

সঞ্চয় প্রথম-এর কবিতা
কোনো এক তরুণ কবির অকালপ্রয়াণে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন: বাগদেবী যুগে যুগে বলি গ্রহণ করেন। এমন উদাহরণ আমরা ঠিকই দেখতে পাই। প্রথমেই যাঁর নাম মনে আসে তিনি হলেন টমাস চ্যাটারটন। ইংরেজ কবি। মারা যান মাত্র সতের বছর বয়সে। তা-ও আবার আত্মহত্যা করে। দারুণ প্রতিভাবান ছিলেন। বয়সের তুলনায় অনেক পরিণত কবিতা লিখেছেন। তাঁর প্রভাব পড়েছিল ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের ওপরে। আমাদের সুকান্ত ভট্টাচার্য? একুশ বছর বয়সে প্রয়াণ তার। রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত উৎসবের ঘটনাই বলে দেয় বাঙালির হৃদয়ে তাঁর অবস্থান কেথায়। নব্বইয়ের দশকের কবি শামীম কবীর চব্বিশ বছর বয়সে চলে যান। আত্মহত্যা। এর পর আমাদের সহযাত্রী কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদের একমাত্র পুত্র কবি সঞ্চয় প্রথম পার্থিবতা ঘোচালেন। শারীরিক ব্যাধিই তার মৃত্যুর নিদান, কিন্তু মানসিক বেদনাও তো মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে। বাইশ বছরের যুবক তখন সে।
সম্ভাবনার দীপ্তিতে ঝলসে উঠে কোনো তরুণ যখন অন্তর্হিত হন, আমাদের মন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। আহা, কত কী-না করতে পারতেন এই যুবা যদি রইতেন বেঁচে। অন্তত সম্ভাবনাটুকু তো ছিলই। এই বলির রক্ত নিয়ে বাগদেবীর কোন তৃষ্ণা মেটে কে জানে! হয়তো ওই তরুণ যতটুকুই স্মারকচিহ্ন রেখে গেছেন সেটাই আরও দীপ্তিমান হয়ে ওঠে তাঁর অন্তর্ধানে। লোকে অবধান করে। এটাই দেবীর বর।
‘সঞ্চয় কখন লেখালেখি শুরু করেছিল?’
জানতে চাইলাম সঞ্চয়ের পিতা কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদের কাছে। সেলিম জানালেন, একদিন তাঁর ভাড়া বাসার কাছে লিটল ম্যাগাজিন দ্রষ্টব্য‘র শাহ আলম আর কামরুল হুদা পথিক এসে খুঁজছিলেন কবি প্রগতি সেঁজুতিকে। সেলিম তো চিনতেন না ওই নামের কাউকে। সঞ্চয় তখন জানাল যে সে-ই ওই নামে লেখা পাঠিয়েছিল। তার বয়স তখন তের। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্র তখন সে। পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ওই ছদ্মনাম আর ব্যবহার করতে হয় নাই তাকে। তবে তখন থেকে ‘দ্রষ্টব্য’, ‘প্রতিশিল্প’ এইসব ছোটকাগজ বা লিটল ম্যাগাজিনে তার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। ‘নিমপাতা’ নামে তার কবিতার একটি সংকলনও প্রকাশিত হয় এর কিছু পরে। সময়ের প্রচলিত হিসাবে সঞ্চয়কে শূন্য দশকের কবি বলে ধরে নেওয়া হয়। সোহেল হাসান গালিব শূন্য দশকের কবিদের যে সংকলন করেন তাতে তার কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ওই সংকলনটি তাকেই উৎসর্গ করা হয়। সঞ্চয়ের জন্ম ১৯৮১ সালে, মৃত্যু ২০০৩ সালে।
