শত ফুল ফুটুক বনে… সুবাসটুকু নিয়ো
১.
নতুনত্ব কিংবা অভিনবত্ব কোনো আকস্মিক অভিঘাতের ফলে জন্ম নেয় না। পেছনে থাকে এক পটভূমি, দীর্ঘ সময়ের ঘটনাপ্রবাহের পলি। ইতিহাসের নানা বাঁকবদল, যুদ্ধ, সংঘাত, সংঘর্ষ, রাজনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অমানবিকতার মাধ্যমে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী পরিপ্রেক্ষিত ঊনবিংশ শতাব্দীর আধুনিক কবিতার সূচনাপর্বের অভিযাত্রাকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। কিয়ের্কেগার্ড আধুনিকতার উৎসকেন্দ্র সম্পর্কে শূন্যতা, সংশয় এবং বিষাদঘনতার কথা বলেছেন এবং এর নেতিবাচকতার প্রতি ইঙ্গিত করে একেই আধুনিকতার সারবস্তু বলে উল্লেখ করেছেন। ফলে নৈর্ব্যক্তিকতার বদলে ব্যক্তি আত্মকেন্দ্রিকতাই প্রধান হয়ে উঠেছে। এ ব্যক্তিকতার মধ্য দিয়ে যে অভিনবত্বের প্রকাশ, তা আবহমান বাংলা কাব্যধারার বিপরীতে সম্পূর্ণ নতুন এক ক্ষেত্র নির্মাণ করেছে এবং সেই ক্ষেত্র আজও বাংলা কবিতায় প্রভাববিস্তারী এক শক্তিশালী ধারা হিসেবে প্রবহমান।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সমসাময়িক কালে যেকোনো নতুন আন্দোলনের শুধু একটি বিশেষ ধারা প্রবহমান থাকে না; পাশাপাশি নানামুখী আন্দোলন, নতুন নতুন চিন্তাচেতনার সূচনা এবং তার বিস্তৃতিও ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। আধুনিক কবিতাও শুধু একটি সুনির্দিষ্ট সাহিত্য আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিস্তৃতি লাভ করেনি। ইউরোপে, বিশেষভাবে ফ্রান্সে আধুনিক কবিতা বিনির্মাণের আগে বেশ কিছু কাব্য আন্দোলন সমান্তরালভাবে আধুনিক কবিতা নির্মাণের পথকে সুগম করেছিল। তাই এই কবিতার যারা প্রধান পুরুষ, পরাবাস্তবতা, প্রতীকবাদ, চিত্রকল্পবাদ প্রভৃতি সাহিত্য আন্দোলনের মাধ্যমে তারা কবিতার ইতিহাসের মধ্যে এমন এক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বৈপ্লবিক অবস্থান তৈরি করলেন, যাকে গ্রহণ করা ছাড়া নতুন কালের বিপর্যস্ত মানুষের সামনে অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না।
কিন্তু আমার ধারণা, এই নতুনত্বের অভিঘাত খুব দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান তৈরি করে ইতিহাসের মধ্যে এমন কোনো স্থায়ী অবস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি, যার দ্বারা এটা বলা যেতে পারে, আধুনিক কবিরা সম্পূর্ণরূপে রোমান্টিকতাকে উপেক্ষা করে একটি বিধ্বংসী শিল্পকলার জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে বোদলেয়ারকে আধুনিক কবিতার জন্মদাতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে কারোরই কুণ্ঠা নেই, তার কবিতার আত্মঘাতী মনোভাবের ভেতরেও কি আমরা খুঁজে পাই না এমন কোনো রোমান্টিক আবহ, বিশেষ করে তার প্রেমের কবিতাগুলোয়, যাকে বলা যেতে পারে সম্পূর্ণরূপে রোমান্টিকতার এক ছায়াঘন উদ্যান?
আমি এটা একান্তভাবেই বিশ্বাস করি, রোমান্টিকতা শুধু কোনো কাব্যিক অভিযাত্রা নয়, এটা প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের আত্মগত মৌলিক প্রবণতা কিংবা একটি আবেগঘন সত্তা, যাকে বাদ দিয়ে আধুনিকতা সম্পন্ন হতে পারে না। তাই দেড় শ বছরের কাব্য-ইতিহাসের পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে অনুসন্ধান করলেও মিলবে কবির রোমান্টিক চেতনার অনন্ত প্রবাহ, আধুনিকতার মৌলিক শর্তগুলো পূরণ করেও যা হয়ে উঠেছে আধুনিকতার শক্তির আধার।
২.
বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত ত্রিশের দশকে। একটি প্রায় বহুরৈখিক সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় আদলে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত অনেকটা ‘অযাচিত’ বলে অনেকেই মনে করেন, কিন্তু বিশ্বকাব্য-আন্দোলনের সমান্তরাল ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠার এই ‘অযাচিত উল্লম্ফন’ বাংলা কবিতাকে অনেক দূরে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। ইউরোপে যখন রোমান্টিক কবিতার অবসানের যুগ, বাংলা কবিতায় তখনো তা রবীন্দ্রনাথের অসামান্য প্রভাববিস্তারী শক্তির কারণে প্রায় দিগন্তবিস্তৃত। এ অবস্থার মধ্যে আধুনিক বাংলা কবিতাকে বিশ্ব আধুনিক কবিতার আয়নার সমুখে দাঁড় করাতে গেলে একটি বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ঘূর্ণির প্রয়োজনীয়তাকে কেউ কেউ অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করলেও ঐতিহাসিক বিবেচনায় একে গ্রহণ করা প্রায় অনিবার্য ছিল। আধুনিক কবিতা বর্তমান সময় পর্যন্ত তার বিস্তৃতি লাভের প্রেক্ষাপটের মধ্যে বাংলা কবিতা নিজের অবস্থানকে নির্ধারিত করে ফেলেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমি এটা একান্তভাবেই বিশ্বাস করি, রোমান্টিকতা শুধু কোনো কাব্যিক অভিযাত্রা নয়, এটা প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের আত্মগত মৌলিক প্রবণতা কিংবা একটি আবেগঘন সত্তা, যাকে বাদ দিয়ে আধুনিকতা সম্পন্ন হতে পারে না। তাই দেড় শ বছরের কাব্য-ইতিহাসের পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে অনুসন্ধান করলেও মিলবে কবির রোমান্টিক চেতনার অনন্ত প্রবাহ, আধুনিকতার মৌলিক শর্তগুলো পূরণ করেও যা হয়ে উঠেছে আধুনিকতার শক্তির আধার।
