বিদ্রোহী কবিতার ফাটা দিকগুলা
বাংলা সাহিত্যে প্রচুর অভিযোগ আছে লেখা নকল কিংবা ভাবসম্পদ চুরি করা নিয়া। বিদেশি সাহিত্যেও আছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের ‘চৈত্ররজনী’ কবিতা থিকে রোকেয়ার ‘নিষ্ঠুর নিদয় শশী’ কবিতা, অর্থাৎ কবিতা থিকে কবিতা করার বিষয়টিও আছে। তেমন নজরুলের কবিতা ‘বিদ্রোহী’ ও মোহিতলাল মজুমদারের ‘আমি’ প্রবন্ধ নিয়া অনেক তর্কবিতর্ক আছে। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা নিয়া যখন আলোচনা-সমালোচনা চলছিল, তখন স্বয়ং মোহিতলাল বিভিন্ন মহলে মুখে মুখে প্রচার করছিলেন যে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সৃষ্ট হৈছে তার আমি প্রবন্ধের ভাববলয় থিকে। কমরেড মুজফফর আহমদ তার ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’তেও এই লেখার ভাব চুরির কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেও এ-ও বলেছিলেন, যখন মোহিতলাল নজরুলরে তার ‘আমি’র প্রবন্ধটি পড়ে শোনাইতেছিলেন তখন নজরুলের পেছনে বইসা থাকার ধরনে বোঝা যায় যে, মোহিতলালের ‘আমি’ প্রবন্ধটি শোনার জন্য নজরুল প্রস্তুত নন কিংবা মনোযোগ দেন নাই। ফলত, ভাবসম্পদ চুরির বিষয়টি অবিশ্বাস্যও। মোহিতলালের লেখা মনোযোগসহকারে না শোনার পিছনে নজরুলের হিন্দুশাস্ত্র সম্পর্কে মোটামুটি ধারণার ফল হয়তো। মানে নজরুলের পক্ষে ওই গদ্য লেখাটির মর্মানুসরণ সম্ভব ছিল বইলাই অন্যমনস্ক ছিলেন নজরুল। আরও একটি উদাহরণ সুকুমার সেন ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে’র চতুর্থ খণ্ডে উল্লেখ করছেন, সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাব মোহিতলাল এড়াইতে পারলেও মোহিতলাল নজরুলের গুরু হওয়া সত্ত্বেও নজরুলের প্রভাব থিকে মুক্ত হইতে বেশ দেরি হইছিল। এর থিকেও বোঝা যায় নজরুল মোহিতলাল দ্বারা প্রভাবিত হন নাই। কিন্তু গুরু মোহিতলালের অভিযোগটাও তো আর হেসেই উড়ায়ে দেওয়া সম্ভব না যে কেননা নজরুলের গুরু তো ছিলেন মোহিতলাল। নিশ্চয় অভিযোগের ভিত্তি কিছু না কিছু তলায়ে দেখা জরুরিই।
এইখানে, আমিও অবশ্য সবকিছুই উদ্ধার করবার জন্য বসি নাই। জাস্ট কিছু হিংস দিতেই এ বিষয়ের অবতারণা করা। প্রথমেই জানায়া রাখা দরকার যে, মোহিতলালের আমি প্রবন্ধে নিপীড়িত মানুষের মুক্তিচেতনার কোনো ইঙ্গিত নাই। কিন্তু নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাতে মানুষের মুক্তির কথা আছে। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের জন্য কুশাসনকে নিশ্চিহ্ন করে নতুন বিশ্ব সৃষ্টির যে স্বপ্ন, সেইটা বস্তুবাদী প্রলেতারিয়েতদের। এই পলিটিক্যাল দর্শন মোহিতলালের ‘আমি’র দর্শন না। এইটা মার্ক্সের, লেনিনের তথা বিপ্লবী রাশানদের। কিংবা হিন্দু, মুসলমানের ধর্মের, অর্থাৎ বিভিন্ন অবতার, মহামানবদের আবির্ভাবে মানুষদের পশুশক্তিদের হাত থিকে রক্ষা করছেন। এগুলা কোরানেও আছে, বাইবেলেও আছে, গীতাতেও আছে। নজরুল যে প্রতীকগুলা ব্যবহার করেছেন, তা এই ধর্মীয় বিষয়-আশয় জানার ফলেই। মোহিতলালরেও যে খারিজ করে দেওয়া যায় না, তা-ও না আবার। মানে, মোহিতলালের ‘আমি’ প্রসঙ্গের সাথে ‘বিদ্রোহী’র ভাবগত কিংবা আকারগত সাদৃশ্যও আছে। যেমন ‘আমি’তে আছে, ‘আমি সুন্দর! শিশুর মত আমার ওষ্ঠাধর, রমণীর মত আমার কটাক্ষ’! এই লাইনগুলা তো সত্যই নজরুলের বিদ্রোহী’র ‘আমি চিরশিশু চিরকিশোর’ এবং ‘আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি’ এগুলা তো স্পষ্ট স্বাক্ষরিত বিষয়-আশয়।
