:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
বিধান রিবেরু

গল্পকার, চলচ্চিত্র সমালোচক

নীল ইশতেহার : চলচ্চিত্র ইতিহাসের একাংশ পাঠ
প্রচ্ছদ: ‘রিডিলস অব দ্য স্ফিংস’ থেকে

নীল ইশতেহার : চলচ্চিত্র ইতিহাসের একাংশ পাঠ

Gry Bay and Morten Schelbech in All About Anna (2005). Image Source: imdb.com

১.
ইশতেহার রাজনৈতিক চলচ্চিত্র, নারীবাদী চলচ্চিত্র বা শৈল্পিক চলচ্চিত্রে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তেমনি ভূমিকা রেখেছে নীল ছবির ক্ষেত্রেও। সমাজে প্রচলিত নৈতিকতার যে আইন তা নীল আইন (Blue Law) নামেই পরিচিত, এই নীল আইনের পরিপন্থী ছবিগুলো যা নীল ছবি নামে পরিচিত, সেখানে যা দেখানো হয় তা মোটাদাগে যৌনতা হলেও নারীবাদী অনেকেই মনে করতে শুরু করলেন এসব কামক্রীড়া যেভাবে চিত্রায়িত হয়, তা নারীর জন্য অবমাননাকর। আবার অনেকে মনে করলেন, বাইরে থেকে নীল ছবি সম্পর্কে দেগে দেওয়াটা ঠিক নয়, ভেতরে ঢুকে তাদের অবস্থান জেনেই তবে মন্তব্য করা উচিত। নারীর অবস্থান কেমন হওয়া দরকার, নীল ছবি আদতে নারীকে সম্মানের জায়গায় রেখে তৈরি করলে কী দাঁড়াবে, নারীর যৌনাকাঙ্ক্ষাকে মাথায় রেখেই নীল ছবি তৈরি করতে হবে, নীল ছবিকে বিশুদ্ধ যৌনতার মধ্যে আটকে না রেখে তাতে শিল্পগুণ যুক্ত করতে হবে, তাতে করে মানবসমাজের অবিচ্ছেদ্য এই অংশ যৌনতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে অথবা নীল ছবি থেকে পুরুষতন্ত্র ও ধনতন্ত্রকে মুছে ফেলার জোগাড় করা দরকার ইতি ও আদি যে দিকনির্দেশনা বা ঘুরিয়ে বললে এক কল্পরাজ্যের লিখিত বয়ান আমরা দেখি, সেটাই নীল ছবির ইশতেহার আকারে আমাদের সামনে হাজির হয়।

১৯৭০ সালের নভেম্বরে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে একটি চলচ্চিত্র উৎসব হয়, নাম Wet Dream Film Festival, বাংলা করলে দাঁড়ায় স্বপ্নদোষ চলচ্চিত্র উৎসব। তবে আমি একে স্বপ্নদোষ বলতে নারাজ, বরং বলা ভালো স্বপ্নস্নাতক। তো এই স্বপ্নস্নাতক চলচ্চিত্র উৎসবে লৈঙ্গিক সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের ঝাণ্ডা তুলে কয়েকজন লেখক ও আন্দোলনকর্মী যৌথভাবে একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন। জারমেইন গ্রিয়ার, আল গোল্ডস্টেইন, জন শ্রিম্পটন, জে লান্ডম্যান, রিচার্ড নেভিল প্রমুখের সেই ইশতেহারে বলা হয় অধিকার খাটানোর মানসিকতা থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে, বিশেষ করে যৌনতার ক্ষেত্রে। যৌন হতাশা, যৌন হিংসা, যৌন ভীতি মানব সম্পর্কের ভেতর বসবাস করে বলেই মানুষ বিকৃত হয়ে ওঠে। কিন্তু মানুষ যদি যৌন বিচারে সংস্কারমুক্ত হয়, সহনশীল ও উদার হয়, তাহলে সে জীবনের অন্য সব ক্ষেত্রেই মুক্তমনের ও উদার হবে। এই ইশতেহার থেকে তাই সবাইকে যৌনচর্চায় স্বাধীন, সহনশীল ও উদার হয়ে ওঠার আহ্বান জানানো হয়।

সুইডেনে ১৯৭৭ সালে নীল ছবি নিয়ে আরেকটি ইশতেহার প্রকাশিত হয়। ‘পর্নোকাদায় এক সারস: সিনেমায় যৌনতা নিয়ে কয়েক নোক্তা’ শিরোনামের ইশতেহারটি রচনা করেন সুইডিশ পরিচালক বিলগত সোমান। তিনি বিখ্যাত দুটি ছবির জন্য— আই অ্যাম কিউরিয়াস (ইয়েলো) (১৯৬৭) ও আই অ্যাম কিউরিয়াস (ব্লু) (১৯৬৮)। সোমান এই ইশতেহারে চলচ্চিত্রে যৌনতা উপস্থাপনের ইতিহাস তুলে ধরেন, গত শতাব্দীর ছয় ও সাতের দশক তাঁর আলোচনার অঞ্চল। এই ইতিহাস উপস্থাপনের ভেতর দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চান তাঁর মতবাদ। সোমানের মতে নীল ছবির ভেতর যৌনতাকে কোণঠাসা করে না রেখে, শিল্পগুণসমৃদ্ধ চলচ্চিত্রে সেটাকে তুলে ধরা দরকার। সোমানের এই চিন্তাধারা পরবর্তী সময়ে আমরা দেখি ‘সিনেমা ব্রুট’ ‘নিউ ফ্রেঞ্চ এক্সট্রিমিজমে’ প্রতিফলিত হতে।