বছর আটেক সময় পেয়েছিলেন সঞ্চয় লেখালেখি করবার জন্য। কৈশোর ও প্রথমযৌবন। এসময়ে কবিতাই লিখেছেন প্রধানত, তবে কিছু গদ্যও আছে তাঁর।
সঞ্চয়ের নির্বাচিত কবিতার পাণ্ডুলিপি পড়তে গিয়ে প্রথম কবিতা ‘বনসংঘের বন্দেগীনামা ও বিবি বন্দনার বিরল পাঠক্রম’ পড়ে প্রথমেই যেটা অবাক করে তা হল তার বয়সোচিত উচ্ছল আবেগ ও তারল্য নেই তাঁর রচনায়। যেন আগেভাগেই মননজটিল ও বিস্তৃত ক্যানভাসের একটা আবহ পেয়ে গেছেন। তাঁর কবিতার উপাদানরাজি ও বর্ণনার প্রকরণ মনে পড়িয়ে দেয় নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের নাট্যধারার কথা। সেই বর্ণনামূলক দৃশ্যকাব্যের একটা রকম যেন সঞ্চয়ের কবিতা। সঞ্চয়ের বর্ণনায় বাস্তবতা, লোককাহিনি, ধর্মীয় উপাদান, পুরাণ মিলেমিশে একটা জাদুকরি আবহ তৈরি করে। এগুলোর মধ্যে বেশ একটু অসংলগ্নতাও থাকে, যা স্বপ্নিল বাস্তবতাকে বুনন করে। আর এইসব উপাদানের সাথে খুব নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে তার গভীর কিছু আবেগ-অনুভূতি-বোধ, কিন্তু একটু পরোক্ষভাবে। তাঁর হৃদয়ের উত্তাপ টের পাওয়া যায় এই আবহে। একজন তরুণের পক্ষে এই নৈর্ব্যক্তিকতা অর্জন নিশ্চয়ই প্রশংসার ব্যাপার। পরের দিকের কবিতায় ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ বেড়েছে, কিন্ত তার ভাষিক জটিল গ্রন্থন, ওজনদার শব্দসম্ভার আর উপাদানসমূহের দূরান্বয় তাঁর কবিতাকে দুরূহ করেছে নিশ্চয়ই।
কবি কাজ করেন শব্দ নিয়ে। মধুসূদন কবিকে ঘটক আখ্যা দিয়েছিলেন, যিনি শব্দের সাথে শব্দের বিয়ে দেন। কবি তৈরি করেন অনেক নতুন শব্দ; পুরনো শব্দের ব্যঞ্জনা পাল্টিয়ে দেন; পাশাপাশি দুই বা ততোধিক শব্দ বসিয়ে সমাস কিংবা রূপক কিংবা নতুন তাৎপর্য তৈরি করেন। শব্দ ব্যবহারে কুশলতা একজন কবির কৃতিত্বের অন্যতম নির্দেশক। সঞ্চয়ের কবিতায় পাওয়া যায় মনোহর সব শব্দসংস্থান :
ছায়ানদ, জলঠোঁট, দেহের আয়াত, জলছায়া, আগুনকপাট, রোদের পিঞ্জর, রাত্রিযান, বৃক্ষসন্তান, পতঙ্গপিয়াসী, বৃক্ষঋষি, সূর্যসন্ধি, অভ্রকানন, হিমাচারী, মৃৎবিছানা, সূর্যপরিধি, সূর্যশাবক, ছায়ানদী, বলাকানামা, জমজ আগুন, ফোবিয়া দানব, আঙুলকরাত, বৃষ্টিনূপুর, যোনির পৃষ্ঠায় ইত্যাদি।
কবিতার উপাদান দুটি: গান আর ছবি। গান মানে ধ্বনির সুষমা। উচ্চারণ করে পড়লে, এমনকি মনে-মনে যখন পড়া হয় তখনও নিঃশব্দেই ধ্বনিত হয় শব্দসমূহের নিহিত কল্লোল। কবিতায় এই ধ্বনিবিন্যাসে ভূমিকা রাখে অনু্প্রাস, অর্থাৎ একই বা কাছাকাছি ধ্বনির ব্যবহার। রবীন্দ্রনাথের ‘দুঃসময়’ কবিতাটি যদি মনোযোগ দিয়ে দেখি ও পড়ি তবে অনুভব করতে পারব কবিতার বক্তব্যটুকু ছাড়াও এর ধ্বনিবিন্যাস কিভাবে মোহজাল ছড়ায়, ভাবের আবেশ তৈরি করে :
যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক্-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা—
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
ছন্দও কবিতার সংগীতগুণকে বাড়িয়ে দেয়, কারণ কবিতার ক্ষেত্রে ছন্দ হল সেই জিনিস, গানের মধ্যে যা তাল। ছন্দের নানা বৈচিত্র্য আছে। কিন্তু সঞ্চয় মূলত মু্ক্তছন্দ অথবা অক্ষরবৃত্তেই কবিতা লিখেছেন। তবু তাঁর কবিতায় ধ্বনির সংগীত কিভাবে এসেছে তা দেখবার জন্য দুই-একটি উদাহরণই যথেষ্ট। নির্বাচিত কবিতা বইটির প্রথম কবিতাটির প্রথম অংশ দিই :
পাথরে ছেয়ে গেছে নদী, কেঁপে ওঠা তটিনীর বুক।
আরো কাছে বিস্তৃত আছে বনতুলসীর এলায়িত ডাল অশান্ত শঙ্খের
গোধূলির হিমায়িত দেবী নূরের প্রহর ঘেঁষে, অচেনা পরিচ্ছদ
খানি খুলে দিয়ে সচেতন শিহরণে অচেনা কিম্ভূত।
(বনসংঘের বন্দেগীনামা ও বিবি বন্দনার বিরল পাঠক্রম)
এই পঙক্তিগুচ্ছটিই বুঝিয়ে দেয় সঞ্চয়ের কবিতায় ধ্বনির সংগীত কিভাবে রচিত হয়েছে।
আবার ধরুন,
মেঘ দেখে দূরে চলে গেছে হাওয়া
দূর, সে তো দূর বহুদূর ফেরানো গেল না আর।
(দূরকথা-১)
কিংবা,
সচেতন চুলের আলোয় নিরাকার
দেবতার ডেরা ভস্মস্তূপে খোঁজে
দিশেহারা সূর্যশাবক।
(পূর্বসূত্র)
তবে সঞ্চয়ের কবিতায় সাধারণভাবে ধ্বনির প্রয়োগ গীতিকবিতার সরল সংগীতের চাইতে নিশ্চয়ই একটু ভিন্ন; যেন-বা ধাতবযন্ত্রময় আধুনিক হাইস্পিড হেভি মেটাল সংয়ের ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়।
সঞ্চয়ের নির্বাচিত কবিতার পাণ্ডুলিপি পড়তে গিয়ে প্রথম কবিতা ‘বনসংঘের বন্দেগীনামা ও বিবি বন্দনার বিরল পাঠক্রম’ পড়ে প্রথমেই যেটা অবাক করে তা হল তার বয়সোচিত উচ্ছল আবেগ ও তারল্য নেই তাঁর রচনায়। যেন আগেভাগেই মননজটিল ও বিস্তৃত ক্যানভাসের একটা আবহ পেয়ে গেছেন। তাঁর কবিতার উপাদানরাজি ও বর্ণনার প্রকরণ মনে পড়িয়ে দেয় নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের নাট্যধারার কথা।
কবিরা ছবিতা আঁকেন, ছবি লেখেন। শব্দের বিন্যাসে গড়ে তোলেন দৃশ্যপ্রতিমা। শুধু দৃশ্যকল্পই নয়, সব ইন্দ্রিয়ের প্রত্যক্ষণকেই মূর্ত করেন তাঁরা। এমনকি যা দেখা যায় না তাকেও দৃশ্যগোচর করে তোলেন। উপরন্তু ইন্দ্রিয়সমূহের সচেতন বিপর্যয় ঘটিয়ে মহাহট্টরোলও বাধিয়ে তোলেন তাঁরা। তাঁদের বর্ণনা চিত্ররূপময়। আবার উপমা-তুলনা-উৎপ্রেক্ষা এইসব বিবিধ অলঙ্কারে বিভূষিত করে মোহনীয় (কখনও-বা ভয়ানক-অদ্ভুত-বিদঘুটে) রূপ গড়ে তোলেন তাঁরা। ছবিময় বর্ণনা কবিতার এক অপরিহার্য উপাদান।
সঞ্চয়ের ছবিতা কেমন?
