চলচ্চিত্রিক মানসিকতা–৭
শুটিং বিড়ম্বনা (পর্ব-২)
শুটিং বিড়ম্বনা (পর্ব-১)-এর পর থেকে-
অভিনয় শিল্পীদের নিয়ে সব থেকে বেশি যে বিড়ম্বনাটির সৃষ্টি হয় তা হল দেরি করে সেটে বা লোকেশনে আসা। একেবারে নূতন বা নন-স্টার আর্টিস্টরা অবশ্য অধিকাংশই ঠিক সময় মত উপস্থিত হয়। সমস্যা করেন স্টার আর্টিস্টরা। এ পর্যন্ত যতবারই আমি ক্যামেরাম্যান বা অভিনেতা হিসাবে কোন শুটিংয়ে থেকেছি, প্রায় প্রতিবারই আমার অভিজ্ঞতাটা অনেকটা এ রকম-
সকাল ৬টার দিকে প্রোডাকশনের গাড়ি এসে বাসার সামনে হাজির হয়। কখনও আমি আগে থেকেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি আবার কখনও আমার মিনিট দশেকের মত সময় লাগে গাড়িতে উঠতে। গাড়িতে উঠে এর ওর সাথে হ্যান্ডশেক করা। যদি পরিচালক সেই গাড়িতে থাকে তো তার সাথে শট নিয়ে সামান্য আলোচনা। ঢাকার ভিতরে হলে ৭ টার মধ্যে লোকেশনে গাড়ি পৌঁছে যায়।
আমি গ্যাস্টিকের রোগী। সকালের খাওয়াটা তাই তাড়াতাড়ি সেরে নেয়ার পক্ষপাতি। কোন কোন সেটে নাস্তা রেডিই থাকে, কোথাওবা প্রোডাকশন ম্যানেজার জানায়- নাস্তা ইজ অন দা ওয়ে। তো ক্যামেরার দায়িত্বে থাকলে আমি পরিচালকের সাথে ঘুরে ঘুরে লোকেশেনের সুবিধা অসুবিধা, কোথায় কি লাইট হবে, ক্যামেরা কোথায় বসবে, এসব দেখে নিয়ে পেট পুজোয় বসে যাই, অথবা পেট পুজো করে দেখাদেখির কাজটা করি। এবং তারপর কোন সোফা বা বিছানায় লম্বা হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আর অভিনয় শিল্পী হলে সেটে এসেই নাস্তা, তারপরে ঘুম।
অবাক হচ্ছেন? কি করব বলেন, অযথা জেগে থেকে নিজেকে কষ্ট দিয়ে তো লাভ নেই। নায়ক নায়িকা আসার পরে মেকআপ, কস্টিউম ইত্যাদি আনুষাঙ্গিকতা সমাপ্ত করতে অন্ততঃ ১ ঘন্টা তো লাগেই। তারচেয়েও বড় কথা নায়ক নায়িকা কখন আসবে? একজন ঘুম কাতুরে মানুষের জন্যে এই সময় ঘুমানোটাই তো বুদ্ধিমানের কাজ, তাই না? ও, বলতে ভুলে গেছি, এর মাঝে কখনও কখনও আবার প্রোডাকশনের কেউ এসে হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে যায়। মোটকথা ক্যামেরাম্যান বা অভিনেতা হিসাবে আমি সে সময় বেশ একটা রাজকীয় মেজাজে থাকি।
তবে পরিচালকের অবস্থাটা সে সময় একেবারেই ভিন্ন। টেনশনে বেচারা অনেক সময় নাস্তা পর্যন্ত করতে পারে না। পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয় যখন দেখা যায় নায়ক বা নায়িকার ফোন বন্ধ। পরিচালক তখন তার সহকারীর উপরে হম্বিতম্বি করে, “কালকে লোকেশনের ঠিকানা ঠিক মত এসএমএস করছিলা তো? কল টাইম কয়টার সময় বলছ? এই শালার নায়ক নায়িকাগুলা… টুট.. টুট.. টুট.. যাওয়ার সময় আবার তাড়াতাড়ি যাইতে চায়… টুট.. টুট.. টুট.. টুট ..”
