ম্যান অব লা মাঞ্চা : নাটকের নিরলস যাত্রায় নতুন অভিজ্ঞান
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রযোজনা ‘ম্যান অব লা মাঞ্চা’। এটা দেখার জন্য জাহাঙ্গীরনগর পর্যন্ত যেতে হলো না, ঢাকায় বসে দেখে ফেললাম। এটা একটা সুযোগ বটে। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে একটা বিদেশি নাটকের বাংলা অনুবাদের মঞ্চ প্রযোজনা দেখার নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হলো। নাটকের ভেতর নাটক। অভিনেতারা মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে নিজেদের রূপান্তর ঘটিয়ে চরিত্রে প্রবেশ করছে, সেটাও নাটকের অংশ হয়ে উঠছে। সহজ গল্প নয়, কিন্তু প্রকাশভঙ্গীর সহজতার কারণে জটিলতা সরিয়ে রেখে কাহিনীর সাথে এগুনো যায়।
সংলাপ রসাত্মক, অভিনয়ও উপভোগ্য। প্রতিটি চরিত্রই আলাদা। কোরাস থেকে চরিত্রে প্রবেশের বেলায় আলোনসো কিহানোর অংশটুকু প্রায় ছবির মতো। একটা বই হাতে নিয়ে কিহানো পাতা উল্টাচ্ছে, উল্টাচ্ছে, পাতা উল্টাতে উল্টাতে বইটা সে ছুঁড়ে ফেলে দিল। বইটা মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেল। এই অল্প সময়টুকুতে অভিনেতার অঙ্গভঙ্গিই তাকে কোরাস থেকে আলোনসো কিহানোতে পৌঁছে দেয়।
নাটকের ভেতর নাটক। অভিনেতারা মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে নিজেদের রূপান্তর ঘটিয়ে চরিত্রে প্রবেশ করছে, সেটাও নাটকের অংশ হয়ে উঠছে। সহজ গল্প নয়, কিন্তু প্রকাশভঙ্গীর সহজতার কারণে জটিলতা সরিয়ে রেখে কাহিনীর সাথে এগুনো যায়।
আলোনসো কিহানো এই নাটকের প্রধান চরিত্র, বই পড়তে পড়তে যার মগজ সম্ভবত শুকিয়ে গেছে। তার জীবনে রয়েছে বইয়ের মারাত্মক প্রভাব। বই পড়তে পড়তে কিহানোর অবস্থা এতটা কাহিল যে, সে নিজেকে বইয়ের একটা চরিত্র ভেবে নেয়, নিজেকে ভাবে একজন অকুতোভয় যোদ্ধা যার নাম ডন কিহতে। ডন কিহতের মতো করে সে তার নিজের ভোল পাল্টে ফেলে, নিজেকে আবৃত করে সৈনিকের বেশভূষায়, সে মানব কল্যাণের জন্য ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামে। একটা সরাইখানাকে সে ভাবে দুর্গ, সেখানেই তার সাথে দেখা হয়ে যায় এক পতিতার, যাকে সে ভালোবেসে ফেলে। ভালোবেসে তাকে ডাকতে শুরু করে আলদোনসা লরেনসো (বা অন্য কোনো) নামে। এই নামের এক মেয়ের প্রতি সম্ভবত সে একসময় টান অনুভব করত। মানসিক ভারসাম্যহীন আলোনসো কিহানোকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনে তার বন্ধুরা। ততদিনে তার অবস্থা সংকটজনক, তার মৃত্যুশয্যায় এসে দেখা করে সেই পতিতা যাকে সে আলদোনসা লরেনসো নাম ডাকত এবং মেয়েটির কোলেই তার মৃত্যু ঘটে।
এই গল্পটা আদালতকে শোনায় এক নাট্যকার, যে নিজেকে নির্দোষ হিসাবে দাবি করে। দাবির সপক্ষে সে এই গল্পটি অভিনয় করে ফুটিয়ে তোলে। নাট্যকার যখন মুক্তি পাওয়ার অপেক্ষায়, নাটকের অন্তিমে নাট্যকারের জন্য নতুন আরেকটি সমন আসে ধর্ম আদালত থেকে যেখানে তাকে পুড়িয়ে মারার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু নাট্যকার নিজের প্রতি আস্থাশীল। নাট্যকার জানে সে তার যুক্তি দিয়ে হয়তো বেরিয়ে আসবে।
এমন একটি জটিল মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েনের উচাটন গল্পকে হেসে খেলে তুড়ি বাজিয়ে অভিনয় করে দেখাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ছেলেমেয়েরা। তত্ত্বের পাশাপাশি অভিনয়ের জ্ঞানকে আয়ত্ত করতে তারা যে নিরলস তার একটা নমুনা আমরা দেখলাম। তাদের কল্যাণে বিশ্বসাহিত্যের এক অমর উপাখ্যানকে নাট্য প্রযোজনা হিসাবে দেখার সুযোগ ঘটল। সাধুবাদ জানাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে, আমাদের নাটক ও নাট্যপ্রচেষ্টাকে উন্নততর ও সমৃদ্ধ করার জন্য। ম্যান অব লা মাঞ্চা, আমাদের নাটকের নিরলস যাত্রায় নতুন অভিজ্ঞান হয়ে থাকবে।
০২.০৪.২০১৯