

সেলিম মোরশেদের ‘সাপলুডু খেলা’: নিয়তি ও কর্মের দ্বন্দ্বযুদ্ধ
মানুষের জীবনের পরিসর যেন একটা সাপ-লুডু খেলার বোর্ডের মতোই ভাগ্য নির্ধারিত! কিন্তু কারা ভাগ্যকে মারাত্মক হাঁ-করা সাতানব্বইয়ের মুখে বসিয়ে দিল কিংবা পঞ্চাশ থেকে তিরানব্বই-এ যাওয়ার তেরছা-কোনাকুনি অলৌকিক একটা সিঁড়ি ধরিয়ে দিল?
‘বাইরের খেলাটা সাপ আর মই-এর, নিয়তি আর সৌভাগ্যের। পুরো ক্ষেত্রটাই সর্পিল নিয়তির।… ভীতিকর নিয়তি সারা বোর্ড জুড়ে নানা রঙের। তাদের ক্ষমতানুসারে শরীরী দৈর্ঘ্য প্রস্থ। সর্বোচ্চ যে, তার ক্ষমতা রয়েছে সাতানব্বই থেকে একেবারে বারোতে নামিয়ে দেবার। সর্ব্বোচ্চ সৌভাগ্য পঞ্চাশ থেকে তিরানব্বই-এ যাবার। আশ্চর্য নানা দৈর্ঘ্য প্রস্থের এমনকি বিচিত্র রঙের বিবিধ সাপের অবস্থান লক্ষণীয়, কিন্তু সমস্ত মইয়ের, সারা বোর্ড জুড়ে, একই রঙের প্রিন্ট, প্রস্থ একইরকম, লম্বায় ছোটো বড়ো আছে। মানুষের দুর্ভাগ্যগুলো নানা রঙের আর সৌভাগ্যের রঙ একটাই।’
গুটিটা কে চালছে? লেখক প্রতিবাদ করছেন তাদের বিরুদ্ধে যারা দীর্ঘদিন মানুষের জীবন নিয়ে সাপ-লুডু খেলার মতো করে খেলেই চলেছে। কিন্তু কারা তারা? যারা বুদ্ধিজীবী, যারা নীতি-নির্ধারক, যারা জ্ঞানী।
একজন সংবাদপত্র সম্পাদক সলোমানের জ্ঞান, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণের প্রকাশ ঘটানো লেখকের মুখ্য উদ্দেশ্য। সম্পাদকের সঙ্গে কখনো একাত্ম হয়ে গেছেন লেখক, দিয়েছেন উত্তমপুরুষে বর্ণনা, কখনো-বা সর্বজ্ঞ হিসেবে সর্বনাম পাল্টে ফেলেছেন; অর্থাৎ নিজেকে দুভাবে দেখছি- কখনো ভেতর থেকে ‘আমি’ হয়ে, কখনো বাইরে থেকে ‘সে’ হয়ে।
লেখক সাপলুডু খেলা’য় চৈতন্য-প্রবাহ রীতির ব্যবহার ব্যাপক আয়োজন করেই করেছেন। সাহিত্যে চৈতন্য-প্রবাহ রীতির ধারণাটি নতুন কিছু নয়। চৈতন্য-প্রবাহ তো নদীর স্রোতের মতোই, তার চলা বিরামহীন। একে বাক্যজালে কী করে বন্দি করা সম্ভব?—বাক্যে যতিচিহ্নগুলোকে অত্যন্ত সচেতনভাবে ব্যবহার করে। ঠিকঠাক বিরাম দিলে অর্থোদ্ধার সম্ভব হবে সাপলুডু খেলা-র। এভাবেই চৈতন্য আর ভাষার সম্মিলন ঘটাতে চেয়েছেন সেলিম মোরশেদ।
উপন্যাসটা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রচুর তত্ত্বকথা টেনে আনতে হচ্ছে। কারণ লেখক নিজে উপন্যাসের ভিতরেই রেখেছেন এই উপন্যাসটির সমালোচনা। একটা উপন্যাসের মধ্যে লেখক উপন্যাস তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করছেন — বিষয়টি নতুন নয়। কিন্তু সাপলুডু খেলা-য় প্রায় প্রতিটি ঘটনা-দুর্ঘটনা-আকস্মিক অঘটন ইত্যাদির মধ্যে রূপক-ধর্মিতা রাখা হয়েছে— যার প্রায় সবকটার একটা ব্যাখ্যা একটু বাদেই লেখক করে দিচ্ছেন। উদাহরণ দিচ্ছি—
