:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
ইহতিশাম আহমদ

পরিচালক, সমালোচক

চলচ্চিত্র রিভিউ: ‘টান’

চলচ্চিত্র রিভিউ: ‘টান’

শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের কবি আল মাহমুদের ‘জলবেশ্যা’ নামক গল্পটি থেকে অনুপ্রাণিত চলচ্চিত্র ‘টান’-এর কাহিনি। কিন্তু আদতে ‘জলবেশ্যা’ কনসেপ্টটিই শুধু এই চলচ্চিত্রে গ্রহণ করা হয়েছে। গল্পের বাকি ঘটনার সাথে চলচ্চিত্রটির আর কোনো মিল নেই।

বেদেনিরা নৌকায় চড়ে ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। সাপখেলা দেখায়। তাদের মাঝে অনেকেই রাতের আঁধারে নৌকার পাটাতনের ওপরে পয়সার বিনিময়ে আদিম পেশায় লিপ্ত হয়। যেহেতু তাদের বেশ্যাবৃত্তি নৌকায় বা জলের ওপরে, তাই তাদের নাম জলবেশ্যা। চলচ্চিত্রে একাধিকবার জলবেশ্যা শব্দটি এসেছে। মূল নায়িকা সুন্দরী (ঋতুপর্ণা)-সহ অন্য জলবেশ্যাদের বেশ্যা জীবনকে দেখানো হলেও চলচ্চিত্রটির মূল আলোচ্য কিন্তু একেবারেই ভিন্ন।

টান মূলত দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর-গোত্রীয় সেন্টিমেন্টকে ঘিরে নির্মিত। নায়ক সাজু পেশায় একজন ফটোগ্রাফার। কিন্তু বিজ্ঞাপনের জন্য নানাবিধ পণ্যসামগ্রীর ছবি তুলে তুলে সে ক্লান্ত। অপর দিকে তার বাকি দুই বন্ধু লিজা এবং জন মুম্বাইতে গিয়ে বিজ্ঞাপন নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। লিজার প্রতি সাজুর মানসিক দুর্বলতা থাকলেও লিজা প্রতিষ্ঠিত কাউকেই আপন করে নিতে চায়। ফলে সাজু চলে যায় সুন্দরবনে ন্যাচার ফটোগ্রাফি করতে। আর লিজা ও জন মুম্বাইতে তাদের কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠা খুঁজে পায়। সেই সাথে তারা একত্রে বসবাসও শুরু করে।

চলচ্চিত্রটিতে কয়েকটি বেড সিন বা যৌনদৃশ্য রয়েছে। সাধারণত আমরা দুইভাবে বেডসিন দেখতে অভ্যস্ত। এক, সরাসরি নগ্নতা। অর্থাৎ পাত্রপাত্রীর যৌনাচারকে খোলামেলাভাবে দেখানো। দুই. যৌনতার শুরুটুকু দেখিয়ে জাম্প কাট করে যৌনতার পরের দৃশ্যে চলে গিয়ে মূল যৌনাচারটি এড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু ‘টান’ চলচ্চিত্রটিতে তৃতীয় একটি উপায়ে যৌনাচারকে চিত্রায়ণ করা হয়েছে। এখানে জাম্প কাটের সহায়তা নেওয়া হয়নি। মানে পুরো যৌনাচার দেখানো হয়েছে। কিন্তু নারী বা পুরুষের কেউই সেই অর্থে নগ্ন ছিল না।