এরকম :
- আমাদের জ্যোৎস্নাঘরেতে সই তারা ফোটে খৈ-এর মতন। (দেনমোহর)
- দুলছে মেঘের বুকে চেয়ে দেখ সাদা সাদা সূর্যের চুল। (দেনমোহর)
- সূর্যবাচ্চাসব শ্বেত ঘোড়া হয়ে দৌড়ে দৌড়ে ঠোকে নিজের শরীর। (জলবিবি ছায়ানদ)
- আমার আকারে শুধু রেখে গেলি ধ্যানের আখ্যান। (জলবিবি ছায়ানদ)
- রোদ আমার পেখমে ভর করে উঠে চলে আরশে আরশে। (জলবিবি ছায়ানদ)
- স্রষ্টার কৃত্রিম খোলসের মতো মস্তকে খসে পড়ে ঋতুমত্ত দেহ থেকে নীলের প্রলাপ। (মাতৃস্তুতি পাঠপর্ব)
- ভাসন্ত বাতাসের ভাঁজ খুলে বেরিয়ে পড়েছে সাপের মাধুরী। (মাতৃস্তুতি পাঠপর্ব)
- অশান্ত আত্মার চোখের আড়ে আড়ে পড়ে থাকা অসংখ্য হাড়ের ক্রাচের ঘরে হেঁটে চলি নরক-অরণ্যে। (সুপর্ণা শিখা)
- যোনিঘরে নিজের প্রস্থান। (ক্রীড়নক প্রার্থনা)
- স্বপ্ন-সীমান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি এক অবাস্তব পাথর। (আত্মহত্যা)
- বাবার চোখেই শুধু উড়ছে প্রভুর চিল। (প্রামাণ্য দলিল)
- মাতুল হরীতকী/বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসে যীশু, দেখ চেয়ে স্বয়ং/ঈশ্বর আত্মজ গুণে চলে নক্ষত্র তসবি। (আলিঙ্গন-১)
- প্রতিদিন নীলের প্রাচীর ভেঙে নেমে আসে বৃষ্টির ধ্বনি। (চিরায়ত)
- ইদানীং সবুজ আধুলি হাতে নেমে আসে সুপ্রভাত। (চিরায়ত)
- চাঁদের আধখানি দাঁতে কতটুকু আমিষ গেঁথে ছিল। (চিরায়ত)
- বুকের আঁচল ঠেলে উঠে আসা গোপন সনেটে। (ত্রাণকন্যা এবং অন্যান্য)
- দূরবীনে বিষ ছিল শুধু আর চোখ কফিনের মোম দিয়ে আঁকা। (বন বধযজ্ঞের পঞ্চ পাঠক্রম)
- চোখ তার মৃৎ বিছানার তুলতুলে ঘাস। (তার চোখ)
- অবাধ জ্যোতির দিনে দেবাংশী শয্যার/ছোঁয়া মুহূর্তে হয়েছে ম্লান/নীরব সন্ধ্যায়। (নির্জনতা)
- হাজার তৃষ্ণার ফোঁটা একবুক নুনজল আমাকে দিয়েছ। (জাহানারা)
- দেখ রাত ঘন নীল জলের ফোয়ারা থেকে/বেরিয়ে আসবে কত ঘরণি কঙ্কাল। (জাহানারা)
- কাঁকড়ার পায়ে পায়ে পেঁচানো বিলাপ/টানপড়া বড়শির সুর বুকে ধরে হেঁটে এসে/নাভির সুইমিংপুলে ঝাঁপ দেয়। (ফোবিয়া দানব)
- তোমার জন্য একটি বৃক্ষ কেটে ফেলি আঙুল করাতে। (অভিভূত আস্তাকুঁড়)
- ঘরকুনো সমকামী ছায়া প্রেতশবে কিছুটা সুপ্তি পেয়ে/আবার এসেছে সূর্যের ঘাস হয়ে লিবিডোর ঠোঁটে। (প্রেম)
- ঠোঁটের চামচ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তরল আগ্রাসন। (অবলুপ্তির কেউ)
- একদিন এই অন্ধকার এই ঘন অন্ধকার ত্রিকোণ চিলেকোঠা বেয়ে/রক্ত বোতলের ছিপি খোলা মুখ কম্পিত পায়ে পায়ে/এগিয়ে আসছিল। (অবলুপ্তির কেউ)
- সমুদ্রনাকের ভিতর ঢুকে যায় ছায়ার নোলক। (অবলুপ্তির কেউ)
- কুচি কুচি স্বপ্নের ভেতর হেঁটে যায় অলীক ময়ূর। (স্নানযাত্রার দিন)
- অন্তত একটিবার পৃথিবীর দুর্দান্ত নাশপতি ফল/প্রদক্ষিণ করে যাক আমার ছায়াপথ। (চিত্রগীতি)
কবিতার সংগঠনে আরও অনেক কিছু থাকে, থাকতে পারে। যেমন অন্য কোনো কবির রচনা থেকে এক বা একাধিক পঙক্তি ব্যবহার করা: সেটা সরাসরিও হতে পারে আবার প্রয়োজনমতো খানিক পাল্টেও হতে পারে।
যেমন বিষ্ণু দে লিখলেন :
হেলেনের প্রেমে আকাশে বাতাসে ঝঞ্ঝার করতাল,
ভূলোকে দ্যুলোকে দিশাহারা দেবদেবী,
কাল রজনীতে ঝড় হয়ে গেছে রজনীগন্ধা বনে।