‘সু অ গো বলেন,… যাইহোক সেমো, সলোমানের ক্ষেত্রটা ঠিক কোনদিকে— নিশ্চই তুমি তার লক্ষ্য স্থির করে দেবে না। আর গন্তব্যের দায় তো তার। যেই বেনকে নিয়ে শুরু হলো তোমার এই লেখা তার চড়া একটা তাপ আছে। সেই তাপ দাহ না ধু-ধু আগুন তা জানালে না। সলোমান কি সংশয়বাদী তা কিন্তু লিখলে না; আর বেনের ঈশ্বরভাবনা নিয়ে কিছু বললে না তবে জুবায়ের বিশ্বাসহীনতা থেকে বিশ্বাসী হলো। বেন অবশ্য তাকে সমর্থন করলো প্রেক্ষিতটা নিয়ে অর্থাৎ ইবনে আজিজের ব্যক্তিবিশ্বাস জুবায়ের নিলো। দুটি মানুষ এক জায়গায় গিয়ে যেন ফুরিয়ে গেলো। বেনের বাবা নেভাল অফিসারের ঐক্যটা মানুষের ঐক্য দেখালে। তুমি লিখলে অসীম শান্তনু আর মাসুদ নিয়ে—ওদের বৈপরীত্য আর ঐক্য একটা স্ফূরণ। ঠিক লাবণ্যময়ী নেহেরি আর গবেষণাগারে যুক্ত থাকা মেয়েটির মত। তোমার লাবণ্যময়ী শুধু নিজেকেই দেখলো, নেহেরি তো দেখতে চাইল না, চাইলে হয়তো রোগামুখের সাইকেল চালানো ছেলেটাকে দায়ী করে বিচারই চাইতে হতো। পরিচিত মানুষ মোহাদ্দেস হুজুরকে দেখালে। মালাটার গাঁথুনি নিটোল হলে সলোমান ঝুঁকি নিয়ে কিনতো কিনা লিখলে না।’
— সু অ গো-র সঙ্গে কথা বলছেন সেমো, মানে লেখক সেলিম মোরশেদ। উপন্যাসে যেটুকু আখ্যানভাগ তার বেশ-অর্ধেকটাই উঠে এসেছে এই আলাপচারিতার মাঝে; সেই সঙ্গে আরো আলোচিত হয়েছে চরিত্র-দর্শন এবং বয়ান-কৌশল। সলোমান-বেন-জুবায়ের-ইবনে আজিজ- অসীম-শান্তনু-মাসুদ প্রত্যেকের সঙ্কট বলা চলে অভিন্ন— তা হল জ্ঞান ও কর্মের মিলন না-হওয়া। তত্ত্বের জগতে থাকা প্রতিটা মানুষ যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে, যুক্তির ধারালো ছুরির চকচকে ফলা যেন তাদের রক্তাক্ত করছে। যুক্তি কোনো মুক্তি এনে দিতে পারছে তো না-ই বরং কেড়ে নিচ্ছে আবেগ-বিস্ময়। আসলে সেলিম মোরশেদের এই উপন্যাসটি অমীমাংসিত তাত্তি¡ক জিজ্ঞাসায় পূর্ণ। উপন্যাসটি নিয়ে লেখকের মাঝে দ্বিধা ছিল কি? না থাকলে কেন তিনি প্রতিটি বিষয়ের অন্তত একটা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন? কেন ভাবছেন মালাটার গাঁথুনি নিয়ে? লক্ষ করি—
১. ‘কোনো কিছুই যেন দাঁড়াচ্ছে না— বিষয় কিংবা বিষয়বস্তু, আইডিয়া আর ট্রিটমেন্ট এমনকি চিন্তার সূত্রটাও— আর হয়ে ওঠা চরিত্র— সে তো সোনার পাথরবাটি— যাত্রায় দেখা ছাড়া…’
২. ‘পাঁচমিশালি একটা মালা… তেমন ফুলও ছিল না তাতে, …নুয়েপড়া জবার মুখটাই মালাবৃত্তের দিকে ঘোরা, গোলাপটা উল্টোমুখী, পরপর কয়েকটা বেলীর সামান্য ভারসাম্য, ফাঁকা, সুতোর গিটের দাগ তারপর কাটা কাটা অগ্রন্থিত উল্লম্ফন। ফুটিয়ে তোলার বা ফুটে ওঠার অবকাশের অলক্ষে যেটুকু হয়, ফোটে না ফেটে যায়…’
— এটা কি সৃজনশীল লেখকদের চিরায়ত সমস্যা, নিজের লেখা নিয়ে অতৃপ্তি? নাকি পোস্টমডার্ন লেখকদের নিজস্ব সঙ্কট?—বিষয় কিংবা বিষয়বস্তু, আইডিয়া আর ট্রিটমেন্ট, চিন্তার সূত্র, হয়ে ওঠা চরিত্র—সব ভেঙে ফেলা, কোনো কিছুকে আর দাঁড় করানোর, গড়ে তোলার বৃথা চেষ্টা না করা তো সম্পূর্ণতই পোস্টমর্ডান লেখার চরিত্র।
