রাজার কঙ্কাল বনাম রাষ্ট্রীয় ভাবনায় কবিতার বিস্তার
কবি সাখাওয়াত টিপুর একুশে বইমেলা ২০২০-এ প্রকাশিত বই রাজার কঙ্কাল। বইটি দৃষ্টিনন্দন, হাতে নিলেই পড়তে ইচ্ছে করবে। বন্ধু বলে না, পাঠক হিসেবেই বলছি। সাখাওয়াত টিপুর কবিতার জগতে আবির্ভাব নব্বইয়ের দশকে। তার আগে লিখতেন কিনা জানি না। সেই থেকে তার কবিতার সাথে একটু আধটু চেনা-জানা। তার কবিতা লেখার প্রথম দিক থেকেই নিরিক্ষাধর্মী, ভাষা, দর্শন ভাবনা সবদিক থেকেই। এবারের বইটিতেও তার ব্যতিক্রম নয়।
তবে তিনি এই বইটিতে একটু ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তার কবিতার জগতে। একটু বাঁক নিয়েছেন। সেখান থেকে পাঠকের জন্য চমক আছে বৈকি! তার কবিতার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন ছন্দে, ভাষায়, চিন্তায়।
শুধু ভাবাবেগ দিয়ে কবি তাড়িত হচ্ছেন না। কঠোর হাতে ভাবনার রাশ টেনে ধরেছেন।
রুপক, ইমেজের ব্যবহার তার কবিতায় কম থাকলেও ভাষা, ছন্দ এবং চিন্তার ধারালো চাবুকে কবিতা হয়ে ওঠে ইউনিক। মানুষের মুখের বুলিকে তিনি কবিতায় ব্যবহার করছেন সহজেই। রাষ্ট্রীয় ভাবনা, জনগণ, আর শাসন-শোষণ বঞ্চনা তাকে ভাবিয়ে তুললে কবিতার স্বর হয়ে ওঠে বিদ্রোহী। বোবাচিৎকারে পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করেন অবরুদ্ধ এক সত্তায়। আর তার সে দ্রোহী চেতনায় আছেন চে, গ্যাবো, সার্ত্রে। সে চিন্তার দেখা মেলে ‘রাষ্ট মরা দেখা!’ কবিতায়—
একদিন আলো সব অন্ধকার হবে
খসে যাবে চোখ চামড়া আর সুন্দর।
…
একদিন রাজপথ শেয়ালেরই দখলে যাবে
দেখিলাম স্বপ্নে, কাক কাকেরই গোস্ত খাবে!
(রাষ্ট মরা দেখা!)
শব্দচয়নে টিপু কথ্য ভঙ্গিটাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। ফলে কবিতা পাঠকের কাছে দূরবর্তী মনে হয় না। তবে কবিতার্থের দিকে থেকে তার কবিতার গভীরতা ব্যাপক। পাঠশেষে পাঠককে ভাবায়।
রাষ্ট্র বনাম কবি। লেখক বা কবি সে যে রাষ্ট্রেরই হন না কেন তিনি সেই রাষ্ট্রের বাইরের কেউ নন। একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রঘটিত অহেতুক বিড়ম্বনা তাকে ভাবায়, তার মগজ আঁকড়ে ধরে, তারই বিস্ফোরণ ঘটে তার কবিতায় ‘লাশের নাম কী?’ কবিতায়—
যেন যাবে না বলেই, রাত হলো দিন
হাত বাঁধা অন্ধ চোখে রাষ্ট্রের ইঞ্জিন
ঝরা পাতাদের সাথে উড়ে যাচ্ছে গান
গোধূলির ধূলা সেও এক কলা প্রাণ
(লাশের নাম কী?)
