:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
ইহতিশাম আহমদ

পরিচালক, সমালোচক

শুটিং বিড়ম্বনা (পর্ব-৪)
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

চলচ্চিত্রিক মানসিকতা – ৭

শুটিং বিড়ম্বনা (পর্ব-৪)

শুটিং বিড়ম্বনা (পর্ব-৩)-এর পর থেকে-

এবার যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলব সেগুলো অভিনয় শিল্পী সংক্রান্ত হলেও এর পুরো দায় অভিনয় শিল্পীদের নয়। বরং আমি মনে করি এর অধিকাংশ দায় পরিচালকদের। তার মধ্যে একটি হল ডায়লগ মুখস্থ না থাকা। ভাবছেন, এখানে পরিচালকের দোষটা কোথায়? শুনলে অবাক হবেন, কিছু কিছু টিভি নাটকের পরিচালক আছে যারা স্ক্রীপ্ট ছাড়াই শুটিং করে। তারা শুধু ঠিক করে নেয় কোন দৃশ্যের পর কোন দৃশ্য হবে এবং সেখানে কি কি ঘটবে। সেটে হাজির হওয়ার পরে অভিনেতা অভিনেত্রীকে তারা বিষয়টা বুঝিয়ে দেয়। তারপর লাইট ক্যামেরা এ্যকশন। অর্থাৎ নায়ক নায়িকাসহ সবাই-ই তাৎক্ষনিক ভাবে নিজে নিজে বানিয়ে বানিয়ে ডায়লগ বলতে থাকে।

বাংলা ভাষায় একটা অনেক পুরোনো প্রবাদ আছে, ‘যার কাজ তার সাজে, অন্যের লাঠি বাজে’। সংলাপ নির্মাণ বা একটা চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলা যদি এতটা সহজই হবে, তো পুরো বাংলাদেশটা হুমায়ূন আহমেদ আর সৈয়দ শামসুল হক-এ ভরে যাচ্ছে না কেন? তাছাড়া অভিনয় শিল্পীরাই যদি ডায়লগ বানাবে, তো লেখকদের জন্যে আর আলাদা করে বাজেটই বা রাখা কেন? বস্তুতঃ এই অভিনব প্রক্রিয়াটি আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে স্ক্রীপ্ট রাইটারদের সম্মান এবং সম্মানী দুটোই বন্ধ হওয়ার পথে।

নিজেদের মত করে ডায়লগ দেয়া যেতে পারে এই বিষয়টা জানতে পারার পর থেকে যে সমস্ত পরিচালকরা চায় যে তার নায়ক হুবহু স্ক্রীপ্টে লেখা ডায়লগকে অনুসরণ করুক, সেই সমস্ত পরিচালকদের প্রতি বর্তমানে বেশির ভাগ অভিনেতাই বিরক্ত বোধ করেন। অথচ হলিউড বা বলিউডের যে সমস্ত সিনেমা দেখে আমরা মুগ্ধ হই, আফসোস করি, আমাদের দেশে কেন এমন কিছু হয় না, সেই সব সিনেমার ডায়লগ তৈরি করা হয় অনেক ভেবে চিন্তে এবং কোন আর্টিষ্ট যদি তার এক চুলও পরিবর্তন করার চেষ্টা করে তো তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে, ‘এই স্ক্রীপ্টটার পিছনে আমার এত টাকা ব্যয় হয়েছে। তুমি সেটাকে এভাবে পাল্টানোর অধিকার রাখো না।’

এভাবে নিজের ইচ্ছা মত ডায়লগ বা স্ক্রীপ্ট পাল্টানোকে বলা হয় ইমপ্রোভাইজেশন। মূলতঃ এটার সূচনা মঞ্চ নাটক থেকে। তবে মঞ্চে এটা তেমন একটা জনপ্রিয়তা পায় নাই। আমি আমার থিয়েটার জীবনে মাত্র একটা ইমপ্রোভাইজেশন ড্রামা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। নাটকটির নাম ছিল- একটি রাত, একটি রাইফেল ও রাজাকার। ১৬ই ডিসেম্বর উপলক্ষে নাটকটি নির্মিত হয়।