‘আধুনিক’ শব্দটি সময়ের দিক থেকে ক্রম-অগ্রসরমাণ, ক্রমপরিবর্তমান ও সঞ্চরণশীল। রবীন্দ্রনাথ ‘পাঁজি মিলিয়ে’ আধুনিকতার সীমানা নির্ণয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন উত্তাপন করেছেন। তাঁর মতে, ‘এটা কালের কথা ততটা নয় যতটা ভাবের কথা। নদী সামনের দিকে সোজা চলতে চলতে হঠাৎ বাঁক ফেরে। সাহিত্য তেমনি বারবার সিধে চলে না। যখন সে বাঁক নেয় তখন সেই বাঁকটাকেই বলতে হবে মডার্ন। বাংলায় বলা যাক আধুনিক। এই আধুনিকটা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে।’ [আধুনিক কাব্য: সাহিত্যের পথে] এই ‘মর্জি’র সাথে তিনি শাশ্বত গুণের কথা বলেন: ‘আধুনিক বিজ্ঞান যে নিরাসক্ত চিত্তে বাস্তবকে বিশ্লেষণ করে আধুনিক কাব্য সেই নিরাসক্ত চিত্তে বিশ্বকে সমগ্র দৃষ্টিতে দেখবে, এইটেই শাশ্বতভাবে আধুনিক।’ জীবনানন্দ দাশের মত রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত কাছাকাছি: ‘সব সময়ের জন্যেই আধুনিক-এ রকম কবিতা বা সাহিত্যের স্থিতি সম্ভব। মানুষের মনের চিরপদার্থ কবিতায় বা সাহিত্যে মহৎ লেখকদের হাতে যে বিশিষ্টতায় প্রকাশিত হয়ে ওঠে তাকেই আধুনিক সাহিত্য বা আধুনিক কবিতা বলা যেতে পারে।’ [জীবনানন্দ দাশ: কবিতার কথা] সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আধুনিক কবিকে অনাদিকালের ‘চারণের উত্তরাধিকারী’ এবং আধুনিক কবিতাকে ‘মহৎ কবিতা’রূপে অভিহিত করেন। [কাব্যের মুক্তি: স্বগত]
অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪) বিচিত্র দৃষ্টিতে আধুনিক কবিতাকে চিহ্নিত করেন: ‘আধুনিক কবিতা এমন কোনো পদার্থ নয় যাকে কোনো একটা চিহ্ন দ্বারা অবিকলভাবে শনাক্ত করা যায়। একে বলা যেতে পারে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের কবিতা, সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানের, আবার এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিস্ময়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ, বিশ্ববিধানে আস্থাবৃত্তি।’ [ভূমিকা: আধুনিক বাংলা কবিতা]
আধুনিক কবি ও কবিতা বলতে অধিকাংশ লেখক রবীন্দ্রোত্তর তথা তিরিশোত্তর কবি ও কবিতার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। যাকে সমকালে ‘অতি আধুনিক’ বা ‘অত্যাধুনিক’ বাংলা কবিতাও বলা হতো। প্রকৃতপক্ষে, আধুনিকতার দুটি অর্থই বর্তমান; এক অর্থে সে সাম্প্রতিক, সমকালীন ও সমসাময়িক; অন্য অর্থে চিরকালীন, শাশ্বত, ভাস্বর। এই অর্থময় আধুনিক বাংলা কবিতার স্রষ্টারা হলেন: জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অজিত দত্ত, সঞ্জয় ভট্টাচার্য , সমর সেন প্রমুখ।
রবীন্দ্রনাথ ‘আধুনিক সাহিত্য’ (১৯০৭) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যেখানে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিহারীলাল, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, আবদুল করিম, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, যতীন্দ্রমোহন প্রমুখ। মোহিতলাল মজুমদার ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যে’ (১৯৩৬) বঙ্কিমচন্দ্র, বিহারীলাল, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, দীনবন্ধু মিত্র, দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয়কুমার বড়াল, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে বিষয়ীভূত করেন। আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ (১৯৪০) এবং বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ (১৯৫৪) সংকলন দুটি শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে, শেষ হয়েছে তৎকালীন তরুণতম কবির কবিতার মাধ্যমে। কিন্তু দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ও দীপক রায় সম্পাদিত ‘বাংলা আধুনিক কবিতা-১’ (১৯৯২) জীবনানন্দ দাশকে দিয়ে সূচিত হয়েছে। অর্থাৎ রবীন্দ্রদ্রোহী তিরিশোত্তর কালের ‘কল্লোল’ (১৩৩০) প্রভৃতি পত্রিকাবাহিত নতুন ভাবধারা ও আঙ্গিক শৈলীর কবিতাকে প্রকৃত অর্থে আধুনিক কবিতারূপে চিহ্নিত হতে থাকে।
৩.
কল্লোলের কাল হঠাৎ করে ভূমিষ্ঠ হয়নি। তার হয়ে ওঠার পেছনে একটা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল। বছর ছয়েক হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। যুদ্ধ তো নয়, সে এক বিশাল পতন। বিশ্বব্যাপী সেই অকারণ ও নিষ্ঠুর ‘নরমেধ যজ্ঞে’ সমস্ত প্রচলিত নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও মানবিকতা চুরচুর করে ভেঙে পড়েছে। বিশ্বমানবের ওপর এই চরম আঘাত নেমে এসেছে আবার সেই রাষ্ট্রগুলোর হাত দিয়ে তথাকথিত আলোকপ্রাপ্তির সুবাদে যারা এত দিন নিজেদের পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য ও শিক্ষিত দেশ বলে দাবি করে আসছিল। সভ্যতার মুখোশের আড়াল ভেঙে তাদের পাশবিক লোভ ও লালসার আসল দানবিক মুখ বেরিয়ে পড়েছে। আবার অন্য দিকে শ্রমিকবিপ্লবের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে সাম্যবাদী রাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়া। দেশীয় রাজনীতিতে ঘটে গেছে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, সূচনা হয়েছে অসহযোগ আন্দোলনের। ভূমিষ্ঠ হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি।
এদিকে দেশীয় সমাজও তখন ভাঙছে। গ্রাম-গঞ্জে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ, শিক্ষিতের সংখ্যা বৃদ্ধি, কলকাতা ও ঢাকার আশপাশে কলকারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি সবকিছুর ফলে গ্রাম ভেঙে শহরে আসা মানুষের স্রোত বাড়ছে।
সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে আস্তিক্য-বুদ্ধি, সত্যনিষ্ঠা, সৌন্দর্যবোধ, আনন্দ-মঙ্গল-কল্যাণ-প্রেম এই সব মিলিয়ে তিল তিল করে গড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথের ভাবনালোকও আর নতুন প্রজন্মের মনঃপূত হচ্ছে না। রবি-কিরণের প্রকোপে হাঁসফাঁস করা অস্তিত্বের সংকটে ভোগা কবি-যশঃপ্রার্থী তরুণ-লেখক কবিরা খুঁজছেন অন্য পথ। পাশ্চাত্য শিক্ষার সুবাদে তাদের জানা হয়ে গেছে ইউরোপীয় সাহিত্য এবং ফ্রয়েড ও মার্ক্সের দর্শন। আদিগন্ত ছায়া-বিস্তারকারী রবীন্দ্রচেতনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাঁদের মনে হচ্ছে সর্বত্যাগী বৈরাগী বা সন্ন্যাসী হবার মধ্যে যেমন আনন্দ আছে, অনাচারী, ব্যভিচারী, লম্পট হবার মধ্যেও কিছু কম আনন্দ নেই। নিজেদের রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য সেই ভাবনা থেকেই কল্লোলের সূত্রপাত। তাঁদের কাছে মানুষের মানে দাঁড়াল রক্ত মাংস হাড় মেদ মজ্জা ক্ষুধা তৃষ্ণা লোভ কাম হিংসাসমেত গোটা মানুষ। সেটা অবশ্য জগদীশ গুপ্ত, মণীশ ঘটক (যুবনাশ্ব), বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত এঁদের গল্প-উপন্যাসে যতটা বেশি প্রকট হয়েছিল, কবিতায় ততটা নয়। তবে কজন কবি, যেমন নজরুল ইসলাম, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জীবনানন্দ দাশ – এঁদের কবিতায় একটা দ্রোহ একটা ভিন্ন উচ্চারণের বীজ অবশ্যই বোনা হয়ে গিয়েছিল।
বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদকীয় নেতৃত্বে কবিতা লেখার কাজটি হয়ে উঠেছিল রীতিমতো একটি আন্দোলন, যার মুখপত্ররূপে উজ্জ্বল প্রকাশ ‘কবিতা’ পত্রিকার। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল আধুনিক বাংলা কবিতার সগৌরব অবয়ব নির্মাণ। আন্দোলনের লক্ষ্য পূরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘কবিতা’ পত্রিকা বন্ধ করে দেন বুদ্ধদেব। ১৯৩৫ থেকে শুরু, ছাব্বিশ বছরের আয়ু ‘কবিতা’র , যেন ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে দ্রুত নিজের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে অন্তর্হিত হলো।
‘কল্লোল’ পর্বের এই কবিদের লক্ষ্য মূলত দুটি দিকে প্রবাহিত। এক. সচেতনভাবে ‘রবীন্দ্রোত্তর হওয়া’, দুই. নিজস্ব কাব্যলোক সৃষ্টির প্রচেষ্টা। ‘কল্লোলে’র লেখকদের মানসিকতার পরিচয় মেলে জীবনানন্দ দাশের আলোচনায়: ‘কল্লোলের লেখকেরা মনে করেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ অনেক সার্থক কবিতা লিখেছেন- কিন্তু তিনি যাবতীয় উল্লেখ্য বিষয় নিয়ে কবিতা লেখবার প্রয়োজন বোধ করেন না- যদিও তাঁর কোনো কোনো কবিতায় ইতিহাসের বিরাট জটিলতা প্রতিফলিত হয়েছে বলে মনে হয়; তিনি ভারত ও ইউরোপের অনেক জ্ঞাত ও অনেকের মনে শাশ্বত বিষয় নিয়ে শিল্পে সিদ্ধি লাভ করেছেন, কিন্তু জ্ঞান ও অন্তর্জ্ঞানের নানা রকম সংকেত রয়েছে যা তিনি ধারণ করতে পারেননি বা করতে চাননি।’ [অসমাপ্ত আলোচনা: কবিতার কথা] সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সমকালের সাথে রবীন্দ্রনাথের দূরত্ব সম্পর্কে বলেন: ‘এ-কথা না মেনে তার উপায় নেই যে প্রত্যেক সৎ কবির রচনাই তার দেশ ও কালের মুকুর, এবং রবীন্দ্রসাহিত্যে যে-দেশ ও কালের প্রতিবিম্ব পড়ে, তাদের সঙ্গে আজকালকার পরিচয় এত অল্প যে উভয়ের যোগফলকে যদি পরীর রাজ্য বলা যায়, তাহলে বিস্ময় প্রকাশ অনুচিত।’ [সূর্যাবর্ত: কুলায় ও কালপুরুষ] অন্য দিকে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত রবীন্দ্রদ্রোহের ফলে ‘নতুন পথ’ ও ‘নতুন পৃথিবী’র সন্ধান পেয়েছেন: ‘ভাবতুম, রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যের শেষ, তাঁর পরে আর পথ নেই, সংকেত নেই। তিনিই সবকিছুর চরম পরিপূর্ণতা। কিন্তু “কল্লোলে” এসে আস্তে আস্তে সে-ভাব কেটে যেতে লাগল। বিদ্রোহের বহ্নিতে সবাই দেখতে পেলুম যেন নতুন পথ, নতুন পৃথিবী। আরো মানুষ আছে, আরো ভাষা আছে, আছে আরো ইতিহাস। সৃষ্টিতে সমাপ্তির রেখা টানেননি রবীন্দ্রনাথ- তখনকার সাহিত্য শুধু তাঁরই বহুকৃত লেখনীর হীন অনুকৃতি হলে চলবে না। পত্তন করতে হবে জীবনের আরেক পরিচ্ছেদ।’ [কল্লোল যুগ] আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি কবিতায় ইশতেহার রচনা করলেন:
‘পাশ্চাত্যে শত্রুরা শর অগণন হানুক ধারালো, সম্মুখে থাকুন বসে পথ রুধি রবীন্দ্রঠাকুর, আপন চক্ষের থেকে জ্বালিব যে তীব্র তীক্ষ্ণ আলো যুগ-সূর্য ম্লান তার কাছে। মোর পথ আরো দূর’
তিরিশোত্তর আধুনিক কবিদের ‘পথ’ অনেক দূরবর্তী বন্দরের দিকে এবং ‘আপন চক্ষের’ আলোয় তারা সেইখানে পৌঁছাতে চান। আর পৌঁছাতে চান বলেই দ্রোহী মনোভাবের প্রতিধ্বনি শোনা যায় ‘নাম রেখেছি কোমলগান্ধার’ কাব্যের ২৫ শে বৈশাখ কবিতায় বিষ্ণু দের কণ্ঠে:
‘রবীন্দ্রব্যবসা নয়, উত্তরাধিকার ভেঙে ভেঙে চিরস্থায়ী জটাজালে জাহ্নবীকে বাঁধি না, বরং আমরা প্রাণের গঙ্গা খোলা রাখি, গানে গানে নেমে সমুদ্রের দিকে চলি, খুলে দেই রেখা আর রং সদাই নূতন চিত্রে গল্পে কাব্যে হাজার ছন্দের রুদ্ধ উৎসে খুঁজে পাই খরস্রোত নব আনন্দের’
‘ররীন্দ্রব্যবসা’ ছেড়ে আধুনিকেরা ‘সমুদ্রের দিকে’ যাত্রা করেন নতুন দিগন্তের প্রত্যাশায়। এ ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ: ‘বাঙালি কবির পক্ষে, বিশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে, প্রধানতম সমস্যা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে পারস্পরিক বৈসাদৃশ্য প্রচুর- কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুস্তর; দৃশ্যগন্ধস্পর্শময় জীবনানন্দ আর মননপ্রধান অবক্ষয় চেতন সুধীন্দ্রনাথ দুই বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন, আবার এ-দুজনের কারো সঙ্গেই অমিয় চক্রবর্তীর একটুও মিল নেই। তবু যে এই কবিরা সকলে মিলে একই আন্দোলনের অন্তর্ভূত, তার কারণ এঁরা নানা দিক থেকে নতুনের স্বাদ এনেছেন; এদের মধ্যে সামান্য লক্ষণ এই একটি ধরা পড়ে যে এঁরা পূর্বপুরুষের বিত্ত শুধু ভোগ না-করে, তাকে