:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
কুলসুম হেনা

প্রাবন্ধিক

সেলিম মোরশেদের ‘রাতে অপরাজিতা গাছে ফুল’: সময়, সম্পর্ক ও মূল্যবোধের পাঠ
শিল্পকর্ম: রাজীব দত্ত

সেলিম মোরশেদের ‘রাতে অপরাজিতা গাছে ফুল’: সময়, সম্পর্ক ও মূল্যবোধের পাঠ

সেলিম মোরশেদ (জন্ম. ১৯৬২) বাংলা সাহিত্যের লেখক যিনি গত শতকের আটের দশক থেকে কথাসাহিত্য ও কবিতায় তাঁর চর্চার জগত বিস্তৃত করে চলেছেন। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের বিকাশপথ নির্মাণে সেলিম মোরশেদের অবস্থান স্বতন্ত্র। বাংলাদেশের সাহিত্যের স্বাতন্ত্র্য তৈরিতে তিনি সাহিত্যকর্মীর ভূমিকায় সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। আটের দশক থেকে তীব্রভাবে গড়ে ওঠা লিটল ম্যাগাজিন-ভিত্তিক সাহিত্য আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রণী। সেলিম মোরশেদের লেখালেখির যাত্রাও শুরু হয় সেই তাৎপর্যপূর্ণ কালপ্রবাহের ভেতর দিয়ে। ‘গাণ্ডীব’ থেকেই বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সঙ্গে তিনি জুড়ে রয়েছেন একাত্মভাবে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা বিষয়ে তাঁর রয়েছে নিজস্ব দার্শনিক অবস্থান এবং যৌক্তিক স্বচ্ছতা। তিনি লেখালেখির মাধ্যমে সেই আদর্শকে ধরে রেখেছেন এখনো। সময়ের পরিবর্তনশীলতার সাথে সমাজের অনেক কিছুর বদল তিনি মেনে নিয়েছেন প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে কিন্তু আদর্শ থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। সেলিম মোরশেদ তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা প্রসঙ্গে বলেন :

‘চলমান প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ মিথ্যা, বিভ্রান্ত ও আপাত নিরাপদ। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কোনো খণ্ডিত বিষয় না বরং তা হচ্ছে প্রচলিত মূল্যবোধ, ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়ায় অবস্থিত সর্বপ্রকার নান্দনিক ধারণার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন ও আক্রমণ। মধ্যবিত্ত শ্রেণিচৈতন্যকে প্রমোট করা যাবতীয় নান্দনিক বিষয়কে ভাঙাই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা।’

