:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
তানভীর মোকাম্মেল

চলচ্চিত্রকার

বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমা আন্দোলন : জমা, খরচ ও ইজা
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

পর্ব : ২

বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমা আন্দোলন : জমা, খরচ ও ইজা

বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমা আন্দোলন : জমা, খরচ ও ইজা (পর্ব: ) এর পর থেকে-

অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমার মাধ্যমে একটা কাজ আমরা করতে পেরেছি; তা হচ্ছে বাণিজ্যিক সিনেমার নির্ধারিত ৩৫ মি: মি:’র বদলে ১৬ মি: মি:’তে ছবি তৈরি করে উৎপাদন শক্তিতে পরিবর্তন এনে উৎপাদন সম্পর্কেও পরিবর্তন ঘটাতে পারা। ফলে আমরা নিজেরাই আমাদের ছবির প্রিন্টের মালিক হতে পেরেছি এবং আমাদের ছবি যেখানে খুশী, যেমন খুশী প্রদর্শনের স্বাধীনতাটা অর্জন করেছি। তাছাড়া এদেশে সেলুলয়েডের বদলে ডিজিটাল মাধ্যমে ছবি তৈরি শুরু করে এফডিসি’র নানা রকম দূর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক দাসত্ব থেকেও আমরা মুক্ত থাকতে পেরেছি। আমরা সত্যিকারভাবেই হতে পেরেছি স্বাধীন নির্মাতা।

তবে দূর্বলতা যেখানে তা হচ্ছে আমাদের সব ছবির কারিগরী ও নান্দনিক মান তেমন ভাল হয়নি। অনেক ছবিই বেশ দূর্বল। কিন্তু তারপরও দর্শক আমাদের ছবি দেখতে এসেছেন। আমাদের অনেক দূর্বল ছবিকেও তারা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন। এদেশের রুচিশীল দর্শকেরা সত্যি সত্যিই চেয়েছেন যেন আমরা সফল হই। দর্শকদের শুভাশীষ আমরা তাই সব সময়েই আমাদের চারপাশে অনুভব করে এসেছি। এখনও করি।

আমরা জানি বিকল্পধারার ছবির বাজেট হতেই হবে কম। অন্যথায় কর্পোরেট পুঁজির কাছে বাঁধা পড়ে যেতে হবে। আপনি আপনার শৈল্পিক স্বাধীনতাটা হারাবেন। বিকল্প কী, আপনি তখন একজন আত্মমর্যাদাশীল শিল্পীও থাকতে পারবেন না। কর্পোরেট পুঁজির একটা সমস্যা হচ্ছে, তা সব কিছুকেই কলুষিত করে। আপনার ছবিকেও করবে। এ থেকে দূরে থাকতে হলে কম বাজেটে ছবি তৈরি করা আমাদের শিখতেই হবে। আমাদের কিছু পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি অত্যন্ত স্বল্পব্যয়ে তৈরি। আমি সব সময় বিশ্বাস করে এসেছি যে বিকল্পধারার নির্মাতাকে অর্থের জন্যে জনগণের কাছে যেতে হবে, বাণিজ্য পুঁজির কাছে নয়। জনগণের পাশে থেকে, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্যে তৈরি হতে হবে তার শিল্প। দর্শকরাই আমাদের লক্ষ্মী। সরকার বিরূপ হলেও ক্ষতি নেই। আমার একাধিক ছবি সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছিল। অন্যদেরও। এস্টাব্লিশমেন্ট আমাদের ছবির বিরোধিতা করবে সেটাই স্বাভাবিক। সে ক্ষতি সর্বনাশা নয়। কিন্তু জনগণ বিরূপ হলে বিরাট ক্ষতি। পরবর্তী ছবির জন্যে আপনি অর্থ পাবেন কোথায়! আগের ছবির ঋণই বা শোধ করবেন কী করে? তাই জনগণের কাছেই যেতে হবে। আর আমরা জানি জনগণ কেবল সিনেমা হলে থাকেন না, সিনেমা হলের বাইরেও থাকেন। থাকেন শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরির মত মিলনায়তনে, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, কলেজ-স্কুলের মাঠে, খোলা ময়দানে, মায় ফসল কাটা ধানের ক্ষেতেও। এই সব জায়গাতেই ছবি দেখানোর অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। দর্শকদেরকে আমরা কেবল পকেটওয়ালা একজন জড় জীব বলে মনে করি না। মনে করি আমাদের সহযাত্রী, আন্দোলনের সাথী। আমরা কখনোই ভুলি না যে সাধারণ দর্শকেরাই আমাদের শিল্পের লক্ষ্য, আমাদের পথ ও পাথেয়।