যৌন হতাশা, যৌন হিংসা, যৌন ভীতি মানব সম্পর্কের ভেতর বসবাস করে বলেই মানুষ বিকৃত হয়ে ওঠে। কিন্তু মানুষ যদি যৌন বিচারে সংস্কারমুক্ত হয়, সহনশীল ও উদার হয়, তাহলে সে জীবনের অন্য সব ক্ষেত্রেই মুক্তমনের ও উদার হবে। এই ইশতেহার থেকে তাই সবাইকে যৌনচর্চায় স্বাধীন, সহনশীল ও উদার হয়ে ওঠার আহ্বান জানানো হয়।

বুনুয়েল, ফেলিনি বা আন্তোনিওনি তাঁদের চলচ্চিত্রে নগ্নতা এনেছেন— সেটা কখনো কাপড় খুলে, কখনো কাপড় না খুলে, কখনো আবার লংশটে নগ্ন আলিঙ্গনে— নব্য বিশুদ্ধবাদীরা হয় তো বলবেন, বড় বড় পরিচালকেরা যদি এভাবে চলচ্চিত্রে যৌনতা আনতে পারেন, তাহলে আর নতুন করে এটা নিয়ে কথা বলার কী আছে? সোমান এর উত্তরে বলেন, বিষয়টি এমন নয় যে নগ্নতা বা যৌনতাকে সিনেমায় কোনো রকম কায়দা করে আনলেই হলো, তিনি বলতে চান, মানবসভ্যতা টিকে আছে এই যৌনতা আছে বলেই, তাই একে ইশারা-ইঙ্গিতে বোঝানোর কিছু নেই। নীল ছবিতে যৌনতাকে ভণিতা ছাড়াই ধরা যাচ্ছে ক্যামেরায়, অতএব, বড় পরিচালক ও অভিনয় শিল্পীরা কেন সেটাকে ধরতে পারবেন না?

সোমান বলছেন, ‘আমার প্রস্তাব খুব সোজা— কোনো কিছুই নতুন ঘটবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রথম সারির নির্মাতা, অভিনেতা, অভিনেত্রী সেন্সরশিপের নতুন স্বাধীনতা কাজে লাগাবে। এর আগপর্যন্ত আমরা মানবসত্তার স্বরূপ দেখতে পাব না, যেখানে যৌনতা থাকবে সমগ্রের একটি অংশ হয়ে। নীল ছবি মার্কা নয়, বালসুলভ বাঁধাধরাও নয়, যৌনতা হবে সংহত—গোটা মানবসত্তায়।’ (সোমান ২০১৪: ৩৭৩)

যত দিন না, সোমানের বক্তব্য অনুসারে, আমরা যৌনতাকে শিল্পের পর্যায়ে আনতে পারছি, তত দিন আমরা ওই পর্নের জলাতেই, কাদা মাখামাখি করে থাকব। প্রথম সারির অভিনয়শিল্পীরা যৌনতাকে পর্দায় ফুটিয়ে তুললেই কেবল সেখানে সত্যিকারের মানবীয় আবেগ ফুটে উঠবে, নয়তো সেখানে দেখা যাবে আবেগের ক্ষরা।

দীর্ঘদিন ধরেই একটা ধারণা প্রচলিত আছে, সেটা হলো যৌনতা বিকোয় ভালো, যদি সেটা কিঞ্চিৎ আবেগমাখা হয়। তাহলে সেই চলচ্চিত্রের ছবি-শব্দ-অভিনয়ে হাজার সমস্যা থাকলেও লোকে অভিযোগ তুলবে না। কিন্তু যৌনতাকে এভাবে যেনতেনভাবে তুলে ধরাতেই আপত্তি সোমানের। যৌনতা থেকে কাদাজল বের করে দেওয়ার পক্ষে সোমান, এতে হয় তো ভোক্তা হারাতে হবে, তারপরও মানবিক আবেগ বিবর্জিত যৌনতা পর্দায় আনার দরকার নেই বলেই মনে করেন সোমান।

শিল্প যেহেতু বাস্তবকে নিয়ে কাজ করে, যেহেতু এর ভেতর দিয়ে সমাজ বিশ্লেষিত হয়, তাই এর মাধ্যমে নারী-পুরুষের কামকলা পর্নের সীমাবদ্ধ গণ্ডি পেরোতে পারবে এবং যৌনতা যে জীবনের অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য বিষয় সেটাকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারবে। আর এতে করে কদর্য অর্থে কামুকতাও দূর হবে বলে উল্লেখ করেন সোমান।

Lena Nyman and Vilgot Sjöman in I Am Curious (Blue) (1968). Image Source: imdb.com