সাধ্যমতো সুদে বাড়াতেও সচেষ্ট হয়েছেন, এঁদের লেখায় যে-রকমেরই যা-কিছু পাওয়া যায়, রবীন্দ্রনাথে ঠিক সে-জিনিসটি পাই না। কেমন করে রবীন্দ্রনাথকে এড়াতে পারবো- অবচেতন, কখনো বা চেতন মনেই এই চিন্তা কাজ করে গেছে এঁদের মনে; কোনো কবি, জীবনানন্দের মতো, রবীন্দ্রনাথকে পাশ কাটিয়ে সরে গেলেন, আবার কেউ-কেউ তাঁকে আত্মস্থ করেই শক্তি পেলেন তাঁর মুখোমুখি দাঁড়াবার। এই সংগ্রামে- সংগ্রামই বলা যায় এটাকে, এঁরা রসদ পেয়েছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভান্ডার থেকে, পেয়েছিলেন উপকরণরূপে আধুনিক জীবনের সংশয়, ক্লান্তি ও বিতৃষ্ণা। এঁদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধসূত্র অনুধাবন করলে ঔৎসুক্যকর ফল পাওয়া যাবে; দেখা যাবে, বিষ্ণু দে ব্যঙ্গানুকৃতির তির্যক উপায়েই সহ্য করে নিলেন রবীন্দ্রনাথকে; দেখা যাবে সুধীন্দ্রনাথ, তাঁর জীবনভুক- পিশাচ-প্রমথর, রাবীন্দ্রিক কাব্যবিন্যাস প্রকাশ্যভাবেই চালিয়ে ছিলেন, আবার অমিয় চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথেরই জগতের অধিবাসী হয়েও, তার মধ্যে বিস্ময় আনলেন প্রকরণগত বৈচিত্র্যে, আর কাব্যের মধ্যে নানা রকম গদ্য বিষয়ের আমদানি করে। অর্থাৎ এঁরা রবীন্দ্রনাথের মোহনরূপে ভুলে থাকলেন না, তাঁকে কাজে লাগাতে শিখলেন, সার্থক করলেন তাঁর প্রভাব বাংলা কবিতার পরবর্তী ধারায়।’
অর্থাৎ ‘রবীন্দ্রেতর’ হওয়ার সংগ্রামে এই সব আধুনিক কবি রবীন্দ্র-ব্যতিক্রমী মন ও মর্জি, ভাষা ও ভঙ্গির অবলম্বন করেন। এর প্রমাণ তাঁদের প্রাথমিক কাব্যপ্রয়াসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে: জীবনানন্দ দাশের ‘ঝরাপালক’ (১৯২৭) ও ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬); সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘তন্বী’ (১৯৩০); বিষ্ণু দে-র ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ (১৯৩৩); বুদ্ধদেব বসুর ‘বন্দীর বন্দনা ও অন্যান্য কবিতা’ (১৯৩০); প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘প্রথমা’ (১৯৩০) ইত্যাদি।
৪.
কল্লোলের পরও বাংলা কবিতায় পরিবর্তন কিছু কম হয়নি। কল্লোলের অব্যহিত পরই ‘পরিচয়’ ও ‘কবিতা’ পত্রিকা আধুনিক বাংলা কবিতার বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদকীয় নেতৃত্বে কবিতা লেখার কাজটি হয়ে উঠেছিল রীতিমতো একটি আন্দোলন, যার মুখপত্ররূপে উজ্জ্বল প্রকাশ ‘কবিতা’ পত্রিকার। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল আধুনিক বাংলা কবিতার সগৌরব অবয়ব নির্মাণ। আন্দোলনের লক্ষ্য পূরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘কবিতা’ পত্রিকা বন্ধ করে দেন বুদ্ধদেব। ১৯৩৫ থেকে শুরু, ছাব্বিশ বছরের আয়ু ‘কবিতা’র , যেন ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে দ্রুত নিজের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে অন্তর্হিত হলো। বিরোধ আর বৈপরীত্যের মধ্যে বিরল সমন্বয়ের কৃতিত্ব সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর। আধ্যাত্মিকতার পাশে রাজনৈতিক দর্শন, নাগরিক বিচ্ছিন্নতা ও নৈঃসঙ্গ্যের মাঝে প্রকৃতি তন্ময়তা, পদ্যছন্দের পাশে গদ্যছন্দ, রোমান্সনির্ভর কবিতার পাশে বুদ্ধিবৃত্তিক দর্শন, অতিন্দ্রীয় চেতনার পাশে ইন্দ্রিয়ঘন উচ্ছ্বাস- সবকিছুই প্রশ্রয় পেয়েছে ‘কবিতা’র পাতায়। তাই আমরা বলতেই পারি, বাংলা কবিতা কখনো বন্ধ্যা হয়ে যায়নি। আমাদের সৌভাগ্য, বাংলা কবিতার সূচনায় রয়ে গেছে পরম সৌগতের ছোঁয়া। কারণ তার জন্ম বৌদ্ধ সিদ্ধাই-যোগী হাতে। যা প্রথম দিন থেকেই তাকে দিয়েছে একটা বৈরাগ্য ভাব, তান্ত্রিক ও তাত্ত্বিক রহস্যময়তা, একটা শূন্যতার দর্শন। পরবর্তী সময়ে বৈষ্ণব পদকর্তাদের হাত ধরে বাংলা কবিতায় এল রোমান্টিকতা, পরকীয়া প্রেমধর্ম তথা জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে প্রেমধর্মের প্রকাশ। চৈতন্যদেবের প্রভাবে দীর্ঘদিন ধরে তার বিস্ফোরণ চলল। মঙ্গলকাব্যের কবিরা তার সঙ্গে মেশালেন মহাকাব্যিক মেজাজ ও দেব-কাহিনিতে প্রান্তিক মানুষজনের সুখ-দুঃখ । পরে শাক্ত-পদাবলিতে এল পরম বাৎসল্য ও ভক্তিরস। ‘মায়ে-পোয়ের’ ঘরোয়া আলাপচারিতায় দেবীকে সম্বোধন করা হলো তুই বলে। আবার ভারতচন্দ্র আনলেন নাগরিক বিচক্ষণতা ও বৈদগ্ধ।
বাংলা কবিতায় মডার্নিজম ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন। শিথিলভাবে তাঁরা ভাবেন যা কিছু সমসাময়িক তাই বুঝি মডার্ন। ব্যাপারটা আদৌ তা নয় বা অত সহজ নয়। মডার্নিজমের সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক অতি ক্ষীণ। মডার্নিজম মানে ইউরোপীয় কবিতার একটা বিশেষ ভঙ্গি, যার জন্ম হয়েছিল দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ইংলিশ সাহিত্যে, এবং এর কিছু পূর্বে ফরাসি দেশে।
সুতরাং প্রতিটা যুগ থেকেই বাংলা কবিতার অর্জন কিছু কম নয়। সেই দিক দিয়ে কাম বা যৌনতাও এখানে কিছু নতুন নয়। বাংলার কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ- এতে বা মহাজন পদাবলিতে যে শৃঙ্গাররসের প্রকাশ বা ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরে যে যৌনতার বর্ণনা তা বাঙালি সাহিত্য-রসিকের স্মৃতি থেকে কখনোই মুছে যাবার নয়।
অবশ্য ঔপনিবেশিক পর্বের ভিক্টোরীয় মূল্যবোধ ও রবীন্দ্রকবিতার মার্জিত শুচিতায় তা কিছুকাল ঢাকা পড়েছিল। নতুন সময়ে পশ্চিমি হাওয়ার নতুন মেজাজ গায়ে মাখিয়ে কল্লোলের গল্প-উপন্যাস বাঙালির সেই স্মৃতিকেই আবার উসকে দিয়েছিল মাত্র। আর সমাজে বা সাহিত্যে শুচি-অশুচি বা শ্লীলতা-অশ্লীলতার এই টানাপোড়েন কোনো দিনই লুপ্ত হবে না।
৫.
