:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
অদিতি ফাল্গুনী

কবি, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক

সেলিম মোরশেদের ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’: কালো যজ্ঞের মন্ত্র
শিল্পকর্ম: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

সেলিম মোরশেদের ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’: কালো যজ্ঞের মন্ত্র

আশির দশকের শক্তিমান কথাশিল্পী ও নিরাপোষ লিটলম্যাগ অ্যাক্টিভিস্ট সেলিম মোরশেদের গল্পভুবন সত্যি বলতে বাণিজ্যিক, বড় কাগজের লেখকদের লেখার চৌহদ্দি থেকে অনেকটাই আলাদা। নব্বইয়ের দশকে আমরা যখন গল্প লিখতে ঢুকছি, ১৯৯৯-এ আমার প্রথম গল্পের বই ‘ইমানুয়েলের গৃহপ্রবেশ’ প্রকাশিত হবার পর আশির আর এক খ্যাতনামা লেখক নাসরীন জাহান বা নাসরীন আপার মাধ্যমেই সেলিম ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। তখন আবার একটা কথা হাওয়ায় উঠছিল যে লিটল ম্যাগাজিনে না লিখেও সিরিয়াস লেখালিখি করা সম্ভব। এ নিয়ে অনেক কথা-চালাচালিও হয়েছে অগ্রজ সেলিম মোরশেদ বা সেলিম ভাইয়ের সাথে। আজ ২১ বছর পর পিছন ফিরে দেখি ভুল তো বলেননি তিনি। কথাশিল্পের বিষয়বস্তুতে মৃত্তিকাসংলগ্ন ও নিরীক্ষাপ্রবণ হবার সংগ্রামে রত বলে বৃহত্তম পত্রিকার শুভাশিস থেকে দিন দিন কি ছিটকে পড়ছি না? অথচ ভেবেছিলাম যে মা কমলা বা লক্ষ্মীর ক্রোড়ে বসেই আমরা দেবী বীণাপাণি বা সরস্বতীর উপযুক্ত তপস্যা করব বা করতে পারব। তা হয়নি। বিভক্ত বাংলার বাংলাদেশ অংশের বেদনা এই যে এখানে পশ্চিম বাংলার মতো একটি উপযুক্ত লিটলম্যাগ আন্দোলনের পরিকাঠামোই গড়ে উঠতে পারল না নানা সীমাবদ্ধতায়। ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’-র মতো গল্প লেখার অসম্ভব ধক ও ক্ষমতা নিয়ে জন্মানো লেখক সেলিম মোরশেদকে উপযুক্ত লালনের পরিবেশ আমাদের মৃত্তিকা দিতে পেরেছে কি? তবে তারপরও সেলিম মোরশেদের ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’-এ ১৫৯ পাতায় মোট বারোটি গল্পে বিচিত্র প্রকৃতির নানা নর-নারী, তাদের ক্ষুধা-প্রেম-বিশ্বাস-রাজনীতি-যৌনতার এক অবিশ্বাস্য বুনোট তিনি উপস্থাপন করেন। প্রতিটি গল্পই বিশদভাবে আলোচনাযোগ্য। কিন্তু ‘মেঘচিলে’র আয়োজনের সময় শেষ হবার প্রহর ঘনিয়ে এসেছে বলে এবং আমি নিজেও মাঝখানে বেশ কিছুদিন নানা কাজে ব্যস্ত ছিলাম বলে আজ এই ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’-র প্রথম গল্প ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ নিয়েই আলোচনা করব। জানি, এতে তাঁর পুরো সুকৃতির ওপর একদমই যথাযথ বিচার করা হচ্ছে না। তবে এক জাপানি জেন বৌদ্ধ গল্পে যেমন এক বাদ্যযন্ত্র-শিক্ষক রোজই তার ছাত্রকে একটিই স্বরলিপি বাজাতে বলায় একদিন ছাত্রটি বিরক্ত হয়ে, বিদ্রোহ করে পালিয়ে যায় এবং পরে এক হোটেলে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে গেলে সবাই তাকে বলে, ‘তুমি এত নিখুঁত বাজাতে শিখলে কী করে?’ এই জেন গল্পের মূল ভাবটি হল কেবল একটি মাত্র সুর, একটি মাত্র কবিতা বা গল্পের পঠনও আমাদের সমগ্রতার বোধ দিতে পারে যদি যথাযথভাবে শ্রুত, আবৃত্ত বা পঠিত হয়।