২.
সোমানের এই ইশতেহার রাষ্ট্র হওয়ার দুই দশক পর, ১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নীল ছবির ওপর আরেকটি উল্লেখযোগ্য ইশেতাহার প্রকাশিত হয়: ‘দ্য পোস্ট পর্ন মডার্নিস্ট মেনিফেস্টো’। এতে স্বাক্ষর করেন অ্যানি স্প্রিঙ্কল, ভেরোনিকা ভেরা, ফ্রাঙ্ক মুরস, ক্যান্ডিডা রয়াল ও লি গেটস। এঁদের অনেকেই আগে নীল ছবিতে অভিনয় করেছেন, পরে এই বিষয়ক নানা কর্মসূচি, যেমন যৌনতার সপক্ষে নারীবাদী আন্দোলন বা সেক্স-পজিটিভিজম ফেমিনিজমের সঙ্গে যুক্ত হন এবং পর্নো তারকাদের নিরাপত্তা বিধানে কাজ করেন। নাতিদীর্ঘ ইশতেহারটিতে তাঁরা ঘোষণা করেন, নারী হিসেবে যৌনাঙ্গকে তাঁরা বিচ্ছিন্ন কিছু মনে করেন না, বরং এটিকে নিজেদের আত্মার অংশ বলেই জ্ঞান করেন।

ইশতেহারে বলা হচ্ছে, ‘আমরা যৌনতাবিষয়ক চাঁছাছোলা শব্দ, ছবি, প্রদর্শনী ব্যবহার করি আমাদের ভাবনা ও আবেগের সংযোগ ঘটাতে। যৌনতাকে শিল্পবিরোধী ও হৃদয়হীন বলে কাঁচি চালানোকে আমরা নিন্দা জানাই। যৌনতার প্রতি ইতিবাচক থেকে আমরা আমাদেরকে ক্ষমতায়ন করি।’ (অ্যানি স্প্রিঙ্কল ও অন্যান্য ২০০৪: ৩৮২)

আপন যৌনতার প্রতি ভালোবাসা নিয়ে তাঁরা আনন্দিত, এটা দিয়েই তাঁরা পৃথিবীর ভালো করতে চান ও নিজেরা টিকে থাকতে চান। তবে বছর আট কি নয়ের মধ্যেই এই আন্দোলনে প্রথম যুক্ত হয় প্রথম সারির একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। বলছি ডেনমার্কে ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ‘পুজ্জি পাওয়ারে’র কথা। ১৯৯৮ সালে তারা একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন, যা পুজ্জি পাওয়ার মেনিফেস্টো নামে পরিচিত, উপশিরোনামে রয়েছে—‘থটস অন উইমেন অ্যান্ড পর্নোগ্রাফি’। নীল ছবিতে নারীকে অধস্তন অবস্থা থেকে মুক্ত করতে তাঁরা শুধু ইশতেহার প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থাকেননি, পরপর তিনটি নীল ছবিও নির্মাণ করে মুক্তি দিয়েছেন: ‘কন্সটেন্ট’ (১৯৯৮), পিঙ্ক প্রিজন (১৯৯৯) ও ‘অল অ্যাবাউট আন্না’ (২০০৫)। এই তিনটির মধ্যে প্রথম দুটি গোটা স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে বেশ সমাদৃত হয়। এই দুই ছবির সমাদর দেখে ২০০৬ সালে নরওয়েতে নীল ছবিকে দেওয়া হয় আইনি বৈধতা।

পুজ্জি পাওয়ার ইশতেহারের বক্তব্য হলো— নীল ছবিতে যে খোলামেলাভাবে কামকলার সব দেখানো হয়, যেটাকে বলে হার্ডকোর (আমরা সবিস্তার অশ্লীল লিপিও বলতে পারি), সে কারণে নারীরা নীল ছবি পছন্দ করেন না, তা নয়, তাঁদের নীল ছবি না-পছন্দ হওয়ার কারণ সেখানে নারীদের মর্যাদাহানি করা হয়। পুজ্জি পাওয়ার তাই নারীবাদী খোলামেলা অশ্লীল লিপির নান্দনিকতার (ফেমিনিস্ট হার্ডকোর পর্নোগ্রাফিক অ্যাসথেটিক) পক্ষে যুক্তি করে। তারা ইশতেহারে স্পষ্ট করেই বলে দেয়, চালচ্চিত্রিক অশ্লীল লিপিতে কী থাকবে আর কী থাকবে না।

সাধারণত নীল ছবিতে পুরুষের কল্পনা বা ফ্যান্টাসিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, সেই অনুযায়ী তৈরি করা হয় ছবি, তাই নারী থাকেন অবদমিত। পুরুষের কর্তৃত্বের হাত নারীর অস্তিত্বকে মলিন করে দেয় সেখানে। আর এ কারণেই নীল ছবির প্রতি নারীরা খুব একটা আগ্রহ বোধ করেন না। পুজ্জি পাওয়ার বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে মনে করেছে, এই অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। আর তাই তারা নীল ছবি প্রযোজনায় হাত দেয় এবং একে একে তিনটি ছবি নির্মাণ করে। প্রাথমিকভাবে ছবিগুলো ভিডিও ফরম্যাট ও টেলিভিশনের জন্যই নির্মিত হয়। নিজেদের নির্দেশনা, অর্থাৎ ইশতেহার মেনেই ছবিগুলো বানানো হয়।

