:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
কাজী মহম্মদ আশরাফ

গদ্যকার, প্রাবন্ধিক

ম্যাজিক, ম্যাজিকমশারি ও সেলিম মোরশেদের গল্প: কান্নাঘর
চিত্রকর্ম: মোশারফ খোকনের করা 'কান্নাঘর'-এর প্রচ্ছদ থেকে

ম্যাজিক, ম্যাজিকমশারি ও সেলিম মোরশেদের গল্প: কান্নাঘর

লিটল ম্যাগাজিনে যারা লেখালেখি করেন, তাদের সম্পর্কে আমাদের দেশের সাহিত্য অঙ্গনের বিরাট একটা অংশের ধারণা, লিটল ম্যাগাজিন হলো, বড় কাগজে লেখার জন্য প্রাথমিক সিঁড়ি, এখানে লিখে লিখে হাত পাকিয়ে তারপর বড় কাগজে লিখতে হয়। আমাকেও অনেকে বলেন, ‘এখন তো বড় কাগজে লেখা উচিত।’ এই যে ‘এখন তো’ এটাই ইঙ্গিত। যদিও আমার ছোট বা বড় কাগজ নিয়ে বাছাবাছি নাই। চাইলে সব কাগজেই লেখা দেই। আর বৃহত্তর পাঠকের কাছে আমার লেখাটা পৌঁছাক তাও আমি চাই।

তবে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক সম্পর্কে উপরোক্তদের ধারণাটাই সম্পূর্ণ নয়। আবার অন্যদিকে লিটল ম্যাগাজিনে সারাজীবন পরীক্ষামূলক বা নিরীক্ষাধর্মী লেখা লেখেন বলে শুনি অনেকের কাছে। আমাদের দেশে এই ‘পরীক্ষামূলক’ আর ‘নিরীক্ষাধর্মী’ শব্দবন্ধদুটি বিশেষ মর্যাদা পায়। আমরা জানি, পরীক্ষা বা নিরীক্ষার সাথে ফলাফলও জড়িত। সারা জীবন পরীক্ষা করলেন তারপর পেলেন কী? তা তো আমরা জানি না। কৃষিজমিতে মাঝে মাঝে দেখি কৃষিবিজ্ঞানীরা পরীক্ষামূলকভাবে কোনো বিশেষ ফসল চাষ করেন, সে ফসলের তো একটা ফল আছে, তা মেয়াদ শেষে পাওয়া যায়। তারপরে সে ফসল মানুষের খাওয়ার উপযোগী কি না, তা পুষ্টিকর কি না, বা ক্ষতিকর কি না তা জানা যায়।

শতবর্ষ আগে জেমস জয়েস যে ভাষারীতি ব্যবহার করে সাহিত্য রচনা করেছেন, সে ধরনের ভাষা নিয়ে আপনিও শতবর্ষ পরে পরীক্ষা করেছেন, নিরীক্ষা করেছেন তা জানলাম। কিন্তু পরীক্ষার পরে কী পেলেন? তা তো আমরা জানার সুযোগ পেলাম না। কমলকুমার মজুমদারের গদ্যভাষা, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গদ্যভাষা, হাসান আজিজুল হকের গদ্যভাষা কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষা বা ভঙ্গি নিয়ে আপনি পরীক্ষা করলেন, তারপরে কী পেলেন, তা জানালেন না। আপনি চালিয়ে গেলেন সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধারা। জীবন ভরেই কি পরীক্ষা চালাবেন?