আমাদের চরিত্রগুলো ঠিক করে দেয়া হল। কাহিনির লাইন আপ জানিয়ে দেয়া হল। তারপর আমাদের নিজেদের মতো করে অভিনয় করতে বলা হল। আমরা সবাই চরম অসহায় বোধ করতে লাগলাম। পারলে রিহার্সেল রুম থেকে ভেগে যাই। তারপর ধমক খেয়ে যে যা পারি একটু একটু করে বলতে বা করতে শুরু করলাম। পরিচালক, আমার নাট্য গুরু শ্রদ্ধেয় মাজেদ রানা, রিহার্সেল ফ্লোরের এক কোনে বসে সব দেখছিলেন এবং আমরা যখন আটকে যাচ্ছিলাম তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। সেই সাথে খেয়াল রাখছিলেন আমরা মূল কাহিনি থেকে সরে যাচ্ছি কি না। আর একজন খাতা কলম নিয়ে যে ডায়লগগুলো ফাইনাল হচ্ছিল তা টুকে রাখছিল।

এভাবে দিন ব্যাপী এক ওয়ার্কশপের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক দাঁড়িয়ে গেল। এরপরে আমরা এটা নিয়ে মাত্র চার দিন রিহার্সেল করেছিলাম। যেখানে অন্যান্য নাটকে এক মাসের মত রিহার্সেল করতে হতো। ইমপ্রোভাইজেশন ড্রামার মূল কনসেপ্টটা হল, যেহেতু আর্টিস্টের নিজের মাথা থেকেই ডায়লগগুলো বের হচ্ছে, তাই সেটার জন্যে আর বাড়তি রিহার্সেলের প্রয়োজন থাকছে না। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রত্যেকটি অভিনয় শিল্পীকেই সেক্ষেত্রে নাট্য বোদ্ধা হতে হবে, নয়ত মানসম্মত কোন নাটক দাঁড়বে না। আর একটা নাট্য দলে হাতে গোনা মাত্র কয়েকজনই এমন নাট্য বোদ্ধা পাওয়া যায়। বাকিরা সব ফলোয়ার। তাদের যা বলা হবে, তাই তারা চমৎকার ভাবে করতে পারবে। কিন্তু নুতন কিছু সৃষ্টি করতে পারাটা তাদের জন্যে নেহাতই কষ্টকর। শুধু মাত্র এই দূর্বলতাটির জন্যে থিয়েটার জগতে ইমপ্রোভাইজেশন ড্রামা তেমন একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। যদিও তা বর্তমানে টিভি নাটকের জগতে অতি জনপ্রিয় একটি বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে সিনেমা জগতেও।

শুনলে অবাক হবেন, কিছু কিছু টিভি নাটকের পরিচালক আছে যারা স্ক্রীপ্ট ছাড়াই শুটিং করে। তারা শুধু ঠিক করে নেয় কোন দৃশ্যের পর কোন দৃশ্য হবে এবং সেখানে কি কি ঘটবে। সেটে হাজির হওয়ার পরে অভিনেতা অভিনেত্রীকে তারা বিষয়টা বুঝিয়ে দেয়। তারপর লাইট ক্যামেরা এ্যকশন। অর্থাৎ নায়ক নায়িকাসহ সবাই-ই তাৎক্ষনিক ভাবে নিজে নিজে বানিয়ে বানিয়ে ডায়লগ বলতে থাকে।

আমার লেখা প্রথম টিভি নাটক, যেটা অন এয়ার হয়নি এবং আর কোনদিন হবে বলে মনেও হয় না, সেটার শুটিংয়ে কয়েক ঘন্টার জন্যে এক স্টার আর্টিস্ট আসলেন। স্ক্রীপ্ট দেখলেন। পরিচালকের কথা শুনলেন। তারপর বললেন, “আমি ডায়লগগুলোকে আমার মত করে দেই, হ্যাঁ?” তারপর তিনি সিরিয়াস একটি চরিত্রকে কমেডি বানিয়ে তার পেমেন্ট বগলদাবা করে বাড়ি চলে গেলেন। এবং পরিচালক সেটা শুধু মেনেই নিলেন না, বরং উৎফুল্ল কন্ঠে বললেন, ‘এইটাই বরং ভাল হইছে।’ পরিচালক সাহেব, আপনার যদি ভাঁড়ামীই দরকার, তো বলতেন, আমি আপনাকে না হয় গোপাল ভাঁড়ের কোন কাহিনীর নাট্যরূপ করে দিতাম। অযথা রাতের পর রাত জেগে প্রতিটি চরিত্র নিয়ে এত কষ্ট আর করতাম না।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, হলিউডে কি ইমপ্রোভাইজেশন হয় না? হয়। টরান্টিনোর জ্যাংগো আনচেইনড সিনেমাটির একটি সিন ছিল, ডিক্যাপ্রিও টেবিলে জোরে একটা বাড়ি মেরে কথা বলবে। কিন্তু কাঁচের টেবিলে বাড়ি মারতে গিয়ে টেবিলটা ভেংগে যায় এবং ডিক্যাপ্রিওর হাত কেটে রক্ত ঝরতে শুরু করে। কিন্তু ডিক্যাপ্রিও তার অভিনয় ওভাবেই চালিয়ে যান, টেক শেষ না হওয়া পযর্ন্ত। পরিচালক সেই শটটাকেই ওকে হিসাবে গ্রহণ করেন। বিভিন্ন সিনে পত্রিকায় বা প্রচার মাধ্যেমে এই ইমপ্রোভাইজেশন নিয়ে ব্যাপক আলোচনাও হয়। টেবিল ভেংগে এবং হাত কেটে যাওয়ার পরেও তিনি অভিনয় চালিয়ে গেছেন বলে সবাই ডিক্যাপ্রিওর অভিনয়ের প্রতি নিষ্ঠার প্রশংসা করে। সাংবাদিক ও সমালোচক ভাইয়েরা, আপনারা তো জানেন না, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এমন অনেক নিষ্ঠাবান অভিনেতা রয়েছে, যারা নাটক সিনেমা ভেংগে গেলেও, পরিচালক, প্রযোজক বা স্ক্রীপ্ট রাইটারদের বুক থেকে রক্ত ঝরলেও, তাদের অভিনয় তারা চালিয়েই যান।