নির্দেশনা তৈরি হয় চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা জেনট্রোপিয়ার কল্যাণে। জেনট্রোপিয়াকে প্রণোদনা দিতেই পুজ্জি পাওয়ারের জন্ম হয়। নির্দেশনায় স্বাক্ষর করেন ভিবেকে ভিন্দেলব, লিন বলাম, গের্ড ভিনতার, লিলি হেনড্রিকসেন প্রমুখ। তাঁদের লিখিত ইশতেহারে দেখা যায়, ছবিতে অবশ্যই একটি কাহিনি থাকতে হবে, সেই কাহিনির ভেতর যুক্তিযুক্তভাবে কল্পনা, আবেগ ও অনুভূতি থাকবে, যা সরাসরি যুক্ত করবে ছবির চরিত্রদের। কাহিনির ভেতর যেন খুব বেশি যৌনতাবহির্ভূত জিনিসপত্র না চলে আসে, মনে রাখতে হবে। ইশতেহারে বলা হচ্ছে, কামনার আগুন যেন নিভে না যায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। ছবিটা আবার এমনও হবে না, যেখানে কয়েকটি চরিত্র এসেই যৌনতা শুরু করে দেবে। ছবিগুলোর দৈর্ঘ্য বেশি হবে না। ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত থাকবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এক বা একাধিক সঙ্গমদৃশ্য উঠে আসতে হবে নারীর কল্পনা থেকে, প্রাত্যহিক জীবনে যে ধরনের কল্পনায় নারীরা বিভোর থাকেন। মোদ্দা কথা নারীর বাসনা ও সন্তুষ্টিই হবে এসব ছবির মূল লক্ষ্য।

সাধারণত নীল ছবিতে পুরুষের কল্পনা বা ফ্যান্টাসিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, সেই অনুযায়ী তৈরি করা হয় ছবি, তাই নারী থাকেন অবদমিত। পুরুষের কর্তৃত্বের হাত নারীর অস্তিত্বকে মলিন করে দেয় সেখানে। আর এ কারণেই নীল ছবির প্রতি নারীরা খুব একটা আগ্রহ বোধ করেন না। পুজ্জি পাওয়ার বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে মনে করেছে, এই অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। আর তাই তারা নীল ছবি প্রযোজনায় হাত দেয় এবং একে একে তিনটি ছবি নির্মাণ করে। প্রাথমিকভাবে ছবিগুলো ভিডিও ফরম্যাট ও টেলিভিশনের জন্যই নির্মিত হয়। নিজেদের নির্দেশনা, অর্থাৎ ইশতেহার মেনেই ছবিগুলো বানানো হয়।

যৌনতার প্রকাশ কেবল যৌনাঙ্গকেন্দ্রিক হবে না। নারীরা যে পুরুষের শারীরিক সৌন্দর্য দেখতে চান, তাঁরা যে চান পুরুষও নিজেদের সঁপে দিক তাঁদের কাছে, সেটাও যেন থাকে ছবিতে। পুরুষকে যে এ জন্য সম্পূর্ণ নগ্ন হতে হবে তা নয়, একটু আড়াল থাকলেও চলবে, বরং সেই আড়ালে যৌন আবেদন একটু বেশিই থাকে বলে মনে করে এই ইশতেহার। নারীদের ক্ষেত্রে হয়তো কোনো দৃশ্যে শুধু নগ্ন কাঁধ বা পায়ের গোড়ালিই হয়ে উঠতে পারে যৌনতার শক্তিশালী বার্তা।

ছবির সময়কাল নিয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, কাহিনি হতে পারে অতীত বা বর্তমানের, ছবিতে কী দেখানো হচ্ছে, সেটাই আসল কথা। ছবির শুরুতে হাস্যরস থাকতে পারে সীমিত আকারে। তবে খবরদার, সঙ্গমদৃশ্যে যেন সেই রস প্রবেশ না করে। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ইশতেহারে আরও বলা হচ্ছে, ছবিতে কোনোভাবেই নারীর প্রতি সহিংসতা বা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরজবরদস্তি দেখানো যাবে না। তবে ছবিতে নারীর ফ্যান্টাসিতে ধর্ষিত বা অপরিচিত কারও দ্বারা আক্রমণের শিকার হচ্ছে, এমন দৃশ্য দেখানো যাবে বলেও ফতোয়া দেয় এই ইশতেহার। অর্থাৎ নারীর যৌনলিপ্সাকে উসকে দিতে যা যা প্রয়োজন, সবকিছুই যোগ করার নির্দেশ দেওয়া আছে এই ইশতেহারে।

সবকিছুর পর ইশতেহারে ঘোষণা করা হয় ঘৃণা, বলা হয়, ‘যা আমরা ঘৃণা করি… তা হলো মুখরতির (ওরাল সেক্স) দৃশ্য, যেখানে নারীকে বাধ্য করা হয় পুরুষাঙ্গ চুষতে (ফেলাসিও), তার চুল শক্ত করে টেনে ধরা থাকে, আর তারপর নারীটির মুখে বীর্যপাত করা হয়।’(ভিবেকে ভিন্দেলব ও অন্যান্য ২০১৪: ৩৮৫)

তো এই নীল ছবির ইশতেহার শুধু যে আমেরিকা বা স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোতে প্রকাশ হয়েছে তা কিন্তু নয়। ফরাসি নারীবাদী নির্মাতা, প্রযোজক ও নীল ছবির অভিনেত্রী অভিডির লেখা একটি বইই প্রকাশ পায় ‘পর্নো মেনিফেস্টো’ (২০০২) নামে। একই বছর তিনি ‘মাই পর্ন মেনিফেস্টো’ নামে এক ইশতেহার লেখেন, যা প্রকাশ পায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে। জঙ্গি নারীবাদকে চিন্তায় ধারণ করে অভিডি প্রবেশ করেন নীল ছবির দুনিয়ায়। নিজে নাচতেন, নৃত্যপরিচালনার কাজও করেছেন, পড়াশোনা করেছেন দর্শন ও সাহিত্যে। মুক্তমনা ও উচ্চশিক্ষিত পরিবার থেকে আসা এই অভিডি কেন এমন এক দুনিয়ায় প্রবেশ করলেন, সেই বয়ানই তিনি হাজির করেছেন এই নিজস্ব ইশতেহারে।