গুটিটা কে চালছে? লেখক প্রতিবাদ করছেন তাদের বিরুদ্ধে যারা দীর্ঘদিন মানুষের জীবন নিয়ে সাপ-লুডু খেলার মতো করে খেলেই চলেছে। কিন্তু কারা তারা? যারা বুদ্ধিজীবী, যারা নীতি-নির্ধারক, যারা জ্ঞানী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ আর কোনো কিছুতেই বিশ্বাস রাখতে পারে না। হেগেল-ডুরিং-ফয়েরবাখ-লাসেল-সার্ত্র—সবাই বাতিল হয়ে যায় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী তাত্ত্বিকদের কাছে।
‘‘আমি মানুষ। আমার শূন্যতা সত্য। মানুষের সত্য এইটুকুই, কোনো ডিক্রি জারি করে ‘কোনো যূথবদ্ধতা’ বা ‘মহান কর্তব্যের’ দোহাই দিয়ে তার শূন্যতা পূরণের অবকাশ নেই। এই শূন্য মানুষ যার লক্ষ্য, যার বাসনা কেবল চির অসীমতার সঙ্গে যুক্ত হওয়া। হেগেল বা ডুরিং এর ভাবসত্তা বা পরমসত্তার ভেতর না, ফয়েরবাখের নরনারীর প্রেমে না, লাসেলের স্বতঃস্ফূর্ত কাজে না, এমনকি সার্ত্রের ব্যক্তিগত সত্যেও না, কেবল শূন্যতার স্বতোৎসারিত গতি আর যার ওপর দাঁড়ানো চিরায়ত মানবসত্তার সব সত্য।’’
সব কিছু যখন ভেঙে পড়ে তখন শুধু রয়ে যায় এক অসীম শূন্যতা। আফ্রিকান যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষক ইবনে আজিজ তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং প্রজ্ঞার সমন্বয়ে উপলব্ধি করেছিলেন যে, বিজ্ঞানের সব সূত্র ছাপিয়ে পঞ্চাশ হাজার ফুট উপর থেকে কেবল একটি সূত্রই ধ্রুব হয়ে ওঠে; তা হল মানুষের সীমাহীন শূন্যতা আর একাকিত্ব। মানুষ এই শূন্যতার গহ্বর থেকে অস্তিত্বকে রক্ষা করার জন্য সৃষ্টি করে ঈশ্বরকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটিশ রয়েল ফোর্সের একজন নেভাল অফিসার বেনের বাবা এমনই সঙ্কট-কালে শরণাগত হয়েছিলেন ঈশ্বরের: ‘মা, মাগো, মাদার’ উচ্চারণে থেমে যেত মহাসাগরের ঝড়; শত শত লোকের কাছে এ ছিল এক সাংঘাতিক আশ্চর্য বিশ্বাস, যা এক যাদুকরি সাহস এনে দিত।
রীতিমতো ঘোষণা দিয়েই সেলিম মোরশেদ নেরেটিভের সঙ্গে শত্রুতা পাতিয়েছেন। তাই সাপলুডু খেলা উপন্যাসে বলার মতো কোনো কাহিনি নেই, সম্ভব নয় কোনো সারসংক্ষেপ তৈরি করা। সলোমানের কৈশোর উঠে এসেছে কয়েকটি পৃষ্ঠায়, ফ্ল্যাশব্যাক রীতিতে। সংস্কৃতিমনা নাট্যকর্মী বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়ি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন পাকিস্তানপন্থী মাসুদ ডাক্তারের চক্রান্তে। সলোমানের বাবার নাম পুণ্য আর চাচার নাম প্রফুল্ল বলে, অর্থাৎ ‘হিন্দুয়ানি’ নামের জন্য মাসুদ ডাক্তার কথা শুনিয়েছিলেন তাদের। কিশোর সলোমানের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় কেটেছে বাণিশ্বরদিতে। সেখানে তার পরিচয় হল নীতার সঙ্গে; ‘সু অ গো’-র মতে নীতা সলোমানের নস্টালজিয়া আর মুক্ত-ভূখণ্ড। নীতার সঙ্গে খেলতে খেলতে কেটে গেছে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘকাল। নীতার হাত ধরে সোনার বাংলাকে ভালোবাসার গান গেয়েছেন তিনি।