ডায়লগ মুখস্থ না থাকার আরেকটি কারণ হল, অভিনেতার হাতে সময়মতো স্ক্রীপ্ট না পৌঁছানো। আমি অনেকগুলো শর্টফিল্মে অভিনয় করলেও এ পর্যন্ত মোট তিনটা নাটকে কাজ করেছি। প্রত্যেকটাই নায়ক নায়িকার আশে পাশের চরিত্র। টিভি নাটকের নায়ক নায়িকাদের নিশ্চিত ভাবেই স্টার হতে হয়, যা আমি নই। তো, প্রতিবারই আমি সেটে উপস্থিত হওয়ার পরে স্ক্রীপ্ট হাতে পেয়েছি। কেন? কারণ দুটো। এক, আগে থেকে স্ক্রীপ্ট দিলে কাহিনি চুরি হয়ে যেতে পারে। আর ২য় কারণটি হল, শুটিংয়ের ডেট ফাইনাল হওয়ার পরেও স্ক্রীপ্ট ফাইনাল না হওয়া। মানে তখনও স্ক্রীপ্ট লেখা শেষ হয়নি। ডাইরেকটর নিজেই যদি তার ভাই বেরাদর, বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে স্ক্রীপ্ট লিখতে বসে যান, তাহলে তো পরিস্থিতি এমন হবেই। হাজার হোক, যার কাজ তারই সাজে। অন্যের লাঠি বাজে।

প্রথম দুটি নাটকে আমার অতি জঘন্য পারফমেন্স হয়। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, শর্ট ফিল্মে অভিনয় করে যা কিছু সুনাম কামিয়েছি টিভি নাটক করে তা খোয়াতে চাই না। কিন্তু পরে আমার এক ছাত্রের অনুরোধে তার একটা নাটকে অভিনয় করি। তবে সেখানেও কাজ করে আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই। যদিও স্ক্রীপ্ট আমার হাতে অনেক আগেই এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু অভিনয় ভাল হতে গেলে কো-আর্টিস্টের সাথে সামঞ্জস্য রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার ডায়লগ মুখস্থ থাকলেও নায়ক তো বারবার তার ডায়লগ ভুলে যাচ্ছিল। বলে রাখা ভাল, টিভি নাটক বলেন আর পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বলেন, নায়ক এবং নায়িকা সব সময়ই আগে থেকে স্ক্রীপ্ট হাতে পায়। ইনফ্যাক্ট, স্ক্রীপ্ট পড়েই তারা সিদ্ধান্ত নেয় উক্ত টিভি নাটক বা সিনেমাতে সে কাজ করবে কি না।

টিভিতে ডাবিংএর খুব একটা প্রচলন না থাকলেও সিনেমায় যেহেতু ডাবিং করতেই হয় (কেউ যদি না করতে চান তো তার বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা করার কোন সুযোগ অবশ্য নেই), তাই সিনেমার শুটিংয়ের সময় স্ক্রীপ্ট রাইটার উপস্থিত থাকে। ডায়লগে কি কি পরিবর্তন আসল সেটা সে তৎক্ষনাৎ লিখে ফেলে। কারণ অন্যান্য দেশে গাইড ট্র্যাক হিসাবে একটা অডিও রেকর্ড করা হলেও, আমাদের চলচ্চিত্রে শুটিংয়ের সময় কোন অডিও রেকর্ড করা হয় না। অর্থাৎ বোবা শুটিং করা হয়। তাই ডাবিংয়ের সময় অভিনেতা প্রায়শঃই ঠিক মত মনে করতে পারে না তিন চার মাস আগে শুটিংয়ের সময় সে কি ধরনের কন্ঠ বা আবেগ ব্যবহার করেছিল। আমাদের সিনেমার বেশির ভাগ অভিয়নগুলো একই ধাঁচের হওয়ার এটাও একটা কারণ। ডিজিটাল যুগে টিভি ক্যামেরা আর সিনে ক্যামেরার পার্থক্যটা অনেকখানি কমে আসায় সাম্প্রতিক কালে অবশ্য এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করেছে।