খুব সহজ কথায় ব্যঙ্গ করা যেন নিজেই নিজের সাথে ব্যঙ্গ করে সামনে নিয়ে আসেন নিগূঢ় সত্যকে। রাষ্ট্রের বিদঘুটে তিতকুটে একতান্ত্রিক চেহারা কবিকে বিষণ্ন করে তোলে।
রুপক, ইমেজের ব্যবহার তার কবিতায় কম থাকলেও ভাষা, ছন্দ এবং চিন্তার ধারালো চাবুকে কবিতা হয়ে ওঠে ইউনিক। মানুষের মুখের বুলিকে তিনি কবিতায় ব্যবহার করছেন সহজেই। রাষ্ট্রীয় ভাবনা, জনগণ, আর শাসন-শোষণ বঞ্চনা তাকে ভাবিয়ে তুললে কবিতার স্বর হয়ে ওঠে বিদ্রোহী। বোবাচিৎকারে পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করেন অবরুদ্ধ এক সত্তায়। আর তার সে দ্রোহী চেতনায় আছেন চে, গ্যাবো, সার্ত্রে।
কস কি মোমিন!, টুকরো বাংলা, এ কবিতাগুলো রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে যেন ভেঙেচুরে দেখতে চাইছে। দেখার ভেতরেও আরেক দেখার জগৎ। যেখানে কবি যেন একজন চিন্তকও বটে।
কিন্তু ‘মায়ের কবিতা’টিতে তার দ্রোহী সত্তা কোমল হয়ে ওঠে। পাঠক যেন খোঁজ পায় একজন কোমল পিতৃহৃদয়ের যে কিনা কন্যার প্রশ্নের সন্মুখীন—
দাঁত কড়কড় করছিল, পৃথিবী ভাঙবে বলে
বললাম : মাগো লড়াই করতে শেখো!
মেয়েটি বললো : বাবা কেন মেয়ে হয়ে জন্মালাম?
বললাম : মারে, তুই না হলে আমি কী করে আসতাম?
(মায়ের কবিতা)
কি অদ্ভুত অনুভূতি! এমন করে কেবল এ শতকের কোন একজন কবিই বলতে পারেন, পিতৃতন্ত্রের উর্দ্ধে উঠে কন্যার মুখোমুখি হন। এ এক নতুন স্বর। একেবারেই আনকোরা, চিন্তার দিক থেকে। তবে অন্য পূর্বসূরী কবিরা কেবল খোকা খোকা করে গেছেন কিন্তু সমস্যার জায়গা চিহ্নিত করেন নাই। সেদিক থেকে কবি সাখাওয়াত টিপু অন্য কবিদের চাইতে এগিয়েই থাকেন চিন্তায় এবং ভাবনায়। সহজে বলে ওঠেন কঠিন কথা।
কখনো কখনো কবির অসহায় আর্তনাদ যেন ফরিয়াদ জানায় যার কোন বিহিত নাই।
‘আমরা কেমন দেশে, আব্বাজান?’ কবিতায়—
আমাদের রক্ত ধূলায় পড়লে পানি হয়ে যায়
আমরা কেমন দেশে আছি আব্বাজান?
আমরা মানুষ নই এমিবার মতো ছোটো
আমরা গাছের কাছে রেখে দিয়েছি করাত
(আমরা কেমন দেশে, আব্বাজান?)
যেন গাছ নিজেই নিজের গলা কাটুক এছাড়া উপায় নাই। তার কবিতায় মুসলিম লোকজ মিথগুলো উঠে আসে অনায়াসে নৈকট্য নিয়ে। ‘আব্বার মৃত্যুর পর…’ কবিতায়—
আব্বার মৃত্যুর পর উত্তর আকাশে মেঘ জমেছিল। মেঘ ডাকছিল শীতে। সূর্য নেমেছিল মেঘেরও নিচে। তাহলে আব্বা কি মেঘের জন্য জেগেছিল! দেখলাম : আব্বার মৃত্যুতে আমাদের জানালার মৃত কাঠগুলো গুমরে কাঁদছে। কাঠের আলমিরা থেকে শব্দ হচ্ছে। আম্মা চৌকাঠের ভাষা বুঝতেন। শব্দ মাত্র জড়। স্থিতি জড়তার যেখানেই শেষ সেখানেই অর্থ শেকাকুল হয়। আমরা কখনো ভাবিনি এমন জড় পদার্থও আব্বাকে ভালোবাসতেন।
…
পুকুরের মাছগুলো সেদিন ডাঙায় উঠেছিল। অব্বার বিদায় তারাও মানেনি। আমাদের বাগানের বাঁশগুলো হেলে গেল মদীনার দিকে।
(আব্বার মৃত্যুর পর…)
কবিতা এক নিগূঢ় ঈশারা। পাঠককে কখনো তার কবিতার জগতে স্বল্পভাষ্যে অনেক কিছু বলে। পাঠক নিজেই নিজের মতো করে নির্মাণ করে আরেক জগৎ কিংবা নিজের ভাবনার সাথে রিলেট করে নেন। কবির কবিতা পাঠকের ভোতা হয়ে যাওয়া অর্ন্তগত বোধে ধারালো শব্দের চাবুক হানে—
বাঁকা কাস্তের
হাতলে হস্তির
দাঁতাল রাষ্ট্রের
সেই তো সেদিন
ভলগার পাড়ে
জাগছে লেনিন!