বিকল্পভাবে সিনেমা দেখানোর অনেক বাধার মধ্যে এদেশের সেন্সর ব্যবস্থাটাও এক বড় বাধা। বিশেষ করে রাজনৈতিক সেন্সর। প্রায় সব বিকল্পধারার নির্মাতারাই তাঁদের ছবির রাজনৈতিক বক্তব্যের কারণে সেন্সর বোর্ডের হাতে নানাভাবে ভুগেছেন। সেন্সর বোর্ড আমার নিজেরও একাধিক ছবি আটকে দিয়েছিল। “নদীর নাম মধুমতী”-র মুক্তির জন্যে আমাকে হাইকোর্টে যেতে হয়েছিল। হাইকোর্টে রীট করেই “কর্ণফুলীর কান্না” প্রামাণ্যচিত্রটিকে মুক্ত করতে হয়েছিল।

বিকল্প সিনেমার বৈশিষ্ট্য অনেকগুলিই। প্রচলিত বিষয়বস্তুগুলির বাইরের কোনো বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র, স্বল্প বাজেট, তারকাবিহীনতা, বাণিজ্যিক কাঠামোর বাইরে যেয়ে ছবি তৈরি ইত্যাদি। তবে সে সব তো যে কোনো ইন্ডিপেন্ডেন্ট চলচ্চিত্রনির্মাতার ক্ষেত্রেই সত্য। এবং পৃথিবীর সব দেশেই। বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমার যে আলাদা বৈশিষ্ট্য, এবং আমি মনে করি সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য, তা হচ্ছে এর প্রদর্শন ব্যবস্থা। নিজের ছবি নিজেই প্রজেক্টর কাঁধে করে বিভিন্ন জায়গায় দেখিয়ে বেড়ানো। এটাই বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমাকে অনন্যতা দিয়েছে। বলতে পারেন নিজস্ব উদ্যোগে বিকল্পভাবে চলচ্চিত্র প্রদর্শন, বাংলাদেশের বিকল্প ধারার এটাই সবচে’ ব্যতিক্রমী ও প্রধানতম চারিত্র্যলক্ষণ। তিরিশ বছর আগে আমাদের প্রথম দিককার ছবি ‘আগামী’-‘হুলিয়া’ থেকে অতি সাম্প্রতিক আমার ‘সীমান্তরেখা’ পর্যন্ত আমাদের ছবিগুলি আমরা এভাবেই বিকল্পভাবে সারাদেশে প্রদর্শন করে এসেছি। আর তা থেকে অর্জন করেছি অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতাই। হয়তো সেসব অভিজ্ঞতা কেবলই ইতিবাচক নয়।

তবে নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও এভাবে বিকল্পভাবে ছবি প্রদর্শনের কিছু সাফল্য তো নিঃসন্দেহে আছে। একটা বড় সাফল্য যে ছবি কত রকম হয়, কত বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের হতে পারে, সে ব্যাপারে এ দেশের দর্শকদের অভিজ্ঞতাটা বাড়ানো গেছে। তাছাড়া সিনেমা হলের বাইরে, যে কোনো মিলনায়তনেই যে চলচ্চিত্র দেখা ও দেখানো সম্ভব, এমন কি, কোনো ক্লাসরুমে, বা খোলা মাঠেও, এসব ধারণাও বিকল্পধারার নির্মাতারাই এদেশে এনেছেন। তাছাড়া প্রামাণ্যচিত্রও যে শিল্পসম্মত হতে পারে এবং দর্শকরা যে টিকিট কেটে প্রামাণ্যচিত্রও দেখতে পারেন এটাও বাংলাদেশে বিকল্পধারার নির্মাতারাই প্রতিষ্ঠা করেছেন।