সলোমানের চিন্তায় কিংবা আলোচনায় বার বার ঘুরেফিরে এসেছে কৈশোরক দুঃসহ স্মৃতি তথা সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গ— কখনো দেশভাগের ইতিহাসরূপে, কখনো বাস্তব ঘটনার সূত্রে। সলোমানের বন্ধু, মাইনরিটি কমপ্লেক্সে ভোগা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি বিষ্ণু বিশ্বাস ছাপ্পান্ন হাজার একশ ছাব্বিশ বর্গমাইলের ভেতর ভারসাম্যহীন অবস্থায় থাকতে পারলেন না; থাকতে চাইলেন না রুদ্র, ইসহাক খান, হাবিব ওয়াহিদদের প্রিয়ভাজন হয়ে। সলোমান তাই ইতিহাস হাতড়ে খোঁজেন এর দায় কার— সুলতান মাহমুদ, বখতিয়ার-ঔরঙ্গজেব, লর্ড ক্লাইভ— নবাব সলিমুল্লাহ, জিন্নাহ, লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস- সুরেন্দ্রনাথ বা নেহেরু—কাকে দায়ী করবেন তিনি।… সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের আশঙ্কার প্রসঙ্গ যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে সাধারণ মানুষের মাঝে যে সম্প্রীতি, মৌলবাদের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ রয়েছে সেই সম্ভাবনার কথা।
লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকে নানা ভাবে জোরদার করার চেষ্টা করেছেন লেখক। উপন্যাসে তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি সলোমান সে-সব বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করছে মাঝে-মধ্যেই। যেমন আলোচনায় আনছেন উদয়ন ঘোষকে। আমরা উপন্যাসে উদয়ন সম্পর্কে পাচ্ছি যে, তিনি জীবনটা নিয়ে শিল্প করতে জানেন, অনেক কম ছাপেন ইত্যাদি। ‘প্রতিশিল্প’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে সেলিম মোরশেদ তাঁকে প্রভাবিত করে এমন লেখককুলের তালিকায় উদয়ন ঘোষের নামটা বলেছেন। এছাড়াও উপন্যাসে বেশ কজন লেখকের প্রসঙ্গ পাব আমরা ইঙ্গিতে-আন্দাজে; ‘সু অ গো’, ‘ফম’, ‘সেআদী’, ‘আমা’ ইত্যাদি।
সাপলুডু খেলা-কে লেখক ঔপন্যাসিকা, কাউন্টার নভেলেট বলছেন; এ সম্পর্কিত কৈফিয়ত দিয়েছেন ‘প্রতিশিল্প’কে। লেখকের ব্যাখ্যাটি উদ্ধৃত করছি:
‘এখানে আমি ঠিক ওইভাবে উপন্যাসিকা হিসেবে পরম্পরা রক্ষা করা সনাতন গল্পের কাঠামোতে না গিয়ে অন্যভাবে বলেছি। লেখার উপরিকাঠামোতে তেমন কোনো যোগসূত্র রাখিনি, আখ্যানভাগের সংযোগ রক্ষা করার তেমন চেষ্টাও করিনি। বরং আন্তঃযোগাযোগটাকে প্রাধান্য দিয়েছি। তাছাড়া কারেক্টারাইজেশন প্রমিনিয়েন্ট না করে যে পরিস্থিতির ভেতর চরিত্র বেরিয়ে আসছে সেখানে ট্রিটমেন্টের ওপর জোর দিয়েছি। চেষ্টা করেছি এন্টি-ন্যারেটিভ লিখতে কিন্তু ডিটেলে যত্নবান ছিলাম। মনে হয়েছে, আসলে এটা কাউন্টার লেখা— তাই কাউন্টার নভেলেট বললাম।’