(তামাদি লেনিন)
কিংবা শ্যাভেজ, নবারুণ আথবা লাশকেই প্রশ্ন করে বৃষ্টি কেন হবে? লাশের কোন দেশ নাই, পরিচয় নাই, সে শুধু লাশ এই ফাঁপা বুনিয়াদি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় জনগণ যেন লাশ, তার কোন অনুভূতি নাই।
বলা যায় কবি সাখাওয়াত টিপুর কবিতা তীক্ষভেদী রাষ্ট্রীয় ভাবনার কবিতা। তার ভেতর যে কোমল এক কবিহৃদয় যেন মেঘবিদ্যুরেখা উঁকি দিয়ে যায় যদিও তা স্বল্প সময়ের জন্য সাদা চোখে সেই কোমল অনুভূতিকে দূরে সরিয়ে রাখে—
মৃত্যুর ছায়ার নিচে দীর্ঘ হচ্ছে রে জীবন
পথের রেখাও যাচ্ছে মুছে শীতল আগুনে
আহা অগ্নি কত কাণ্ড হলে কোন ভূবনের
হাসতে হাসতে তব প্রাণ যাও দৈব ঘরে
…
আধুনিক মানুষের শোক মাত্র একদিন, তবে
যে ছায়া বিছায় ঘরে তার আয়ু বহু বহুদিন!
(সাদা চোখ)
কবিতাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায় কিন্ত তারও এক অব্যখ্যাত জগৎ থাকে যা কথনো উন্মোচিত হয় না। তবে নানারকম ইমাজিনেশন মেটাফোর অথবা রূপকধর্মীতা কবিতাকে আলঙ্করিক করে তোলে সেখানে কবির নিজস্ব স্বর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়। সেই স্বর যাকে কবি টি.এস.এলিয়ট বলেন কবির নিজস্ব। ওয়েষ্ট ল্যাণ্ডের ভেতর দিয়ে কবি টি.এ.এলিয়ট পূর্বসুরীদের কাছে থেকে কবিতার নান্দনিক ভাবনাকে এক ঝটকায় বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলেন। দেখিয়েছিলন যুদ্ধ বিদ্ধস্ত পশ্চিমের চেহারা যেখানে ওয়ার্ডসওয়ার্থের রোমান্টিসিজম উবে যায়। কবিতার এক নতুন রূপ আমাদের সন্মুখে হাজির হয়। কবিতা হয়ে ওঠে জটিল, গল্প, কথার গাঁথুনি কিংবা ঐতিহাসিক চরিত্ররা যেখানে এসে ভর করে। ফলে পাঠক অচমকা কবিতার এই পরিবর্তনে হতচকিয়ে গেলেও মেনে নেয় আরে এ তো পাঠকেরই গল্প অথবা কবিতা!
এই স্বর নির্মাণে যে কোন সিরিয়াস কবি বা শিল্পীর প্রয়াস থাকে নিজস্ব শৈলী বা স্বরের সন্ধান করা। কবি সাখাওয়াত টিপু নিজের সৃষ্টিশীলতায় সেখানেই নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন। নিজের চিন্তার, দার্শনিকতার জগৎ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর নানা চিন্তার ভেতর দেখতে চেয়েছেন। একরৈখিক ভাবনার এ ধরণের কবিতাতে কিছুটা একরৈখিক হয়ে ওঠার ঝুঁকি থাকে। উচ্চকিত কিংবা নীতিবাদী কবিতা হওয়ার কারণে তা শিল্পোত্তীর্ন হয়ে ওঠে না।
কবি সাখাওয়াত টিপু এই বইটিতে ছন্দের নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। তার ‘কবির মৃত্যুর কথা’ কবিতা দিয়েই শেষ করি লেখেটি আপতত—
কবি কি রাষ্ট্রের জরায়ু ছিঁড়ে অকস্মাৎ বেরুবে কখনো?
ভোতা দাঁত আর নিরুপায় ঠোঁট ছাড়া কবির কিছুই নেই
কবিকে ঘুমাতে দাও কোলাহল, সুপ্ত ট্রেন আর কাশফুল
না হলে আকাশ ভাঙবে কপালে, নমিত চোখের জল!
(কবির মৃত্যুর কথা)