তবে বিকল্প সিনেমা প্রদর্শনে যে আমরা সব সময় সফল হতে পেরেছি তা নয়। ব্যর্থতারও অনেক অভিজ্ঞতা ও উপাখ্যান আমাদের রয়েছে। কিছু ছবি সফল হয়েছে, অনেক ছবি আবার হয়ওনি। অনেক ছবিতেই দর্শক বেশ কম এসেছে। আর এখন তো দর্শকের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। তবে সামগ্রিকভাবে বিকল্পভাবে ছবি দেখানোর অভিজ্ঞতাগুলো মূলতঃ ইতিবাচক ও শিক্ষণীয়। তারেক মাসুদ ওর ‘মুক্তির গান’ ও ‘রানওয়ে’ ছবি বিভিন্ন শহর ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে সাফল্য পেয়েছিলেন। সম্প্রতি বিকল্পভাবে দেখানোর ক্ষেত্রে ‘ভুবনমাঝি’ ছবিটিরও কিছু সাফল্য আছে।

বিকল্প ছবির নির্মাতাকে হতে হয় সত্যের সাধক। জীবনের সত্যই হওয়া উচিৎ তার আরাধ্য। এখন জীবনসত্যের কাছে আপনি দু’ভাবে পৌঁছতে পারেন, কাহিনীচিত্রের মাধ্যমে, আর প্রামাণ্যচিত্রে তো বটেই। বাংলাদেশে বেশ কিছু সত্যিকারের ভালো প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হয়েছে। শ্রেণিবিভক্তি, দারিদ্র, স্বল্প গণতন্ত্র আর ধনবৈষম্যের দেশ বাংলাদেশ প্রামাণ্যচিত্রের বিষয়বস্তুর দিক থেকে বলতে পারেন এক স্বর্ণখনি বিশেষ। তাছাড়া নবীন নির্মাতাদের জন্যে চলচ্চিত্র শিক্ষার হাতেখড়ি হিসেবেও প্রামাণ্যচিত্র খুবই কার্য্যকর এক পথ। কারণ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে খুব বেশি অর্থের প্রয়োজন পড়ে না। তবে প্রামাণ্যচিত্র দেখানোর সমস্যা রয়েছে এদেশে। এবং বেশ বড় সমস্যাই। দুঃখজনক যে এদেশের প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলো বিকল্পধারার ছবিগুলো মাঝে মাঝে দেখালেও প্রামাণ্যচিত্র দেখাতেই চায় না। অথচ প্রামাণ্যচিত্র যে টেলিভিশনের দর্শক দেখে না তা’ ঠিক নয়। আমার “তাজউদ্দীন আহমদ: নিসঙ্গ সারথি” প্রামাণ্যচিত্রটি এক টেলিভিশন চ্যানেল দেখালে দর্শকদের কাছ থেকে সেই চ্যানেলে বেশ কয়েক হাজার ই-মেইল এসেছিল। সংখ্যাটি এত বেশী ছিল যে ওদের সার্ভার জ্যাম হয়ে গিয়েছিল!

‘নদীর নাম মধুমতী’র একটি দৃশ্য।

বিকল্পভাবে সিনেমা দেখানোর অনেক বাধার মধ্যে এদেশের সেন্সর ব্যবস্থাটাও এক বড় বাধা। বিশেষ করে রাজনৈতিক সেন্সর। প্রায় সব বিকল্পধারার নির্মাতারাই তাঁদের ছবির রাজনৈতিক বক্তব্যের কারণে সেন্সর বোর্ডের হাতে নানাভাবে ভুগেছেন। সেন্সর বোর্ড আমার নিজেরও একাধিক ছবি আটকে দিয়েছিল। “নদীর নাম মধুমতী”-র মুক্তির জন্যে আমাকে হাইকোর্টে যেতে হয়েছিল। হাইকোর্টে রীট করেই “কর্ণফুলীর কান্না” প্রামাণ্যচিত্রটিকে মুক্ত করতে হয়েছিল। আর সেন্সর সনদ থাকলেও যে রাষ্ট্রশক্তির দিক থেকে ছবি দেখানোর ক্ষেত্রে বাধা আসতে পারে এরকম উদাহরণও আছে। উগ্র ধর্মান্ধ শক্তির বাধার কারণে সেন্সর-পাওয়া “লালসালু” ছবিটি আমি সিলেট আর খুলনায় দেখাতে পারিনি।