গল্প হিসেবে ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’-র আলোচনা শুনেছিলাম মাত্র দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়। আমার বড় ভাই-বোনদের, বিশেষত ভাইদের কেউ কেউ খুবই পাঠানুরাগী ও নিয়মিত আজিজে যেতেন বলেই হয়তো। গল্পটি বেশ কয়েকবারই পড়েছি। গত কয়েকদিনে এ লেখাটি তৈরির জন্য যতবারই গল্পটিতে নতুন করে চোখ বোলাচ্ছি, প্রতিবারই নতুন করে চমকে উঠতে হচ্ছে। মনে করাই যায় যে এই গল্পটি লেখার সময় সেলিম ভাইয়ের বয়স খুব বেশি ছিল না। গোটা গল্পে একটি শব্দও যেন এদিক-ওদিক করার নয়। প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি সিকোয়েন্স এবং প্রতিটি উপমা এত নিখুঁত ভাবে সংশ্লিষ্ট যে বলার নয়। এত নিখুঁতভাবে কোনো গল্প তৈরি হতে পারে? এত লক্ষ্যভেদী, তীব্র ও ভয়ানক? কী সাঙ্ঘাতিক শক্তি এই গল্পের! কাহিনির ‘নায়িকা’ হেমাঙ্গিনী এক নুলো ভিখিরি নারী যে বাস করে বস্তির এক খুপরিতে। গল্প শুরুই হয় সকালবেলা বস্তির খুপরিতে পিচুটিভরা চোখে হেমাঙ্গিনীর জেগে ওঠায়, যখন সামনের জামগাছে সুচিক্কন টান টান রোদ দেখা দিয়েছে আর হেমাঙ্গিনী খুপড়ি ছেড়ে পা ভেঙে ভেঙে বড় রাস্তায় যায়। ‘…মুসলমানরা হেমাঙ্গিনীকে পয়সা দিয়ে আপিস গেলো। …তার চারপাশে অফুরন্ত ধুলো। টুকরো চটের ওপর গোটা দু-এক দশ-পয়সা অথবা সিকি- নিরিবিলি।’ হেমাঙ্গিনীর বাম ঠ্যাং বাঁকা এবং ‘মিহি করে আঙুলগুলো কাটা থাকায় সে ঠ্যাং-এর পাতা খড়মের কাঠ।’ এমনটা কেন হয়েছে হেমাঙ্গিনীর? আমাদের দক্ষিণ এশীয় সমাজে মায়েদের ভেতর প্রচলিত নানা বিশ্বাস যেমন, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ঝগড়া করেছে বলে সন্তান ঝগড়াটে বা সেসময় মা হাসি-খুশি ছিল বলে সন্তানটি হাসি-খুশি প্রকৃতির, সেইসব লোকজ বিশ্বাসকেই দারুণ বুদ্ধিদীপ্তভাবে ব্যবহার করেছেন লেখক। হেমাঙ্গিনীর মা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বটি দিয়ে ঢ্যাঁড়স টুকরো করে আগুনে সেদ্ধ করে খেয়েছিল। তাই হেমাঙ্গিনীর পায়ের পাঁচটি আঙ্গুল তার মায়ের পেটের ভেতর গলে গেছিল বলে মা-ই তাকে দুঃখ করে জানিয়েছিল। এহেন হেমাঙ্গিনী ‘ভদ্দরলোকদের’ কাছে বিশ্বস্ততা লাভের আশায় তুমুল প্রয়াসে ডান হাতটা বুকের কাছে লেপ্টে রাখত, সে ইচ্ছে করেই হাতটি বেশি নাড়াতে চাইত না। তবু হাতটি নাড়ানোর একদিন দরকার পড়ে। নিজের খুপরিতে একদিন হালকা হলদে রঙ সহ জলপাইরঙা এবং লেজ ক্রমশ সরু ও কুচকুচে কালো মোটা লাঠির মত দু’হাত লম্বা বিষাক্ত সাপ দেখে ভীত হেমাঙ্গিনী ডান হাত নাড়াতে গিয়ে দ্যাখে চার মাসের স্বেচ্ছা অনুশীলনে-হাতটি বাস্তবিক আর নড়ছে না।