বর্তমান সময় পর্যন্ত বংলাদেশের সাহিত্যে তাঁর ভূমিকা কেবল একজন লেখকের নয় বরং তার চেয়েও অধিক একজন নিবেদিত সাহিত্যকর্মীর গুরু দায়িত্ব তিনি পালন করে চলেছেন। তবে সকল কর্মমুখরতার মাঝে তাঁর সাহিত্যকর্মই চিনিয়ে দেয় তাঁর অন্তর্দর্শনের সাথে। ইতিহাসের পাঠ সাক্ষ্য দেয়, যুগে যুগে বহু বর্বরতা, নির্যাতন, অবরুদ্ধতার শেকল কখনো মানুষের জীবনপ্রবাহ স্তব্ধ করে দিতে পারেনি, আবার সাহিত্যও তার পিছু ছাড়েনি। তাই সঙ্কটের মুহূর্তে প্রাগ্রসর সাহিত্যিকদের কলমে রচিত হয়েছে প্রতিবাদনামা, সাহিত্যেও ঘটেছে ইতিবাচক রূপান্তর। এমন চেতনার জাগরণ আটের দশকের বাংলাদেশের সাহিত্যে লক্ষ করা যায়। লেখক সেলিম মোরশেদও সেই চেতনার জাগরূক সাহিত্যকর্ম রচনা করেন। কথাসাহিত্যের অন্যতম শাখা ছোটগল্পের ধারাতে তিনি নিজেকে প্রতিনিয়ত শাণিত করেছেন। তাঁর অন্যতম তাঁর গল্পগ্রন্থ রাতে অপরাজিতা গাছে ফুল (২০০৫)। এই গ্রন্থে গল্প রয়েছে মোট চারটি; যথাক্রমে ‘রাতে অপরাজিতা গাছে ফুল’, ‘প্রিসিলার ছাতা’, ‘দ্যা পার্ভার্টেড ম্যান’ এবং ‘মহান সূর্য আর অভিমানী মেয়েটি এবং তুচ্ছ বালির গল্প’। এই চারটি গল্পই আলাদা সুরে বাঁধা। সেই সুরগুলি চিনে নিয়ে সেলিম মোরশেদের গল্পের চেতনপ্রসঙ্গ, বিন্যাসের সাথে পরিচিত হওয়াই এই প্রবন্ধের প্রধান অন্বেষা। কেবল গল্পগুলির নিবিড় পাঠকে সারথী করে এই আলোচনাকে অগ্রসর করার প্রয়াস রয়েছে এখানে। এই গ্রন্থের নাম গল্প ‘রাতে অপরাজিতা গাছে ফুল’ শীর্ষক গল্পটি শহীদুল আলম পিন্টু নামের এক তরুণকে ঘিরে যার জীবন নানানরকম হতাশায় পূর্ণ এবং সেই সকল সঙ্কটের পরিত্রাণ রয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তির কাছে। এই গল্পের শুরু হয়েছে পিন্টুর একটি ক্ষণিক সময়ের অতিবাহিত করা চেতনাপ্রবাহের বর্ণনার ভেতর দিয়ে। নিজের জীবন নিয়ে ভাবতে ভাবতে সে যেন কোনো এক রহস্যে ঘেরা অতীতে ঢুকে পড়ে। একটা মিথ নির্মাণের ভেতর দিয়ে ইতিহাসের বাস্তবতায় পিন্টুকে হাজির করেন লেখক। ১৯৬৯ সালের উত্তাল সময়ে দেশকৃষ্টি গ্রন্থ বাতিল করার আন্দোলনের স্মৃতি ঢুকে পড়ে পিন্টুর মস্তিষ্কে। কোনো এক সন্ধ্যায় উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা পিন্টু তাঁর সেই ছাত্রজীবনের স্মৃতি অবচেতনে স্মরণ করে। যখন সে নিজেও হয়তো সংগ্রাম করেছিল পাকিস্তানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। কিন্তু পিন্টুর ভেতর এই চেতনার প্রবাহের গতি স্তব্ধ হয়ে সে ফিরে আসে তার বাস্তব জীবনে। যেখানে সংসারের নানামুখী যন্ত্রণায় জর্জরিত তার জীবন। একদিকে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বিধ্বস্ত নতুন দেশে স্বপ্ন ও বাস্তবের অসম সহাবস্থান, অন্যদিকে হত্যা ও নৈরাজ্যকে পুঁজি করে সামরিক শাসনের উত্থান— এ দুইয়ের মধ্যবর্তীতায় বিপন্ন হয়ে পড়ে সর্বশ্রেণির জনজীবন। নিরাপত্তা ও প্রতিবাদের তাগিদে নির্ভাষার নৈঃশব্দকে বেছে নেন বহু শিল্পী, সাহিত্যিক। অনেক সাহিত্যিক তখন গল্পে সরাসরি মানুষের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং জীবনসংশ্লিষ্ট বক্তব্যকে উপস্থাপন করতে না পেরে আশ্রয় নেন পরাবাস্তবতার, আবার কখনো জাদুবাস্তবতার। যার ফলে লেখকের নৈর্ব্যক্তিক প্রতিবাদ নির্মাণ বাসনার সমীকরণ প্রতীকী হয়ে ওঠে। উপরন্তু, বিশ্বব্যাপী উজিয়ে ওঠা প্রসারিত নতুন উৎপাদনব্যবস্থা, বিজ্ঞাপনপ্রধান অর্থনৈতিক বিন্যাস, উদার অর্থনৈতিক বিস্তার এবং সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের ইঙ্গিতে বিজড়িত হতশ্বাস মিলেমিশে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে জন্ম দেয় এক প্রতিকারহীন পরিস্থিতির। ‘রাতে অপরাজিতা গাছে ফুল’ গল্পটিতে সময়ের সকল ইঙ্গিতকেই লেখক উপস্থাপন করেন। এই গল্পের প্রত্যেকটি চরিত্রের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চারিত্রিক বিন্যাস লক্ষ করা যায়। এদের সকলের সাথে সঙ্কটগুলোও একেকটি চরিত্রের মতো জীবন্ত হয়ে ওঠে তাই প্রতিটি বিষয় আলোচনার দাবি রাখে। পিন্টুকে নিয়ে তার মায়ের উদ্বিগ্নতা এবং পিন্টুর স্ত্রীর নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা একই রকম নয়। পিন্টুর প্রতি তার জীবনের দুই গুরুত্বপূর্ণ নারীর প্রত্যাশা ও ভালোবাসার ধরনগুলোও স্বভাবতই আলাদা। পেশাগতভাবে পরিচয় তৈরি না হওয়ায় সমাজের কাছে সে ব্যর্থ হয়ে ওঠে। আবার পিন্টুর ছোটবোন নওশোভা ও রাফিন দম্পতি যারা স্বাধীনচেতা, নাস্তিক এবং নিজেদের নির্বাচিত জীবন যাপন করেও তারা কতখানি সুখী বা অসুখী সেই প্রশ্নটা পিন্টুর মনে থেকে যায়। নাস্তিকতা মানে কোনো ভয় না থাকা, এবং কারো প্রতি কোনো আত্মসমর্পণ নয় তাই তখন নিজের বিবেকের দায়িত্ব বেড়ে যায় অনেকগুণ। কোনো লোভে বা ভয়ে নয় বরং নিজের উদ্যোগে তাকে সৎ থাকতে হয়। রাফিন তার পেশাজীবনে অসৎ আয়কে স্বাগত জানিয়েছে, তাহলে মূল্যবোধটুকু কোথায় গিয়ে তলিয়ে যায়। তারা তাদের সন্তানকে নিজেদের আদর্শেও পুষ্ট করতে পারেনি আবার প্রথাগত সামাজিক অনুশাসনও তারা মানতে পারেনি। কোনো ব্যক্তি যত আধুনিক চেতনার ধারকই হোক সেটা তখনি গ্রহণযোগ্যতা পায় যখন সে স্বনির্ভর হয়। অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা সামাজিকভাবে তাকে তুচ্ছ করে ফেলে। আত্মমর্যাদার অভাবে সেই স্বাধীনচেতনার ব্যক্তিটি হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত হয়। বোন নওশোভাকে পর্যবেক্ষণ করে নারীর মন সম্পর্কে তার যে ধারণা জন্মে তা হলো:

সামনে আশ্চর্য কোনো আদর্শ নেই। কোনো মূল্যবোধ নেই। অথচ কোটি কোটি মানুষের উপস্থিতি আছে। ইচ্ছেমতো পুরনো, নতুন, অচল, অবিচল, উগ্র, মিনমিনে, সমসাময়িক এই সমস্ত বিষয় বস্তায় ভরা জ্ঞান থেকে খাবলে-খুবলে যে যেভাবে পারছে তাই নিয়ে একটা ধারণা তৈরি করে বেঁচে থাকতে চাইছে। কিন্তু কই সমাজের অগ্রগতি? কোথায় উপযুক্ত বীক্ষণ? দর্শন আর আদর্শের অপরিহার্যতা কতোটুকু?

এটা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমানভাবে কার্যকর। পিন্টুর বোন নওশোভাও এই জীবনবাস্তবতার মুখোমুখি হয়। নানারকম দর্শনের সাথে পরিচয় তার থাকলেও সে স্বামীর রোজগারের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার সুযোগ নেওয়াও অবশ্যই তার অন্যতম গ্লানির কারণ। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে চায়নি। ফলে সন্তানের দুর্ব্যবহারে সে ভেঙে যায়, স্বামীর ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া তাকে সয়ে নিতে হয়। হীনম্মন্যতা থেকে জন্ম নেয় তার এই সমস্ত হতাশা। এই অনেকগুলো হতাশা পিন্টুর মতো শিক্ষিত যুবককেও নানারকম সংস্কারে বিশ্বাসী করে তোলে। এই গল্পের নির্মাণে লেখক কিছু মিথিক্যাল অনুষঙ্গের ব্যবহার করেছেন। পৃথিবীর নানান সাহিত্যে এই ফর্মের সন্ধান পাওয়া যায় তবে সেলিম মোরশেদের অভিনবত্ব হলো অনুষঙ্গগুলোর ব্যবহারের নৈপুণ্যে। মানুষ প্রকৃতই তাঁর বেড়ে ওঠার প্রতিবেশ প্রক্রিয়ায় এবং সামাজিক চেতনার সঙ্গে ‘মিথিক্যাল কনশাসনেস্’ রপ্ত করে নেয়। ফরাসি লেখক রঁলা বার্ত (১৯১৫-১৯৮০) তাই তাঁর মিথলজিস গ্রন্থে মিথকে চিহ্নিত করে বলেন: Myth as depoliticized speech. এবং মিথের সঙ্গে মানববিকাশ এবং মিথ প্রয়োগের সম্পর্ক বিষয়ে অনুধ্যান করেন এভাবে:

‘Men do not have with myth a relationship based on truth but on use; the depoliticize according to their needs. Some mythical objects are left dormant for a time; they are than no more than vague mythical schemata whose political… Roland Barthes. Mythologies. New York :The Noonday press.’