এখন আধুনিক কাব্যরীতির কিছু প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আরও কিছু কথা বলি। রিয়ালিজম বা মগ্নচৈতন্যবাদ ছিল ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদীদের ভাব প্রকাশের একটা বিশেষ ভঙ্গিমা। এটা ঠিক যে জীবনানন্দের হাত ধরেই এই ভঙ্গি বাংলা কবিতায় প্রথম পা রেখেছিল। তারপর সময় বদলেছে, সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে সেই সব ভঙ্গিও। জীবনানন্দের পরের প্রজন্মের কবিরাও যারা তাঁর কবিতায় বেশি আচ্ছন্ন হয়েছিলেন যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার- এঁদের মতো কবিরা সেই ভঙ্গিকে অনুসরণ করে গেছেন। তারপর প্রজন্মের দূরত্ব যত বেড়েছে, সেই প্রভাবও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। এই সময়ের কবিদের লেখাতেও ‘পরাবাস্তবতা’ আসে, তবে তা এককভাবে নয়। অন্য আরও অনেক কিছুর পাশাপাশি মিলিয়ে-মিশিয়ে। তাতে ভাব প্রকাশের বৈচিত্র্য বাড়ে। কবিতায় অনেক বেশি মুক্তাঞ্চল তৈরি হয়।
জাদুবাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়ালিজম বলতে ঠাসাঠাসি বাস্তবের মধ্যে হঠাৎ বিসদৃশ কিছু ঘটিয়ে ফেলাকে বুঝি আমি। বা ঘটনার সঙ্গে অকস্মাৎ এক অঘটনকে জুড়ে দেওয়া। যেটা মূলত লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের একটা বিশেষ ভঙ্গি। কারণ সে দেশে বাস্তবতা বড়ো ভয়ংকর। সেখানে দুর্ভাগ্য মানুষকে অহরহ তাড়া করে বেড়ায়। সেই কর্কশ বাস্তব থেকে মুক্তির জন্য সেখানের শিল্পী-সাহিত্যিকেরা তাই হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার মতো একটা জাদুকরি ঘটনা ঘটিয়ে তার মধ্যেই খানিক আশ্রয় নিতে চায়। ব্যাপারটা গল্প-উপন্যাসেই বেশি চলে, কারণ সেখানে কবিতার চেয়ে আখ্যান-বর্ণনার জায়গা অনেক বেশি। এখন বাংলা কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে যদি জাদুবাস্তবতাকে বিচার করতে হয়, তাহলে আমি বলব, আমাদের অর্থনৈতিক বাস্তবটা লাতিন-আমেরিকার সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। তবে বাংলাদেশের প্রকৃতির মধ্যেই একটা জাদুকরি মায়া আছে। আমাদের গল্প-গাথা-গান-কবিতা-ছড়া সবকিছুর মধ্যেই আপনা-আপনিই কিছু না কিছু জাদু এসে যায়।
বাংলা কবিতায় মডার্নিজম ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন। শিথিলভাবে তাঁরা ভাবেন যা কিছু সমসাময়িক তাই বুঝি মডার্ন। ব্যাপারটা আদৌ তা নয় বা অত সহজ নয়। মডার্নিজমের সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক অতি ক্ষীণ। মডার্নিজম মানে ইউরোপীয় কবিতার একটা বিশেষ ভঙ্গি, যার জন্ম হয়েছিল দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ইংলিশ সাহিত্যে, এবং এর কিছু পূর্বে ফরাসি দেশে।
বাংলা কবিতাতে তা কোনো স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া ছিল না। এখানে তার আগমন ঘটেছিল সেই ঔপনিবেশিক সময়কালেই। সেই মডার্নিজম ছিল বড় একরোখা, জেদি, আধিপত্যবাদী ও সর্বগ্রাসী-হিংস্র। এক বচনে বিশ্বাস করে জগতের সব বৈচিত্র্যকে দুমড়েমুচড়ে দলা পাকিয়ে সে এক ছাঁদে, একই ছাঁচে একটাই মূর্তি বানাতে চেয়েছিল। তার ছিল চরম সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা। কিন্তু অন্য সবকিছু ভাঙতে চাইলেও নিজেকে ভাঙার ক্ষমতা বা গরজ কোনোটাই তার ছিল না।
অনেকে মনে করেছিলেন, সাম্রাজ্যবাদের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে সেই ঔপনিবেশিক-আধুনিকতার প্রাসঙ্গিকতাও শেষ হয়ে গেছে, বলেন এখন উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগ। যাকে কেউ কেউ পোস্টমডার্ন সময়কালও বলছে। এখন নাকি সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে ঔপনিবেশিক চিহ্নগুলোও আস্তে আস্তে ম্লান থেকে ম্লানতর হচ্ছে। তারা এটা বলার চেষ্টা করেছেন, আধুনিকতা যে দাবি নিয়ে বিশ্বসাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিল, আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রকৌশলের প্রভাবের শক্তি তাকে ক্রমেই দুর্বল করে দিচ্ছে। ফলে নতুন কালের নতুন কবিরা আর আধুনিকতার প্রতি আকৃষ্ট নন, তারা উত্তর আধুনিকতার নতুন ধারা সৃষ্টির মাধ্যমে এক নতুন কাব্য আন্দোলনের সূচনা করতে আগ্রহী। তারই ধারাবাহিকতায় আধুনিক কবিতাবিরোধী প্রায় অবসিত একটি সাহিত্যধারাকে উজ্জীবিত করার মধ্য দিয়ে একশ্রেণির তরুণ যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন, তা সম্ভবত একটি ব্যর্থতার দায়ভার বহন করে আধুনিকতাকেই একটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাওয়ার কাজে তাদের প্রভাবিত করতে চলেছে।
অথচ আধুনিক কবিতাকে প্রত্যাখ্যানের এ ঘোষণা এখানে তুলনামূলক সাম্প্রতিক হলেও ইউরোপে কিন্তু একেবারেই সাম্প্রতিক নয়। এখানে যারা এ আন্দোলনের প্রবক্তা, তারা নিশ্চয়ই জানেন, আজ থেকে এক শ বছর আগেই আধুনিকতার পাশাপাশি উত্তর আধুনিকতার ধারাটিকে প্রতিষ্ঠার কথা কেউ কেউ বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছেন।
আমি একমত নই। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ এখন নতুন মাত্রায় প্রবেশ করেছে। হয়তো আগের মতো সরাসরি নয়, কিন্তু ইতিহাসের যেকোন সময়ের তুলনায় না আরও প্রকট আর নগ্নভাবে বিস্তৃত। এ সময়ের কবিতায় মডার্নিজমের বৈশিষ্ট্যসমূহ তাই আরও প্রকট, বিচ্ছিন্ন আর প্রাণহীন! আধুনিকতার পর নতুন কিছু হলেও তা আধুনিকই থেকে যাবে নিঃসন্দেহে।
আমাদের দেশ সর্বকালেই বহু-বচনের পক্ষে , বৈচিত্র্যের পক্ষে। তার বহু রাজ্য, বহু ভাষা, বহু জাত, বহু ধর্ম, বহু পোশাক, বহু রাজনীতি, বহু বহু সাংস্কৃতিক উপাদান। যদিও এ দেশের মূল বৈশিষ্ট্য বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। আর ব্যাপারটা যখন বহুকে নিয়ে তখন তার মধ্যে জটিলতা থাকবে না, অস্থিরতা থাকবে না, তাই কি হয়! অবশ্যই থাকবে। সেটা কোনো সমস্যা নয়। কারণ অস্থিরতা আছে বলেই বিবর্তন শব্দটা তৈরি হয়েছে। স্থির বস্তুর কোনো পরিবর্তন বা বিবর্তন হয় না। বিবর্তিত হয়েছে বলেই বাংলা কবিতার আজ এত মুখ, এত দিশা।
৬.