এক ভয়ানক কালো পৌরোহিত্যের ভাষায় সেলিম মোরশেদ লিখে যান যে বড় রাস্তার ধুলো কেটে কেটে হেমাঙ্গিনীর চলাচল। শহরে অবশ্য ভিখিরির সংখ্যা কমে গেছে। কেন? সরকার ভিখিরিদের রিহ্যাবিলিটেশনের জন্য যে ব্যবস্থা নিচ্ছে, সে বিষয়ে ভয় পেয়ে হেমাঙ্গিনীর সহ ভিখিরিনী ধিঙ্গি বলে যে, ‘ওদিক যাব নানে, খাওয়া পরার নামে ওরা আমাদের মেরে ফ্যালবেনে, মেরে ফেলে ফকির কুমোবে ওরা।‘ ধিঙ্গি আরো জানায় যে, প্রায় দু/তিনশো ফকির গ্রামের দিকে চলে গেছে। হেমাঙ্গিনী এসব শুনেও কোথাও গেল না, খুপরির ভেতরেই সে নিশ্চিন্তে মরবে।

প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি সিকোয়েন্স এবং প্রতিটি উপমা এত নিখুঁত ভাবে সংশ্লিষ্ট যে বলার নয়। এত নিখুঁতভাবে কোনো গল্প তৈরি হতে পারে? এত লক্ষ্যভেদী, তীব্র ও ভয়ানক? কী সাঙ্ঘাতিক শক্তি এই গল্পের!

কোথায় হেমাঙ্গিনীর এই খুপরি? তার খুপরি এক পুরনো জংশনের পেছনে, যে জংশন নিশ্চল এবং ভাঙা। সেখানে চার ঘর বস্তিতে মেয়ে-মরদ, বাচ্চা-কাচ্চা মিলিয়ে জনা দশেক মানুষ। একমাত্র মসি এখানে সুস্থ ও সুঠাম পুরুষ, যে কালো হলেও দয়ালু এবং যার বয়স ত্রিশ। সারা দিনে ত্রিশ পয়সা আয় করা হেমাঙ্গিনী রাতে খুপরিতে ঢোকার সময় মসিকে ভাত খেতে দ্যাখে এবং মসি তাকে বলে, ‘তোর চুলোয় আগুন দিয়ে আইছি- চাল চড়াবি নাকি?’ হেমাঙ্গিনী এ-কথায় হালকা প্রসন্ন হলেও উত্তর করে না।

তারাপদ রায়ের কবিতা ‘দারিদ্র্যরেখা’-য় হতভাগা, দুঃস্থ মানুষটির কাছে এক ভদ্রলোক প্রায়ই আসে। ভদ্রলোকটি সেই দুঃস্থ মানুষটিকে কখনো বলে যে ‘গরিব’ শব্দটি অপমানকর এবং তাকে বরং ‘নিঃস্ব’ ডাকা যেতে পারে, ডাকা যেতে পারে ‘প্রলেতারিয়েত’ বলেও। এবং একটা সময় আর না-পেরে সেই ভদ্রলোক একদিন একটি ব্ল্যাকবোর্ড এনে সেখানে সাদা চক দিয়ে একটি দাগ এঁকে গরিব লোকটিকে বলে, ‘এর নাম দারিদ্র্যরেখা এবং তোমার বাস এর অনেক নিচে।‘ তারাপদ রায়ের এই ভয়ানক রাগী কবিতার মতোই সেলিম মোরশেদের ভয়ানক রাগী গল্প ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’তে দিনে ত্রিশ পয়সা আয় করা হেমাঙ্গিনী সকালে পয়সাগুলো দিয়ে একটা রুটির আদ্ধেকটা খেয়েছে একটা ইটের হোটেল থেকে। পলকে সেই আদ্ধেকটা রুটি পেটের ভেতর মিশে যাওয়ায় হেমাঙ্গিনী রেগে আছে তখন থেকে। খুপড়ির ভেতর চুলোর পাশে কলস,  তোবড়ানো মগ, হেমাঙ্গিনীর ফুটো থালা, থালার কোণে কিছু লবণ, জং-ধরা বটি অথবা ‘খুপরির ভেতর মাটির চুলোয় আগুনের নীলচে আঁচ রবীন্দ্রনাথকে পুড়িয়ে দিয়ে মরা হাড়ের অস্তিত্ব সারা খুপরিতে ছড়িয়ে দিয়েছে।’ খুপরির এই বিবরণ সেলিম দেন খুব নিরাভরণ টোনে যার সাথে আর তুলনা চলে ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের সময়কার চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীনের সাদা-কালো রেখাচিত্রের। এক মগ পানি খেয়ে শুয়ে পড়া হেমাঙ্গিনী চোখ উপরদিকে তুললে গোলপা তা গলিয়ে আকাশ দেখা যায়। সত্যি বলতে এই গল্পটি পুরোটাই উদ্ধৃতিযোগ্য।