আপনার সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে, শুধু যে ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছি, বা চালাই তা আপনি জানলেন কেমন করে? ভালোমতো আমার লেখা পড়ে দেখলেই বুঝতেন গল্পের আরো নানা উপকরণ নিয়েই তো আমি পরীক্ষা করতে পারি। সুবিমল মিশ্রের মতো গল্পের নিয়মের বৈপরীত্য ঘটিয়ে এন্টিগল্পও তো লেখা যায়।

সেলিম মোরশেদের গল্প সম্পর্কে আমার ধারণা সামান্য। যদিও তাঁর নাম জানি ১৯৯৬ সাল থেকে। লিটল ম্যাগাজিন ‘প্রতিশিল্প’-এর একটি সংখ্যায় তাঁর ‘বাঘের ঘরে ঘোগ’ বইয়ের বিজ্ঞাপন ছিল। সেখানে সৈয়দ তারিকের ‘ছুরি হাতে অশ্ব ছুটি যায়’ কাব্যগ্রন্থের বিজ্ঞাপনও ছিল। কবি সৈয়দ তারিকের সাথে একবার দেখা হওয়ায় আমি সেলিম মোরশেদের লেখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কিছু কথাবার্তা হয়েছিল। সেলিম মোরশেদের বই সুলভ না। যে কোনো দোকানে দেখি না, তাই কেনা হয় নাই। পড়াও না। ভাবতাম, তিনি হয়তো আমার মতো পাঠকদের জন্য লেখেন না বলেই আমার ধারে কাছে তাঁর বইয়ের অস্তিত্ব নাই। আর তিনি সারাজীবন শুধু লিটল ম্যাগাজিনেই লিখে গেছেন। কয়েকটি বাছাই করা লিটল ম্যাগাজিনে লিখেছেন। যে কোনো ছোট কাগজে লেখেন নাই।

সম্প্রতি বিজন অরণ্যের মাধ্যমে পেলাম সেলিম মোরশেদের ‘কান্নাঘর’ গল্পগ্রন্থটি। বইটি পড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হলো। এ লেখা সহজে হজম হওয়ার নয়, খুবই গুরুপাক বস্তু। গুরুদেরই মানায় এই বই পড়ে কিছু লেখার। কান্নাঘর শব্দটি আমাদের চিরপরিচিত রান্নাঘরের সমোচ্চারিত। নামকরণের দিকে লক্ষ করলেই রান্নাঘরের মতো উচ্চারণ দিয়ে লেখক আমাদের মনে বড় আঘাত করবেন। রান্নাঘরে খাদ্য তৈরি হয়, আমরা তা খেয়ে বাঁচি। সেখান থেকে আমাদের প্রয়োজন এবং রুচি অনুসারে খাদ্য পরিবেশন করা হয়। সেই রান্নাঘরের মতোই আরেকটা বিষয় হতে পারে কান্নাঘর। যে ঘরের কথা আমরা ভাবতেও পারি নাই। সেই ভাবনাতীত কাজটাই লেখক করতে চান।

এ গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘সখিচান’ পড়তে গেলেই বুঝতে পারি, সেলিম মোরশেদের বয়স হয়েছে, এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা অল্প বয়সের গোষ্ঠীগত লিটল ম্যাগাজিনের তরুণ লেখকের লেখা না। লেখার হাতের বয়স আরো বেশি। সত্যি লেখকের বয়স এখন প্রায় ষাট। এই বয়সে তিনি একজন তরুণের মতো পরীক্ষা করতে চান না। জগতের স্তরে স্তরে নানা ঘটনার নানা ব্যাখ্যা থাকে। সে সব ব্যাখ্যার কোনটা লেখক কোনভাবে তুলে আনবেন, তাই দেখার বিষয়। তবে সেলিম মোরশেদ শুধু ভাষা আর ভাষারীতি নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন না। তিনি সমাজের অনেক গভীরে প্রবেশ করে তুলে আনেন তাঁর পরীক্ষার ফল। তাঁর সাথে আমি ডুব দিতে পারি, কিন্তু দমে কুলাতে পারি না। তাঁর সাথে সত্যি পারা যায় না। হয়তো ভুস করে ভেসে উঠি অথবা নাকানি-চুবানি খাই। আমার ধারণা সব পাঠক তা পারেও না। ওই-যে বললাম, ষাটের কাছাকাছি বয়সে তিনি সমাজের যত গভীরে ডুব দিতে পারেন, তা আমার পক্ষে সম্ভব না। বরং তাঁর হাতে থাকা শালুকের রঙ আর গন্ধ দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। সম্পূর্ণ স্বাদ নেওয়া সম্ভব হয় না।

