতা (পর্ব-১)

পরিচালনা সমাচার (পর্ব-২)-এর পর থেকে-

“হাসিতে তার মুক্তো ঝরে”- এটা নায়িকার অসাধারণ হাসির বর্ণনা। গল্প বা উপন্যাসে লেখক তো এই বর্ণনা দিয়েই খালাস। কিন্তু এই পরিস্থিতিটি আপনি আপনার চলচ্চিত্রের পর্দায় ফুটিয়ে তুলবেন কেমন করে? খুবই সহজ কিছু টোটকা বুদ্ধি দেই। হয়ত আপনাদের পছন্দ হবে। প্রথমে নায়িকার সুন্দর চেহারাটি দেখাবেন তারপর আপনার সহকারীকে বলবেন ক্যামেরার লেন্সের সামনে ঝুর ঝুর করে অনেকগুলো মুক্তোর দানা ছেড়ে দিতে। নায়িকার হাসি আর ঝরে পড়া মুক্তো, এ দুটো মিলিয়ে দর্শক নিজ দায়িত্বে বুঝে নেবে নায়িকার হাসিতে মুক্তো ঝরে। অথবা আরো সহজ একটা কাজ করতে পারেন। পর্দায় নায়িকা যখন হাসবে, তার নিচে বড় বড় অক্ষরে লিখে দেবেন, “প্রিয় র্দশক, এটা কিন্তু আমাদের নায়িকার মুক্তো ঝরা হাসি। আপনারা সবাই অবিভুত হোন।”

অথবা ধরেন, নায়কের উচ্চতা ভীতি আছে। আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্য নায়ক বাড়ির ছাদের উপরে অস্ত্র হাতে চোর বা অপরাধীকে তাড়া করছে। বহুতল বিশিষ্ট এক ভবন থেকে অন্য ভবনে লম্বা একটা লাফ মেরে চোর পগার পার হয়ে গেল। কিন্তু নায়ক লাফ মারতে গিয়ে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে থেমে গেল। এই ভয় পাওয়ার বিষয়টি আপনি কি ভাবে দেখাবেন? নায়কের মুখে ডায়লগ জুড়ে দিয়ে খুব সহজেই এই সমস্যার সমাধান করা যায়। যেমন, নায়ক নিচের দিকে তাকিয়ে বলবে, “ওরে বাবারে, কত্ত নিচু! ভয় পাইছি।” অবশ্য একজন পূর্ণ বয়স্ক এবং হাইলি ট্রেইণ্ড পুলিশ অফিসারের মুখে এমন ডায়লগ মানাবে কিনা এই নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সেক্ষেত্রে এখানেও দৃশ্যের নিচে লিখে দেয়া যায়, “প্রিয় র্দশক, আমাদের নায়কের উচ্চতা ভীতি রয়েছে। তাই সে লাফ দিতে পারল না। সরি।”

এত সব না হয় বাদই দিলাম। দৃশ্যটা যদি এমন হয় যে, নায়িকার চোখের তারায় নায়কের জন্যে গভীর প্রেম খেলা করে, তখন কি করবেন? নায়িকার চোখের গ্রহ নক্ষত্রের মাঠে খেলাধুলা করা এই প্রেমটুকু আপনি পর্দায় ক্যামনে দেখাবেন? একজন অভিনেতা হিসাবে জানি এ বড়ই জটিল কাজ। এক্টিং ইজ বিলিভিং। বুকের মাঝে প্রেম না থাকলে চোখের তারায় তা নিয়ে আসা পাথরে ফুল ফোটানোর মত ব্যপার। শুধু চোখ দিয়ে এই অভিনয় করার উপায় আয়ত্বে আনতে আনতে অনেকেই বুড়ো হয়ে যান। কিন্তু বুড়ো নায়ক নায়িকা তো আমাদের দর্শক নেবে না। তাহলে?

