যেভাবে নাই হয়ে গেলাম: রূপান্তরের গল্প
মশিউল আলমের ‘যেভাবে নাই হয়ে গেলাম’ একটা রূপান্তরের গল্প। জামিল পেশায় সাংবাদিক, তিনি একদিন শেষ সকালে আবিষ্কার করেন, তার মিরর ইমেজ মুছে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে তার নাম, ছবি, দেহ সব মুছতে থাকে। একদিন তিনি শ্রীমঙ্গলে কোনো একটা রিসোর্টের সুইমিং পুলের পানির মধ্যে মিশে যেতে থাকেন। হয়তো মিশে যান। তার ডুব থেকে তিনি আর ওঠেন না মনে হয়। বানর, পশুপাখি আর পারিবারিক কলরবের মধ্যে তিনি মিশে যেতে থাকেন ক্লোরিন পানির মধ্যে। এর বেশি আর বলার দরকার হয় না। এটুকুই যথেষ্ট উপন্যাস শেষ করার জন্য।
মানুষের যেকোনো দেখা উপলব্ধি কারার জন্য একটা দার্শনিক রেফারেন্স লাগে। একটা বা দুইটা বা তিনটটা রেফারেন্সের আলোকেই সে তার পরবর্তী অনুভূতিগুলো মাপতে চায়। সেই হিসেবে মৌলিক লার্নিং আমাদের কম। যে অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের মনে দাগ কেটে যায়, সেই আলোকেই আমরা পরবর্তী বহু কিছুর হিসাব করি। ফলে অনুভূতি একটা প্রেজুডিস ক্ষেত্রবিশেষে। সে জন্য প্রথম অভিজ্ঞতা ও তা পাঠ হিসেবে মনে রাখা ও বুঝতে পারা জরুরি ব্যাপার। আমরা ১ থেকে ১০-এর হিসাবেই শত শত, হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটির হিসাব করি। তাই জন্য মানুষের যেকোনো রূপান্তরের গল্প এলেই আমাদের মনে পড়ে যাবে কাফকার ‘মেটামরফোসিস’-এর কথা। তবে মশিউল আলমের ‘যেভাবে নাই হয়ে গেলাম’ ঠিক মেটামরফোসিস বা রূপান্তরের গল্প নয়, ডিফরমেশন উপাখ্যান।
জীবনানন্দের একটা গল্প পড়েছিলাম মনে হয়, নায়ক আত্মহত্যা না করে মেঘের আড়ালে হারিয়ে যেতে চায়, সোনালি মেঘের আবডালে নিঃশব্দে নিখোঁজ হওয়ার প্রত্যাশা তার। এগুলো হলো একেকটা রেফারেন্স পয়েন্ট। এইগুলো মনে রেখেই আপনকে মশিউল আলমের উপন্যাস পড়তে হবে। কাফকা ও জীবনানন্দের নায়কের সমস্যা দার্শনিক। মশিউল আলমের নায়কের সমস্যা মনে হলো রাজনৈতিক। তবে মানুষের অস্তিত্বকে দার্শনিক বা রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে দেখতে চাওয়ার প্রবণতা আইডলজিক্যালি দুনিয়া দেখার সংকট। এই সমস্যা যেমন কাফকায় আছে, জীবনানন্দেও আছে, মশিউল আলমও এর বাইরের নন। মানুষে অবিশ্বাসী কাফকা, মানুষ না-চেনা বিস্ময়াক্রান্ত জীবনানন্দ বা হাল আমলের মানুষ-ধারণায় বিশ্বাসী মশিউল আলম এই দার্শনিকের মোকাবিলা কীভাবে করলেন? তিনজনের সমাধান এক। ব্যক্তিকে সমাজের চলমানতার বাইরে মিশিয়ে ফেলা, নাই করে দেওয়া। ব্যক্তির পরিবর্তে পোকা, অদৃশ্য হতে চাওয়ার চয়েস আর পানিতে নুনের দানার মতো মিশতে থাকা মানুষ, এই সমস্তই তাদের সমাধান।
জামিল পেশায় সাংবাদিক, তিনি একদিন শেষ সকালে আবিষ্কার করেন, তার মিরর ইমেজ মুছে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে তার নাম, ছবি, দেহ সব মুছতে থাকে। একদিন তিনি শ্রীমঙ্গলে কোনো একটা রিসোর্টের সুইমিং পুলের পানির মধ্যে মিশে যেতে থাকেন। হয়তো মিশে যান।