একেবারে সাম্প্রতিক কবিতার ধারা নিয়ে কিছু কথা বলি। এটা ঠিক বর্তমানে কবি ও কবিতা কোনোটার মানসই আমরা একসাথে সরলরেখায় আঁকতে পারব না।কিন্তু আজ যাকে অনেকে শিথিলভাবে কবিতায় দিশাহীনতা বলে, সেটাকে আমি বলি বহুদিশাময়তা এবং বিষয়টা নেতিবাচক নয় আর ভাবটা খুবই ইতিবাচক। শূন্য দশক বা দ্বিতীয় দশক হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়েনি। [আমি দশককে সাহিত্য আলোচনায় কালনির্দেশক বা পর্যায়নির্ধারক শব্দই ভাবি। তারচেয়ে বেশি উপযোগিতা এর থাকতে পারে, বিশ্বাস করি না। কবি ও কবিতা সর্বকালের- এসব দশক কোনো ভুঁইফোড় দশক নয়। তারও একটা হয়ে ওঠা আছে। তার আগের পর্বটা যদি দেখি তাহলে দেখব আট বা নয়ের দশকের শুরুটাই হয়েছে একটা পতনের আওয়াজে। বিশাল সে পতন। পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতন, সোভিয়েত রাশিয়ার পতন, সর্বোপরি কমিউনিস্ট আদর্শ নামক আধুনিক সময়ের এক শ্রেষ্ঠ আদর্শের পতন। পতনের পাশাপাশি একই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক উত্থান। সেই উত্থান মানে উচ্চ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক নিঃশব্দ বিপ্লব এবং অর্থনৈতিক উদারনীতির হাত ধরে বিশ্বায়নের সূচনা। আবার যখন মনে হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে গোটা পৃথিবীটাই আমেরিকানির্ভর এক-মেরু বিশ্বে পরিণত হবে, তখনই আরেক উত্থান। বিশ্বজুড়ে মৌলবাদনির্ভর ধর্মীয় উগ্রপন্থার ভয়ংকর উত্থান। সেই উগ্রপন্থার হাত ধরেই আবার নতুন সহস্রাব্দের সূচনাতেই আরেক পতনের আওয়াজে আমরা চমকে উঠলাম। সে পতন আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস– দুঃখজনক হলেও সে আরেক গর্বের পতন। কঠোর নিরাপত্তা নামক আরেক সাম্রাজ্যবাদী মিথের পতন।
এই সব উত্থান ও পতনের স্মৃতিকে সঙ্গে করেই নতুন প্রজন্মের কবিরা কবিতা লিখতে এল। তাদের লেখালেখিতেও অনিবার্য হলো তার প্রভাব। সে ভাবেই পরিবর্তিত হলো শূন্য ও দ্বিতীয় দশকের কবিতা।
যদিও এখন সব শিল্পই পারফরমেন্স-নির্ভর, আমোদনির্ভর। বাংলা কবিতায় কেউ কেউ তার প্রচলন চাইছে। কাব্যধারায় এটাও কোনো অভিনব প্রয়াস নয়। ব্রিটিশ-পূর্ব বাংলা কবিতাও কথকতা-সুর-তাল-ছন্দ এই সবকিছুর মিশেলে এক জনমনোরঞ্জনের প্যাকেজ ছিল এবং তা সেকালের গণ-বিনোদনের প্রধান উপায়ও। ঔপনিবেশিক পর্বে তার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এখন দেখা যাক তা আবার নতুন কোনো রূপে ফেরত আসে কি না।
বর্তমান সময়ের কবিতার মধ্যে শব্দের যে অনৈতিক ব্যবহার বা অর্থ প্রকাশে অশিল্প ধূসরতা তার একটা পর্যায়ক্রমিক যাত্রাপথ আছে। যেকোনো কাজের পেছনে উদ্দেশ্য বা উপলক্ষ তো একটা থাকেই। না হলে অন্য কাজ ছেড়ে সেই কাজটাই বা মানুষ করবে কেন। যারা কবিতা লিখতে আসছে, তারাও কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই আসছে। হতে পারে সেটা একেকজনের ক্ষেত্রে একেক ধরনের। কেউ নিতান্ত শখে, কেউ নাম-যশ অর্জনের জন্য, কেউ আবার নিখাদ প্যাশন থেকে। বাংলা কবিতায় বাজারি পুঁজির অনুপ্রবেশ গত শতকের সেই ছয়ের দশকেই। যখন বাংলা কবিতার আধুনিক পর্বকে বিদ্যায়তনিক সিলেবাসের গণ্ডিতে বেঁধে ফেলা হলো এবং দেখা গেল সেই কবিতা নিয়ে আলোচনা করিয়ে বা কবিতা লিখিয়ে, কবিতাকে নিয়েও ব্যবসা করা যায় তখন কবিতার পেছনেও মূলধন ঢালা হলো। এটা যে খারাপ তা বলছি না। লেখালেখি করে কেউ যদি অর্থ উপার্জন করে তাতে আপত্তির কী আছে। কিন্তু আপত্তি করার ব্যাপারটা ঘটল তারপরে। যখন বাজার চেষ্টা করল এবং সফল হলো তাদের প্রতিষ্ঠানের অনুগত কিছু কবির পেছনে আগমার্কা তকমা লাগিয়ে, বাকিদের লেখা যত ভালোই হোক তাকে পাত্তা না দিয়ে, নিজেদের খাড়া করা কবিদেরই আদর্শ হিসেবে দেখিয়ে বাজার দখল করে একচ্ছত্র আধিপত্য জারি রাখার। এখনো সেই ট্র্যাডিশন চলছে।
তবে বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় বাকিরাও থেমে থাকল না। ওই ছয়ের দশক থেকেই কলকাতা ও তার আশপাশে অজস্র ছোট ছোট পত্রপত্রিকা প্রকাশের প্রচেষ্টা শুরু হয়ে গেল। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তখন অতি-বামপন্থীরা ডাক দিয়েছিল গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলার। তাঁরা সেটা না পারলেও সাহিত্য পত্রিকাগুলো কিন্তু ক্রমে ক্রমে সেটাই করে দেখাল। এখন তো আবার সোশ্যাল নেটওয়ার্কের সৌজন্যে বৈদ্যুতিন দেয়ালে ও পাতায় কবিতা পোস্ট করার অফুরন্ত সুযোগ। সেখানে পত্রিকা সম্পাদকের শাসন বা উপেক্ষাও চলে না। সুতরাং কে কাকে কলকে দেয়। এখন তাই ছেলেমেয়েরা মনের আনন্দে এবেলা-ওবেলা সেখানে কবিতা পোস্ট করছে। এই ট্রেন্ড লেখালেখিতে এক নতুন যুগের জন্ম দিয়েছে।