এখানে তৃতীয় পঙক্তিটি রবীন্দ্রনাথের কবিতার। সাহিত্যে এমন ব্যবহার বৈধ।
সঞ্চয় তাঁর কবিতায় লিখলেন,
‘ওরে সই, একটু একটু করে তোকে আকাশের কথা কই।’ (দেনমোহর) এটা মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের ‘ওলো সই, ইচ্ছা করে তোদের কাছে মনের কথা কই’-এর কথা।
আবার অন্য কোনো প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ এনে ব্যবহার করা যায় কোনো বর্ণনায়। এটাকে উল্লেখ অলঙ্কার বা allusion বলে সাহিত্যতাত্ত্বিক পরিভাষায়। সঞ্চয়ের কবিতায় এর প্রয়োগ দেখি :
‘ছিলে ঘাড়ে, ঘাড় থেকে রগের ভিতরে।’ (ভগবান চুরির বিদ্যাপীঠ)। এই পঙক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয় একটি আয়াতের কথা। কোরানে আছে, আল্লাহ বলছেন, আমরা তোমার শাহারগের চাইতেও নিকটে আছি। (নাহনু আকরাবু ইলাইহি মিন হাবলিল ওয়ারিদ।—সুরা কাফ, আয়াত-৫০)।
কবিতায় কখনও কিছু হেঁয়ালি ধরনের গূঢ় উক্তি ও জিজ্ঞাসা থাকে। চর্যাপদে বা বাউল ঘরানার গানে এর প্রয়োগ বেশি দেখা যায়। সঞ্চয়ের কবিতায় কখনও-কখনও এর প্রয়োগ দেখা যায় :
- বল বাবা, এ কোন বাউলার চাকু?
যাকে ধার দিলে ভোঁতা হয়, ভোঁতা দিলে ধারে? (বার আউলচাঁদের জন্য স্তুতি)
- কেননা আমিই চোর/তুমি থেকে আমার উদ্ভব/কে বা হবে বড়? (ভগবান চুরির বিদ্যাপীঠ)
সেই যে আমাদের গান ‘মানুষ বানাইয়া খেলছ যারে লইয়া’তে ছিল ‘বুঝেছি বুঝেছি তুমি চোরের সর্দার গো।’ - তাহলে কি ভূত বলে কিছু ছিল মায়ের বালিশে? (জন্মের কোল থেকে)
পরের দিকে কবিতায় একই শব্দের দ্বিত্ব ব্যবহার করেছেন সঞ্চয়। এটা তাঁর নিজস্ব শৈলী হয়ে উঠতে পারত হয়তো। যেমন,
- আমি তারে ঢের চিনি চিনি একদিন প্রভাতের বেলা। (জাহানারা)
- আগুনের ভাপ হায় পাখি পাখি মোর। (জাহানারা)
ভারি ভারি শব্দ, মহাকাব্যিক আবহ ও উচ্চ অবস্থান ছেড়ে সঞ্চয়ের কবিতা কখনো-কখনো স্বগতোক্তির সাবলীলতাকে ধারণ করেছে। যেমন তাঁর ‘গোত্রহীন ইতিহাস’ কবিতাটি:
আরো একবার ঈশ্বর আমাকে মৃত্যুর
মুখে ঠেলে দিল। কি অদ্ভুত!
আমার বেঁচে থাকা এবং চতুর্থবারের
মতো নিজের ভিতর নিজেকে হত্যা
করবার প্রস্তুতি।
এই স্বরটি তাঁর কবিতার একটি বিশিষ্ট ধরন হয়ে উঠতে পারত। এখানে তার কবিকণ্ঠ ভিন্ন একটা ধারা পেতে পারত।
কিন্তু সঞ্চয় এরকম সরল বর্ণনার কবিতা লেখা পছন্দ করেননি। তাঁর কবিতায় বাক্যের গঠন ও ভাব অনেক সময়েই জটিল, একটু যেন-বা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত, স্কিৎসোফ্রেনিক, সোমনামবুলিস্ট। তাঁর কবিতার বাক্যের সরল বঙ্গানুবাদ করা দুঃসাধ্য। ব্যাকরণের সূত্রে তাঁর কবিতা বুঝতে গেলে পদে-পদে বিড়ম্বিত হবার সম্ভাবনা প্রবল। অবশ্য কবিতার রস আস্বাদনের জন্য এসব বোঝাও অপরিহার্য নয়। এইসব পদাবলির মধ্যে এক বিক্ষিপ্ত, অশান্ত, মনোপীড়িত, উদ্বেলিত অথচ ধীমান ও বিদ্বান, সংবেদনশীল ও আবেগপ্রবণ যুবকের চিত্তোদ্ভাস আমাদের অনুভূতি-বোধ-মননের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে যায়।
সঞ্চয়ের কবিতা তন্নিষ্ঠভাবে ঘেঁটে তাঁর কবিতার কিছু বৈশিষ্ট্য, প্রয়োগপদ্ধতি, ভাবনাচূর্ণ উদ্ধার করেছি বটে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাঁর কবিতার আস্বাদন কেমন? অন্তত আমার পাঠে?