অনেকের মাথায় প্যাঁচ লাগতে পারে, তাই সিনে ক্যামেরা ও টিভি ক্যামেরার পার্থক্য কমে আসার বিষয়টা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করছি। এরি এ্যলেক্সা সিনে ক্যামেরা, যেটা দিয়ে টিভি বিজ্ঞাপন শুট করা হয়। সনি কোম্পানীর সিনে আল্টা সিনেমার শুটিংয়ের জন্যে বানানো, যা দিয়ে অনেক টিভি চ্যানেল নিউজ কাভার করে। মার্ক থ্রি ফাইভ ডি স্টীল ছবি তোলার ক্যামেরা, যেটা দিয়ে সিনেমা করা হচ্ছে। আশা করি, বিষয়টা খোলাসা হয়েছে।

এক কালে বলা হল, দেশে কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি। পরিস্থিতি দাঁড়ালো, কবিদের থেকে অভিনেতা এবং পরিচালকের সংখ্যা বেশি। জেলা শহরের থিয়েটারগুলোতে তালা ঝুলতে শুরু করল। পরিচালক বা প্রযোজকের সাথে পরিচয় থাকলেই যেখানে অভিনতা হওয়া যায়, সেখানে কষ্ট করে আর কন্ঠের ব্যায়াম, নিঃশ্বাসের ব্যায়াম, শরীরের নমনীয়তা বৃ্দ্ধির ব্যায়াম, স্মরণ শক্তি বৃদ্ধির ব্যায়াম, এত ব্যায়াম করে কি হবে? আমি তো অভিনেতা হব, বডি বিল্ডার তো হব না!!

এবার আসা যাক, আমাদের দেশে অভিনয় শিল্পীদের আঁতুর ঘর কোনটি। এক কালে টিভি বা সিনেমায় অভিনেতারা আসত থিয়েটার নয়ত বিটিভির নতুন কুঁড়ি থেকে। হুমায়ূন ফরীদি, আফজাল হোসেন, সুবর্ণা মোস্তফা, শম্পা রেজা, আলী জাকের, সারা জাকের, রাইসুল ইসলাম আসাদ, রামেন্দ্র মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, আসাদুজ্জামান নূর, ডলি জহুর ইত্যাদী ডাকসাইটে অভিনয় শিল্পীরা এসেছেন থিয়েটার থেকে। আর ঈশিতা, তারিন, আমাদের সাবেক ডাক ও টেলি যোগাযোগ মন্ত্রী তারানা হালিম, এঁদের আগমন বিটিভির নতুন কুঁড়ি থেকে। এরপরে টিভি বিজ্ঞাপনের মডেলদের মাঝ থেকে অভিনয় শিল্পী সংগ্রহ করা শুরু হয়। তাদের মাঝে সবাই অভিনয় শিল্পী হিসাবে সফল না হলেও আফসানা মিনি, তানিয়া আহমেদ, শিমুল দারুণ ভাবে সফলতা দেখান। এছাড়া তৌকির আহমেদ, জাহিদ হাসান, বিপাশা, শমী কায়সার, শহীদুজ্জামান সেলিম সবাইই মূলতঃ থিয়েটার থেকে আসা।

সিনেমার ক্ষেত্রে রাজু আহমেদ, শওকত আকবর, প্রবীর মিত্র, এমন কি নায়ক রাজ রাজ্জাকেরও থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে। পরিচালক সুভাষ দত্ত চট্টগ্রাম জেলার একটি গ্রাম থেকে মিনা পাল নামে এক অভিনয় না জানা তরুনীকে নিয়ে এসে পুরো চার মাস অভিনয় প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে নায়িকা কবরী বানিয়ে তোলেন। অতীতে আমাদের দেশের চলচ্চিত্রে থিয়েটারের বাইরে থেকে অভিনয় সংগ্রহ করা হলে তাকে রীতিমত প্রশিক্ষণ দিয়ে অভিনয় শিখিয়ে নেয়ার রেওয়াজ ছিল।

