:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
সৈয়দ নাজমুস সাকিব

চলচ্চিত্র সমালোচক

অনির্দিষ্ট গন্তব্যের যাত্রা

অনির্দিষ্ট গন্তব্যের যাত্রা

‘জয়যাত্রা’ ২০০৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, তৌকীর আহমেদ পরিচালিত একটি মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা।

মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা বললেই আমাদের মাথায় একটি বিশেষ ধারণা চলে আসে। এই ধারণা আমরা নিজেরা তৈরি করিনি, আমাদের মাথায় অনেকটা জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে বলা যায়। মুক্তিযুদ্ধ মানেই কিছু গোলাগুলির দৃশ্য, নারী-শিশুদের ওপর অত্যাচারের দৃশ্য, কিছু পাকিস্তানি মেরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লাসের দৃশ্য, অনেকটা এ রকম হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার কাঠামো। কিন্তু আসলেই কি মুক্তিযুদ্ধ মানে শুধু ঘুরেফিরে এগুলোই? মুক্তিযুদ্ধ তো আরও বড় কিছু! সে বড় কিছুর কতটা ধরা পড়েছে ‘জয়যাত্রা’ সিনেমায়? দেখা যাক।

সিনেমার নামের মধ্যেই সিনেমার মূল অংশটা বলে দেওয়া হয়েছে। ‘জয়যাত্রা’ শব্দটাকে আমরা যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে দাঁড়ায়, জয়ের জন্য যে যাত্রা, সেটাই জয়যাত্রা। সুতরাং সিনেমাতে একটি যাত্রা বা জার্নি দেখানো হবে। তবে জয়ের জন্য যে যাত্রা, সেই যাত্রা কি এতই সোজা? তাও আবার ১৯৭১-এর মতো বিপৎসংকুল পরিবেশে।

কাহিনিটা একটু জেনে নেওয়া যাক।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ। যুদ্ধের বিভীষিকা যখন ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। হাজার বছরের শাশ্বত বাংলা মুহূর্তেই পরিণত হয় বিরান শ্মশানে। প্রাণভয়ে পলায়নরত একদল সাধারণ মানুষ আশ্রয় নেয় একটি নৌকায়। তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যায় গল্প, কিন্তু শুধু বেঁচে থাকা নয়, ক্রমেই রুখে দাঁড়ানোর স্পৃহা জাগ্রত হয় তাদের হৃদয়ে। এই নিয়েই এগিয়ে চলে জয়ের জন্য যাত্রা, ‘জয়যাত্রা’।

‘জয়যাত্রা’ ছবির দৃশ্যে আবুল হায়াত, তারিক আনাম খান ও হুমায়ুন ফরীদি।

আপাতদৃষ্টিতে খুব নিরীহ এক কাহিনি অসাধারণ হয়ে উঠেছে তৌকীর আহমেদের অসাধারণ স্ক্রিনপ্লে আর পরিচালনার কারণে। তৌকীর আহমেদের সিনেমার আরেকটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, তিনি সব সময় এমন সব অভিনেতা নিয়ে কাজ করেন, যাদের অভিনয়প্রতিভা নিয়ে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ থাকে না এবং তৌকীর আহমেদের সিনেমার ৭০ শতাংশ কাজ হয়ে যায় এই অসাধারণ অভিনেতাদের জন্যই। অভিনেতাদের নামের দিকে খেয়াল করলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন: আবুল হায়াত, আজিজুল হাকিম, বিপাশা হায়াত, মাহফুজ আহমেদ, তারিক আনাম খান, হুমায়ুন ফরীদি, ইন্তেখাব দিনার, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, শামস সুমন, মোশাররফ করিম। এরা যদিও আলাদা কোনো ব্যক্তি বা অভিনেতা নন, প্রত্যেকেই যেন আলাদা এক একটি অভিনয়ের প্রতিষ্ঠান।