সত্যি করে বলতে কী, সেলিম মোরশেদের গল্পে আমি যা দেখেছি তা যেন মশারির ভেতর থেকে দেখা। আমার অবস্থান, আমার চোখ আর দৃষ্টি থেকে দৃশ্যবস্তু এবং ঘটনার মাঝখানে ভাষার একটি সূক্ষ্ম কারুকাজ করা চিকন সুতার মশারি টানানো আছে। এ যুগে যাকে বলা হয় ‘ম্যাজিকমশারি’। আমি সেই ম্যাজিকমশারির ভেতরে বসে দেখেছি। আর এ কারণেই আমার কাছে মনে হয়েছে এটাই ম্যাজিক রিয়েলিজম।

বার বার তাঁর বয়সের কথা উল্লেখ করছি একারণে যে, আমার দেখা অনেক লেখক তরুণ বয়সে ‘দেখিয়ে দিচ্ছি’ ভাব নিয়ে বেশ জটিল এবং দুরূহ করে সাহিত্য উপস্থাপন করেন, কিন্তু সেই শক্তি তাঁর দীর্ঘদিন থাকে না। বয়সের সাথে সাথে গল্পের বন্ধন শিথিল হয়ে যায়। সম্প্রতি একজন গল্পকারের প্রথম বয়সের রচনা এবং বর্তমান কালের রচনা মিলিয়ে পড়তে গিয়ে আবার আমার ধারণার সত্যতা খুঁজে পেলাম। সেলিম মোরশেদ এই বয়সেও বেশ ভালো শক্তি নিয়ে গল্প লিখছেন। ‘কান্নাঘর’ তাঁর এ পর্যন্ত প্রকাশিত সর্বশেষ গল্পের বই।

‘কান্নাঘর’ গ্রন্থে আটটি গল্প রয়েছে। ‘সখিচান’, ‘চিতার অবশিষ্টাংশ’, ‘কাজল রেখা’, ‘রক্তে যতো চিহ্ন’, ‘লাবণ্য যেভাবে এগিয়ে’, ‘কান্নাঘর’, ‘আমি, মীরা ও সুশীলদা’ ‘অপরাচিত্ত’। এগুলোর মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে ‘সখিচান’। এখন যদি আমাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে বলেন, কেন এ গল্পটা বেশি ভালো লেগেছে এবং অন্যগুলো কেন নয়, তাহলেই আমি বিপদে পড়ে যাব। কারণ শিল্পে অনেকখানিই থাকে ব্যাখ্যাতীত। সেলিম মোরশেদের গল্পেও ব্যাখ্যাতীত ব্যাপারের পরিমাণ অনেক। প্রায় প্রতিটি গল্পেই এই ব্যাপারটা আছে। আমি গল্পের চরিত্রদের ঘটনা দেখছি, কথা শুনছি, ভাবনার গভীরে যাচ্ছি, তাদের অনুভবের চেতনা স্রোতে প্রবাহিত হচ্ছি, কিন্তু তা ভাষায় বুঝিয়ে বলতে পারব না। বিষয়টা ঠিক কবিতার মতো। তাঁর গল্পগুলোর ভাষাও অনেকটা কবিতার মতো।

সত্যি করে বলতে কী, সেলিম মোরশেদের গল্পে আমি যা দেখেছি তা যেন মশারির ভেতর থেকে দেখা। আমার অবস্থান, আমার চোখ আর দৃষ্টি থেকে দৃশ্যবস্তু এবং ঘটনার মাঝখানে ভাষার একটি সূক্ষ্ম কারুকাজ করা চিকন সুতার মশারি টানানো আছে। এ যুগে যাকে বলা হয় ‘ম্যাজিকমশারি’। আমি সেই ম্যাজিকমশারির ভেতরে বসে দেখেছি। আর এ কারণেই আমার কাছে মনে হয়েছে এটাই ম্যাজিক রিয়েলিজম। তিনি যা দেখাতে চেয়েছেন তাই সঠিকভাবে দেখেছি কি না তা কে জানে? এ প্রশ্ন তো যে কোনো শিল্প সম্পর্কেই তোলা যায়, পিকাসোর আঁকা ছবিগুলোতে আমি যা দেখি, যেভাবে দেখি, পাবলো পিকাসো কি ঠিক তাই দেখাতে চেয়েছেন? কিংবা রবীন্দ্রনাথের যে গানটি আমি যেভাবে নিচ্ছি, রবীন্দ্রনাথ কি সেভাবেই দিয়েছেন? স্যামুয়েল বেকেটের নাটকে আমি কী দেখছি আর ব্যাকেট কী দেখাতে চেয়েছেন তা আমি জানি না।