এরপরে আসল, ইম্প্রোভাইজেশনের যুগ। তরুণ পরিচালকরা ভাবতে লাগল, দারুণ তো, আর্টিষ্টদের অভিনয় দেখিয়ে দেয়ার ঝামেলা নাই। অপর দিকে আবুল, কাবুল, রহিম, করিম, সালেকা, মালেকারা ভাবতে থাকল, অভিনয় তো খুব সহজ কাজ, আমিও পারব। তাই দূর্দান্ত কনফিডেন্স নিয়ে সবাই পরিচালনায় আর অভিনয়ে নেমে গেল। এক কালে বলা হল, দেশে কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি। পরিস্থিতি দাঁড়ালো, কবিদের থেকে অভিনেতা এবং পরিচালকের সংখ্যা বেশি। জেলা শহরের থিয়েটারগুলোতে তালা ঝুলতে শুরু করল। পরিচালক বা প্রযোজকের সাথে পরিচয় থাকলেই যেখানে অভিনেতা হওয়া যায়, সেখানে কষ্ট করে আর কন্ঠের ব্যায়াম, নিঃশ্বাসের ব্যায়াম, শরীরের নমনীয়তা বৃ্দ্ধির ব্যায়াম, স্মরণ শক্তি বৃদ্ধির ব্যায়াম, এত ব্যায়াম করে কি হবে? আমি তো অভিনেতা হব, বডি বিল্ডার তো হব না!!

যেমন তেমন অভিনয়ের সাথে প্রশিক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত অভিনয়ের তফাৎ যে কতখানি সম্প্রতি তা অমিতাভ রেজা তার আয়নাবাজিতে দেখিয়ে দিয়েছেন। এই সিনেমাটির সফলতার অনেকগুলো কারণের মাঝে একটি হল দর্শক প্রতিটি দৃশ্যে, প্রতিটি চরিত্রে মুগ্ধ হওয়ার মত অভিনয় খুঁজে পেয়েছে।

যাহোক, বর্তমানে অভিনয় শিল্পী সংগ্রহের প্রধান জায়গাটি হল, টিভি রিয়েলিটি শো। তবে অভিনয় সংক্রান্ত রিয়েরিটি শো কমই হয়। বেশির ভাগই হয়, গান ও মডেলিং নিয়ে। কিন্তু তাতে কি? আমার এক পরিচালক ছোট ভাই একদিন আমাকে একটা মেয়েকে দেখিয়ে বলল, “এই মেয়েটাকে দিয়ে ভাল অভিনয় হবে।” জানতে চাইলাম, ”কেন?” উত্তর এলো, “মেয়েটা ভালো নাচ জানে। নাচের মেয়েদের তাল জ্ঞানটা খুব ভাল থাকে।” অভিনয় শিল্পীদের তাল লয় বা রিদম এন্ড টেম্পু শেখাটা বাধ্যতামূলক। তবে শুধু তাল জ্ঞান দিয়েই যে অভিনয় করা যায় এটা সেদিন প্রথম জেনেছিলাম।

আরেকটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অভিনয় শিল্পীদের নিয়ে আলোচনার সমাপ্তি টানবো। সিনেমা দেখাটা যতটা আনন্দের, শুটিং বিষয়টা ঠিক ততটাই বিরক্তিকর ও ক্লান্তিকর। অনেক সময় দেখা যায় অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ নেই এমন কাউকে আপনি পটিয়ে পাটিয়ে নায়িকা বানিয়েছেন তার সুন্দর চেহারার জন্যে। একে তো সে অভিনয় জানে না, তার উপর তার আগ্রহও নাই। সুতরাং পেশাদারীত্ব তো দূরের কথা, অনেক সময় প্রয়োজনীয় সহযোগীতাও আপনি তার কাছ থেকে পাবেন না। এটা পারব না, ওটা করব না, এতটার মধ্যেই আমাকে ছেড়ে দিতে হবে, এই জাতীয় সমস্যা আমি ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই পেয়েছি। তাদের আচরণটা হয়, আমি তো চাই নাই, আপনিই তো আমাকে জোর করে নিয়ে আসছেন। তখন মাথার চুল ছেঁড়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। তাই যারা সিরিয়াসলি অভিনয় করতে চায়, তাদেরকে নিয়ে কাজ করাই নিরাপদ।

এবার দেখা যাক, প্রযোজক, ক্যামেরাম্যান, প্রোডাকশনের লোকজন এবং সব শেষে ক্যাপ্টেন অফ দা শিপ অর্থাৎ পরিচালক সাহেবের কারণে কিভাবে শুটিং বিড়ম্বিত হয়।

চলবে…

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.