অস্তিত্ব যখন মানুষ নামক আইডিয়াটাকে অস্বীকার করে, তখন সে ঠিক আর মানুষ থাকে না। মানুষ নামী আইডিয়ার সংকট নয় এটা? মানুষের ওপর থেকে মানবিকতা বিলোপ করলেও সে মানুষই থাকে। সে কি দিই পায়ের প্রাণী হয়ে নভোছকে বিরাজ করে তখন? চারপাশ, প্রতিবেশ দেখে আপনার মনে হবে মনুষ্য-পরিকল্পিত যে দুনিয়ার গল্প আমরা জানি, তা ঠিক এমন নয়। আধুনিকতা, মানবিক বোধ সর্বদা মানুষকে একটা সুডোরিয়ালিটির মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। যখনই দুনিয়া মানবিক হয়ে ওঠে না, তখনই এই নাটকের চরিত্রগুলো অসুখী হয়ে ওঠে। তাদের কাছে মানবিক দুনিয়া অন্য কিছু, শীতল, সহমর্মী, প্রেমময়, আশাজাগানিয়া। কিন্তু দুনিয়া তেমনই আপনি যেমন দেখেন চারপাশে। এই উপন্যাসের নায়ক জামানের সমস্যার সূচনা এই চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতার দুনিয়াটাকে মেনে না নিতে পারা।
মোদ্দা কথা হলো, মানুষ নামক আইডলজির ওপর প্রবল বিশ্বাস অমানবিক দেশের মধ্যে মানুষ নামক ধারণাকে পোকায় পরিণত করবে। এই মরজগতে স্বর্গের স্বপ্ন হলো এক সুশীল মানবিক প্রকল্প। এই প্রকল্পের কোনো বিকল্প নেই। এর শেষ হলো আপনি ‘মানুষ’ থেকে সুইমিং পুলের পানিতে হাড়হাড্ডিসমেত মিশে যাবেন অ্যাসিডে গলা ধাতুর মতো। মানুষের এই নিয়তি বহুদিনের। মানবজীবন নামক দার্শনিক প্রকল্প যখন আর কাজ করে না ঠিকঠাক, তখন মানুষ মানবিকাতর সংকটে পড়ে, আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক রোগের ব্যাখ্যার মধ্যে সে আশ্রিত হয়। এই রোগগ্রস্ত বিকল্প আশ্রয় ঠিক এই বাস্তব জগৎ নয়। মানবিক দুনিয়া প্রকল্পের আস্যাইলাম হলো এই সমস্ত অসুস্থতা, বিষণ্ণতা।
বড় কথা হলো, দুরাশার কথা হলো, সমাজের অধিকাংশ মানুষ আধুনিক নয়; মানবিক দার্শনিতায় বিশ্বাসী নয়। ফলে, মশিউল আলমের কাঙ্ক্ষিত সমাজের বাইরেই সমাজ টিকে আছে বহুদিন, বহু লোক সুস্থ থেকে সভ্যতা চালায়। কিন্তু কীভাবে?
আমরা মানবিকার শেষ ফলাফল শুভ চাই। সেই রেজাল্ট শুভ কিছু না পেলে মানুষকে কাফকা পোকা বানিয়েছে, জীবনানন্দ অদৃশ্য করতে চেয়েছে, মশিউল আলম পানিতে গলিয়ে দিতে চেয়েছেন। এই সমস্তই ফিলোসফিক্যাল এরর। এরর কেননা মানবিকতা নামক যে দর্শন, তা তখনই কাজ করে, যখন মানুষ নামক ধারণার অ্যাজাম্পশনগুলো ঠিকমতো কাজ করে। অ্যাজাম্পশনগুলো কাজ না করলে মানুষকে মানসিকভাবে অসুস্থ হিসেবে ডিক্লারেশন দেওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। সমাজের অ্যাজাম্পশনগুলো ঠিকমতো কাজ না করার কারণে এই উপন্যাসের নায়ক জামিলকে মনোচিকিৎসকের চেম্বার থেকে সুস্থতার দাওয়াই না পেয়ে পানিতে মিশে যেতে হয়। মানবিক বোধের শেষ পরিণতি এগুলো। মানবিক দার্শনিকতার সংকটটাই মূর্ত হলো মনে হয়। আমি তা-ই দেখতে পেলাম এই উপন্যাসে। এটা আমার অতিরিক্ত পাওয়া ‘যেভাবে নাই হয়ে গেলাম’ পড়ে।
দার্শনিক সমস্যার সমাধান ঔপন্যাসিকের কাজ নয়। সেই হিসেবে মশিউল আলম ঠিক আছেন। মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের চিন্তা ও সংকট তিনি লিখেছেন। যারা মানবিকতায় আস্থা রাখা মানুষ, তারা এই উপন্যাস পড়ে দেখতে পারেন আধুনিকতা ও মানবিক সাম্যের ধারণা পূর্বানুমান অনুযায়ী না চললে সমাজের সবাই অদৃশ্যে মিশে যাবে। বড় কথা হলো, দুরাশার কথা হলো, সমাজের অধিকাংশ মানুষ আধুনিক নয়; মানবিক দার্শনিতায় বিশ্বাসী নয়। ফলে, মশিউল আলমের কাঙ্ক্ষিত সমাজের বাইরেই সমাজ টিকে আছে বহুদিন, বহু লোক সুস্থ থেকে সভ্যতা চালায়। কিন্তু কীভাবে?
এই ফিলসফিক্যাল এররের সমাধান আমাদের খুঁজে পেতে হবে।