‘সখিচান’ গল্পে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর জীবন-জীবিকা এবং তাদের বেঁচে থাকার জীবনরসের ভেতরে প্রবাহিত অদৃশ্য পলির ধারাবহ তুলে ধরেছেন। যাকে আমরা বলতে পারি জীবনদর্শন। দর্শন ছাড়া কোনো পেশাজীবী সম্প্রদায় টিকে থাকতে পারে না। যদি জীবনরস কোনো দর্শন হয়ে দেখা না দেয়, তাহলে হয়তো সে পেশার সবাই পেশা পরিবর্তন করে ফেলত। কীসের ভরসায় মানুষ একটি সম্প্রদায়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলে তা এ গল্পে বোঝা যায়।

লাশকাটা ডোমদেরও জীবন আছে। ‘কল্লোলগোষ্ঠী’র লেখকদের মতো শুধু ‘ক্ষুধা আছে’ বলেই লেখক নৈমিত্তিক বিষয়টা, কমন বিষয়টা তুলে ধরেন না তিনি, শুধু সামাজিক দায়বদ্ধতা দেখান না। ডোমদের জীবন, ধর্মবোধ, শিল্পবোধ, শিল্পপ্রকাশ এবং প্রয়াস এবং সময়ের আবর্তে ঘটনার অনিবার্যতা এ গল্পে বেশ জটিলভাবে সেলাই করে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী সখিচানের চাকরির শেষ দিনে বাসায় মদের আসর বসে। মদ খাওয়ার মধ্যে দিয়েই সখিচানের পূর্ব পুরুষদের এদেশে আসা, লাশকাটাঘরের চাকরি নেওয়া, নবীন ডোম হিসাবে লাশ কাটার অভিজ্ঞতা ইত্যাদি অনেক বর্ণনা আছে। সেখানে গোবিন্দ একটা শীতের পাখি ধরতে কুয়াশার মধ্যে বেরিয়ে যায়। তারখাম্বা বেয়ে ওঠে পাখিটা ধরার জন্য। তবে লেখক সেই তারখাম্বার বিপজ্জনক অবস্থার কথা আগেই বলে রেখেছেন। ফলে গোবিন্দের মৃত্যুর অনিবার্যতা সখিচানের চোখের বয়সের কাছে ধরা দেয়। সখিচান বুঝতে পারেন, ‘কাল সকালে তাকে মর্গে যেতে হবে। … মৃত্যুর নিশ্চিত পাঠে।’