রঁলা বার্তের উপরিউক্ত অনুধ্যানে ঘুরে-ফিরে আসে সেই ব্যক্তির প্রয়োজনের প্রসঙ্গে অতীতচারণের ভিত্তির বিষয়টি। গল্পে পিন্টুর মনোজগতে ‘৬৯-এর অভ্যুত্থান ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, দূর থেকে ভেসে আসা যাত্রায় তার নিজস্ব কথারূপ নিয়ে হাজির হয়। সময়ের অনির্দিষ্টতায় এটি মিথের মতো করেই লেখক বর্ণনা করেন এভাবে: ‘আগুন আর মৃত্তিকার দ্বৈরথ ভাবায়: যে আগুনে মাটি পোড়ে সেই মাটি সে আগুন ধারণও করে। একটা মাটির ছিলিম নিয়ে কথাটা মনে পড়েছিলো। এখন সে মিলিয়ে নেয় আরও দূর আরও কিছুর সাথে। তখনও যুদ্ধ আসেনি।’ নিজের অবচেতনমনে লুকিয়ে থাকা এ বিষয়টি বুঝতে না পেরে পিন্টু বিষণ্নবোধ করে, আবার তার সচেতন মন অর্থনৈতিক ব্যর্থতার অপরাধবোধে ভোগে। এই গল্পের শিরোণামেই মূল আবেদনটি প্রতিকায়িত হয়েছে। এই গল্পে পিন্টুর মায়ের সামনে ভাগ্যবিড়ম্বনা উত্তরণের পথ হিসেবে হাজির করা হয় দুটি বিকল্প বস্তু। একটি হলো ইন্দ্রনীলা পাথর এবং অন্যটি অপরাজিতা গাছ। জ্যোতিষ শাস্ত্রমতে বিশ্বাস করা হয়, সব রত্ন-পাথরের ভেতর ইন্দ্রনীলা (Blue Sapphire) সবচেয়ে দুষ্প্রাপ্য এবং এর দামও অতি চড়া। ইন্দ্রনীলার প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে শক্তিশালী এবং এই পাথর সরাসরি সম্পদ বৃদ্ধির সাথে জড়িত। এই পাথর ব্যবহারের ফলে অর্থনৈতিক দিকে এগিয়ে যাওয়া যায় এবং বহুবিধ আয়ের পথ তৈরি হয়। ফলে অর্থ, যশ, খ্যাতি সবই লাভ হয়। অপরাজিতা গাছের পৌরাণিক বিশ্বাস রয়েছে। রাবণকে বধ করার সময়ে রাম যখন দেবী দুর্গার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন তখন পূজার স্থানে অপরাজিতা ফুল রেখেই রামচন্দ্র দেবী হিসেবে এই ফুলের আরাধনা করেন। হিন্দু পুরাণে স্বয়ং দুর্গার অপর নাম অপরাজিতা দেবী। এই ফুল হাতে নিয়ে ‘ওঁ অপরাজিযৈ নমঃ’ মন্ত্র তিনবার উচ্চারণ করে যেকোনো প্রকার কাজ শুরু করলে তা সফল হয়। পঞ্জিকা থেকে দেখে নিয়ে কোনো এক পুষ্যা নক্ষত্রের সময়ে অপরাজিতা গাছের মূল তুলে এনে শিবের ধ্যানমন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে ধুপ ধুনো সহকারে পূজা করতে হয়। তারপর সেই মূল কোনো একটি রুপোর বাক্সে বা মাদুলিতে ভরে টাকা রাখার জায়গায় রেখে দিতে হয়। এর ফলে জীবনে কোনো আর্থিক কষ্ট থাকে না এবং পারিবারিক সুখ বজায় রেখে শান্তিতে জীবন ভরে থাকবে। পিন্টুর মায়ের চাওয়াও তো শুধু এই সমৃদ্ধিটুকুই। তাই তারা অপরাজিতাকে বিশ্বাস করে নেয়। পিন্টুর জন্য তার মাকে ইন্দ্রনীল পাথর ও অপরাজিতা গাছের মধ্যে ফুলগাছকেই বেছে নিতে হয়। এই গাছের ফুল ফোটার জন্য পিন্টুর অপেক্ষা নিরন্তর। মায়ের মতো সেও বিশ্বাস করে নেয় অপরাজিতার নীল ফুলের সাথে সাথে তার জীবনও বিকশিত হবে। ঘুষের টাকা ছাড়া তার চাকরি হয়ে যাবে, মিনার সাথে সুখের সংসার হবে, সন্তান হবে, মায়ের চিকিৎসা হবে। সবই যেন ফুল ফোটার অপেক্ষায় না হয়ে দূরে সরে আছে। কেনো এক রাতে ফুল ফোটার সঙ্গে সকল না পাওয়াগুলো প্রাপ্তি হয়ে কাছে চলে আসবে। এমনি অজানা প্রত্যাশায় মনকে শান্ত রাখা আর নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া কি-ই বা করতে পারে পিন্টু। এরকম অনেকগুলো সমাধানহীন সংগ্রামকে পিন্টু ভুলে থাকে গাঁজার ধোঁয়াতে যা কেনার অর্থও চাইতে হয় বৌয়ের কাছ থেকে। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুবকের টানাপড়েন এমন যে নিজের পাড়ায় সিগারেট খাাওয়ার উপায় নেই। তাকে যেতে হয় নদীর ঘাটে। সেই একটু সময় পিন্টুর নিজের একান্ত যখন সে এই সমস্ত পঙ্কিল বাস্তবতা থেকে দূরে সরে থাকতে পারে। তবে তার এই একাকী মুহূর্তের চিন্তাপ্রবাহের ভেতরেই লেখক এই সঙ্কটের শেকড়গুলা প্রোথিত রেখেছেন।

