:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
সাদিয়া সুলতানা

গল্পকার

সেলিম মোরশেদের গল্প পাঠপ্রসঙ্গে
শিল্পকর্ম: রাজীব দত্ত

সেলিম মোরশেদের গল্প পাঠপ্রসঙ্গে

কোনো কোনো গল্পের ভেতরের দুর্গম ভাবনাগুলো অতিক্রম করার জন্য গল্পপাঠের পরেও প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় সম্পর্কে জানার তীরতীক্ষ্ণ কৌতূহল জিইয়ে থাকে। সেই সঙ্গে নতুন কোনো পাঠের জন্য নিজেকে আরও নিবিড়ভাবে প্রস্তুত করার ইচ্ছেটাও জেগে ওঠে আরও নতুনভাবে। এইসব ইচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও দিনযাপনের প্রতিটি সেকেন্ডে মনে ও মগজে এরা উৎপাতের মতো জুড়ে থাকে। এমন গল্পের বৃত্ত থেকে স্বস্তিসহকারে মুক্তিলাভ করতে তাই পাঠককে বাড়তি পরিশ্রম করতে হয়।

কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদের গল্পসমূহ পাঠক আমাকে এমনি করে পরিশ্রম করতে বাধ্য করে। তার গল্পকে আত্মস্থ করতে রীতিমতো খাটতে হয়। আসলে এই গল্পকারের গল্প এক কাপ কফি কিংবা চা নয় যে পানের পরে এর আমেজ দ্রুত ফুরিয়ে যাবে, বরং কফির ধোঁয়ার কুহেলিকার মতো তার গল্পের উষ্ণতাকে দীর্ঘদিন সঙ্গী করে বয়ে বেড়াতে হয়।

সেলিম মোরশেদের গল্প ‘রক্তে যতো চিহ্ন’ পাঠ করতে গিয়ে পাঠক হিসেবে আমার প্রথম উপলব্ধি ছিল, এই গল্পের মূল ভাব আর প্রেক্ষাপট বুঝে উঠতে হলে গল্পপাঠের পরেও আরও কিছু বিষয় সম্পর্কে পাঠ নেওয়া খুব জরুরি। আর তাই গল্পের সমাপ্তিতে পৌঁছানোর পরেও এদেশের কিছু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, পার্টিগত আদর্শ, বিপ্লবের নীতি ও কৌশল সম্পর্কে জানার আগ্রহ উসকে দিয়েছে ‘রক্তে যতো চিহ্ন’।

‘রক্তে যতো চিহ্ন’ গল্পের শুরুতে যখন বিশু অমানবিক অভিব্যক্তিতে জানোয়ারের মতো হাঁপাচ্ছে তখনই আমি গল্পে আটকে গিয়েছি কি না জানি না, তবে গল্পটি পড়তে শুরু করেই বিশুর সামনে পেছনে থাকা আসামিদের নিঃশব্দে অনুসরণ করেছি। গল্পের বিশু চরিত্রটি পার্টির একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী এবং বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি। বিচারের জন্য আদালতের সম্মুখে উপস্থিত করা বিশুকে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন করা হয়েছে। কোর্ট-হাজতে থাকা বিশুর সিগারেট খাওয়ার সাধ উবে যায় তৃতীয়বারের মতো রিমান্ডে যাবার আতঙ্কের কথা মনে করে।

পড়তে পড়তে বুঝেছি, ‘রক্তে যতো চিহ্ন’ গল্পটি গল্পের খাতিরে বলা গল্প নয়। আসলে রিমান্ডে থাকাকালীন উদগ্র যন্ত্রণায় কোণঠাসা বিশু মুখ খুলবে কি খুলবে না সেই প্রশ্নের উত্তরের চেয়ে ভিন্নতর সব প্রশ্নের মুখোমুখি একজন পাঠককে যখন গল্পকার দাঁড় করিয়ে দেন তখন গল্পটি বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে।

প্রতিবিপ্লবী, সংশোধনবাদী কিংবা সাম্রাজ্যবাদীর দালাল হতে চায়নি বলে পার্টির নির্দেশে অনেককিছুই করেছে বিশু। বুর্জোয়া শিক্ষার মুখে লাথি মেরে নিজের জীবনের গতিপথ পাল্টে পার্টির কাজ করেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পার্টির আদর্শ কী? বিশুর মতো কিছু মানুষকে আদর্শের শেকলে বেঁধে কেবল পার্টির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা? নাকি প্রকৃত অর্থেই শ্রেণিশত্রু খতম করা?