তবে ‘সখিচান’ গল্পের চেয়ে আরো গভীর আরেকটি গল্প ‘চিতার অবশিষ্টাংশ’। এখানে অনেক চরিত্র, অনেক শিরা-উপশিরা ধমনী সতত প্রবহমান। আমি সাধারণত এ ধরনের গল্প পছন্দ করি না, যে ধরনের গল্পে সংলাপ, ঘটনা এবং চরিত্রে লেখকের নির্বাচন থাকে না। যেখানে এ তিনটি বিষয়ে লেখকের নির্বাচন নেই, সেগুলোকে আমি ঘটনা মনে করি; গল্প মনে করি না। সমাজে সাধারণত যা ঘটে সেখানে আমাদের কোনো নির্বাচন থাকে না। সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে নির্বাচিত চরিত্র, সংলাপ এবং ঘটনা নিয়ে লেখা নতুন ক্রিয়া-প্রক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়ার ভাষিক রূপকেই আমি গল্প মনে করি। আমাকে একটা রাজপ্রাসাদ বানাতে হলে জমি, উপকরণ এবং রাজমিস্ত্রি নির্বাচন করতে হবে। যাকে তাকে নিয়ে যা কিছু সৃষ্টি করা যায় না, করানোও যায় না। আমি প্রস্রাবখানা বানাব না কি রাজপ্রাসাদ বানাব সেই ইচ্ছাশক্তিই আমাকে সবকিছু নির্বাচন করতে শেখাবে। এমন নয় যে, আগে বানাতে থাকি, ইটের পরে ইট গাঁথতে থাকি প্রস্রাবখানা হোক আর রাজপ্রাসাদ হোক যা হয় একটা হবে। যেখানে পরিত্যাক্ত বাগানের আগাছায় ভরে ওঠা গাছপালার মতো গল্প নানাদিকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। মূল প্রসঙ্গের চেয়ে অনুষঙ্গ যেখানে বড় হয়ে ওঠে। বাক্যের ফেনা দিয়ে যেখানে দৃশ্য ঢেকে রাখা হয়। সেখান থেকে গল্প বের করে আনা আমার কাছে একটা বিরক্তিকর কাজ মনে হতো। আর সেই বিরক্তিভরা মন নিয়ে পড়তে গিয়ে সেলিম মোরশেদের শিল্পরূপ দেখে আমি মুগ্ধ। একটা শ্মশানকে কেন্দ্র করে কতটুকু আর ভালো গল্প লেখা যায় তা হয়তো আমরা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা রমেশচন্দ্র সেনের সাহিত্যে দেখে থাকব। কিন্তু সেই তিরিশের দশকের রমেশচন্দ্র সেনের যুগ বিগত হয়ে গেছে প্রায় শতবর্ষ আগে। এখন কি এ যুগের শ্মশান নিয়ে আমাদের মনে কোনো প্রশ্ন নেই? সাজাদ নামের মুসলমান ছেলেটা শ্মশানে ঘুরে ঘুরে বিচিত্র ধরনের কতগুলো শ্মশানবাসী মানুষের সাথে মিলে, মিশে, তাদের সাক্ষাৎ নিয়ে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, এটা নতুন সময়। এ গল্পে আমার কাছে সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী চরিত্র মনে হয়েছে সময়কে।

লেখক লিখেছেন, ‘একটা আত্মপ্রজন্মের আশা এখনও দিলীপ করে— সাজাদ আশ্চর্য হয়।’ এখানে লেখক যে লিখেছেন, ‘এখনও’— এটাই এ গল্পের শক্তি।

এখানে মুখের ভাষার শক্তিতে, কথার ধারে যতই পুষ্পরেণু বলুক, ‘সতীর সতীত্ব হলো আমার এই কাপড়ের নিচে আর আপনার ওই জায়গায়। আমরা দুইজনে মেলামেশা করলে যে আনন্দ পাবো তা আর ব্যাখ্যা করা যাবে না। যা ব্যাখ্যা করা যায় না তার ভেতরই তো স্রষ্টা।’

কিংবা ‘তোমার চেয়ে যে ভালোবাসবে আমি ঘর ছেড়ে সঙ্গে বেরিয়ে যাবো। কে কতো প্রেম দিতে পারে তার ওপরেই আমার কাছে সবকিছু।’

এ তিনটি উদ্ধৃতির শব্দে বা বাক্যে কিংবা ভাষার গতি বা প্রবহমানতায় যত শক্তি আমি দেখি তারচেয়ে বেশি শক্তি রয়েছে সময়ে। তিনটি কথার শক্তিই ভবিষ্যতের ওপর। আমাদেরকে লেখক মনে করিয়ে দেন সময়ের কথা। পড়তে পড়তে আমরা ক্যালেন্ডারে তাকিয়ে মনে করি সময়টা যেন কত!