চারটি গল্পই আলাদা সুরে বাঁধা। সেই সুরগুলি চিনে নিয়ে সেলিম মোরশেদের গল্পের চেতনপ্রসঙ্গ, বিন্যাসের সাথে পরিচিত হওয়াই এই প্রবন্ধের প্রধান অন্বেষা। কেবল গল্পগুলির নিবিড় পাঠকে সারথী করে এই আলোচনাকে অগ্রসর করার প্রয়াস রয়েছে এখানে।

আধুনিক সম্পর্কের মূল্যবোধের পাঠ: এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ও তৃতীয় গল্প ‘প্রিসিলার ছাতা’ ও ‘দ্যা পার্ভার্টেড ম্যান’ যা আধুনিক সম্পর্কের মূল্যবোধের পাঠ নির্মাণ করে। দুটি গল্পের উপস্থাপনরীতি আলাদা হলেও এদের মূল আবেদন একই সূত্রে গাঁথা। সম্পর্ক, যৌনতা, জীবন ও কর্মের বিষয়ে বর্তমান সময়ের নারী-পুরুষের ভাবনা এবং কর্মগুলোকে নির্মোহভাবে তুলে ধরেন লেখক। এই দুটি গল্পেরই চরিত্র অনেক এবং এদের প্রত্যেকের মধ্য দিয়ে লেখক ভাবনা ও দর্শনের সাথে পরিচয় করান লেখক। এই দুই গল্পে কোনো টাইপ চরিত্র নেই এবং কোথাও আরোপিতভাবে কোনো চরিত্রকে দোষ, গুণে ঢেকে দেওয়া হয়নি। ‘প্রিসিলার ছাতা’ গল্পটিতে দেখা যায় অনেকগুলো বন্ধুদের একটি আড্ডা এবং আড্ডা বরাবরই যেমন শৃঙ্খলহীন গতিতে চলে সেভাবেই এগিয়ে যায় গল্পের বয়ান। আপাতভাবে অসংলগ্ন কথাবার্তার ভেতর দিয়ে লেখক বুঝিয়ে দেন সম্পর্ক নিয়ে বর্তমান যুগের নারী-পুরুষের ভাবনা। তবে এই আড্ডার স্থানটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ফুটপাথের উপর অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এই চায়ের টঙ। মিলন জানে তার দোকনটি অবৈধ স্থাপনা তারপরেও সে যখন রাস্তায় এক চোরকে গণপিটুনি খেতে দেখে তখন সেও চা তৈরি রেখে চোরের নাক বরাবর একটা ঘুষি মেরে আসে। গল্পের ভেতর এই অনুষঙ্গটির ইঙ্গিতপূর্ণ ও শক্তিশালী উপস্থিতি এনে লেখক গুণী শিল্পীর কুশলতা দেখিয়েছেন। সমাজের মানুষ নিজের শঠতার পরিচয় জানা এবং সুযোগসন্ধানী মনোভাব থাকার পরেও অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থানে থাকা অপর মানুষটির সমালোচনা করতে, অপ্রয়োজনে আঘাত করতে কোনো কুণ্ঠিত বোধ করে না। অতি উদ্দামে নিজের হীনতাকে লুকিয়ে অন্যের উপর কর্তৃত্ব করার প্রবণতা সব শ্রেণির মানুষের মধ্যেই রয়েছে। এরপর আসে সম্পর্কের প্রতি নৈতিক বিশ্বাসের ব্যাপারে প্রত্যেকটি চরিত্রের আলাদা মতামতের বিষয়টি। এই আড্ডার কেন্দ্রে রয়েছে প্রিসিলা নামের মেয়েটি এবং তার অবনত ছাতা। বিবাহ পরবর্তী সময়ে স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল না থাকাকে হাসান, আমীর, দীপ বা মাহিনেরা কোনো বিশেষ আলোড়নের ঘটনা হিসেবে দেখছে না। প্রত্যেকে নিজের পছন্দের যৌনজীবন যাপন করা এবং বহুগামিতাকে সিদ্ধ মনে করাটাতে প্রিসিলার ভয় হয়, প্রশ্ন জাগে। বন্ধুদের লয়ে প্রিসিলার তাল মিলতে চায় না। তার বন্ধুদের ভাষায় বিনি ও আমিরের পরকীয়া সম্পর্ককে বৈধতা দিতে বলা ‘ক্রিয়েটিভ নার্সিং’ শব্দবন্ধ সে বুঝতে পারে না। তার বন্ধুদের মতে : সারা পৃথিবীর সাহিত্যে এমনকি আমাদের সংস্কৃতির ভেতর গোড়া খুঁজলে দেখা যাবে পরকীয়ার কী অপরিসীম নান্দনিক রূপ। গ্লানির কোনো অবকাশই নেই। যা আছে শুধু প্রেম-প্রীতি।’ সংস্কৃতির নান্দনিকতাকে গ্রহণ না করে ঠিক যে অংশটিকে বারবার প্রচার করার মাধ্যমে অনেকখানি সুযোগ নেওয়া যায় সেদিকেই মানুষের বেশি ঝোঁক। প্রিসিলার বন্ধু দীপ যার সঙ্গী সুদেষ্ণা একজন রূপান্তরিত নারী; সেই সুদেষ্ণা এবং তার স্যাফো পত্রিকা ঘিরে বন্ধুদের আড্ডায় যেধরনের কথা সে বলে তাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সুদেষ্ণার প্রতি তার অশ্রদ্ধার দিকটি। বন্ধুদের আড্ডার মাঝে ছেলেরা নারী সহবাসের বর্ণনা দিয়ে যে পৌরুষের অহংকার করে থাকে তাতে মিশে থাকে বিকৃত রুচির আনন্দ। প্রিসিলা সেই আনন্দের অংশীদার হতে পারে না, তাই সে দাঁড়িয়ে পড়ে তার নিম্নমুখী ছাতা নিয়ে। এক সময়ে বসবাস করে জীবনকে একইরকমভাবে যাপন করার চেষ্টা না করে সে অসুখী নয়। সেলিম মোরশেদের এই গল্পের নির্মাণ তীক্ষ্ণ ও নির্মোহ। অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতি সচেতন থেকেও লেখক ধনী-দরিদ্রের সমাজিক মূল্যবোধের মূল্যায়ন একই মাপকাঠিতে করেন। সেখানে মধ্যবিত্ত চেতনা ও সংস্কৃতির প্রতি আবেগীয় পক্ষপাত দেখা যায় না।

