সুখপাখির বিষাদঘ্রাণ : এক বিষণ্ণ অবগাহনের অনুভূতি
দিনযাপনের আটপৌরে অনুভূতিগুলো যেন অন্তরমহলের ঝুলবারান্দায় বন্দি পাখির মতো। সুখ নামের সেই পাখিটির গভীরতম পালকের সুঘ্রাণ বুকে নিয়ে পথ চলি আমরা। সেই পথ চলার গল্পগুলো ঠাঁই পেয়েছে দেবদ্যুতি রায়ের ‘সুখপাখির বিষাদঘ্রাণ’ গল্পগ্রন্থটিতে।
বইটির ভূমিকায় গল্পকার বলেছেন-‘ছোট্ট একট ঘাসফুলের ও গল্প থাকে৷’ কিন্তু সেই গল্পটা হয়তো সাধারণের অগোচরে থেকে যায়। নিভৃত ঘাসফুল কিংবা আনমনে উড়ে যাওয়া পরিযায়ী পাখির দল যখন লেখকের ভাবনায় অনুরণন তোলে তখন সেটা গল্প নামের ক্যানভাসে মূর্ত হয়ে উঠে। এই গল্পগ্রন্থে সেরকম কিছু জলছবি আঁকা হয়ে গেছে।
প্রথম গল্প ‘ঝরোকা’ পাঠককে চমকে দেয়ার মতো চমৎকার এক প্লটে লেখা। থ্রিলার ঘরানার এই গল্পটির বয়ান চলিষ্ণু স্রোতের মতো অথচ শেষ অব্দি কী হয় সেটা জানতে উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। গল্পের মূল চরিত্র মেধায় আর ব্যক্তিত্বে ঝকঝকে ‘ঝরোকা’ বহুদিন পাঠকের স্মৃতিতে থেকে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
এই বইতে আমার অন্যতম প্রিয় গল্প হলো ‘অলীক যাপন’। দেশহীন, ভিটেহীন নীরজার গল্পটি পড়ে অনুভব করি কেন কিছু মানুষের বুকের ভেতর একটা ‘দ্যাশ’ নামের স্বপ্ন আমৃত্যু জেগে থাকে। নীরজারা কাঁটাতার পেরিয়ে সীমান্তের ওপারে নতুন বসত গড়ে। তবু মনের খুব অতলে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে দোলাচলে ভোগে আর অহর্নিশ জন্মভূমির হাতছানি অনুভব করে। শব্দের মোড়কে লেখক সুচারুভাবে সেইসব যাতনার কথা অনুবাদ করতে পেরেছেন। চমৎকার ঠাস বুনোটে লেখা গল্পটি পড়ে তাই পাঠকমনে বিষাদ জাগে।
বইটিতে লেখকের সহজ অথচ তীক্ষ্ণ শব্দচয়ন আর নিখুঁত বিবরণের গুণে পাঠক যেন ঘটনাগুলো খুব কাছে থেকে অবলোকন করতে পারে। ‘মিঠুন কিংবা অজস্র ঘুণপোকার গল্প’তে কথকের মুখে মিঠুনের স্মৃতিচারণ কিংবা ‘পলাতক’ গল্পটিতে দুঃস্বপ্নের ভেতর শমসেরের পালিয়ে বেড়ানোর বর্ণনায় রোমাঞ্চ আছে। আবার কখনো নিপুণ কারুকাজে, মায়াবী শব্দলহরীর মূর্ছনা দিয়েও গল্পকার আমাদের মুগ্ধ করেছেন। ‘অলীক যাপন’ এ নীরজার স্মৃতিমেদুরতা কিংবা ‘রোদের উড়ান’ এ মহানন্দার বর্ণনা বেশ উপভোগ্য।
চেনা মুখের সারি থেকে টুপ করে কেউ একজন হারিয়ে গেলে কেমন লাগে? বিস্মৃত হয়েও কেউ যখন নতুন করে হারিয়ে যায় স্মৃতির বুদবুদেরা তখন অযথাই ভিড় করে। যার যার নিজস্ব ব্যবচ্ছেদ ঘরে সেই মানুষটার ময়নাতদন্ত চর্চিত হয় । সেই সাথে শুরু হয় মাথার ভেতর অজস্র ঘুণপোকার বিচরণ। কেন এভাবে হারিয়ে যায় কেউ? ‘মিঠুন কিংবা অজস্র ঘুণপোকার গল্প’ পড়ে মিঠুনকে অপরিচিত কেউ বলে মনে হয় না। আমাদের সবার জীবনেই হয়তো দুয়েকজন মিঠুন থাকে যারা রক্তাক্ত না হলে, হারিয়ে না গেলে আমাদের মন-দেরাজের ঘুণপোকাগুলো জেগে ওঠে না।