নিপুণ আয়াসে এর পর বাংলা গল্পে কালো যজ্ঞের হোতা সেলিম মোরশেদ আমাদের আরো জানিয়ে দেন যে ‘অনেক দিন পর হেমাঙ্গিনী জেনেছিলো তার মা সে-সময় গোপনে শরীর বেচতো, বেচতে বেচতে মা যখন লোম-ওঠা বয়সী কুকুর হলো, মাদী কুকুরের মতো মায়ের উরুসন্ধিতে টকটকে লাল জরায়ু বেড়িয়ে পড়ে যোনিমুখে ঝুলে যেত তামাম দুনিয়ার মতো;— তখন ক্ষুধা, কী ক্ষুধা!’ হেমাঙ্গিনীর মা দু’গ্রাম পেরিয়ে এক জলার ধারে যেত যেখানে গেলে জলার জম কমে যেত আর সারা দিন সেখানে কাটিয়ে মা ফিরত সন্ধ্যায় তেলো টাকি চ্যাং জ্যান্ত দু’একটা ধরে ও আঁচলে কলমি শাক নিয়ে। ফ্ল্যাশব্যাকে হেমাঙ্গিনীর এইসব শৈশব স্মৃতিচারণার বয়ানের ভেতরেই বস্তিতে এই ভিখিরিনীর খুপরিতে আবার সাপটির ঢুকে পড়ার কথা জানান লেখক।

‘বিজ্ঞান বলে: সাপ মাঝে মাঝে খোলস ছাড়ে।
অফেন্সকে বেস্ট ডিফেন্স বলা হয়।’

হেমাঙ্গিনী মরিয়া হয়ে এক ঝটকায় গোলপাতা থেকে সাপটা টেনে আনে। তার বিষের ভয় নেই, মৃত্যুভয়ের থেকেও প্রবলতর হচ্ছে ক্ষুধার বোধ। এখানে এসে লেখক আবার ফ্ল্যাশব্যাকে যান। হেমাঙ্গিনীর শৈশবে কাকশিয়াল নদীতে জন্মদাতা গগন ডিঙ্গি চালায়। গগন সারা জীবনে আড়াই হাজার তালা খুলে ছয় হাজার চাবি বানিয়েছিল।

হেমাঙ্গিনীকে বৈধ শিশু হিসেবে জন্ম দেবে বলায় তার মা বহুদিন এই গগনকে শ্রদ্ধা করে গেছে। একদম ছোটবেলায় এই গগন হেমাঙ্গিনীকে তিনটে কমলালেবু কিনে দিয়েছিল। এরপরই এই ফ্ল্যাশব্যাক থেকে আবার হেমাঙ্গিনীর এখনকার লড়াইয়ে ফিরে আসেন লেখক। মুষ্টিবন্দি শঙ্খচূড় সাপটি চুলার আগুনের ভেতর ঢোকায় হেমাঙ্গিনী: ‘প্রায় আধঘন্টা পর পোড়া কাঁচকলার মত সিদ্ধ সাপ হেমাঙ্গিনী পেট পুরে খেতে খেতে ভাবলো— ভয়ঙ্কর সাহসী হলেই খেতে পাওয়া যায়।’

এরপর সেলিম মোরশেদ আরো কয়েক পঙক্তিতে লবণ ছিটিয়ে সেদ্ধ সাপ খাওয়ার গল্প শোনান। এখানেই বুঝি শেষ? না, ধমনী হিম করে দেবার মতো আরো একটু বিবরণ বাকি আছে। হেমাঙ্গিনী শুধু সাপটির দেহটাই সেদ্ধ করে খেয়েছে। তবে সাপটির মুণ্ডুটি মাটিতে পড়ে ছিল। হেমাঙ্গিনী খেয়ে-দেয়ে, নিশ্চিত নিদ্রা দেবার সময় ‘কাটা উরঙ্গের মুণ্ডুটা, হেমাঙ্গিনীর মাথা থেকে পা এক পাক ঘুরে, জাজ্বল্যমান খুপরি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো নিঃশব্দে।’

এই গল্প চিরায়ত বাংলা গল্পের সেরা ৫০টি গল্পের তালিকাতেও নিঃসন্দেহে জায়গা পাবার দাবিদার। সামনে কখনো সেলিম ভাইয়ের সামগ্রিক কাজ নিয়ে আরো বিস্তারিত ভাবে লেখার ইচ্ছে রইল।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!