সেলিম মোরশেদের গল্পে সৃজন ও মননের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ সম্পর্ক ও মানুষের মূল্যবোধকে কেন্দ্র করেই মূর্ত হয়েছে। তিনি রাতে অপরাজিতা গাছে ফুল গ্রন্থের গল্পগুলোতে মানুষের সেই অন্তরঙ্গ ভাষ্যের নির্মাণপ্রয়াসী যা সময়ের নিরিখে নিঃসঙ্গ মানুষের সাহিত্য হয়ে ওঠার পক্ষপাতী। বিশেষত তাঁর সৃজননৈপুণ্য, যেখানে ব্যক্তি মানুষের অভিজ্ঞতা ও স্বতন্ত্র দর্শন, সম্পর্কের উপভোগ এবং বেদনা একইসঙ্গে নন্দনবিশ্বে প্রতিষ্ঠা পায়।

এই গল্পগ্রন্থের তৃতীয় গল্প ‘দ্যা পার্ভার্টেড ম্যান’ সমাজের দৃষ্টিতে অবক্ষয়ী যুবকদের গল্প। রাহুল ও তার মদ আসরের বন্ধুদের প্রত্যেকের যৌনজীবন, প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে আলাদারকম বিশ্বাস রয়েছে। পর্ন আসক্তি, পতিতালয় গমন ইত্যাদির মাধ্যমে তারা সঙ্গীবিহীন অস্থিতিশীল জীবনের চূড়ান্ত অবদমনগুলো প্রকাশ করে। নারীসঙ্গ পেতে নিজেকে কৈফিয়ত করাটা রাহুলের কাছে অর্থহীন লাগে কারণ ‘রাহুল ভাবে, ভালোবাসা ছাড়া কার জন্য এই মানামানি, নীতি আসবে প্রীতি থেকে, ভয় থেকে কেনো?’ এই ভাবনার উদগীরণ উশৃঙ্খলা থেকে নয় বরং আসে হতাশা থেকে। রাস্তায় গাড়ি দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু দেখে যখন স্ত্রী বা প্রেমিকারা শঙ্কিত হয়ে তাদের স্বামীর হাতটি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তখন রাহুলও একটা নারী হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করতে চায়। সঙ্গীর অজানা বিপদের আশঙ্কায় নারীদের হৃদয়ে যে কাঁপন হয় সেটা রাহুলের জন্যও সেই কাঁপনটা কারো উঠুক এটা সে আশা করে। এই না পাওয়াগুলো তাকে মূল্যবোধহীন জীবনে অভ্যস্ত করে তোলে। পিছুটান নেই এমন স্বাধীন জীবনের কথা মানুষ ভাবতে ভালোবাসে কিন্তু সেই জীবন যাপন ততটা সুখের নয়। নিরন্তর ছুটে চলা আধুনিক মানুষেরা কেবল নিজের সুখ সমৃদ্ধির কথা ভাবতে ভাবতে ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছে। এই গল্পে ধর্ম ও সংস্কৃতির চিরকালিন দ্বান্দ্বিকতার কারণে রাহুল তার প্রেমিকাকে নিজের মতো করে কাছে পায় না। গল্পের ভাষ্যে:

‘সাবরিনার ধর্ম তাকে বিশ্বাসী হতে শিখিয়েছে। সংস্কৃতি তাকে সমাজের বিপক্ষে গিয়ে শ্যামল মিত্রের সঙ্গে শুতে চাওয়া শিখিয়েছে। এই আকাশ বৃষ্টি উদরে নিয়ে চোখ ছলছল করে তাকায়। এই পাহাড় নিজের ঋজুতা নিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে। এই সাগর সাবরিনার চুলের মতো লম্বা ঢেউ নিয়ে জীবনের গতিকে শনাক্ত করে। আর এই সকাল সামুদ্রিক ঝিনুকের পেটে সতেজ সুপুষ্ট করে রোদের মুক্তা। রাহুল নিজের চোখে নিজে বালি দেয় চোখ ধোয়। সাগরের লবণ, ঘর্মাক্ত স্তনের মতো, স্তন মানুষের প্রথম পিপাসা আর দাবি, ‘রাহুল তার দাবি নিয়ে ঘুমুতে চায়।’

নারীর শরীর নিয়ে রাহুলের যে আকর্ষণ তা প্রথমে লক্ষ করা যায় লেখক যখন একের পর এক পর্নছবিকে বর্ণনা করেন গল্পের ভেতর তখন। নিজের অবদমিত যৌনবাসনা মেটাতে সে তার প্রতি আসক্ত কিন্তু একইভাবে সেইসব অভিনেত্রীদের শরীরের প্রতি তার অকর্ষণ অনেক নির্লিপ্ত। তার সংবেদনশীলতা কেবল সাবরিনার শরীরকে ঘিরে। লেখক রাহুলের নিত্যদিনকে ব্যাখ্যা করেছেন তিনটি শব্দের দ্বারা ‘আহার.. নিদ্রা.. মৈথুন’ এবং বারংবার এর পুনরাবৃত্তি।

এই গল্পগ্রন্থের ‘মহান সূর্য আর অভিমানী মেয়েটি এবং তুচ্ছ বালির গল্প’ শীর্ষক গল্পটির বক্তব্য ও আবেদন সর্বকালের জন্য প্রাসঙ্গিক। এই গল্পের নাম থেকে শুরু করে ফর্মটি প্রাচীন রূপকথার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তবে সরাসরি নীতিবাক্য প্রকাশ করে না। একটি নান্দনিক আবহ সৃষ্টি করে এর ভেতরের লেখক অন্তর্লীন সামাজিক বার্তাটিও পৌঁছে দেন। এমন একটি শহর যেখানে সূর্য ওঠে না কখনো। অন্ধকারে বাস করতে করতে সবাই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। অনালোকিত শহরের মানুষের জীবনের সকল ভাবনাই অন্ধকারে ডুবে যায়। মানুষ তাতেই অভ্যস্ত হয়। কিন্তু একটি মেয়ে সূর্যের অভাবকে মেনে নিতে পারে না। তার শরীরের বর্ণ পরিবর্তনের সাথে সাথে আরো অনেক অভাব সে হয়তো অনুভব করে নেয়। সেই অভাবের অন্তর্দহন থেকে সে সূর্যকে আহ্বান করে চিঠি লেখে এবং চলে যায় সূর্যের আলো সমৃদ্ধ দেশে। সর্বকালের ইতিহাস থেকে জানা যায় সবসময়ই বঞ্চণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মাত্র অল্পলোক করে, আর বিদ্রোহের সাহসটুকুও সবার থাকে না। এই মেয়েটিও মাত্র একজন হয়ে আলো আনতে যায়। সূর্যের দেশে গিয়েই মেয়েটি পৃথিবীর সবচেয়ে চূড়ান্ত স্বার্থপর চর্চাটির সাথে পরিচিত হয়। লোভ কারো সাথে নিজের সম্পদ ভাগাভাগাগি না করে একা ভালো থাকার যে নিরন্তর সাধনা শুরু হয়েছে পৃথিবীজুড়ে তারই একটা প্রতিচ্ছাপ এই গল্পে লক্ষ করা যায়। মেয়েটি অরণ্য পাহাড় জলাশয় কারো কাছে চেয়ে চেয়ে একটুও সূর্যের আলো পায় না। অবশ্য সূর্য এমন এক সম্পদ যাকে সঞ্চয় করা তো দুঃসাধ্য। আর সাহায্য করতে রাজি হয় তাকে বালি। তবু জগতের সেই অমোঘ নিয়মে মেয়েটি বালিকে প্রথমে ভুল বোঝে। তাই বালি থেকে যখন আতশ কাচ তৈরি করে বালি নিঃশেষিত হয় তখন ভুল ভাঙে মেয়েটির এবং কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য একটি বালুকণাও সে আর খুঁজে পায় না। পৃথিবীতে কাউকে সাহায্য করলে সমস্তটা উজাড় করেই দিতে হয়। যে দেয় তার সামান্য অপারগতায় তাকে তাচ্ছিল্য করা হয়। মনুষ্য পৃথিবীর এই অনুদার চর্চা ক্রমশ গ্রাস করছে নীতি-নৈতিকতার বোধকে। বিশ্বায়নের যুগে, সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যে একে অন্যকে দাবিয়ে রেখে এগিয়ে যাওয়াটাই জীবন। লাগামহীন চাহিদায় ক্রমশ মানুষ ভুলতে বসছে তার পিছনে ফেলে আসা পথকে। প্রতিদিন নিজের অবস্থানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা তাদের জীবনবাহনের প্রধান উদ্দেশ্য। অন্যের জন্য বাঁচা, স্বার্থ ত্যাগ করে বাঁচার মধ্যে যে পারিজাতের সুধা রয়েছে তার নাগাল এই ছুটে চলা মানুষেরা পায় না কখনো। তাই লেখক এই গল্পটিতে অনেকগুলো জীবনচেতনকে ধারাবাহিকভাবে নির্মাণ করেন। কোনো না পাওয়াকে জয় করা এবং বৈষম্য-বঞ্চনার প্রতিবাদ করার ভেতর যে শুদ্ধতম আবেগ থাকে, জয় করার পথটি সেই নিষ্কলুষতা মুক্ত থাকতে পারে না। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে রূপকথার আশ্রয়ে লেখক মূল্যবোধের এক গভীর পাঠ নির্মাণ করেন এই গল্পটিতে।