এখানে আরেকটি ছোট উদ্ধৃতি দিতে পারি, ‘মানুষের শ্রেণিবৈষম্য কোনো প্রশ্নেই মানুষকে পারস্পরিক প্রেমিক করে না।’
এখানেও দেখুন, সময়ের কী শক্তি! ‘করে না’। আগের যুগে করলে করতেও পারে, এখন করে না। আর সময়ের যে স্রোত, ভবিষ্যতেও কি করবে?
এ গল্পের সাজাদ, কালিদাসী, পুরোহিত কার্তিকচন্দ্র হালদার, প্যারালাইসিসে পঙ্গু দিলীপকুমার সেন, স্বপনের বউ এবং সন্তানের মা পুষ্পরেণু, মুসলমান পরিবার থেকে আসা সাঈদা পারভীন, লিলিরানী এই চরিত্রগুলোর মধ্যে এক ধরনের ঐক্য এবং অন্য ধরনের অনৈক্যের সুর বাঁধা আছে। সে সুরে ধর্ম এবং সমাজের গভীরতর আলেখ্য উঠে আসে। দিলীপের ভাষায়, ‘এই সমাজ, এই ধর্ম দুটোই তো দেখলাম, ধর্ম অনেক সহজ, সমাজ কিন্তু অনেক কঠিন।’ এই অভিজ্ঞতা কি শুধু দিলীপের? নাকি আমাদের মতো মধ্যবিত্তসুলভ পাঠকদের মধ্যেকার কারো কারো মনেরও?

লেখক আমাদের জানান বিশুর চেতনায় পলায়ন প্রচেষ্টা বনাম অস্ত্র ধরিয়ে দেওয়ার মধ্যে সে কোনটা কেন গ্রহণ করবে বা করবে না। “বিশু থাকে ভিন্ন জগতে, তার ভাবনার মূল এরকম: সক্রেটিসকে হেমলক দিলে পান করেছিলো, সক্রেটিসের সুযোগ ছিল পালিয়ে যাবার। কিন্তু সিস্টেমের প্রতি আনুগত্য রেখেছিলো সক্রেটিস, তাই সে পালাতে চায়নি।

‘কাজল রেখা’ গল্পটিতে মধ্যবিত্তের জটিলতার একটা শক্ত কিন্তু দূর থেকে দেখতে অস্পষ্ট চিত্ররূপ ভেসে উঠেছে। সে চিত্রে কাজল, সীমা, রুম্মান এবং আরেফিনের চৈতন্যপ্রবাহ প্রিজমের ভেতর দিয়ে রঙ বিভক্ত হওয়ার মতো বিভক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়। সেলিম মোরশেদের অনেক গল্পের মধ্যেই আরো গল্প থাকে। এটিও একটি সমাজবাস্তবতা, কারণ আমাদের কথার ভেতরেও কথা থাকে, আমাদের গল্পের মধ্যেও অনেক গল্প থাকে।

‘রক্তে যতো চিহ্ন’ গল্পে একজন সর্বহারা বিপ্লবী বিশুর আত্মবলিদানের ঘটনাটি আমাদের ভাবিয়ে তোলে। সে এ দেশের কোনো উল্লেখযোগ্য রকমের বিখ্যাত বিপ্লবী না। তাঁর নামে দেশের কোনো থানায় মামলা আছে কিন্তু কোনো স্থাপনা নেই। অস্ত্রের ভাণ্ডারের তথ্য লুকিয়ে রেখে তাকে জীবন দিতে হয়। রিমান্ডের কোনো নিপীড়নই তার পেট থেকে কথা বের করতে পারে না। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পালানোর চেষ্টা করলে তাকে গুলি করে মারা হয়। পার্টির প্রতি, প্রতিজ্ঞার প্রতি তার আমরণ অটল থাকা দেখে আমরা এদেশের বিখ্যাত বাম নেতাদের মুখগুলো একবার দেখে নিতে পারি।