বাংলা কবিতায় আধুনিকতার পুরোহিত ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। যেমন তাঁর সমকালীন তেমনি উত্তরকালীন তরুণ কবিদের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। তাঁর ‘কবিতা’ পত্রিকায় কবিতা ও কবিতা বিষয়ক গদ্য প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা কবিতাচর্চা বেগবান রেখেছিলেন। কিন্তু একটা সময়ে এসে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন বুদ্ধদেব। ঘোষণা করেন, ‘কবিতা’ পত্রিকা বন্ধ করে দেবেন তিনি। কেন? কারণ ওই সময়ের কবিদের কবিতা বুঝতে পারছিলেন না তিনি আর।
এ কী কথা শুনি আজ গুরুজির মুখে! কবিতার সার্থকতা তো বোঝা যাওয়াতে নয়, দ্যোতনা জাগানোতে— আধুনিকতাবাদের এই সূত্রটি বুদ্ধদেবের চাইতে ভালো কে জানতেন আর! আর কবিতা কত রকমেরই-না হয়! প্রতীকবাদ, দাদাবাদ, পরাবাস্তববাদ, ভবিষ্যৎবাদ, ঘনকবাদ, প্রকাশবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি সাহিত্য আন্দোলন হয়ে যাবার পর কবিতার বোধগম্যতার সেই যায়গা তো কবেই চ্যালেঞ্জড হয়ে গেছে। চৈতন্যপ্রবাহী ধারা, অটোমেটিক রাইটিং ইত্যাদি কবিতায় যৌক্তিক পারম্পর্যহীনতা ও অর্থহীনতাকে কবিতায় প্রবেশাধিকার দিয়েছে সেই কবেই। আর প্রচলিত কবিতার ভাষা-ভঙ্গি-ভাবকে চ্যালেঞ্জ করে ভিন্নরকম কবিতা লেখাই নতুন প্রজন্মের আরাধ্য।
কিন্তু যতই এইসব আন্দোলনবাদী ও নিরীক্ষাধর্মী কবিতা রচনা হোক, একসময় পাঠক এ-সবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। বোধগম্য ভাবকাঠামোই খোঁজেন তখন কবিতায়। শব্দসমূহের সংযোগে বুদ্ধিগ্রাহ্য অন্বয় প্রত্যাশা করেন পাঠক।
আমার সমকালীন কবিদের বিকাশকাল আশির দশক। আগের দশকের বর্ণনাধর্মী কবিতার তুলনায় এ সময় কবিতার গঠন ও ভাষা একটু জটিল হয়ে পড়ে। তার পরের দশকে সেটা আরও বাড়ে। এরপর সেটা কারো-কারো ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে যায় যে আমার মতো পাঠকদের অনেকে বুদ্ধদেব বসুর সিনড্রোমে ভুগতে শুরু করেন: এইসব কবিতা বুঝতে পারি না। এগুলো চিত্তবিক্ষেপ তৈরি করে। তা হলে এইরকম কবিতা না পড়লেই হল, যেই রকমের কবিতা পড়ে মন তৃপ্ত হয় সেটাই পঠনীয়।
এই কবিদের তাতে কিছুই আসে-যায় না। তাঁরা তাঁদের মতোই লেখেন। লিখবেন। তেমনি লিখেছেন সঞ্চয় প্রথম। আমি যে তাঁর কবিতার সবকিছু বুঝতে পারি না, এটা আমারই ব্যর্থতা। এটি দেখে মেঘের ওপারে হয়তো খিলখিল করে হাসছে আমাদের সন্তান সঞ্চয় প্রথম।
জানুয়ারি ২০২০