তবে শুধু প্রদর্শন নয়, বাধা শুটিংয়ের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। যেমন নড়াইলে আমাদের “চিত্রা নদীর পারে” ছবির শুটিং মাঝপথে আটকে দেওয়া হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো সৃষ্টি করছিল নানা বাধা। এমন কী স্থানীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির চাপে ও প্রশাসনের মেরুদণ্ডহীনতার কারণে শুটিঙের কাজ পুরো শেষ না করেই আমাদেরকে নড়াইল ছাড়তে হয়েছিল।

আরেকটি বিষয়েও আমরা বিকল্পধারার নির্মাতারা এদেশে খুব ভুগে থাকি। তা হচ্ছে আমাদের ছবিগুলোর বস্তুনিষ্ঠ নৈব্যর্ক্তিক সমালোচনা, যে সমালোচনা থেকে আমরাও কিছু শিখতে পারতাম, সে রকম সমালোচনার ঘোরতর অভাব। সমালোচনার নামে এদেশে যা হয় তা’ হচ্ছে উপরভাসা কিছু ফেসবুকীয় মন্তব্য বা নিছক স্তুতি কিম্বা ছবিটির নির্মাতার নানা খুঁত খুঁজে বেড়ানো! দেশে ভালো চলচ্চিত্রনির্মাতা তৈরি করতে চাইলে শিক্ষিত ও রুচিশীল চলচ্চিত্র সমালোচকদের প্রয়োজন যারা তাদের উন্নত সমালোচনায় আমাদেরকে সমৃদ্ধ করবেন। বাংলাদেশে একজন জর্জ শার্দুল বা পলিন কেলের মত বোদ্ধা সমালোচক হবে না জানি, কিন্তু একজন চিদানন্দ দাসগুপ্ত বা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় তো কেউ হতে পারতেন!

বিকল্পধারায় চলচ্চিত্র তৈরি ও প্রদর্শনে আমাদের নিজস্ব কিছু দর্শন আছে। তবে আমরা সচেতন থাকি যে ডগমা-তত্ত্বের প্রবক্তাদের মতো আমরা নিজেরাই যেন নিজেদের উপর সে সব সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন অতিরিক্ত কঠোরভাবে চাপিয়ে দিয়ে নিজেরাই যেন আবার সেসব নিয়মনীতির হাতে বন্দী হয়ে না যাই। আমরা নিজেরাই যেন কোনো “প্রতিষ্ঠান” না হয়ে পড়ি। তবে সম্পদের দারিদ্র্য অলঙ্ঘনীয় কিছু নিয়ম আমাদের উপর চাপিয়েই দিয়েছে। যেমন ব্যয়বহুল কোনো সেট আমরা তৈরি করতে পারি না। কিম্বা ব্যয়বহুল খুব উন্নত ক্যামেরাও আমরা ব্যবহার করতে পারি না। অনেক খরচ! তাছাড়া একটা ভালো বাজেটের বড় ছবির ক্ষেত্রে যেখানে পঞ্চাশ-ষাট দিন শুটিং হয়ে থাকে সেখানে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ দিনের বেশি শুটিং করার অর্থই থাকে না আমাদের। আমার “রাবেয়া” নামের পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবিটি মাত্র ছাব্বিশ দিনে শুট করা। এর বেশি শুটিং করার মতো কোনো টাকাই আমাদের ছিল না। তাছাড়া আমাদের অনেক ছবিরই শুটিং অনুপাত ছিল ১:১। বড় জোর ২:১। দারিদ্র্য আমাদেরকে মিতব্যয়ী হতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে নিজেদের মতো করে ছবি তৈরির এক নির্মাণপ্রক্রিয়া সৃষ্টি করে নিতে, এক নিজস্ব চলচ্চিত্রভাষাই, যা স্বল্পব্যয়ী এবং শ্রমঘন, পুঁজিঘন নয় মোটেই। পুঁজির অভাবটা আমাদের ফিল্ম ইউনিটে আমরা গায়ে-গতরে পুষিয়ে নেবার চেষ্টা করি। বলতে পারেন, এ এক ভিন্ন ধরণেরই চলচ্চিত্র নির্মাণ।

বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমার একটা ব্যর্থতা হচ্ছে নতুনদের আমরা তেমন টানতে পারিনি। তার অন্যতম একটা কারণ হচ্ছে নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশে কর্পোরেট পুঁজির ব্যাপক বিকাশ। সে সময় থেকে আন্তর্জাতিক ফোন কোম্পানিগুলো তাদের বিশাল পুঁজি নিয়ে বাজারে এল। তাদের তো সবই দরকার, মায় চিত্রনির্মাতাও। ইদানীং ব্যবসা-বাণিজ্যের বিজ্ঞাপনী বিত্তের জগৎটাও বাংলাদেশে অনেক বেড়েছে। সংখ্যায় ও প্রাচুর্য্যে। ফলে গত দুই দশকে অনেক সম্ভাবনাময় নির্মাতাকে বিজ্ঞাপনের এই লোভনীয় জগতে আমরা হারিয়েছি। আরেকটি কারণ হচ্ছে, দেশে বাম-আন্দোলন দূর্বল হয়ে পড়া। আদর্শবাদী, ত্যাগী ও সাংগঠনিক কাজে দক্ষ তরুণেরা বামধারা থেকেই চিরকাল এসেছে। কিন্তু বর্তমানে বাম-আন্দোলন দূর্বল হয়ে যাওয়াতে বাংলাদেশের সব ধরণের প্রগতিশীল সংস্কৃতিচর্চা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বিকল্প সিনেমাও তার ব্যতিক্রম নয়।

আরেকটি বিষয়েও আমরা বিকল্পধারার নির্মাতারা এদেশে খুব ভুগে থাকি। তা হচ্ছে আমাদের ছবিগুলোর বস্তুনিষ্ঠ নৈব্যর্ক্তিক সমালোচনা, যে সমালোচনা থেকে আমরাও কিছু শিখতে পারতাম, সে রকম সমালোচনার ঘোরতর অভাব। সমালোচনার নামে এদেশে যা হয় তা’ হচ্ছে উপরভাসা কিছু ফেসবুকীয় মন্তব্য বা নিছক স্তুতি কিম্বা ছবিটির নির্মাতার নানা খুঁত খুঁজে বেড়ানো! দেশে ভালো চলচ্চিত্রনির্মাতা তৈরি করতে চাইলে শিক্ষিত ও রুচিশীল চলচ্চিত্র সমালোচকদের প্রয়োজন যারা তাদের উন্নত সমালোচনায় আমাদেরকে সমৃদ্ধ করবেন।

এটা ভুলে যাওয়া মোটেই ঠিক হবে না যে কেবল নির্মাতাদের দ্বারাই বিকল্প সিনেমা তৈরি হয়নি। বাংলাদেশে বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে আনোয়ার হোসেন, মকসুদুল বারী, মিশুক মুনীরের মতো চিত্রগ্রাহকেরা, পরিশ্রমী সম্পাদকেরা ও আন্তরিক অভিনেতা-অভিনেত্রীরা, যারা মূলতঃ গ্রুপ থিয়েটার থেকে এসেছেন, তাঁদেরও রয়েছে বিরাট অবদান। তাঁরা সকলেই প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন। এছাড়া সব সময়ই ছিল এক ঝাঁক ঝকঝকে তরুণ-তরুণী, মূলতঃ ফিল্ম সোসাইটি বা শর্ট ফিল্ম ফোরামের কর্মীরা, যাদের চোখে মুখে ছিল আগামীর স্বপ্ন, বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমার ক্ষেত্রে তাদের অবদানও বিশাল।

জ্যাঁ ককতো স্বপ্ন দেখতেন ক্যামেরার দাম যখন কলমের দামের মতো হবে এবং ফিল্মের দাম হবে কালির দামের মতো, কেবল তখনই চলচ্চিত্র একটা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শিল্প হয়ে উঠবে। ডিজিটাল ক্যামেরার ব্যাপক বিকাশ ও এ ধরণের ক্যামেরা বর্তমানে অনেক সহজলভ্য হওয়ায় সিনেমা আজ সে সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে। আপনার মোবাইল ফোন দিয়েও তো আপনি এখন একটা ফিল্ম বানাতে পারেন। তবে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি তৈরির খরচের খাত তো কেবল ক্যামেরা নয়, অন্যান্য আয়োজনেরও খরচ আছে। আর তাও কিছু কম নয়। সে টাকাটাও বা আসবে কোত্থেকে ? একটা ভরসা সরকারি অনুদান। অনুদানের টাকার পরিমাণটা কম বটে, কিন্তু ছবি শুরু তো করা যায়। অর্থের আরেক উৎস হতে পারত বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি ফাউন্ডেশন, ভালো ছবির ক্ষেত্রে পশ্চিমা দুনিয়ায় যেরকমটি অনেক আছে। কিন্তু দুঃখজনক যে এদেশের প্রথম প্রজন্মের ধনী পরিবারগুলো ব্যবসা করে বা দূর্নীতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করলেও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয়ের মতো রুচি বা শিক্ষা তাদের এখনও তেমন গড়ে ওঠেনি।