আর শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে দরাদরির ব্যাপারটা গৌণ, সেখানে সবার আগে সৃষ্টি। তবে লেখালেখি করে অনেকেই কিছু কিছু পাবার আশা করেন না যে তা নয়। অর্থ-যশ-প্রতিপত্তি অনেকেই পেতে চায়। সেটা খারাপ কী। আজকের দিনে লেখালেখিকে কেউ যদি ক্যারিয়ার বানাতে চায়, বানাতেই পারে। তবে সেখানেও যে কথাটা এসে যায়- বাজারের চাহিদা পূরণ করতে গেলে একটা দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং বাজারের শর্তগুলোও মানতে হবে। কেউ যদি তাতে রাজি থাকেন, অবশ্যই সে পথে হাঁটবেন। এখানে আদর্শের কোনো বিষয় নেই, আছে শিল্পের হিসাব-নিকাশ। আদর্শের প্রশ্নে বলতে পারি, আমার কাছে আদর্শ ব্যাপারটাকেই কেমন কেমন মনে হয়। মনে হয় ঠাকুর-দেবতার উপাসনার মতোই এটা যেন একটা ঠিকাদারি প্রথা। যেখানে উপাসক ও উপাস্য দুপক্ষেরই বিড়ম্বনা। কবিতা লিখতে গেলে আদর্শ থাকতেই হবে, এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে! যে যার নিজের মতো লিখুক না। ‘এর মতো’ ‘ওর মতো’ বলাটা আমাদের বহু পুরোনো অভ্যাস। আরেকজনের ‘মতো’ হবার মধ্যে আদৌ কোনো গৌরব আছে কি! আমি অবশ্য অনুপ্রেরণার কথা অস্বীকার করছি না। আজকের দিনেও বাংলা কবিদের কাছে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা তো রবীন্দ্রনাথ। মনে রাখতে হবে, আগে শিল্প তৈরি হয়েছে, তারপরে তৈরি হয়েছে তার বোদ্ধা। তাঁরা বানিয়েছে তত্ত্ব ও ব্যাকরণ। সুতরাং সাধারণ মানুষই শিল্প তৈরি করে। যদিও নাগরিকতার সৌজন্যে তার বেশির ভাগটাই এখন দক্ষ ও কুশলী ও বিশেষজ্ঞদের দখলে। উচিত-অনুচিতের কোনো বাঁধাধরা শাস্ত্রলিখন নেই। লেখালেখির ব্যাপারটা একেবারেই ব্যক্তিগত। যিনি যা ভাবেন তিনি সেভাবেই লেখেন, আর সেভাবেই লেখা উচিত। তবে ভাবনা যা-ই হোক, কারও লিখিত বয়ানের মধ্যে যদি নিজস্ব প্রাণশক্তি জন্ম নেয় এবং তা যদি পাঠককে দিয়ে তার ওপর পাঠকের আপন বয়ান তৈরি করিয়ে নিতে পারে, তবে তা পাঠককুলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় বা টিকে থাকতে পারে। এমনকি কবি-লেখকদের ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শও থাকতে পারে। কিন্তু কবিকে মুল্লায়ন করতে হবে কেবল কবিতা দিয়ে।
৭.
কবিদের ক্ষেত্রে সৎ-অসৎ এসব ফেলে আসা সময়ের তৈরি করা ধারণা। কবিকে প্রথমে শুধু কবিই হতে হবে। পুরোনো অভ্যাস থেকে সৎ-অসৎ প্রশ্ন যারা এখনো তোলেন, তাঁদের ভেবে দেখতে অনুরোধ করি, সেই মাপকাঠিতে তাঁরা নিজেরা কতটা সৎ। আর তথাকথিত সৎ থাকতে হলে যে বাজারের থলি হাতে বেরোনো যাবে না, ভিড় বাসে ওঠা যাবে না, এসব নিষেধাজ্ঞাই বা কে জারি করল। কবিরা তো সমাজ-বিচ্ছিন্ন কোনো অদ্ভুত জীব নয়। রোজকার যাপিত জীবন তার ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতাই তো কবিকে বেশি ভাবাবে। তা না হলে কবির কাজ কি শুধু খাতা-কলম নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা। কোনো দৈবী অনুপ্রেরণার জন্যে! যার দোহাই দিয়ে একসময় বৈদিক স্তোত্র-রচয়িতা বা স্তাবকেরা নিজেদের বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণি বলে দাবি করে সমাজে পুরোহিতের মর্যাদা আদায় করে নিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের বলা একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, ‘একজন কবি যখন নিচু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধে তখনো সে কবি।’ সুতরাং আমরা যারা কবিতা লিখি, যখন যা-ই করি না কেন, মনটা পড়ে থাকে সেই কবিতার কাছেই। সুতরাং সরে যাবার কোনো প্রশ্ন নেই। বরং যেকোনো বৈষয়িক সমস্যা বা জটিলতার মোকাবিলা করতে কবিতাই অনুপ্রেরণা, প্রধান শক্তিদাতা।
হইচই না করে নিজের মতো ভাবা, নিজের কাজটা নিজের মতো করতে হবে কবিদের। নিজেদের বিজ্ঞাপনের কাজ কবিদের নয়। বিজ্ঞাপন ব্যাপারটা পণ্যের বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত। কবিদের উচিত নয় লেখালেখিকে পণ্যে পরিণত করা। তবে নিশ্চয়, বইয়ের কিছু প্রচার দরকার হয়। কিছু বই বিক্রি হলে পরের বইয়ের জন্য প্রকাশকের যেমন আগ্রহ থাকবে, তেমনি যে লেখক বা কবির লেখা যাঁদের ভালো লাগে, লেখা যাঁরা পড়তে চান, তাঁদের কাছে খানিক পৌঁছানোও দরকার। সেই পৌঁছানোর মাধ্যম অবশ্যই শিল্পসম্মত হতে হবে। শিল্পের বিচারে সময় খুব নিষ্ঠুর। তাই কোনো দিন কোনো চটুল ও বিজ্ঞাপন বা প্রচারনির্ভর ‘শিল্পী যশঃপ্রার্থী’ শিল্পী হতে পারেনি।
আজকের প্রজন্মের কাছেও সমস্যা আছে, সংকট আছে। ভেসে যাবার অনেক রাস্তা আগেও ছিল, এখন তা আরও বেড়েছে। যারা পুরোনো দিনের মানুষ, তাদের হয়তো মনে হবে আজকের বিশ্বায়িত প্রজন্মের চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশি। সত্যি সত্যি এখন আধিপত্যবাদের ভোল-ভাল একেবারে বদলে গেছে সব ক্ষেত্রেই।