অভিডি বলছেন, অর্থ বা যৌনতা, এই দুটির কোনোটার জন্যই তিনি এই দুনিয়ায় আসেননি। ইউরোপে নীল ছবিতে কাজ করলেই টাকা আর টাকা, এই ধারণাকেও মিথ্যা বলে মন্তব্য করেন অভিডি। তা ছাড়া অনেক দেশেই প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্মিত এসব ছবির বাজার মরে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি। অনেক সরকারই একে করে রেখেছে নিষিদ্ধ। নীল ছবির অর্থনীতি ওয়েবসাইটে উজ্জ্বল হলেও এখন আর আগের মতো রমরমা নেই এই সিনেমার কারখানা। অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, গরিব পরিবারের মেয়ে, হয়তো তাই এই জগতে পা বাড়িয়েছেন অভিডি, তিনি পাঠককে বলছেন, সেটাও সত্য নয়। পয়সার অভাব কখনোই হয়নি তাঁর। যখন নীল ছবির সংসারে প্রবেশ করেছেন, তখন তিনি দর্শন পড়ছেন এবং নতুন বিয়ে করেছেন এক শিক্ষককে। না, নিজের শরীর দেখানোর আকাঙ্ক্ষা বা অন্য পুরুষের সঙ্গে সঙ্গমের স্পৃহাও ছিল না অভিডির। তিনি একজনের সাথেই আবেগজড়িত যৌনতাকে অতি মূল্যবান বলে মানেন। তাঁর স্বামীও বহুগামী নন। নীল ছবিতে যাঁরা অভিনয় করেন, তাঁরা অভিনয়ই করেন, সেখানে যৌনসুখ পাওয়া যায় না, অবশ্য কখনো কখনো যে সেটা কেউ একেবারেই পান না, সেটা হলফ করে বলা যায় না, তবে অভিনয় তো অভিনয়ই। এসব যুক্তি দিয়ে অভিডি আগের প্রশ্নটিই জারি রাখেন— নীল ছবির বাজার খারাপ জেনেও কেন তিনি এই কারখানায় শামিল হলেন?

Ovidie. Image Source:gettyimages.co.uk

একসময় অভিডি চরম নারীবাদী ছিলেন, নারীবাদী কর্মী হিসেবে সে সময় তিনি নীল ছবির নিন্দামন্দ করতেন। মজার বিষয়, তখন অভিডি এই জগৎ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না, জানবেন কী করে, নীল ছবি তখনো দেখাই হয়নি তাঁদের। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ভাবার একপর্যায়ে অভিডি দোকান থেকে নীল ছবি ভাড়া করে আনতে শুরু করলেন। প্রথম ছবিটি দেখে অবাকই হয়েছেন অভিডি, মন্দ লাগেনি তাঁর। নারী পুরুষের সঙ্গমদৃশ্য তো বটেই, কোথাও কোথাও ছবির পরিচালনাও পছন্দ হয়েছে তাঁর। বুঝতে পারলেন, নারীবাদ আর অশ্লীল লিপি কোনো বিপরীতার্থক বিষয় নয়। তা ছাড়া নারীবাদীদের যুদ্ধক্ষেত্র তো লিঙ্গগত বৈষম্য নিয়েই, যেখানে অবধারিতভাবে যৌনতা আছে। এখন নীল ছবি নিয়ে যদি বক্তব্য দিতেই হয়, তাহলে সেই জগতে নারীবাদীদের প্রতিনিধি থাকা প্রয়োজন, ঠিক এ কারণেই অভিডি যুক্ত হন নীল দুনিয়ায়। একসময় যে নারীদের তিনি করুণা করতেন, পরে তাদেরই অংশ হয়ে অভিডি বলছেন, ‘আমি সমান শক্তিশালী যৌন প্রতিমূর্তি তৈরি করতে চেয়েছিলাম।’(অভিডি ২০১৪: ৩৯১) এ কারণেই নীল দুনিয়ার ডেরা বাঁধেন অভিডি।

আরও একটা ব্যাপারে আগ্রহ ছিল অভিডির। যেহেতু তিনি নাচ নিয়ে কাজ করেছেন, তাই দেহবল্লরির দিকেও নজর ছিল তাঁর। নীল ছবিতে সঙ্গমের দৃশ্য তাঁর কাছে একধরনের নৃত্যবিন্যাস বা কোরিওগ্রাফি বলেই মনে হয়, সেখানে নৃত্যের মতোই পুরো দেহকে সংযুক্ত হতে হয়। ব্যাপারটিকে উপভোগ করেন অভিডি।

নীল ছবিতে অভিনয় করেছেন, ভালো কথা, কিন্তু পরিচালক হলেন কেন? অভিডিই এই প্রশ্নকর্তা, জবাবদাতাও তিনি। বলছেন, “আমি স্রেফ আমার কল্পনা আর আমার নারীবাদী আকাঙ্ক্ষাকে পর্দায় রূপ দিতে চেয়েছিলাম। আমি এমন ছবি বানাতে চেয়েছি, যেখানে একেকটি দৃশ্যে আবেগের মাত্রা ও যৌনচর্চা হবে একেক রকম—এই চাওয়ার কিছুটা পূরণ হয়েছে আমার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘লিলিথে’।” (ঐ)