গল্পের ভেতরের একটা বিশাল অংশজুড়ে পার্টির আদর্শ ও সেসব নিয়ে বিশুদের মতো কর্মীদের ভাবনা বিস্তৃত আছে। গল্পকার জানাচ্ছেন, ‘শ্রেণিশত্রু খতমের লাইনটা শেষমেশ গ্রাম আর মফস্বলেই চলছে। কই, নগরে তো বহু শ্রেণিশত্রু? এখানে তো কোনও অ্যাকশন নেই। পার্টির ভূমিকা কোথায়? তার ভাবনার মূলে কখনও-বা এমন কিছু বাস্তবতা কাজ করে তা দিয়ে পার্টিকে নতুনভাবে গড়াও সম্ভব না। নেতৃত্ব দিচ্ছে অধিকাংশই সামন্তশ্রেণি থেকে আসা, ফলে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের নামে নিজস্ব ইমেজ তৈরি আর ক্যাডার বাহিনী বানানোটাই লক্ষ্য। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় বিপ্লবের নীতি এবং কৌশল কেমন হবে যতোক্ষণ না তুলে ধরা হচ্ছে ততোদিন সমাজের কাছে এই বিপ্লব সন্ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত। প্রজন্মরাও অবশেষে পুরোবুর্জোয়া দলগুলোতে যুক্ত হবার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠবে, কিন্তু এ-ভাবনার ফুরসত তাদের নেই। বিষয়টা এমনভাবে দাঁড়িয়ে গেছে যে, পার্টির অস্তিত্বের প্রশ্নেই অস্ত্রবাজি; অন্যথায় মরে যেতে হবে।’

যদিও বিশু জানে, ‘পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভ্যরা চরমবাদী। সিদ্ধান্ত বলতে একটাই: বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক— তা যে-কোনও জায়গা থেকে শুরু হতে পারে। কোনও ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনেই প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে না।’

বিশুর মতো যারা প্রকৃত বিপ্লবের জন্য কেবল নিজের নিয়তি বানিয়েছে তাদের চূড়ান্ত পরিণতি হয়তো বিশুর মতোই হয়। তবু ভুল থেকে নতুন কোনো ভুলে যাবার মতো আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হতে পারে না বিশু, নিজের মনে ভিড় করা প্রশ্নের উত্তর পেতেই হয়তো সে পার্টির নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চায়, তাদের মুখোমুখি হতে হাসপাতালে বন্দি অবস্থায় থেকেও অস্থির হয়ে ওঠে।

‘রক্তে যতো চিহ্ন’ গল্পটির আখ্যান খুব জটিল আবহ তৈরি না করলেও গল্পের ভেতরের ভাবনাগুলো যতো চিহ্ন রেখে গেছে পাঠ পরিক্রমায়, দিব্যি বুঝতে পারছি সেসব থেকে আমার সহজে পরিত্রাণ পাবার উপায় নেই।

আখ্যানের চমক দিয়ে পাঠককে মুগ্ধ করা অথবা উপমার বহুমাত্রিকতায় নিছক গল্প বলে যাওয়া হয়তো কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদের উদ্দেশ্য নয়; তার উদ্দেশ্য হয়তো প্রথাগত গল্পশৈলীর দুর্গকে ভেঙেচুরে দেওয়া, জীবন নিঙড়ে বের করে আনা মানুষের অন্তর্গত উপলব্ধির স্বর।

‘সখিচান’ গল্পের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সখিচানের কারবার ছিল মৃত্যুকে নিয়েই অথচ সে মৃত্যুকে চেনে না। সখিচানের কর্মজীবনের শেষ দিনে বাড়িতে আসর বসেছে। এই দিনে তার তামাটে রঙের শরীরের ভেতরে উড়ুউড়ু মন ঘরের বাইরে দেখা দেওয়া পাখির ‘নির্জীব অস্তিত্বকে জাগিয়ে তুলে একাত্ম হতে চাচ্ছিল।’ আসরে মদ্যপান চলছিল, চলছিল সখিচানের স্মৃতিযাপন। বারবার আনমনা হচ্ছিল সে।

মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিশ্লেষণের সহায়ক ডোম সখিচান এত বছর ধরে মানবদেহ ঘেঁটে, কেটে, ছিঁড়ে দেহের অবাঞ্ছিত আঘাত সনাক্ত করেও মৃত্যুকে উপলব্ধি করতে পারেনি। বাবা ভাচু ডোমের সঙ্গে লাশকাটা ঘরে ছুরি, ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে লাশকে ব্যবচ্ছেদ করার কাজ শিখে ডোম হিসেবে কর্মজীবন অতিবাহিত করলেও সে সরকারের খাতায় উদ্ধৃত ঝাড়ুদার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছে।

অপঘাতে মৃত্যুর বহুমাত্রিক রূপ দেখে অভ্যস্ত সখিচান অবসরযাপন করতে এসে মৃত্যুকে খোঁজে বারবার। মৃত্যুর নিশ্চিত পাঠ লাভের উদগ্র বাসনা সখিচানের বাঁশির সুরকে করে তোলে শুদ্ধ আর গভীর।

