নারসিসাসের জল আয়না -২
শিউলি বকুল কুড়োবার পালা শেষ
পড়ে নিতে পারেন- নারসিসাসের জল আয়না -১
বিকেলে ফড়িং উড়লে
বৃষ্টি হতোই ভোরবেলা;
কানামাছি গোল্লাছুটের মাঠে
হাত বাড়িয়ে ফড়িঙ ধরার মতো
কিংবা বুকপকেটে কুয়াশা, মেঘমালা
হাফ প্যান্টের পকেটে মারবেল,
মন চাইলে দু একটা ঘাসফুল
জমিয়ে রাখবার মতো
শব্দ টোকানোর খেলা-
কবিতার হয়ে ওঠা ।
পাতলা রঙিন কাগজের ঘুড়ির উপরেই তখন যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আসেনি, আমার নজর গেল চং ঘুড্ডি আর চিলা ঘুড্ডির দিকে! চং (চং ->চংগ->মই ->সিঁড়ি) ঘুড়ি ছিল যতদূর মনে পড়ে বাঁশ বা বেতের বর্গ বা আয়তকার কিছুটা মইয়ের মোটিফে, আর চিল ঘুড়ি ছিল ব্রাউন কাগজে গড়া চিলের আদলে। আমার চিল চিৎকারেই কিনা, একদিন এক বড় ভাই আমাকে একটা চিল ঘুড়ি উপহার দিলেন।
আরেকটা সম্পদ ছিল কাঠের লাটিম, তার একদিকের গর্তে ছোট্ট লাঠি বসিয়ে তোফা ঘুরানো যেত! লাটিমটার গায়ে লাল নীল হলুদ ডোরা কাটা ছিল। প্রিয় আর একটা খেলনা ছিল লোহার চাক্কি! মাঝে মাঝে চাক্কি নিয়ে বৈকালিক ভ্রমণে বের হতাম। সেই চাক্কির নাম দিয়েছিলাম ভাইকিং! কিছু মার্বেল ছিল সব সময়, আংটিসে বেশি পারদর্শী ছিলাম।
আবুমামা ওয়ারি ক্লাবে খেলতেন। ফুটবল, ভলিবল, বাস্কেটবল। সেই সুবাদে দুবার দুটো কমলা রঙের বাস্কেটবল পেয়েছিলাম। সে সব বাস্কেটবল দিয়ে ফুটবল খেলতে আমাদের মোটেই অসুবিধা হত না, তবে গোলকিপার হওয়াতে জোরের বল ধরতে গেলে আমার হাত জ্বালা করত।
আমার সেই শৈশব কেটেছে টনসিল নিয়ে ভোগা আর কুমুদিনী হাসপাতালে গিয়ে দাঁত ফেলাফেলি করে, তারপরেও ক্লাশ ফোরের ঐতিহাসিক ডিসেন্ট্রিতে ভোগার আগ পর্যন্ত নাদুসনুদুসই ছিলাম বলা যায়। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে স্বাস্থ্য বিষয়ে পড়ানোর সময় টিচাররা যখন ভালো স্বাস্থ্য কাকে বলে এরকম প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন, তখন সহপাঠীরা আমার দিকে তাকিয়ে বোকা -বোকা হাসি হাসত।
ক্লাস ফাইভে তখন। আব্বা একটা ছোটখাটো রাশান সাইকেলে চড়ে অফিস যেতে শুরু করলেন। বিকেলবেলা সেই সাইকেলের পা-দানির দখল নিয়ে (সীটের দখল নেয়া সম্ভব হত না) ঘুরে বেড়াতাম।