লেখক আমাদের জানান বিশুর চেতনায় পলায়ন প্রচেষ্টা বনাম অস্ত্র ধরিয়ে দেওয়ার মধ্যে সে কোনটা কেন গ্রহণ করবে বা করবে না। ‘বিশু থাকে ভিন্ন জগতে, তার ভাবনার মূল এরকম: সক্রেটিসকে হেমলক দিলে পান করেছিলো, সক্রেটিসের সুযোগ ছিল পালিয়ে যাবার। কিন্তু সিস্টেমের প্রতি আনুগত্য রেখেছিলো সক্রেটিস, তাই সে পালাতে চায়নি। সক্রেটিস সঠিক ছিলো, ফলে তার সমর্পণও যদি ভুলের কাছে হয় তাহলে বিশু পার্টির সামষ্টিকতায় একটা বড়ো ভুল সনাক্ত করেছে শক্তে; এমতাবস্থায় পার্টির সঙ্গে তার কোনও বোঝাপড়া হয়নি, সে কেন অস্ত্র জমা দেবে? সতীর্থদের নাম কেন বলবে; পার্টি যেহেতু ভুল, চলমান সমাজ-বাস্তবতা তো আরও ভুল, ফলে ভুলের থেকে আরেকটা ভুলে যাবার মতো স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক কেন হবে? শুধুই নিজের সুখ-শান্তি।’

‘লাবণ্য যেভাবে এগিয়ে’ গল্পে আমরা সেই রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’র অমিত আর লাবণ্যকে এ যুগের জটিলাতায় পুনঃস্থাপিত হতে দেখি। যেন সময়ের গুহায় তাদের পুনর্জন্ম এবং তাদের চলমানতা নিয়ে লেখকের পুনর্বিবেচনা।

‘কান্নাঘর’ গল্পে দেখি বিলুপ্তপ্রায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ের কথা এবং তাদের জীবন্তু সত্তা। সাহিত্যের ইতিহাসগ্রন্থে আমরা কর্তাভজাদের কথা পাই। কিন্তু বাস্তবে তারা কোথায় থাকেন? সেখানেই সেলিম মোরশেদ ডুব দিয়ে আমাদের নিয়ে যান সেই গভীরে। যারা বলে, ‘আমরা হিন্দু না, মুসলমান না’..

গল্পটিতে গোত্রপ্রধান বিজয়ের পরাজয়ই প্রাধান্য পেয়েছে। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের স্বধর্মরক্ষাহেতু অনেক কঠিন নিয়ম-কানুন রয়েছে। তারমধ্যে একটা হলো ডাক্তারদের কাছে না যাওয়া। গেলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। আর এখানে ব্যাপারটা কী ঘটল? বিজয়ের মেয়ে আসমা তার অনিয়মিত ঋতুস্রাবের সমস্যার কারণে পেটের ব্যথায় ডাক্তারের কাছে যায় চাচীর সাথে। যদিও গোপনে যায়, কিন্তু বিষয়টা জানাজানি হতে বিলম্ব হয় না। আর এতেই তরুণরা চাঁদাবাজি করার সাহস পায়। পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হলে তারা বিষয়টা দেখবে বলে দুজন সন্ত্রাসী আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে আসে। আর সে অস্ত্রেই তারা নিহত হয়।

যে বিজয়ের ডানচোখে সদানন্দ আর বামচোখে নিত্যানন্দ ডুব দেন। বিজয় যখন সাধনায় সমাহিত হয়ে চোখের পানি ফেলেন, তখন তার ছোট ভাইয়েরাও সাধনায় সিদ্ধির অভিলাষে নিমজ্জিত হন। বিজয়কে হামলা করছে দেখে ভাইয়েরা এগিয়ে আসেন। অবশেষে নিত্যানন্দ সেই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েই দুজন চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীকে গুলি করে হত্যা করেন। ভাই যখন খুনি হয়, মেয়ে যখন রীতিভ্রষ্ট হয় তখন আর বিজয় গোত্রপ্রধান থাকেন কেমন করে? তিনি পদত্যাগ করেন। বিজয়ের পরাজয়ের অশ্রুপাত একই নিয়মে প্রবাহিত থাকে।
বিজয় তো রক্তপাত চান নাই। তিনি বলতেন, ‘জগতের সবচেয়ে কঠিন কাজ আত্মপ্রেম থেকে বের হওয়া। দুনিয়ায় সবচেয়ে মূল্যবান হলো প্রেম আর এর গন্তব্য আত্মতৃপ্তি।’
তিনি আরো বলতেন, ‘নিজের রক্তের ভেতরে পানি নিয়ে জন্মেছেন— কান্না আর কান্না— শুকিয়ে যাওয়া কান্না ছাড়া একজন গুরুর কী আর থাকে? মানবপ্রেমটুকু ছাড়া?’