অভিনয় শিল্পীরা দেরিতে আসার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো আরো বেদনাদায়ক। পরিচালক হয়ত এক মাস ধরে ভাবছে এই সিনে কি কি আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি করবে। কিন্তু উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পরিচালকের শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। সুতরাং ধর মুরগী, কর জবাই। কোথায় সৃজনশীলতা আর কোথায় নান্দনিকতা, পরিচালক তখন সব কিছুর উর্ধ্বে। তার এক মাত্র লক্ষ্য র্নিদিষ্ট সময় কাজ শেষ করা। তা যদি না করা যায় তো আরো এক দিনের ক্যামেরা, লাইট, ট্রান্সপোর্ট, ফুড, মেকআপ ইত্যাদির খরচ। সব মিলিয়ে একটা মোটা টাকার ধাক্কা।
কোন কোন পরিচালক আবার অধিক শোকে পাথর। তারা এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকে। বিড়ি ফুঁকে আর ঘড়ি দেখে। কেউ কেউ আবার সময়টাকে গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করতে চায়। তার পরবর্তী কাজের স্ক্রীপ্ট নিয়ে স্ক্রীপ্ট রাইটার বা প্রডিউসারের সাথে আলোচনা করে। এমনি নানাবিধ ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে কপাল যদি খুব ভালো হয় তো নায়ক নায়িকা সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে সেটে এসে হাজির হয়। আর শুটিং শুরু হয় বেলা ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে।
আর যদি কপাল খারাপ হয় তো, ৯টা ১০টার দিকে নায়ক বা নায়িকা ঘুম থেকে উঠে তার মোবাইল ফোন চালু করে জানায়, গত রাতে এই এই সমস্যার কারণে তার ঘুমাতে দেরি হয়েছিল। সে ভীষণ দুঃখিত। সে একটু পরেই রেডি হয়ে রওনা দিচ্ছে। বলাই বাহুল্য, সেই ‘একটু পরে’ কখনই ‘একটু পরে’ থাকে না। হয়ে যায় দীর্ঘ সময়। না, এবার আর নায়ক নায়িকার দোষ নয়। দোষ শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থার। মোটামুটি আটটার পর থেকেই ঢাকায় রাশ আওয়ার শুরু হয়ে যায়। সুতরাং দীর্ঘ জ্যাম ঠেলে যখন তারকা অভিনেতাটি সেটে পৌঁছান তখন মধ্য দুপুর।
এরপরে যা যা ঘটে, তা সংক্ষেপে এরকম- যেমন তেমন করে হোক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই শুটিং শেষ করার তাড়াহুড়া পড়ে যায়। দুপুরের খাবার খাওয়ার সুযোগ বিকাল ৪/৫টার আগে পাওয়া যায় না। কখনও কখনও অনেক রাত জেগে কাজ করতে হয়। কারণ নায়ক বা নায়িকার যে সিডিউল পাওয়া গেছে তার মধ্যে যদি শুটিং শেষ না করা যায় তো ঐ প্রোডাকশনের ভবিষ্যৎ তাল গাছের মাথায় ঝুলতে থাকা বাবুই পাখির বাসাটির মত। নূতন সিডিউল দুই এক দিনের মধ্যে পাওয়া যাবে কিনা তার কোনোই নিশ্চয়তা নাই। কারণ নায়ক/ নায়িকার এর মাঝে আরো অন্য পরিচালককে সময় দেয়া আছে। তাদের কাজগুলো শেষ করার পরে আপনি নূতন সিডিউল পাবেন।
বস্তুত, সমস্যাটা আরো গভীর। নূতন শিডিউল মানে বাড়তি পরিশ্রম। কিন্তু সেই বাড়তি পরিশ্রমের জন্যে তো বাড়তি কোন পেমেন্ট মিলছে না। পেমেন্টের হিসাব তো প্যাকেজ চুক্তিতে, দিন চুক্তিতে নয়। তাছাড়া নিজের দোষেই বাড়তি সিডিউল লাগছে। তাই বাড়তি টাকা চাওয়ারও সুযোগ নেই। সুতরাং হাতের সব কাজ শেষ করে যখন অবসর থাকবে, তারকা অভিনয় শিল্পীটি তখন আপনাকে সিডিউল দেবে। এতে করে আপনার প্রোডাকশন বাঁশ খাক আর বাঁশ বাগান হয়ে যাক, যায় আসে না। যদি আসত, তবে তো শুরুতেই সে বা তারা সময় মত সেটে আসত। শুটিংও সময় মত শুরু এবং শেষ হত।