‘সখিচান’ গল্পে গল্পকার জীবনের আখ্যান হুবহু চিত্রিত করার একঘেঁয়েমিতে না গিয়ে মৃত্যু জিজ্ঞাসাকে মুখ্য করে কৌশলে জীবনের গল্পই নির্মাণ করেছেন।

কলেজের লেকচারার লাবণ্য বাড়ি ফেরার পর বিকেলের কাটলেট, কফির অবসরটুকু ফুরিয়ে এলে ‘রাতের সুতোয় ঝুলে থাকে মহা অন্ধকার।’ ‘লাবণ্য যেভাবে এগিয়ে’ গল্পে মা আর লাবণ্যের শৈশবের ভেতরের পার্থক্যটুকু জানা থাকলেও লাবণ্যের অন্তর্গত আঁচড়সমূহ পাঠককে অনুভব করতে হয় অনেকটা সময় নিয়ে। টবের রঙ্গনের ওপরে ঘুরপাক খাওয়া সবুজ ফড়িং যখন উড়ে চলে যায় তখন ‘সবুজ শ্যাওলার বিস্তৃতিতে যে হ্রদ অপূর্ণ, লাবণ্য সে হ্রদের কাছে বসে পাথরখণ্ডের ওপরে’—ঠিক এই জায়গাতে এসেই গল্পটি যেন সত্যিকার অর্থেই শুরু হয় আর লাবণ্যের নির্জনতার জগত ভাঙতে পাঠককে হতে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’র অভিমুখী।

অমিতের কথার উত্তরে সিসি বলেছিল, ব্যাঙটা এখন টুপ করে জলের ভেতরে লাফ দিলো, অনন্তকালের ভেতর এ-মুহূর্তটাও ফিরবে না। এ যেমন সত্য তেমনি লাবণ্যের এই ভাবনাও সত্য, ‘সত্য হলো তাই যার একাধিক অবয়ব নিজ-নিজ পরিধির ভেতর; পরিধি পাল্টালে আরেকটা সত্য; সেটা সরে গেলে আরেকটা সত্য। সত্যগুলো হাতের পাঁচটা আঙুলের মতো যার-যার বলয়ে অস্তিত্ব, আর কব্জিটা উপলব্ধির ক্ষেত্র, এক সংজ্ঞাহীনতার বোধে ভাসে।’ এই যে গল্পের ভেতরে ভাবনার কুহক-এ যেন পাঠককে ভিন্নতর এক সংকটের আবর্তে ফেলে দেয়।

ছকবাঁধা কোনো আখ্যান নয় ‘লাবণ্য যেভাবে এগিয়ে’। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র লাবণ্যের একাকিত্বের বিভ্রমে এই গল্পে ধ্বনিত হয়েছে ভালোবাসার অনুচ্চ স্বর। যেখানে বাস্তবতার কাছে ফিরে আসার আগে লাবণ্যের সমর্পিত মন ‘রক্ষাহীন লুব্ধতায় ভিজে একাকার হয়ে গেলে প্রত্যঙ্গের ভেতর থেকে খোলসগুলো বেরিয়ে আসে।’

কথাসাহিত্যিক নাসরীন জাহানকে উৎসর্গ করা এই গল্পে অমিত আর লাবণ্যের সম্পর্কের নিটোল পরিণতির সন্ধান করা একপ্রকার দুরূহ কাজ হবে। এদিকে গল্পের গোলকধাঁধা পেরিয়ে সমাপ্তিতে এসেও গল্পকার অমিতের হাতের কাঁটাচামচের চার দাঁতের ভেতরে জীবনের ‘সাধারণ সত্য, প্রগতি, সংযম, সৃষ্টিশীলতা’র সন্ধান দিয়ে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন অদ্ভুত এক বিভ্রমের মধ্যে। আর তাই গল্পটি শেষ হয়েও শেষ হয় না।

আখ্যানের চমক দিয়ে পাঠককে মুগ্ধ করা অথবা উপমার বহুমাত্রিকতায় নিছক গল্প বলে যাওয়া হয়তো কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদের উদ্দেশ্য নয়; তার উদ্দেশ্য হয়তো প্রথাগত গল্পশৈলীর দুর্গকে ভেঙেচুরে দেওয়া, জীবন নিঙড়ে বের করে আনা মানুষের অন্তর্গত উপলব্ধির স্বর। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার গল্পের আখ্যান নির্মিত হয় বিক্ষিপ্ত ভাবনার কোলাজে যেখানে অনুরণিত হয় মানুষের জীবন-আদর্শের সংকট আর দ্বন্দ্ব সংঘাত। তবে শব্দশৈলীর প্রশ্নে লেখক যে উদাসীন তা কিন্তু না, এজনই সেলিম মোরশেদের সুলিখিত গল্পগুলো পাঠ করলে ইচ্ছে হয় একটি শব্দও অপচয় না করি, একটি বাক্যও হেলায় না হারাই।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!