‘আমি, মীরা ও সুশীলদা’ গল্পে ঐতিহ্যচেতনা রয়েছে একটি পরিবারের রক্তধারায়। এ গল্পের নির্বাণ চরিত্রটিকে সমকালের মানবভূগোলের সমাজচেতনার মধ্যে ইতিহাসের চৈতন্যের আড়সুতার কঠিন বুনন রয়েছে। ‘এইতো নির্বাণ— যে মীরাকে বলতো, আমার প্রথম প্রেমিকা আমার মা, মাকে ওই বয়সে মনে হতো, মা আমাকে সব দিতে রাজি, কেবল তাঁর প্রতি আমার প্রেমটিকে তিনি আমল দেন না; বারবার স্নেহের আর সৌজন্যভরা হাসি দিয়ে যেন গুরুত্বহীন মনে করে তোলেন।’
ঋতা-মিতা এবং তাদের মায়ের একত্রে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনার পরে, লেখকের মতে,
‘নির্বাণ নিজেও তো ছিঁড়ে যাওয়া তার। লোকে যেগুলো সুস্থ আর স্বাভাবিক জীবন মনে করে, আশ্চর্য, নির্বাণের কাছে তাই মনে হতো উল্টো।’
এরপরে নির্বাণের পাগল হয়ে যাওয়া, চিকিৎসার ধারাবাহিকতা, তারপরে সুস্থতা, তারপরে বিয়ে কিন্তু মীরা আর নির্বাণের ছায়াতে থাকেনি।

‘অপরাচিত্ত’ গল্পে সান্দ্রার মতো সমাজের উঁচুতলার মানুষের সাথে অধীরের মতো অটোগাড়ির ড্রাইভারের একটা প্রতিচিত্র দেখতে পাই। একজন পার্টিরুমে গিয়ে শান্তি পাচ্ছে না। অন্যজন মন্দিরে শ্রীমদ্ভগবৎগীতা শুনতে গিয়েছিল। সে গীতার বাণীর প্রভাব দুই দিন পরেও তার মধ্যে রয়ে গেছে। ইহজাগতিকতার বিরুদ্ধে ছিল গীতার বাণী। গীতাপাঠপর্বে জীবন ও মৃত্যুবিষয়ক আলোচনা শুনে অধীর অবচেতনে অবগাহন করে। লেখকের ভাষায়, ‘মৃত্যুর রহস্য নিয়ে শোনা অনুগল্পগুলো তাকে প্রভাবিত করায় গতদিন কর্মবিমুখ ছিলো।’

সান্দ্রার যখন প্রকাশ্য অনুভূতির প্রকাশ। লেখক আমাদের দেখান সান্দ্রার ভেতরটা, ‘কোথাও মুক্তির আশা নেই। অসহ ক্রোধে ক্ষিপ্ত হলো, তার উষ্ণতা চাই, সবেগে উৎসারিত হয়ে উঠলো চাপা দুঃখ, হতভাগ্য লোকগুলোর ওপর প্রতিশোধ নেবো। অন্যদের কাছে নিকৃষ্ট নিদর্শন হবো।’

সত্যিই গল্পের শেষে সান্দ্রাকে আমরা নিকৃষ্টদের নিদর্শন হতে দেখি।

 

[‘কান্নাঘর’-এর গল্পগুলো আরো ১০/১২ বছর আগের লেখা। একক গ্রন্থ হিসেবে এটি বের হয়েছিল না বলে ‘পরানকথা’ রচনাসমগ্র থেকে নিয়ে এই বইটি প্রকাশ করে। ౼সম্পাদক]

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!