যদিও এখন সব শিল্পই পারফরমেন্স-নির্ভর, আমোদনির্ভর। বাংলা কবিতায় কেউ কেউ তার প্রচলন চাইছে। কাব্যধারায় এটাও কোনো অভিনব প্রয়াস নয়। ব্রিটিশ-পূর্ব বাংলা কবিতাও কথকতা-সুর-তাল-ছন্দ এই সবকিছুর মিশেলে এক জনমনোরঞ্জনের প্যাকেজ ছিল এবং তা সেকালের গণ-বিনোদনের প্রধান উপায়ও। ঔপনিবেশিক পর্বে তার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এখন দেখা যাক তা আবার নতুন কোনো রূপে ফেরত আসে কি না।
পাশাপাশি আমি বলতে চাই, একটা অন্য পরিবর্তনের কথা। সে পরিবর্তন ভাষার পরিবর্তন। এটা আমাদের অগোচরে খুব নিঃশব্দে ঘটে যায়, আমরা ততটা খেয়াল করি না। ভাষার ক্রমবিকাশে একটা বড় ভূমিকা থাকে কবিতার ও কবিদের। কারণ কবিদের কাজ ভাষার প্রয়োগ নিয়ে। বাংলা ভাষার জন্মলগ্নের রূপ বা বিভিন্ন পর্বে তার ক্রমবিকাশের রূপ কিন্তু আমারা জেনেছি নানা সময়ের কবিতার মাধ্যমেই। আজ দুই শ বছরের কিছু বেশি গদ্যের পথচলা শুরু হয়েছে। কিন্তু গদ্য বিষয়ীদের ভাষা। ভাষা পরিবর্তনটা তাই ঘটে কবিদের হাত ধরেই। কবিরা ভাষাশিল্পী। নানা ভাবে নানা পরিসরে তারা ভাষার চর্চা করে। কবিরাই পারে ভাষার ব্যবহারকে আরও উদার, আরও নমনীয়, আরও সম্প্রসারিত করতে, যাতে সে আরও বেশি ভাব বহনে সক্ষম হয়। আরও ক্ষমতাশালী হয়। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সমাজ পরিবর্তনের এই উন্নত ভাষা ব্যবহারের একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে। মধ্যযুগের ভাষার বিবর্তনের সূত্র ধরে আমরা সেই সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলোও বুঝতে অনেকটা সক্ষম হই। ভাষার নতুন ও অভিনব ব্যবহার মানুষের মনে একঝলক টাটকা বাতাস নিয়ে হাজির হয়। আর মানবমনের ওপর ভাষার কী অপরিসীম প্রভাব, তা নিভৃতে রবীন্দ্রনাথের গান শুনলেই উপলব্ধ হয়। সুতরাং প্লেটোর অনুসারীরা যতই ভাবুন সমাজে কবিদের কোনো কাজ নেই, তাতে কবিদের ভূমিকা এতটুকু ছোট হবে না।
৮.
আমি কবিতা লিখি ভালো লাগা ও ভালোবাসার জন্য। অবশ্যই নিজের জন্য। কারণ আমি নিজেই তো আমার কবিতার প্রথম পাঠক। কবিতা আমার কাছে বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন। রোজকার সংসারজীবন যখন প্রতি মুহূর্তে কড়ায়-গন্ডায় আমার কাছ থেকে তার মাশুল উশুল করে নিতে চায়, তখন একটু আনন্দ, একটু সুখ, একটু স্ফূর্তির জন্য আমার কবিতার কাছে বারবার ছুটে আসা। দুই লাইন নতুন কিছু লিখতে পারলে কাঁধের ওপর থেকে অনেকটা চাপ কমে যায়, টেনশন লঘু হয়, ক্লান্তি কমে, অবসাদকে জয় করতে পারি। মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়।
বাংলা কবিতা এগোচ্ছে না পছাচ্ছে, এমন বিতর্কেও আমার রুচি নেই। তবে বলতে পারি, বাংলা কবিতার একটা আছে নিজস্ব প্রাণশক্তি, একটা নিজস্ব গতি। একেক পর্বে তার বিকাশ একেক রকম।
প্রতিটা যুগেরই নিজস্ব কিছু সংকট থাকে, যাকে আমরা যুগ-সমস্যা বলি। যুগে যুগে অনেক সমস্যা-সংকট বা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়েই কবিকে ভাবতে হয়, লিখতে হয়, লেখার ভেতর দিয়ে উত্তরণ খুঁজতে হয়। আমরা সেসবের সঙ্গে মানিয়ে নিই বা সেসবের সঙ্গে মোকাবিলা করেই সামনের দিকে এগিয়ে যাই। যখন সেই সংকট মাত্রাছাড়া হয়, যা মোকাবিলা করা যায় না- মানিয়ে নেওয়া যায় না, তখন আসে ভাঙন আর ধ্বংস। সেই ধ্বংসের হাত ধরে আরেক নতুন নির্মাণের জন্ম হয়।
আজকের প্রজন্মের কাছেও সমস্যা আছে, সংকট আছে। ভেসে যাবার অনেক রাস্তা আগেও ছিল, এখন তা আরও বেড়েছে। যারা পুরোনো দিনের মানুষ, তাদের হয়তো মনে হবে আজকের বিশ্বায়িত প্রজন্মের চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশি। সত্যি সত্যি এখন আধিপত্যবাদের ভোল-ভাল একেবারে বদলে গেছে সব ক্ষেত্রেই। নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী রূপে এখন আর সে আক্রমণ করে না। সে আসে বন্ধুর রূপ ধরে, বাজার অর্থনীতির হাত ধরে, উন্নত জীবনযাপনের নামে মানুষের ভোগের ইচ্ছাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে লাগামছাড়া করে। তার ‘মানুষ’ পরিচয় ভুলিয়ে দিয়ে তাকে নিছক এক উপভোক্তাতে পরিণত করতে চায়। চারপাশে অহরহ এসবেরই ব্যাপক আয়োজন। আজকের প্রজন্মকে নিজেদের বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করে তাকে চিনতে ও বুঝতে হচ্ছে। নিজস্ব শক্তিতে তার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আশার কথা, ভোগের এত প্রলোভন থাকার পরও প্রতিদিন নতুন নতুন কবিরা কবিতা লিখতে আসছে। তাই বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। যুগে যুগে মানুষ নিজের গরজেই কবিতার কাছে এসেছে, ভবিষ্যতেও আসবে।