বাংলাদেশে লন্ডনের ন্যাশনাল ফিল্ম সেন্টার বা কলকাতার “নন্দন”-য়ের মতো একটা ফিল্ম সেন্টার নেই বলে আমরা খুবই ব্যথিত থাকি। দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যাপারে আমরা দাবী জানিয়ে আসছি, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রতিশ্রুতিও রয়েছে, তারপরও হচ্ছে না। দেশে উন্নত চলচ্চিত্র সংস্কৃতি চাইলে একটা ন্যাশনাল ফিল্ম সেন্টার থাকাটা খুবই প্রয়োজনীয়। এই ফিল্ম সেন্টারকে ধারণ করেই গড়ে উঠবে নতুন প্রজন্মের সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণীরা যারা ভবিষ্যতে এদেশে বিকল্প সিনেমার হাল ধরবে। আমাদের মতো স্বল্প গণতন্ত্রের দেশে সরকার হচ্ছে সবচে বড় সামাজিক সংগঠন -ক্ষমতায় ও সম্পদে। ফলে ন্যাশনাল ফিল্ম সেন্টারের মতো একটা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গঠনে সরকার বড়ভাবে এগিয়ে আসবে এটাই আমরা আশা করি।

এটা ভালো সংবাদ যে দেশে সরকারি উদ্যোগে একটা ফিল্ম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বেশ কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়েও বর্তমানে ফিল্ম পড়ানো হয়। ব্যক্তিগত পর্যায়েও দু’একটি ফিল্ম ইনস্টিটিউট কাজ করছে। কিন্তু সিনেমা শিল্প, আরো সব শাস্ত্রের মতোই, গুরুমুখী এক বিদ্যা। গুরুই মূল, দালানকোঠা নয়। বাংলাদেশে ভালো চলচ্চিত্রশিক্ষার বড় একটা সমস্যা হচ্ছে, ভালো শিক্ষকের অভাব। যেহেতু চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে প্রকৃত শিক্ষা দেবার উপযোগী শিক্ষক দেশে খুব কম, ফলে মূলতঃ নাট্যতত্ত্ব ও গণমাধ্যমে পাস করা ব্যক্তিরা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলচ্চিত্র পড়াচ্ছেন। সিনেমা ঠিক গণমাধ্যম নয়, এটা একটা শিল্পমাধ্যম। ফলে নাট্যতত্ত্ব বা গণমাধ্যমের শিক্ষকদের দিয়ে চলচ্চিত্র শেখানোর চেষ্টা, এ অনেকটা পাখি দিয়ে হালচাষ করার মতো ! ফলে সে জমির ফসল বা ছাত্ররাও সেরকমই শিখছে। সিনেমা মূলতঃ একটা প্রযুক্তিনির্ভর মাধ্যম। সে প্রযুক্তিটা না জানা থাকলে সিনেমার ভাষা ও নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কেও তেমন কিছু জানা বোঝা যায় না। আর প্রযুক্তিনির্ভর সেই চলচ্চিত্রের ভাষা ও নন্দনতত্ত্বকে শেখানোর মত উপযুক্ত শিক্ষক বাংলাদেশে আসলেই হাতেগোণা কয়েকজন। ফলে ছাত্ররা অনেক আগ্রহ নিয়ে, প্রচুর অর্থ ব্যয় করে সিনেমা শিখতে এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলেও তেমন কিছু শিখতে পারছে না। অথবা নিজেদের শিক্ষকদের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেরে হতাশ হচ্ছে।

 

এরপর পড়ুন- বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমা আন্দোলন : জমা, খরচ ও ইজা (পর্ব : ৩)

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.