সমাধান হিসাবে নায়ক নায়িকাকে প্রেডাকশনের খরচে দু মাসের জন্যে কক্সবাজারে হানিমুন করতে পাঠাতে পারেন, যাতে করে তাদের মাঝে কড়া একটা প্রেম তৈরী হয়। কিন্তু প্রেম ভালবাসার উপরে তো কারো নিয়ন্ত্রণ নেই, দুই মাসের মধ্যে নায়িকার চোখের তারায় উথলে উথলে পড়বার মত প্রেমের জন্ম যদি না হয়, তখন? তাছাড়া, নায়কের বউ যে এই দুই মাসে আপনার প্রোডাকশন হাউজের নামে ২/৪টা মামলা ঠুকবে না, তারই বা কি গ্যারান্টি? সুতরাং শেষ ভরসা হিসাবে এখানেও পর্দার এক কোনে লিখে দিতে পারেন, “ইহা একটি অতি রোমান্টিক দৃশ্য। আপনারা সকলে দয়া করিয়া রোমাঞ্চিত হউন।”

প্রশ্ন হল, কাজ হবে এমন প্রচেষ্টায়? দর্শক নেবে সেই সিনেমা? উত্তরটা নিশ্চিত ভাবেই- না।

নায়িকার হাসি আর ঝরে পড়া মুক্তো, এ দুটো মিলিয়ে দর্শক নিজ দায়িত্বে বুঝে নেবে নায়িকার হাসিতে মুক্তো ঝরে। অথবা আরো সহজ একটা কাজ করতে পারেন। পর্দায় নায়িকা যখন হাসবে, তার নিচে বড় বড় অক্ষরে লিখে দেবেন, “প্রিয় র্দশক, এটা কিন্তু আমাদের নায়িকার মুক্তো ঝরা হাসি। আপনারা সবাই অবিভুত হোন।”

দর্শককে আপনার সিনেমাটা গ্রহণ করাতে হলে আপনাকে এমন কিছু করতে হবে যাতে করে দর্শক নিজে থেকেই বলবে বাহ্ মেয়েটার হাসিটা তো চমৎকার। কিংবা বিল্ডিংয়ের ধারে দাঁড়ানো নায়ককে দেখে দর্শক নিজেই মুখ ফসকে বলে উঠবে, “গেছিল রে আরেকটু হলে।” অথবা নায়িকাকে নায়কের চোখে চোখ রাখতে দেখে দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মত হলের রূপালি পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকবে। আশে পাশের কেউ কথা বলার চেষ্টা করলেই বিরক্ত হয়ে বলবে, “চুপ করেন তো ভাই, দেখতে দেন।” তবেই না আপনি সফল।

দর্শকদের এমন প্রতিক্রিয়া পৃথিবীর অসংখ্য সিনেমা অসংখ্যবার অর্জন করেছে। কিন্তু বর্তমানের বেশির ভাগ বাংলাদেশী সিনেমা কেন দর্শকদের এমন প্রতিক্রিয়া থেকে বঞ্চিত তা নিয়েই আমার আজকের এই রচনা। আলোচনার সুবিধার্থে অতি সংক্ষেপে জানিয়ে দেই উপরের আলোচিত পরিস্থিতিগুলোতে আদতে কি কি করা হয়।

হাসিতে তার মুক্তো ঝরে- এখানে সফ্ট লাইট ব্যবহার করতে হয়। আলো বা রংয়ের কনট্রাস্ট কম রাখা হয়। সেই সাথে অতীতকালের র্নিমাতারা লেন্সে এক ধরনের ফিল্টার ব্যবহার করত, যার ফলে নায়িকার দাঁতসহ পুরো চেহারায় এক ধরনের আলোকিত আভা যুক্ত হত। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন পুরো সিনেমাতে নায়িকাকে যেমনই দেখান না কেন, র্নিদিষ্ট এই দৃশ্যটিতে নায়িকাকে জোর্তিময় বা আলোকিত আভা যুক্ত দেখায়। বর্তমান কালেও সফ্ট লাইট এবং কম কন্ট্রাস্ট ব্যবহার করা হয়। তবে ফিল্টারের ব্যবহারটুকু কমে গেছে। তার বদলে এডিট প্যানেলে কালার গ্রেডিং করার সময় নায়িকার দাঁতগুলোকে একটু বেশি চকচকে করে দেয়া হয়। সেই সাথে দাঁতের সারির এক কোনে ছোট্ট করে একটা লেন্স ফ্লেয়ার এফেক্ট যুক্ত করে দেয়া হয়। এই কাজটুকু খুব সুচারু ভাবে না করলে অবশ্য দৃশ্যটা হাস্যকর হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।