এই গল্পগ্রন্থে আরেকটি ভিন্ন স্বাদের গল্প হলো ‘পাহারাদার’। শুরুটা নিতান্ত নিরীহভাবে হলেও শেষ পর্যন্ত গল্পের গতি যে এভাবে বদলে যাবে সেটা অনুমান করা মুশকিল। গল্পের প্লট সাজানোয় লেখকের দক্ষতা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
‘পলাতক’ গল্পটি পড়ে স্তম্ভিত হতে হয়। একই সাথে ঘৃণা আর করুণা জাগে শমসের চরিত্রটির প্রতি। বিচারহীনতার এই সমাজে শরফুনের পিতাদের পরিণতি গল্পের মতোই। তবে প্রকৃতির শোধ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। তাইতো শমসের নিজেকে সেই পিতার জায়গায় কল্পনা করতে বাধ্য হয় আর ভয়ানক একটা দুর্ভাবনা তাকে ক্রমশ গিলে খেতে থাকে।
‘অন্দরমহল’ আর ‘সমান্তরাল’-এই গল্প দুটির বক্তব্য সাদামাটা হলেও লেখকের বর্ণনাশৈলীর গুণে দুটোই পাঠকহৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। সমান্তরাল গল্পটি কৈশোর পেরুনো এক সদ্য তরুণের মনস্তত্ত্ব নিয়ে নিটোল একটা গল্প। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের নতুন করে পথচলা সন্তানের মনে যে ক্ষোভ আর দ্বিধা তৈরী করে সেটা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ভাবে ফুটে উঠেছে। গল্পের সমাপ্তিতে সৌরভের উপলব্ধিটুকু মনকে আর্দ্র করে দেয়।
‘সুখপাখির বিষাদঘ্রাণ’ বইটিতে বেশিরভাগ গল্পই অলীক সুখের সন্ধানরত জীবনের বিষণ্ণতম অধ্যায়ের গল্প। গল্পগুলো পড়তে গিয়ে মন খারাপের পারদ যখন ক্রমশ বাড়তে থাকে তখন শেষ গল্প ‘রোদের উড়ান’ এক চিলতে রোদের মতোই ঝিকিয়ে ওঠে। আশা জাগানিয়া এই গল্পে যৌন হয়রানির স্বীকার হওয়া শিউলির প্রতি রহমতের অনুরক্তি কিছুমাত্র কমে না বরং সে এই অন্যায়ের একটা বিহিত করতে চায়। আজকের দিনে রহমতের মতো চরিত্রের খুব প্রয়োজন। তাহলেই শিউলিরা নিজেকে এত সহজে অচ্ছুৎ ভাববে না।
বইটিতে লেখকের সহজ অথচ তীক্ষ্ণ শব্দচয়ন আর নিখুঁত বিবরণের গুণে পাঠক যেন ঘটনাগুলো খুব কাছে থেকে অবলোকন করতে পারে। ‘মিঠুন কিংবা অজস্র ঘুণপোকার গল্প’তে কথকের মুখে মিঠুনের স্মৃতিচারণ কিংবা ‘পলাতক’ গল্পটিতে দুঃস্বপ্নের ভেতর শমসেরের পালিয়ে বেড়ানোর বর্ণনায় রোমাঞ্চ আছে। আবার কখনো নিপুণ কারুকাজে, মায়াবী শব্দলহরীর মূর্ছনা দিয়েও গল্পকার আমাদের মুগ্ধ করেছেন। ‘অলীক যাপন’ এ নীরজার স্মৃতিমেদুরতা কিংবা ‘রোদের উড়ান’ এ মহানন্দার বর্ণনা বেশ উপভোগ্য।
চমৎকার প্রচ্ছদ আর নামকরণের কারণে ‘সুখপাখির বিষাদঘ্রাণ’ বইটি হাতে নিয়েই মুগ্ধ হতে হয়। আর পাঠ শেষে ডুবে যেতে হয় অতল ভাবনায়। লেখকের নির্মেদ আর সাবলীল বয়ানভঙ্গি দেখে বিস্মিত হতে হয়, মনে হয় না এটি তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ। এই ধারাবাহিকতায় আগামীতে তাঁর কাছে আরো চমৎকার সব লেখা পাবো বলে প্রত্যাশা করি। স্বতন্ত্র লেখনশৈলীর গুণে তিনি যে পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নেবেন তা সহজেই অনুমেয়।
পড়ুন দেবদ্যুতি রায়-এর গল্প: ‘ঝরোকা’