সাহিত্য কি একপ্রকারের রিলেরেস? ঐতিহাসিকভাবেই অতীতের সাথে বর্তমানের আর বর্তমানের সাথে ভবিষ্যতের যোগসূত্রতার নামই সাহিত্য। হয়তো তাই। নয়তো মোহিতলাল নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নিয়া যে তর্কটা উঠাইলেন, মোহিতলালের ‘আমি’ প্রবন্ধটিও তো একই দোষে দুষ্ট। মানে, ‘আমি’ প্রবন্ধটাও ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় নামক পূর্বজ কোনো লেখকের ‘অভয়ের কথা’ গ্রন্থ থিকে এই আমির ভাব নেওয়া।
এইখানে নজরুলের কিংবা মোহিতলালের মতো কিংবা ন্যায়ের মতো তুলনাবাচক শব্দে কিংবা উপমার দ্বারা উপমানের সমতুল্যতা প্রদর্শনের কিছু নাই অবশ্য। কারণ ‘আমি’ শুধু বিশ্ব নয়, মহাবিশ্বকেও ছাড়িয়ে যায়। মানে, খোদার আরশ ছেদ করেও ওপরে উঠেছে। কল্পনাশক্তির এই রূপ নজরুল শুধু মোহিতলালেই পান নাই, জালালউদ্দিন রুমীতেও পাইছেন। ‘বিদ্রোহী’ লেখার আগে মোহিতলালের ‘আমি’র সঙ্গে নজরুলের যতটুক পরিচয় ঘটছিল, তার চাইতেও বেশি পরিচয় হৈছিল ফারসি কবি রুমী, জামি ও খৈয়ামের সাথে। সে সময়কার সামাজিক পরিবেশে এরা পারস্যের বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিতি পাইছিলেন। এ কারণে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পড়ে যখন লোকজন নজরুলের ওপরে বিদ্রোহী হয়ে উঠছেন, তখন নজরুল ইব্রাহিম খাঁর কাছে চিঠিতে লেখেন, যারা ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পড়ে আমার ওপরে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন, তারা যে হাফেজ-রুমীকে শ্রদ্ধা করেন, এ ত আমার মনে হয় না। আমি ত আমার চেয়েও বিদ্রোহী মনে করি তাঁদেরে।
সাহিত্য কি একপ্রকারের রিলেরেস? ঐতিহাসিকভাবেই অতীতের সাথে বর্তমানের আর বর্তমানের সাথে ভবিষ্যতের যোগসূত্রতার নামই সাহিত্য। হয়তো তাই। নয়তো মোহিতলাল নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নিয়া যে তর্কটা উঠাইলেন, মোহিতলালের ‘আমি’ প্রবন্ধটিও তো একই দোষে দুষ্ট। মানে, ‘আমি’ প্রবন্ধটাও ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় নামক পূর্বজ কোনো লেখকের ‘অভয়ের কথা’ গ্রন্থ থিকে এই আমির ভাব নেওয়া। এ রকমই জানিয়েছেন শ্রী রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত তাঁর ‘নীলকণ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলাম’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে। তার মানে, যোগসূত্রতা আছে বৈকি। হ্যাঁ, যোগসূত্র বলতে কিছু শব্দগত আর কিছুটা ভাবগত, তবে আকারগত না। ‘আমি’তে কবিকল্পনা আছে, উপমা আছে, চিত্রকল্পও আছে, তবে নেই কাব্যের আবেগ, নেই ছন্দ, নেই ছন্দোদ্ভূত ভাবাবেগ। না থাকারই কথা, কেননা কাঠামোগত সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য আছে ‘বিদ্রোহী’ ও ‘আমি’তে।
এত তর্কবিতর্ক ওঠার পরও দিন শেষে নজরুল কবি। মানে, সব যোগ-বিয়োগ শেষেও যেটুকু রস তলানিতে থাকে সেইটুকুই তিনি। অর্থাৎ সে রসটুকুই নজরুলের নিজস্বতা, নজরুলের জীবনাভিজ্ঞতা, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা, যা মোহিতলালের ‘আমি’তে কখনোই থাকবার কথা না।