বাসার সামনে একটা শিউলি গাছ ছিলো। ভোরবেলা বালিকাদের সাথে পাল্লা দিয়ে শাদা শাদা ফুল কুড়াতাম, মালাও গাঁথতাম। অনেক সময় জাফরান রঙের শিউলি ফুলের বোঁটা সংগ্রহ করে আলাদা মালা হতো কিংবা ক্ষুদে রসায়নবিদের পরীক্ষাগারে রঙ তৈরির ব্যস্ততা চলতো। শিউলি ফুলগুলো পরে থাকতো শিশিরসিক্ত সবুজ ঘাসে; সেই স্পর্শ আর ঘ্রাণ আজও আমার স্মৃতির প্রতি বিশ্বস্ত রয়ে গেছে। আর একটা ‘বকুল বৃক্ষ’ ছিল বাসা থেকে বেশ দূরে; একা একা সাইকেলে করে বিকেলের দিকে বকুল ফুলের অভিযানের কথা মনে পড়ে। দু-একবার এক বন্ধুর সাথেও গেছি; সে আর নাই, নিহত হয়েছে কিছুকাল আগে, বিডিআরের হত্যাকাণ্ডে। বকুল ফুল মৃত্যুর ঘ্রান পেয়েছিল সেই ছিয়াত্তর সালেই! আমার একটা গোপন দেরাজ ছিলো; সেখানে খবরের কাগজ থেকে কাটা নজরুল-জয়নুল-ভাসানির ছবিগুলো বকুল ফুলের মালা দিয়ে ফ্রেম করে রাখতাম। ওনারা সে বছরেই প্রয়াত হয়েছিলেন। খুব বেদনাময় একটা বছর ছিলো সেটা। পরবর্তীকালে ‘বয়ঃসন্ধির গান’ নামে একটা কবিতা শুরু করেছিলাম এভাবে—
‘শিউলি-বকুল কুড়োবার পালা শেষ
কুয়াশাকাতর আজ সকালের ঘুম
নীল খামে আঁকা স্বপ্ন- সীলমোহর
শৈশব কেটে গেছে’।
বাসার সামনে একটা শিউলি গাছ ছিলো। ভোরবেলা বালিকাদের সাথে পাল্লা দিয়ে শাদা শাদা ফুল কুড়াতাম, মালাও গাঁথতাম। অনেক সময় জাফরান রঙের শিউলি ফুলের বোঁটা সংগ্রহ করে আলাদা মালা হতো কিংবা ক্ষুদে রসায়নবিদের পরীক্ষাগারে রঙ তৈরির ব্যস্ততা চলতো। শিউলি ফুলগুলো পরে থাকতো শিশিরসিক্ত সবুজ ঘাসে; সেই স্পর্শ আর ঘ্রাণ আজও আমার স্মৃতির প্রতি বিশ্বস্ত রয়ে গেছে।
আজ যখন কবিতাটি নিয়ে ভাবতে বসেছি আর তারই সাথে মনে পড়ছে ছেলেবেলার গান, আরো মনে পড়ছে শিউলি আর বকুল নামে আমার দুই ম্লানমুখ শৈশবের সাথীও তো ছিলো! ৯২-৯৩ তে যখন কবিতাটি লেখা হয়েছিল তখন কী ভেবে লেখা হয়েছিল আজ আর মনে পড়ছে না। বকুলের বাবা বাসায় পত্রিকা দিতেন, সেই ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকায় বাংলাদেশে মুল্যের পাশাপাশি লেখা থাকতো ‘ভারতে বিমান ডাকে ৮০ পয়সা’— এ কথার মানেটা বুঝতাম না, লাইনটা দেখলেই মাথায় বিমানের শব্দ খেলা করতো। মাঝে মাঝে আসল বিমান থেকে দাড়িগোঁফওয়ালা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ছবিসহ ‘এদের ধরিয়ে দিন’-জাতীয় লিফলেটও ফেলা হতো। আব্বা কখনোবা অফিসের ইংরেজি পেপারটা বাসায় নিয়ে আসতেন; বিকেলে আমার দায়িত্ব পড়তো কাগজটা আব্বার বসের বাসায় দিয়ে আসা। অবধারিতভাবেই আমার চেয়ে কম বয়েসি আব্বার বসের মেয়ে পেপারটা রিসিভ করতো। তো, সে একদিন আমাকে জিগেস করে বসলো মাঝে মাঝে পেপার দিতে দেরি হয় ক্যানো? আমাকে হকার ভেবেছে এই লজ্জায় আর অই বাসামুখো হবার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম।