রীতিমতো ঘোষণা দিয়েই সেলিম মোরশেদ নেরেটিভের সঙ্গে শত্রুতা পাতিয়েছেন। তাই সাপলুডু খেলা উপন্যাসে বলার মতো কোনো কাহিনি নেই, সম্ভব নয় কোনো সারসংক্ষেপ তৈরি করা। সলোমানের কৈশোর উঠে এসেছে কয়েকটি পৃষ্ঠায়, ফ্ল্যাশব্যাক রীতিতে। সংস্কৃতিমনা নাট্যকর্মী বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়ি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন পাকিস্তানপন্থী মাসুদ ডাক্তারের চক্রান্তে।
— সলোমানের বন্ধু নারীন অভিযোগ করছিলেন যে, তিনি লেখককে ‘ভ্রাম্যমাণ প্রবন্ধ’ বলেই জানেন। প্রসঙ্গত লেখক সলোমান বলছিলেন যে লেখাটা তাঁর কাছে কনশাস ইফোর্ট। সচেতনভাবেই লেখক ভাঙছেন উপন্যাসের পরম্পরা, সনাতন গল্পের কাঠামো, উপরিকাঠামোর যোগসূত্র, কারেক্টারাইজেশন এবং ন্যারেটিভ; ফলত, নারীনের মতো অনুভব-সর্বস্ব শিল্পীর কাছে এটি ভ্রাম্যমাণ প্রবন্ধ বলে মনে হয়েছে বলে অনুমান করা যায়। তবে, একে কেন নভেল না বলে নভেলেট বলছেন এ বিষয়ক ব্যাখ্যায় যাননি লেখক। হয়তো আকৃতি ছোট বলেই তাঁর নভেলেট বলা; কিন্তু বর্তমান প্রবন্ধে এটিকে নভেল বলা হয়েছে এর প্রকৃতি, পরিসর, তত্ত্ব-দর্শন ইত্যকার বিচার-বিবেচনাপ্রসূত সাহিত্যতাত্ত্বিক বিচার-নিরিখে। জাতীয়তা-আন্তর্জাতিকতা মিলিয়ে সাপলুডু খেলা এর আকৃতিগত ক্ষুদ্র আয়তন ছাপিয়ে বোধের বিস্তৃতি ও গভীরতায় এর উপন্যাসায়ন ঘটিয়েছে।লেখক চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়েছেন বিভিন্ন পরিচর্যায়। লেখক সলোমান চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ‘প্রতিশিল্প’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলছেন:
‘সলোমান এনলাইটেন ইয়াং বুর্জোয়া, তার গ্লানি নেই। কিন্তু কিছু করণীয় আছে বলে মনে করে। সে একটা আলোচনার ভেতর থাকতে চায়। এক ধরনের আত্মজবানীমূলক প্রক্রিয়ার ভেতর থাকার ইচ্ছা আছে তার। … এই সলোমানকে আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। বুর্জোয়া অনেস্টিটা তার আছে। আবার বাম চেতনা নিয়েও মাঝে মাঝে ভাবে।’
সলোমান এবং বেন—এ দুটো চরিত্রের নামকরণ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা লেখক রাখছেন উপন্যাসের আত্মজবানীমূলক প্রক্রিয়ার মাঝেই। লক্ষ করি:
১. ‘সলোমান তো পয়গম্বর… আল্লাহ এক-এক নবীকে এক-একটি গুণ দিয়েছিলেন। সোলায়মানকে দিয়েছিলেন জ্ঞান, উইজডম, ওই যে করতলে তর্জনী শুরু হবার ক্ষেত্রে উঁচু মাংসপিণ্ড—যার উপর অর্ধবৃত্তাকারে এই রেখা— সব হাতে থাকে না— ওই যে রিং অব সলোমান…’
২. ‘আমার নাম ছিল আবু হোসেন মির্জা। আমি পাল্টিয়ে আমার নাম ওটা (বেন) রাখলাম। পরে দেখলাম ওটা জৈবযৌগ। খুবই রহস্যময় আর বিচিত্র।… দেখলাম প্রচুর জ্বলছে আর কিছুক্ষণ পরে একেবারে ঠাণ্ডা। দ্রুত ক্রিয়া করে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। রাজনীতিতে তখন ছদ্মনাম লাগতো। আমি ওটির রাসায়নিক সংকেত C6H6-এই কোড ব্যবহার করতাম।’