কিন্তু একঘেয়ে ব্যস্ত শহুরে জীবনে লিজার মাঝে একসময় ক্লান্তি আসে। সে সাজুর প্রতি টান অনুভব করতে থাকে। প্রায় চার মাস যাবৎ সাজুর কোনো খোঁজ না পেয়ে সে সাজুকে খুঁজতে সুন্দরবনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বন্ধুত্ব বা প্রেমের খাতিরে জন রাজি হয় লিজাকে সঙ্গ দিতে। দুই বন্ধু মিলে তাদের পুরোনো বন্ধু সাজুকে খুঁজতে সুন্দরবনের গহিনে প্রবেশ করে। একে একে জানতে পারে, সেখানকার মরণপুরের হাট, ডাকাত জাহাঙ্গীর সর্দার, জলবেশ্যা সুন্দরী আর মেঘনার কথা। জানতে পারে সেখানকার এনজিও ডাক্তার রণজিৎ এবং থানা পুলিশের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে। চলচ্চিত্রের কাহিনি এভাবেই একটু একটু করে তার রহস্যের খোসা ছাড়াতে থাকে।

‘টান’ ছবির একটি দৃশ্য।

মাত্র কিছুদিন আগেও এই দেশেই শুধু নয়, বরং পুরো পৃথিবীজুড়েই নগরায়ণ বা সভ্যতার বিকাশকেই মানবতার প্রধান অন্তরায় বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু অধুনা শিল্পী, সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের অবস্থান সরাসরি নগরায়ণের বিরুদ্ধে নয়, বরং বর্তমানে তারা নগরকেই সবুজায়নের পক্ষে। সভ্যতাকে পরিবেশবান্ধব করার পক্ষে। তো, এ রকম পরিস্থিতিতে ‘টান’ চলচ্চিত্রটির সময়োপযোগিতা কতটুকু, তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ রয়েছে।

এবার কারিগরি দিক নিয়ে কিছু কথা। চলচ্চিত্রটির আর্ট ডিরেকশন বা শিল্পর্নিদেশনা সব ক্ষেত্রে মানোত্তীর্ণ নয়। সেই সাথে ক্যামেরা ওয়ার্ক কখনো কখনো খুবই চমৎকার আবার কখনো একেবারেই সাদামাটা। বিশ্বের একমাত্র ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন যেখানে কাহিনির প্রেক্ষাপট, সেখানে এই বনের সৌন্দর্য এই চলচ্চিত্রে সর্বোচ্চ উঠে আসবে, এটা আশা করা বোধ করি দর্শকদের জন্য অন্যায় নয়। চলচ্চিত্রটি দর্শকদের এই চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।

ন্যাশলান জিওগ্রাফিকে যদি বাদও দিই, সুন্দরবনকে নিয়ে বাংলাদেশি ও ভারতীয় নির্মাতাদের যেসব ডকুমেন্টারি ইউটিউব চ্যানেলে খুঁজে পাওয়া যায়, তাতে সুন্দরবন যতটা উঠে এসেছে, এই চলচ্চিত্রটিতে তার কিছুই আসেনি। যদিও ন্যাচার ফটোগ্রাফি, বনের মাঝে ডাকাত ও পুলিশের বন্দুকযুদ্ধসহ আরও অনেক ঘটনাই রয়েছে, যার মাধ্যমে সুন্দরবনের সৌন্দর্যকে পরিচালক নির্দ্বিধায় তুলে আনতে পারতেন।

‘টান’ ছবির একটি পোস্টার।

অ্যাকশন দৃশ্য খুবই দুর্বল। কখনো কখনো বিষয়টাকে চরম আনাড়িপনা মনে হয়েছে। এডিটিং মানসম্মত হলেও অ্যাকশন দৃশ্যের এডিটিংয়ে মানহীনতা নিদারুণভাবে দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। সংগীত বেশ আর্কষণীয়। মনের মাঝে দাগ কাটতে সক্ষম। সাজু আর সুন্দরীর প্রেমের সংলাপকে অনেক বেশি কাব্যিক করার ব্যর্থ চেষ্টা লক্ষণীয়।