সেলিম মোরশেদের গল্পে সৃজন ও মননের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ সম্পর্ক ও মানুষের মূল্যবোধকে কেন্দ্র করেই মূর্ত হয়েছে। তিনি রাতে অপরাজিতা গাছে ফুল গ্রন্থের গল্পগুলোতে মানুষের সেই অন্তরঙ্গ ভাষ্যের নির্মাণপ্রয়াসী যা সময়ের নিরিখে নিঃসঙ্গ মানুষের সাহিত্য হয়ে ওঠার পক্ষপাতী। বিশেষত তাঁর সৃজননৈপুণ্য, যেখানে ব্যক্তি মানুষের অভিজ্ঞতা ও স্বতন্ত্র দর্শন, সম্পর্কের উপভোগ এবং বেদনা একইসঙ্গে নন্দনবিশ্বে প্রতিষ্ঠা পায়। তাই গল্পকার প্রামাণ্য ইতিহাসকে বিবেচনায় রেখে তার প্রচ্ছায়ার ব্যাপ্তিতে সমাজের রূপায়ণ, নির্মোহের চোখে দেখা পরিবর্তিত মানুষের স্বপ্ন ও প্রাপ্তির শিল্পনির্মিতি করেন। একইভাবে বিবর্তমান বিশ্বায়নে ব্যক্তির ক্ষয়িষ্ণু সত্তার আত্মকথন এবং ব্যক্তিসত্তার চূড়ান্ত পরিণতির ইঙ্গিত নির্মাণে সেলিম মোরশেদ সচেতন পারঙ্গমতার পরিচয় দেন। লেখক সাহিত্যের জটিল পথকে সাধনার মসৃণতা জুগিয়ে পুষ্ট করেন তাঁর গল্পকে। সেই সূত্রেই সেলিম মোরশেদের এই ছোটগল্পগুলি সময়ের জঠরে ব্যক্তিমানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের প্রামাণ্য দলিল হয়ে ওঠে।

 

  1. সেলিম মোরশেদ, রচনা সংগ্রহ ১, (সম্পা.), ঢাকা : উলুখড় প্রকাশনী, ২০ পৃ, ৩৩২
  2. সেলিম মোরশেদ, রচনা সংগ্রহ ১, (সম্পা.), ঢাকা : উলুখড় প্রকাশনী, ২০ পৃ, ১৭৩
  3. Roland Barthes. Mythologies. New York :The Noonday press.
  4. সেলিম মোরশেদ, রচনা সংগ্রহ ১, (সম্পা.), ঢাকা : উলুখড় প্রকাশনী, ২০ পৃ, ১৭২
  5. সেলিম মোরশেদ, রচনা সংগ্রহ ১, (সম্পা.), ঢাকা : উলুখড় প্রকাশনী, ২০ পৃ, ১৭৮
  6. সেলিম মোরশেদ, রচনা সংগ্রহ ১, (সম্পা.), ঢাকা : উলুখড় প্রকাশনী, ২০ পৃ, ১২৯
  7. সেলিম মোরশেদ, রচনা সংগ্রহ ১, (সম্পা.), ঢাকা : উলুখড় প্রকাশনী, ২০ পৃ, ১৩৩

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.

error: Content is protected !!