অভিনয় শিল্পীরা দেরিতে আসার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো আরো বেদনাদায়ক। পরিচালক হয়ত এক মাস ধরে ভাবছে এই সিনে কি কি আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি করবে। কিন্তু উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পরিচালকের শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। সুতরাং ধর মুরগী, কর জবাই। কোথায় সৃজনশীলতা আর কোথায় নান্দনিকতা, পরিচালক তখন সব কিছুর উর্ধ্বে। তার এক মাত্র লক্ষ্য র্নিদিষ্ট সময় কাজ শেষ করা। তা যদি না করা যায় তো আরো এক দিনের ক্যামেরা, লাইট, ট্রান্সপোর্ট, ফুড, মেকআপ ইত্যাদির খরচ। সব মিলিয়ে একটা মোটা টাকার ধাক্কা।
এখানে বলে রাখা ভাল এই পরিস্থিতি টিভি নাটকের সুটিংয়ের ক্ষেত্রে বেশী করে হয়। টিভি নাটকের বাজেট খুব সীমিত, লাভও নাম মাত্র। সিনেমার শ্যুটিংয়ে চিত্রটা একটু ভিন্ন। দেরি করে সেটে আসার প্রচলন সেখানেও আছে। তবে সিনেমার বাজেট বেশি, তাই বেশি সময় নিয়ে কাজ করার সুযোগ সেখানে রয়েছে। যদিও এই বাড়তি সময়টা অপচয় না করে বাজেটের আকার সংকুচিত করা যেতেই পারে।
সিনিয়র অনেক অভিনয় শিল্পীই তো এই ইন্ডাস্ট্রিতে আসেন যারা দেখিয়ে গেছেন প্রকৃত গ্লামার থাকে অভিনয়ে, চেহারায় নয়। পদ্মা নদীর মাঝি করবার সময় নায়িকা চম্পা কয়েক মাস ধরে তেল মেখে গায়ে রোদ লাগিয়ে ছিলেন শুধু মাত্র চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ গায়ের শ্যামলা রংটি আনার জন্যে। হুমায়ুন ফরীদি ভণ্ড সিনেমায় চরিত্রের প্রয়োজনে তার মাথা ন্যাড়া করেছিলেন। রাইসুল ইসলাম আসাদও ৮০ দশকে একটি টিভি সিরিয়ালে ন্যাড়া মাথায় মধু পাগলা নামক একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কই, তাতে তো তাদের কারো জনপ্রিয়তা কমেনি?
এবার আমার জীবনে ঘটে যাওয়া কষ্টকর একটি ঘটনা বলি। টেলিফ্লিমটি আমার লেখা। গল্পের আইডিয়াটা পরিচালকের। আমরা দিনের পর দিন এই নিয়ে আলোচনা করেছি। পরিকল্পনা করেছি। সুটিং ২ দিনের। নায়িকা একজন মডেল তারকা, অভিনেত্রী হিসাবে যার সে সময় যথেষ্ঠ চাহিদা। একটি বিশেষ চরিত্রে নায়ক রাজ রাজ্জাকও আছেন। আমি ও পরিচালক খুবই আশাবাদী যে ভাল কিছু একটা দাঁড়াতে যাচ্ছে। প্রথম দিন নায়িকার কোন সিন নেই। নায়কের সাথে অন্যান্যদের সিনগুলো মোটামোটি ভালোই হল। পরের দিন মূলতঃ সবগুলো সিনই নায়িকার। বেশ অনেকগুলো সিন। আউটডোর লোকেশনও চমৎকার। নায়িকার চরিত্রটি হল কোন এক মফস্বল শহরের নিম্ন আয়ের এক তরুণী স্কুল টিচার।
২য় দিনে আমরা সবাই বসে আছি। নায়িকার দেখা নেই। সকালের নরম রোদে নায়ক নায়িকার কিছু নরম নরম দৃশ্য নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু নায়িকা আসলো একেবারে ভর দুপুরে। সমস্যা এখানেই শেষ নয়। নায়িকা ঝকঝকে তকতকে সব পোষাক এনেছে। হাজার হোক সে মডেল কন্যা। হয়ত তার র্যাম্পে ক্যাটওয়াক করার ইচ্ছে। কিন্তু চরিত্র তো গরীব স্কুল টিচারের। পরিচালক রেগে আগুন। কিন্তু কিছু করারও নাই। এখন যদি নায়িকাকে সাদামাঠা পোষাক আনার জন্যে পাঠানো হয় তো সে সন্ধ্যার আগে ফিরবে কি না সন্দেহ। টোটাল মাইনকা চিপা।
প্রযোজক সমাধান বের করল। হাজার হোক টাকা তো তারই যাচ্ছে। তাই সে বেশ মরিয়া। নাটকের কিছু দৃশ্যে পরিবর্তন আনা হল। নায়িকা গরীব স্কুল টিচার থেকে হয়ে গেল অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে। যদিও সে তখনও গ্রামের সাধারণ স্কুলটির টিচার হয়েই থাকল। এবং মূল কাহিনী অনুসারে টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকতে ধুঁকতে মারা গেল!!