চলচ্চিত্রটিতে কয়েকটি বেড সিন বা যৌনদৃশ্য রয়েছে। সাধারণত আমরা দুইভাবে বেডসিন দেখতে অভ্যস্ত। এক, সরাসরি নগ্নতা। অর্থাৎ পাত্রপাত্রীর যৌনাচারকে খোলামেলাভাবে দেখানো। দুই. যৌনতার শুরুটুকু দেখিয়ে জাম্প কাট করে যৌনতার পরের দৃশ্যে চলে গিয়ে মূল যৌনাচারটি এড়িয়ে যাওয়া।
কিন্তু ‘টান’ চলচ্চিত্রটিতে তৃতীয় একটি উপায়ে যৌনাচারকে চিত্রায়ণ করা হয়েছে। এখানে জাম্প কাটের সহায়তা নেওয়া হয়নি। মানে পুরো যৌনাচার দেখানো হয়েছে। কিন্তু নারী বা পুরুষের কেউই সেই অর্থে নগ্ন ছিল না। জাহাঙ্গীর সর্দার পুরোটা সময়ই কোমরে জাঙ্গিয়া পরে ছিল। মেঘলার উন্মুক্ত পিঠ দেখানো হলেও তার কোমরে সর্বদাই শাড়ি ছিল। সাজু শুধু তার শার্ট খুলেছিল। আর সুন্দরী হাঁটু পযর্ন্ত তার শাড়ি তুলেছিল। এ-জাতীয় ড্রেসকোড মেইনটেইন করে কীভাবে সেক্স সম্পন্ন করা যায়, তা ঠিক বোধগম্য নয়।

‘টান’ ছবির দৃশ্যে রাজেশ শর্মা ও ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত।

এবার কাহিনির চরিত্রগুলোর চরিত্রায়ণের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে আসি। প্রথমত, একজন বেশ্যা, যে অর্থের বিনিময়ে শরীর বিকিয়ে থাকে, তার কাছে আসবার জন্য সাজুকে এত কসরত করতে হলো কেন? কেনইবা জলবেশ্যা সুন্দরীকে কাছে পাওয়ার জন্য টাকা প্রদানের পাশাপাশি তার মনও জয় করতে হবে?

দ্বিতীয়ত, সকল জলবেশ্যাই জাহাঙ্গীর সর্দারের সম্পত্তি। এদের মধ্যে বিভিন্ন সময় বিভিন্নজন জাহাঙ্গীরের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। আবার কিছুদিন পরে নতুন কাউকে পেলেই আগেরজন অপাঙক্তেয় হয়ে পড়ে। প্রশ্ন হলো, যারা অপাঙক্তেয় হচ্ছে, কী কারণে তারা জাহাঙ্গীর সর্দারের বর্তমান রক্ষিতার প্রতি বড় বোন বা মা-সুলভ আচরণ করছে?

সব শেষ অভিনয়। জলবেশ্যা মেঘনা (দেবলীনা) ও ডাক্তার রণজিৎ শুধু এই দুজনই পুরো সিনেমায় মানানসই অভিনয় করেছে। বাকিদের অভিনয়ের মান দৃশ্যভেদে ওঠানামা করেছে। নায়ক সাজুর অভিনয় রীতিমতো আনাড়ির মতো। তবে জলবেশ্যা সুন্দরী (ঋতুপর্ণা) ভালো অভিনয় করলেও তার বয়স এবং শারীরিক গঠন এই চরিত্রের সাথে মানানসই নয়। পুরুষেরা সব পতঙ্গের মতো ছুটে আসছে, এমন অগুনের মতো চরিত্রে ঋতুপর্ণাকে এককালে মানালেও এখন তাকে সিনিয়র কোনো চরিত্রেই বেশি মানায়।

সবশেষে বলি, চলচ্চিত্রটি আরও অনেকখানি ভালো হতেই পারত। তবে যারা আর্ট ফিল্মের লেবেল আছে, এমন চলচ্চিত্র দেখতে বিষেশভাবে আগ্রহী, তারা ‘টান’ চলচ্চিত্রটি দেখতে পারেন। হয়তো ভালো লাগবে।

 

আরও পড়ুন- আল মাহমুদের ছোটগল্প ‘জলবেশ্যা’

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.