নৌকা নিয়ে একদল নিরীহ যাত্রীর অনির্দিষ্ট গন্তব্যের যাত্রা, এই থিমে ২০০৪ সালেই আরেকটি সিনেমা রিলিজ পায়, হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত সেই সিনেমার নাম ‘শ্যামল ছায়া’। যদিও নৌকার থিম বাদে বাকি সব দিক থেকেই দুটি সিনেমা একদম আলাদা। ‘শ্যামল ছায়া’র কাহিনি, চিত্রনাট্য, পরিচালনা, সব হুমায়ূন আহমেদ একা সামলালেও ‘জয়যাত্রা’র ক্ষেত্রে সেটা ছিল না। আমজাদ হোসেনের কাহিনি থেকে চিত্রনাট্য ও পরিচালনার কাজ সামলেছেন তৌকীর আহমেদ।

উদাহরণ দিলে জিনিসটা পরিষ্কার হবে কিছুটা। যে রামকৃষ্ণ (আবুল হায়াত) মুসলমানের স্পর্শ পেলেই বলেন, জাত গেল! সেই রামকৃষ্ণের নাতিকে যখন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে, আর তার ছেলের বউ দুধ খাওয়াতে পারছেন না, তখন হাওয়া (বিপাশা হায়াত) অনেকটা জোর করে সেই দুধের শিশুকে দুধ খাওয়ান! আবুল হায়াত তখন, আরে করো কী! করো কী! বলে চিৎকার করে উঠলেও পরে নিজের কাছেই ছোট হয়ে যান। হাতে থাকা দেবীর ছোট মূর্তিটা পানিতে ফেলে দিয়ে বিপাশার দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমিই তো দেবী! আসল দেবী!

‘জয়যাত্রা’ সিনেমার প্রধান দিক হচ্ছে, প্রায় প্রতিটি চরিত্র নিয়ে পরিচালক অনেক বেশি খেলেছেন, বিপদে পড়ার আগমুহূর্তে তাদের মন-মানসিকতা আর বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে বা বিপদ থেকে উদ্ধারের পর তাদের মন-মানসিকতার যে পরিবর্তন, নিজের দ্বৈত সত্তার সাথে যে সংঘর্ষ, সেটা অনেক সুনিপুণভাবে এই সিনেমাতে পরিচালক আর অভিনেতাদের মুনশিয়ানাই উঠে এসেছে।

উদাহরণ দিলে জিনিসটা পরিষ্কার হবে কিছুটা। যে রামকৃষ্ণ (আবুল হায়াত) মুসলমানের স্পর্শ পেলেই বলেন, জাত গেল! সেই রামকৃষ্ণের নাতিকে যখন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে, আর তার ছেলের বউ দুধ খাওয়াতে পারছেন না, তখন হাওয়া (বিপাশা হায়াত) অনেকটা জোর করে সেই দুধের শিশুকে দুধ খাওয়ান! আবুল হায়াত তখন, আরে করো কী! করো কী! বলে চিৎকার করে উঠলেও পরে নিজের কাছেই ছোট হয়ে যান। হাতে থাকা দেবীর ছোট মূর্তিটা পানিতে ফেলে দিয়ে বিপাশার দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমিই তো দেবী! আসল দেবী!

প্রচণ্ড বিপদে পড়া শামস সুমন একসময় বলে ওঠেন, আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবান, এরা কই? এরা কি আসলেই আছে? এরা আমাদের এত কষ্ট দিচ্ছেন কেন? ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান থাকা এই শামস সুমন নিজের গর্ভবতী স্ত্রীকে আবার সাহস দেওয়ার সময় বলেন, চিন্তার কিছু নাই, আল্লাহ সব ঠিক করে দেবেন!