নায়কের উচ্চতা ভীতি- আলফ্রেড হিচককের ভার্টিগো সিনেমাটা কে কে দেখেছেন? সেখানে হিচকক প্রথম বারের মত ক্যামেরা নামক যন্ত্রটিকে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করেন। যা পরবর্তিতে ভার্টিগো এ্যফেক্ট নামে র্নিমাতাদের কাছে জনপ্রিয়তা পায়। একই সাথে জুম ইন এবং ব্যাক ট্রলি করার কারণে দৃশ্যটির মাঝে আলাদা একটা মাত্রা যুক্ত হয়। দর্শক যেন নায়কের মনের উচ্চতা ভীতিটুকু নিজের মাঝেই উপলব্দী করে। এই ‘জুম ইন প্লাস ব্যাক ট্রলি’ অথবা ‘জুম আউট প্লাস ফ্রন্ট ট্রলি’ পদ্ধতিটুকু আজও পরিচালকদের কাছে সমান ভাবে জনপ্রিয়।

নায়িকার চোখের তারায় প্রেম- কাজটা খুব সহজ। ছোট্ট কিন্তু মোটামোটি তীব্র একটা লাইট সরাসরি নায়িকার চোখের উপরে মারেন, ব্যাস। নায়িকার বোবা চোখ কথা বলতে শুরু করবে। অবশ্য নায়িকাকে মিনিমাম প্রেমের অভিনয়টুকু করতেই হবে। এখানে কোন মাফ নাই।

এবার আসা যাক সেই কোটি টাকা দামী প্রশ্নে, আমাদের দেশের চলচ্চিত্রে এসব পদ্ধতি কেন ব্যবহার করা হচ্ছে না? হচ্ছে না, কারণ অনেকেই বিষয়গুলো জানেন না। আর কেউ কেউ জানার পরেও তা ব্যবহার করার তাগিদ অনুভব করেন না। প্রথমেই যারা জানে না তাদের নিয়ে কথা বলা যাক।

ছোট্টবেলায় স্কুলের স্যার আপারা পঁই পঁই করে আমাদের শিখিয়েছিলেন, না জানাটা অপরাধ নয়, কিন্তু জানতে না চাওয়াটা অপরাধ। তারপরও কেন আমাদের দেশের তরুণ পরিচালকেরা পর্যাপ্ত না জেনেই সিনেমা বানানোর কাজে হাত দিচ্ছেন? এর কারণ কয়েকটি। অনেকেই আছেন যারা মোটেও সিনেমা নিয়ে ভাবেন না। কিন্তু শো বিজনেসের আলোকোজ্জ্বল পরিবেশে নিজেকে দেখতে চান। সেই সাথে তাদের নিজেদের টাকা আছে বা টাকা সংগ্রহ করার সামর্থ আছে।

ছোট্টবেলায় স্কুলের স্যার আপারা পঁই পঁই করে আমাদের শিখিয়েছিলেন, না জানাটা অপরাধ নয়, কিন্তু জানতে না চাওয়াটা অপরাধ। তারপরও কেন আমাদের দেশের তরুণ পরিচালকেরা পর্যাপ্ত না জেনেই সিনেমা বানানোর কাজে হাত দিচ্ছেন? এর কারণ কয়েকটি। অনেকেই আছেন যারা মোটেও সিনেমা নিয়ে ভাবেন না। কিন্তু শো বিজনেসের আলোকোজ্জ্বল পরিবেশে নিজেকে দেখতে চান। সেই সাথে তাদের নিজেদের টাকা আছে বা টাকা সংগ্রহ করার সামর্থ আছে শুধু মাত্র এই কারণেই তাদের পরিচালক হিসাবে চলচ্চিত্রের মাঠে অবর্তীণ হওয়া। শুধুমাত্র গ্লামার জগতে বসবাস করাই যাদের আকাংখা, তাদের নিয়ে আলোচনা র্দীঘায়িত করার কিছু নাই। কিন্তু অনেকেই আছে যারা মনে প্রাণে চলচ্চিত্রকে ভালবাসেন বলেই পরিচালনায় হাত দিয়েছেন। তারাও যখন জানার বা শেখার গভীরতা ছুঁতে চান না তখন মনের মাঝে বিষ্ময় জাগাটা অবান্তর নয়। প্রকৃত পক্ষে সমস্যাটা অনেক গভীরে প্রথিত।