শৈশবের কথা লেখা বেশ কঠিন কাজ। একটা কথা বলতে গেলে সেটা দশটা কথার সাথে সম্পর্কিত দেখতে পেয়ে কোনোটাই বাদ না দিয়ে লেখার লোভ পেয়ে বসে দেখতে পাচ্ছি! শৈশব তো কিছু স্মৃতি ছাড়া আর কিছু নয়— তা হয়তোবা একটা শিউলি কিংবা বকুল ফুলের মালায় গাঁথা।
আমাদের সেই সত্তরের দশকের শৈশব এমন কাব্যময় ছিল যে গদ্যে আর কতটা বলা যায়, বরং কবিতারই আশ্রয় নিচ্ছি আবারও—
আমরা বেড়ে উঠেছি জলপাই রঙের দিনে,
মাটির গন্ধ ছেড়েছুড়ে, রোজ রোজ
সদ্য ছাঁটা বুনো ঘাসের ঘ্রাণে ভরা বিকেল;
পুবে পশ্চিমে তখনো হুঁশিয়ারি
নিউজ পেপারে ঠাণ্ডা যুদ্ধের দিন।
আমরা বেড়ে উঠেছি কারবালা কাহিনি পড়ে পড়ে,
হাতেম তায়ির গল্প শুনে শুনে,
ঐতিহাসিক ময়দানে মাইকের অমায়িক দূষণে,
শাদাকালো টেলিভিশনে তেলের যুদ্ধ দেখে,
দেশে দেশে রাষ্ট্রপ্রধান খুন হতে দেখে;
আমরা বেড়ে উঠেছি অজস্র শিশুমৃত্যুর দেশে।
আমরা বেড়ে উঠেছি সদ্য স্বাধীন দেশে
রিলিফের বিলিতি দুধের টানে ইস্কুলে ইস্কুলে –
উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্রের কল্যাণে মোহাম্মদ আলীর প্রজাপতি নৃত্য দেখে
শুক্রবার হাফ ইস্কুলে,
বসন্তের টীকার ভয়ে জানালা ভেঙে পালিয়ে –
হাটের পাশের জটলায় পুলিশ কীভাবে চোর ধরে, বানরের অভিনয় দেখে
আমরা বেড়ে উঠেছি।
আমরা বেড়ে উঠেছি ইজের-পরা খালি পা-য়
বেলবটমের স্বপ্নে, ডিসকোর ঝড়ে
আমরা বেড়ে উঠেছি র-সু-ন উৎসবের দিনে
পাঠ্যবইয়ের কবিতার ছন্দে ভরা দুপুরে
এক কান ছিল পাতা রেডিওর ‘বিজ্ঞাপন তরঙ্গে’,
বেড়ে উঠেছি বিচিত্রার ‘এখানে সেখানে’ উল্টিয়ে,
সন্ধ্যার আগে আগে লক্ষীমন্ত ঘরে ফিরে।
আমরা বেড়ে উঠেছি রঙিন মার্বেল, ডাংগুলি, কানামাছির মাঠে
আবাহনী- মোহামেডানের সরল হিংসায়; এক্কা দোক্কার
সূদূরতম কল্পনায় ছিল না ডিজিটাল শৈশব।
আমরা বেড়ে উঠেছি টিফিনের ফাঁকে লটারির লুকোচুরি খেলায় –
স্বাধীন শৈশব উড়ত আকাশজোড়া ঘুড়িতে,
আমরা বেড়ে উঠেছি স্বয়ম্ভূ কৈশোরে।
[ সত্তরের দশক ]