আমার লেখা স্ক্রীপ্টের এমন পরিণতি দেখার পর থেকে আমি সিদ্ধান্ত নেই, যে কারো সেটে আমি যেতে রাজি আছি, কিন্তু আমার লেখা নাটকের শুটিং যেখানে হবে, সেই সেটে আমি আর কখনও উপস্থিত থাকব না। লেখক হিসাবে স্ক্রীপ্টের এমন পরিণতি দেখা আর বাবা হিসাবে চোখের সামনে আপন কন্যা সন্তানের বলৎকার দেখা প্রায় সমার্থক।
নিজের গ্লামারাস ইমেজ নিয়ে সচেতনতা শুধু যে নায়িকাদেরই থাকে তা নয়। নায়করাও কখনও কখনও তাদের গ্লামারাস ইমেজ নিয়ে অতি সচেতনতা দেখান। এক নায়ককে দেখেছিলাম যে কোন ভাবেই তার চুল এলোমেলো করতে রাজি না। অথচ দৃশ্যটি হল, নায়িকাকে নিয়ে সে ব্যাপক প্যারার মধ্যে আছে। কয়েক রাত তার ঠিক মত ঘুম হয় নাই। খাওয়া দাওয়ারও কোন ঠিক ঠিকানা নেই। এমন দৃশ্যে নায়ক তার চেহারা এবং চুল কিছুতেই এলোমেলো করতে রাজি না। প্রযোজক, পরিচালক, ক্যামেরাম্যান, মেকআপম্যান কারোরই র্নিদেশনা বা অনুরোধ, কিছুতেই কিছু হল না। নায়ক সাহেব তার চকচকে চেহারা নিয়েই ছ্যাঁকা খাওয়া দৃশ্যের শুটিং শেষ করল। বলে রাখা ভাল, সেই প্রডাকশনটিও যথারীতি বাঁশ বাগানে ভরে গিয়েছিল।
আমি প্রায়ই ভাবি যারা তাদের গ্লামার নিয়ে এত সচেতন, তারা এই জাতীয় নাটক বা সিনেমায় কাজ করতে রাজি হয় কেন? এমন তো না যে আগে থেকে তাদের কাহিনীটা জানা থাকে না। তাছাড়া সিনিয়র অনেক অভিনয় শিল্পীই তো এই ইন্ডাস্ট্রিতে আসেন যারা দেখিয়ে গেছেন প্রকৃত গ্লামার থাকে অভিনয়ে, চেহারায় নয়। পদ্মা নদীর মাঝি করবার সময় নায়িকা চম্পা কয়েক মাস ধরে তেল মেখে গায়ে রোদ লাগিয়ে ছিলেন শুধু মাত্র চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ গায়ের শ্যামলা রংটি আনার জন্যে। হুমায়ুন ফরীদি ভণ্ড সিনেমায় চরিত্রের প্রয়োজনে তার মাথা ন্যাড়া করেছিলেন। রাইসুল ইসলাম আসাদও ৮০ দশকে একটি টিভি সিরিয়ালে ন্যাড়া মাথায় মধু পাগলা নামক একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কই, তাতে তো তাদের কারো জনপ্রিয়তা কমেনি? বরং তারা দর্শকদের বুকে চিরস্থায়ী ভাবে জায়গা করে নিয়েছেন।
চলবে…