তারকা হতে বা নিজের গোপন বাসনাকে চরিতার্থ করতে নয়, বরং নারীবাদী কর্মী হিসেবে তিনি চেয়েছেন নীল পেশার নারীদের পক্ষে দাঁড়াতে, যাঁরা অকারণে সব দিক থেকে আক্রমণের শিকার হন। যৌনবান্ধব নারীবাদের প্রচারের লক্ষ্যেই নীল দুনিয়ায় জড়িয়েছেন বলে ইশতেহারে উল্লেখ করেন অভিডি। তা ছাড়া এই কারখানায় প্রত্যেকেই প্রত্যেকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। নারীদের প্রতি দায়িত্ববোধ ছাড়াও এটাও একটা কারণ অভিডির এই নীল দুনিয়ায় থেকে যাওয়ার।

সুইডিশ পরিচালক বিলগত সোমানের মতো অভিডিও মনে করেন, পর্নোগ্রাফিতে শিল্পের ছোঁয়া থাকা চাই। অভিডি বলছেন, তিনি দুঃখ পাচ্ছেন এটা দেখে যে ধীরে ধীরে নীল ছবিগুলো থেকে শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া খ্যাতিমান পরিচালকেরাও আর কাজ পাচ্ছেন না। এই ইশতেহারের উপসংহারে তিনি যৌনকর্মীদের ওপর যে সামাজিক চাপ বৃদ্ধি করা হচ্ছে, সেটা নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেন।

তবে যৌনতা নিয়ে উন্নত দেশগুলো যেভাবে ভেবেছে, বিশেষ করে চলচ্চিত্রে যৌনতা বা খোদ নীল ছবি অথবা নীল ছবিতে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে, সেভাবে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশ ভাবতে পারেনি, পারেনি এর বড় একটি কারণ যদি হয় শিক্ষা, তো আরেকটি বড় কারণ ধর্মীয় নৈতিকতাশাসিত সমাজকাঠামো। শিল্প ও অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা তো আছেই।

অভিডির এই রচনাটি প্রকাশের সাত বছর পর আবারও উত্তর ইউরোপের দেশ সুইডেনে একটি সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ইশতেহার প্রকাশ করেন মিয়া এনবারি, নাম: ‘ডার্টি ডায়েরিজ মেনিফেস্টো’ (২০০৯)। ‘ডার্টি ডায়েরিজ’ নামে একটি চলচ্চিত্রও তৈরি করেন এনবারি, যেখানে তেরোটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি সংকলিত হয়। নারীবাদী নির্মাতাদের এসব ছবিতে বিষমকাম ছাড়াও বিচিত্রকাম (quee) দেখানো হয়। ছবিটি নির্মাণে গণ-অর্থায়ন থাকাতে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় পরিচালককে। পুজ্জি পাওয়ারের মতো ডার্টি ডায়েরিজও তত্ত্ব ও প্রয়োগ দুটিই করে দেখিয়েছে। তবে পুজ্জি পাওয়ারের মতো বিধিনিষেধের দড়ি অতটা আঁটোসাঁটো করে বাঁধেনি ‘নোংরা দিনলিপি’

নিজেদের ইশতেহারে দশটি ভাগে ডার্টি ডায়েরিজ সংক্ষেপে যা বলেছে তা হলো পণ্য ও বাণিজ্যের এই দুনিয়ায় যেন সৌন্দর্য হারিয়ে না যায়, যেন এই দুনিয়া আমাদের প্রয়োজন ও বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ না করে। নিজের কামনা প্রকাশের অধিকার থাকতে হবে। তা ছাড়া যৌনচর্চায় সক্রিয় ও স্বাধীন নারীরা হয় পাগল, নয় তো সমকামী, এই ধরনের ক্লিশে সাংস্কৃতিক ভাবনারও নিন্দা জানায় এই ইশতেহার।

অন্যান্য ইশতেহারের মতো শুধু যৌনতা ও নারীতে আবদ্ধ না থেকে এই ইশতেহার রাজনীতি ও সমাজের দিকেও চোখ ফিরিয়েছে। তাই একে বলতে দেখা যায়: ‘পর্ন কারখানা লৈঙ্গিক পক্ষপাতদুষ্ট (sexist)। কারণ, আমরা বাস করি পিতৃশাসিত পুঁজিবাদী সমাজে। এই সমাজ লোকেদের যৌনতা ও যৌনাবেগসম্পর্কীয় প্রয়োজন থেকে মুনাফা বানায় এবং কৌশলে নারীদেরও শোষণ করে। লৈঙ্গিক পক্ষপাতদুষ্ট পণ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে আপনাকে পুঁজিবাদ ও পিতৃতন্ত্রকে আঘাত করতে হবে।’ (এনবারি ২০১৪: ৩৯৮)