‘জয়যাত্রা’ ছবির পোস্টার।

নৌকার এক যাত্রী মারা গেলে আবুল হায়াত বলে ওঠেন, যা হয় ভালোর জন্য হয়। যা হয়েছে, ভালোর জন্য হয়েছে। অথচ এই আবুল হায়াতের নিজের কেউ মারা গেলে তিনি বলে ওঠেন, যা হয় তার ভালোর জন্য হয় না, যা হয়েছে সেটা ভালো হয় নাই! চরিত্রের এমন বিচিত্র বিশ্লেষণ খুব কম বাংলাদেশি সিনেমাতেই দেখা গেছে।

এই সিনেমাতে আদর্শের দ্বন্দ্বও দেখানো হয়েছে, কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ, সেই জিনিসকেও নতুন করে প্রশ্ন করা হয়েছে। নৌকার যাত্রীদের খাওয়ার জন্য যখন মাহফুজ আহমেদ গ্রামবাসীর ঘরের তালা ভেঙে চাল ডাল সংগ্রহের চেষ্টা করছেন, তখন নৌকার মাঝি আলী সেই চাল-ডাল নিতে অস্বীকার করেন। তার মতে, এটা চুরি, আর চুরি করা জিনিস তিনি নিজের নৌকায় ওঠাবেন না। এখানেই পরিচালক দুটি চরিত্রের মাধ্যমে আমাদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, কোনটি আগে বেশি দরকার? জান বাঁচানো, নাকি নৈতিকতা?

হুমায়ূন ফরীদির চরিত্রটাও বেশ বিচিত্র এই সিনেমায়। স্ত্রী-সন্তানকে পাকিস্তানিরা মেরে ফেলেছে, একা একজন মানুষের ক্যারেক্টারে অভিনয় করেছেন তিনি। যক্ষ্মা থাকার কারণে সারাক্ষণ খুক খুক করে কাশতে থাকেন তিনি। অথচ কাশি থাকার পরও একটি খাবারের জন্য তিনি পারলে নিজের প্রাণ দিয়ে দেন, আর সেটি হচ্ছে সিগারেট! সবাই যেখানে চাল-ডাল খুঁজতে ব্যস্ত, সেখানে তিনি যত পারেন, সিগারেট নিজের সংগ্রহে রেখে দেন। সারাক্ষণ কলকাতার গুণগান করা মানুষটা একসময় আবার বলে ওঠেন, এই দেশ ছেড়ে আমি কোথায় যাব? আবারও সেই চরিত্রের দ্বৈত অবস্থা।

এবং জয়বাংলা। ‘জয়যাত্রা’ ছবির শেষ দৃশ্যপট।

তৌকীর আহমেদ বেশ যত্নের সাথে এই সিনেমাটি তৈরি করেছেন। ২০০৪ সালে মুক্তিযুদ্ধের ওপর কারিগরি দিক থেকে এমন সুনির্মিত সিনেমা অনেকটাই অপ্রত্যাশিত! ৭১ সালের রেডিওর ধারাভাষ্যকার হিসেবে তৌকীর নিজের কণ্ঠস্বর ব্যবহার করেছেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অ্যাকশন দৃশ্যগুলো বেশ ভালো ছিল। রফিকুল বারী চৌধুরীর সিনেমাটোগ্রাফিও দারুণ ছিল। ৭১ সালে মানুষ যে ক্যাপসটেন সিগারেট খেত, সেই সিগারেটকেই ২০০৪ সালের সিনেমায় তৌকীর দেখিয়েছেন হুমায়ুন ফরীদির মুখে! নিঃসন্দেহে দারুণ কাজ!

তবে কিছু জিনিস চোখে লাগে। গুলি লাগার পরও রুমানা খানের এতক্ষণ বেঁচে থাকা, নৌকাতে বেশ কিছুদিন পার করলেও ইন্তেখাব দিনারের সব সময় ক্লিনশেভড গাল, এগুলো ছোটখাটো কিছু ত্রুটি।

তবে পুরো সিনেমাটি এত অসাধারণ যে এমন ছোট ত্রুটি আসলেই খুব একটা চোখে ধরা দেয় না। তবে একটি জিনিস চোখে ধরা দেয়, দারুণ স্ক্রিনপ্লে আর পরিচালনা থাকলে সীমিত বাজেটেও মুক্তিযুদ্ধের দারুণ সিনেমা বানানো যায়। আর ‘জয়যাত্রা’ তার অন্যতম সেরা উদাহরণ! তার প্রমাণ হিসেবে ‘জয়যাত্রা’ পেয়েছে দর্শক-সমালোচকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা আর ৭টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.