জাতিগত ভাবে আমরা বিশ্বাস করি- “শিল্পের কোন ফরমুলা হয় না। শিল্প আসে মনের অনুভুতি বা চেতনা থেকে।” আমরা আরো বিশ্বাস করি “যন্ত্র এবং যান্ত্রিকতা আমাদের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।” আমাদের মাঝে অধিকাংশ শিল্প মনষ্ক মানুষই ‘ফিরিয়ে দাও সেই অরণ্য’ গোছের সাধনায় লিপ্ত। আর সিনেমা যেহেতু বিরাট বড় একটা শিল্প, তাই যুগ যুগ ধরে প্রতিষ্ঠিত ফরমুলাগুলোকে ব্যবহার করার চেয়ে মনের ক্ষমতা এবং মাধুর্য্যের প্রয়োগ ঘটাতেই আমাদের তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালকরা বেশী আগ্রহী। অনেককেই মুখ চোখ শক্ত করে বলতে শুনি, আমি মন থেকে এই সিনেমাটা বানিয়েছি বা সিনেমাটা বানানোর ক্ষেত্রে আমার আন্তরিকতার কোন ঘাটতি ছিল না।

হয়ত ছিল না। কিন্তু তাতে তো আপনার সিনেমাটা সুন্দর আর আর্কষণীয় হয়ে যাচ্ছে না। ক্যামেরার নিজের একটা ভাষা আছে, ব্যাকরণ আছে। লাইট, সাউন্ড, সেট, কস্টিউম, এডিটিং এ সব কিছুরই নিজেস্ব ভাষা ও নিয়ম নীতি আছে। সেগুলোর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমেই কেবল আপনি আপনার চলচ্চিত্রকে দর্শক বোধগম্য ও আকর্ষনীয় করে তুলতে পারবেন। চলচ্চিত্র কোন যাদু বিদ্যার চর্চা নয় যে সাদা মনে বা সাচ্চা দিলে মন্ত্র পড়বেন আর সিনেমা তৈরী হয়ে যাবে।

ভেবে দেখেন তো, আপনি যদি আপনার ক্যামেরাটাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে, খুব করে আদর করে বলেন, ‘বাবা ক্যামেরা, আমি এখন কিছু কান্নার শট নেব। তুই এমন সব ছবি আমাকে তুলে দে যা দেখে র্দশক কাঁদতে কাঁদতে হল ভাসিয়ে দেবে।’ ক্যামেরা কি আপনার আদরে গলে গিয়ে ভাল ভাল সব শট নেয়া শুরু করবে?

অথবা এডিট প্যানেল ছুঁয়ে বারবার কদমবুচি করে যদি বলেন যে, ‘বাবা এডিট প্যানেল তোর সাথে আমি আমার সুন্দরী যুবতী কনিষ্ঠ কন্যাটির বিয়ে দেব। যদি চাস তো আমার সবগুলো মেয়ের সাথেই তোর বিয়ে দেব। তুই শুধু আমাকে পার করে দে। এমন এডিট করে দে যেন র্দশক চোখ ফেরাতে না পারে।’ কাজ হবে?

ভাই মানলাম, আপনার মনের ক্ষমতা অনেক। সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে আপনি পাড়ার সেরা সুন্দরীটিকে আপনার প্রেমে পড়তে বাধ্য করতে পারেন। আপনার অবাধ্য সন্তানকে পড়াশুনার প্রতি আগ্রহী করতে পারেন। এমন কি আপনার শিল্প কারখানার শ্রমিক আন্দোলন পর্যন্ত থামিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু বিশ্বাস করেন এই এত ক্ষমতাধর আপনি কোন ভাবেই মনের ক্ষমতা দিয়ে আপনার ক্যামেরা, লাইট বা এডিটি প্যানেলকে বশে আনতে পারবেন না। কারণ যন্ত্রের কোন মন নেই। মন দিয়ে কেবল মনকেই বশ করা যায়। যন্ত্রকে বশ করতে হলে তার জন্যে র্নিধারিত নিয়মগুলোই মানতে হয়। যন্ত্রের ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতাগুলোকে বুঝতে হয়। প্রয়োজনীয় বিজ্ঞানটা উপলব্ধি করতে হয়। সেই বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হয়। হলিউড, বলিউড, ইরান বা কোরিয়াসহ প্রায় সব দেশের র্নিমাতারা তা-ই করেন।

চলবে…

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.