যৌনতার ক্ষেত্রে হ্যাঁ বা না যেটাই হোক উত্তর, সেটা প্রকাশে নির্ভীক হওয়ার পরামর্শ যেমন দেয় এই ইশতেহার, তেমনি বৈধ উপায়ে গর্ভপাতেরও সমর্থন জোগায় এটি। চিত্রশাসন (censorship) যৌনতাকে মুক্ত করতে পারবে না। তা ছাড়া নারীর যৌনতার যে চিত্র, সেটাও ততক্ষণ পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত যৌনতার চিত্র নিজেই নিষিদ্ধ বস্তু বা ট্যাবু হয়ে থাকছে। সমাজের প্রতি তাই এই ইশতেহারের আহ্বান, যৌনতা প্রকাশের জন্য নারীকে আক্রমণ করবেন না, যৌনবাদকে (sexism) আক্রমণ করুন, কারণ, এটি আমাদের যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।

পারস্পরিক লৈঙ্গিক লড়াইয়ে বিশ্বাসী নয় এই ইশতেহার, যেকোনো লিঙ্গের মানুষকে পছন্দ করুন, তাঁকে ভালোবাসুন। কারণ, যৌনতা বিচিত্র, এমনটাই বিশ্বাস করে ‘নোংরা দিনলিপি’। যৌনাবেগসম্পর্কীয় বিষয়াদি খুবই ভালো এবং এগুলোকে আমাদের দরকার। এই দিনলিপির ইশতেহার আরও মনে করে, মূলধারার নীল ছবির বাইরে বিকল্প ধারা তৈরি করা সম্ভব, নিজেদের পছন্দসই কামোদ্দীপক ছবি বানানোর মধ্য দিয়ে।

Mia Engberg. Photo: © Sarah Mc Key

৩.
চলচ্চিত্রে মূলধারার অশ্লীল লিপি বা পর্নোগ্রাফি যে কারখানায় নির্মাণ করা হয়, তার ভেতর নারীদের অবস্থান নির্ণয় করে নতুন ধরনের নারীবাদকে তুলে ধরা অথবা নারীবাদে ক্রমপরিবর্তনশীল চিন্তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন ধরনের নীল ছবি নির্মাণ করতে চাওয়া—এ দুটো বিষয়ই মূলত প্রধান হয়ে উঠেছে ইশতেহারগুলোতে। এগুলোর মধ্যে অবশ্য বিচিত্র রকম যৌনতার বিষয় এসেছে, এসেছে লিঙ্গে লিঙ্গে সমতা আর ভালোবাসা প্রতিষ্ঠার কথা, আরও এসেছে কর্তৃত্ব না ফলানোর আহ্বান। লড়াই করার দিকনির্দেশনাও এসেছে—পিতৃতন্ত্র আর পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে অশ্লীল লিপি বা এর সংশ্লিষ্টদের নিয়ে নতুন করে ভাবার ও নতুন কিছু করে বিদ্যমান সমাজের কিছু প্রচলিত ধারণাকে পেছনে ফেলবার একটা প্রয়াস এসব ইশতেহারে জ্বলজ্বল করছে।

নারীবাদ ও ইশতেহারের কথা যেহেতু হচ্ছেই সে ক্ষেত্রে ব্রিটিশ পণ্ডিত লরা মালভের কথা না বললে অন্যায় হবে। তাঁর সুলিখিত ‘ভিজ্যুয়াল প্লেজার অ্যান্ড নেরেটিভ সিনেমা’ (১৯৭৫) প্রবন্ধটি বর্তমান সময়ের নারীবাদী চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে বাতিঘরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বলা যায় নির্দ্বিধায়। একে এখন ইশতেহারের মর্যাদাই দেওয়া হয়, আর লরা মালভে ও তাঁর স্বামী পিটার উলেন মিলে যে ছবিটি তৈরি করেছেন—‘রিডিলস অব দ্য স্ফিংস’ (১৯৭৭), সেটিকে বলা হয় ‘ইশতেহার চলচ্চিত্র’

ফ্রয়েডীয় ও লাকাঁনীয় মনোবিশ্লেষণের মাধ্যমে লরা মালভে ওই রচনায় দেখিয়েছেন কীভাবে প্রচ্ছন্নদর্শনরতি (scopophilia) ও দর্শনরতি (voyeurism) সক্রিয় থাকে পর্দার সামনে বসা দর্শকের মনে। এই প্রক্রিয়া শুধু কাহিনিচিত্র দেখা দর্শকদের ভেতর নয়, নীল ছবির দর্শকদের ভেতরেও ক্রিয়াশীল থাকে। এসব ছবির দর্শক নিজেদের প্রতিস্থাপন করে পর্দায় থাকা চরিত্রে এবং এর মাধ্যমেই রতিসুখ পায় তারা।

তবে যৌনতা নিয়ে উন্নত দেশগুলো যেভাবে ভেবেছে, বিশেষ করে চলচ্চিত্রে যৌনতা বা খোদ নীল ছবি অথবা নীল ছবিতে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে, সেভাবে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশ ভাবতে পারেনি, পারেনি এর বড় একটি কারণ যদি হয় শিক্ষা, তো আরেকটি বড় কারণ ধর্মীয় নৈতিকতাশাসিত সমাজকাঠামো। শিল্প ও অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা তো আছেই।