নামকরণ, উপন্যাসের দর্শন কিংবা এর কোনো রূপক, অথবা খোদ উপন্যাসটির ফর্ম নিয়ে লেখক বারবার ব্যাখ্যা জাহির করতে চাইছেন সাপলুডু খেলা-য়। আধুনিক উপন্যাস যেমন গল্পভুক পাঠকদের জন্য নয়, তেমনি রূপক-দর্শনের ব্যাখ্যাও ধরে-ধরে দেয়ার কোনো মানে থাকতে পারে না। এই উপন্যাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হল এর বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত অনুভবমালা; মালাটা নিটোল হল কিনা এ নিয়ে লেখকের দ্বিধা নিষ্প্রয়োজন। এই অনুভবমালা স্বয়ংসম্পূর্ণ, এর ব্যাখ্যা-দান গুরুত্বহীন। তুলে ধরছি:
সলোমান বলছে ‘ফ্রয়েড ঘুড়ি ওড়ালো অথচ সুতোয় যার মাঞ্জা ধরেনি কিংবা বলতে পার হাত-গোটানো একজন তরুণ কবি। তবু আমি তাকে দেখি ভিন্ন জায়গায়—ইডিপাসের গ্লানিতে সবচেয়ে কষ্ট পাওয়া পৃথিবীর একজন।’
কিংবা, ‘স্ববিরোধের ভেতর সব সমন্বয়ের আর সমন্বয়হীনতার সূত্র ’—এই বাক্যটি রচনাসংগ্রহ-১-এর ‘অনুভবমালা’ অংশেও জুড়ে দেয়া হয়েছে। অনুভবমালা অংশ ওল্টালেও দেখব সেখানে এই বাক্যের বিরোধিতা করা মানুষদের নাম উল্লেখ আছে, উপন্যাসে যেমন বিরোধিতা করছিল নারীন।
ব্যক্তিগত শূন্যতা-একাকিত্ব খুব ভাবায় লেখককে। সলোমান তার স্ত্রী সালমাকে আর একটি সন্তান নিতে বললে সে রাজি হয় না। ভয়ে বার বার প্রেগনেন্সি টেস্ট করায় সালমা। সলোমান লক্ষ করে আশপাশের মানুষগুলো কী রকম বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হয়ে যাচ্ছে, জেনোফোবিয়ায় ভুগছে। কারো সঙ্গে যুক্ততার জন্য ব্যাকুল সলোমান কখনো বেছে নেয় নারী—কখনো যৌনকর্মী সঙ্গমে, কখনো ভুটানের কৈশোরোত্তীর্ণ কিঞ্চি দেমা’র সান্নিধ্যে সে শুশ্রুষা পায়।
তবে সলোমানের শান্তি মেলে না, অশান্তিই তার নিয়তি। তার প্রজ্ঞা, উইজডম তাকে কর্মবিচ্ছিন্ন, জনবিচ্ছিন্ন করে তোলে। সেজন্য টেলিফোনের অপর প্রান্তের মানুষটির সঙ্গেও সে একাত্ম হতে পারে না, টেলিফোনটি অচল-মৃত রয়ে যায় বলে। ল্যাম্পপোস্টের দুটো বাতিও কখনো একসঙ্গে জ্বলে না, জ্বালাতে গেলে কেবল হানাহানি, মারামারির ঘটনা ঘটে। উত্তরণের উপায় বাতলাচ্ছেন লেখক— জ্ঞানকে আরো রক্তাক্ত হতে হবে। রিং অব সলোমানকে রক্তে ভিজে ভিজে ঠিক করে নিতে হবে তার কর্মপথ। প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তির রিং অব সলোমান বুকের রক্তে ভিজতে ভিজতে একদিন জয় করবে এই নিয়তিকে। সাপ লুডু খেলার মইগুলো তখন আর থাকবে না, কারণ এই মইগুলোই ফরচুন, আর সব ফরচুনের পেছনেই থাকে ক্রাইম। এমনকি লাঠি-লজেন্স চুষতে না-পারার ব্যক্তিগত ক্ষোভে আচ্ছন্ন মধ্যবিত্তরাও সত্যিকারের গোত্রান্তরিত হওয়ার পথের দিশা পাবে এই রক্তাক্ত দ্ব›দ্বযুদ্ধের অবসানে।
আকর-গ্রন্থ
- সেলিম মোরশেদ রচনাসংগ্রহ- ১ উলুখড়, ফেব্রুয়ারি, ২০১১
[প্রথম প্রকাশ: ভীষ্মদেব চৌধুরী সম্পাদিত ষাণ্মাসিক ‘অন্তর্দেশ’ (ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল ২০১৫) ]