কিন্তু উন্নত বিশ্বে এই যে প্রচলিত নীল ছবির বাইরে গিয়ে ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা ফুটে ওঠে ইশতেহারে, এটাই ইঙ্গিত করে বাজারে চলতি নীল ছবিতে তথা সমাজে যৌনতা নিয়ে সমস্যা কিছু রয়েছেই। যদি ফিরে যাই আন্তোনিও গ্রামসির কাছে, বেহাত বিপ্লব (passive revolution) প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি এক জায়গায় বলছেন, কোনো সমাজে যদি উত্তরণের পথ খোঁজা হয়, তাহলে বুঝতে হবে সেই সমাজে সংকট বিদ্যমান। (গ্রামসি ২০০৪: ১০৬) গ্রামসি অবশ্য এই কথা ধার করেছেন কার্ল মার্ক্সের কাছ থেকে। ‘দ্য ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’ বইয়ের মুখবন্ধে মার্ক্স লিখেছেন, ‘কোনো সামাজিক বিন্যাসই ধ্বংস হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না ওই সমাজের সাপেক্ষে উৎপাদনশীল শক্তি পূর্ণ বিকশিত হয়ে ওঠে; এবং নতুন উৎকৃষ্টতর উৎপাদন সম্পর্ক পুরোনোটাকে কক্ষনো প্রতিস্থাপন করে না, যতক্ষণ না তাদের অস্তিত্বের জন্য বস্তুগত অবস্থা আগের সামাজিক কাঠামোর ভেতর পরিপক্ব হয়ে উঠছে। মানবসভ্যতা তাই সেই কাজ করতেই অবধারিতভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে, যেটা সে সমাধা করতে পারবে…।’ (মার্ক্স: অনলাইন)

কাজেই উল্লিখিত ইশতেহারে যৌনতাকে কেন্দ্র করে যে নতুন পথের সন্ধান করা হচ্ছিল বা নতুন কর্মপরিকল্পনা করছিল একদল মানুষ পুরোনোকে বদলে ফেলার জন্য, সেটাই প্রমাণ করে সমাজের ভেতর যৌনতাকে কেন্দ্র করে নানামুখী সংকট বিদ্যমান। আর তাই সংকট সমাধানে সক্রিয় হয়ে শুধু ইশতেহার নয়, অনেকে মাঠেও নেমে পড়েন নতুন চিন্তাধারার নীল ছবি নির্মাণে। ইশতেহার লেখকদের মধ্যে অনেকের মতো আমরাও মনে করি মানবজীবনে যৌনতা একটি অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এখানে নারীকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই, তবে নীল ছবিকে শৈল্পিক করে তুলতে হবে কেন এবং তাকে কেনই-বা শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে অপরিহার্য করে তুলতে হবে, সেটা নিয়ে আমরা সন্দিহান, কারণ, শিল্পের কাজ কি সবই উন্মুক্ত করে দেওয়া, না কিছুটা আড়াল ও ইশারা তৈরি করা, এই প্রশ্ন জারি রেখেই মনে হয় এই আলোচনা আপাতত মুলতবি ঘোষণা করা যায়।

 

সহায়

  1. Scott MacKenzie, Introduction: An invention without a future, Film Manifestos and Global Cinema Cultures: A Critical Anthology, edited by Scott MacKenzie (London: University of California Press, 2014)
  2. Germaine Greer, Al Goldstein, Jean Shrimpon, Jay Landeman, Richard Neville, Didi Wadidi, Mike Zwerkin, Wet Dream Film Festival Menifesto: S.E.L.F, Film Manifestos and Global Cinema Cultures: A Critical Anthology, edited by Scott MacKenzie (London: University of California Press, 2014)
  3. Laura Mulvey, Visual Pleasure and Narrative Cinema, Film Manifestos and Global Cinema Cultures: A Critical Anthology, edited by Scott MacKenzie (London: University of California Press, 2014)
  4. Vilgot Sjöman, An Egret in the Porno Swamp: Notes of Sex in the Cinema, Film Manifestos and Global Cinema Cultures: A Critical Anthology, edited by Scott MacKenzie (London: University of California Press, 2014)
  5. Annie Sprinkle, Veronica Vera, Frank Moores, Candida Royale and Leigh Gates, The Post Porn Modernist Manidesto, Film Manifestos and Global Cinema Cultures: A Critical Anthology, edited by Scott MacKenzie (London: University of California Press, 2014)
  6. Vibeke Windeløv, Lane Børglum, Gerd Winther, Lili Hendriksen, Christian Loshe and Mette Nelund, Puzzy Power Manidesto: Thoughts on Woman and Pornography, Film Manifestos and Global Cinema Cultures: A Critical Anthology, edited by Scott MacKenzie (London: University of California Press, 2014)
  7. Ovidie, My Porn Manidesto, Film Manifestos and Global Cinema Cultures: A Critical Anthology, edited by Scott MacKenzie (London: University of California Press, 2014)
  8. Mia Engberg, Dirty Diaries Manidesto, Film Manifestos and Global Cinema Cultures: A Critical Anthology, edited by Scott MacKenzie (London: University of California Press, 2014)
  9. Louis Althusser, Machiavelli and Us (London: Verso, 1999)
  10. Antonio Gramsci, Selection from Prison Notebooks (Chennai: Orient Longman Private Ltd., 2004).
  11. Karl Marx and Friedrich Engels, The Communist Manifesto (London: Penguin Books, 2002).
  12. Karl Marx, A Contribution to the Critique of Political Economy, Link Source: https://bit.ly/1MB6af7
  13. ধ্রুবজ্যোতি মজুমদার (সংকলক), মনোবৈজ্ঞানিক পরিভাষা-সংগ্রহ, সুভাষ ভট্টাচার্য সম্পাদিত (কলকাতা: ডি.এম. লাইব্রেরি, ২০১৩)

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.