লেখায় স্মৃতিই এক একটি ছবি হয়ে ওঠে : মারিও বার্গাস ইয়োসা
মিগেল আনহেল সাপাতা : মারিও, এই যে আপনি আশ্চর্য সুন্দর এই দৃশ্যের সামনে বসে আছেন, এমন দৃশ্য পেলে আমি প্রতিদিন একটি করে কবিতা লিখতে পারতাম!
মারিও বার্গাস ইয়োসা : হ্যাঁ, অবশ্যই পারবেন কিন্তু আমি এখানে বসে সারাদিনেও একটি উপন্যাস শেষ করতে পারব না। তবে কিছু না কিছু লেখার কাজ অবশ্যই করতে পারছি, এখানে বসে প্রতিদিনই আমার উপন্যাসটি লিখে শেষ করার চেষ্টা করছি; একটু একটু করে লিখছি।
সাপাতা : তাহলে আপনি বলছেন এরকম আশ্চর্য নীরবতা, এমন এক একাকীত্ব ঘিরে রয়েছে এখানে, চারপাশে গাছগাছালির ঘের এমন হয়ে আছে যেন প্রকৃতি স্বয়ং একজন লেখককে আগলে রেখেছে মায়ের মতো, এরকম পরিপার্শ্ব কি লেখালেখি ও সৃষ্টির কাজকে উসকে দেয় না?
ইয়োসা : উসকে যে দেয় তাতে কোনও সন্দেহ নেই; আমি এখনও এটা বিশ্বাস করি যে যখন আপনি একটি গল্পের সঙ্গে আছেন, গল্পটিকে আপনি একটু একটু করে লিখছেন, আচ্ছন্ন হয়ে আছেন গল্প লেখার প্রক্রিয়াটির সঙ্গে, তখন আপনার আশপাশের পরিবেশেও ঠিক সেই আচ্ছন্নতা বিরাজ করবে। এভাবে লেখার পরিবেশ তৈরি হয়, প্রকৃতির মধ্যে। লেখার জন্য একটি মনোরম পরিবেশ, যেমন- চমৎকার একটি ল্যান্ডস্কেপের কথাই ধরুন যা প্রতি মুহূর্তে রঙ বদলাচ্ছে, আলোর রকমফেরে ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে… সকল ধ্রুব পরিবর্তনেরই একটি নান্দনিক দিক থাকে, একটি শাশ্বত রূপ থাকে; ভোরের সমুদ্র আর গোধূলিবেলার সমুদ্র দেখতে একরকম নয়, দিন যখন মেঘলা হয় কিংবা রৌদ্রজ্জ্বল থাকে, তখনও সমদ্র আগের মত থাকে না, বদলে যায়, এই সব আশ্চর্য কুহক যে কেবল আনন্দদায়ক তাই নয়, আমাকে ভীষণ উদ্দীপ্তও করে রাখে। তখন লেখা ভর করে। খুব লিখতে ইচ্ছা করে। লিখিও।
আমি এখনও এটা বিশ্বাস করি যে যখন আপনি একটি গল্পের সঙ্গে আছেন, গল্পটিকে আপনি একটু একটু করে লিখছেন, আচ্ছন্ন হয়ে আছেন গল্প লেখার প্রক্রিয়াটির সঙ্গে, তখন আপনার আশপাশের পরিবেশেও ঠিক সেই আচ্ছন্নতা বিরাজ করবে। এভাবে লেখার পরিবেশ তৈরি হয়, প্রকৃতির মধ্যে। লেখার জন্য একটি মনোরম পরিবেশ, যেমন- চমৎকার একটি ল্যান্ডস্কেপের কথাই ধরুন যা প্রতি মুহূর্তে রঙ বদলাচ্ছে, আলোর রকমফেরে ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে… সকল ধ্রুব পরিবর্তনেরই একটি নান্দনিক দিক থাকে, একটি শাশ্বত রূপ থাকে; ভোরের সমুদ্র আর গোধূলিবেলার সমুদ্র দেখতে একরকম নয়।
সাপাতা : আপনি তো দেশে দেশে ঘুরেন, বসবাস করেন। একেক জায়গায় একেক রকম পরিবেশে কিভাবে লেখার কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম হন?
ইয়োসা : আমার বসবাসের জায়গা ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়, এটা সত্য; বছরের বিভিন্ন সময়ে আমি লিমা, মাদ্রিদ, প্যারিস এবং লন্ডনে থাকি। কিছুদিনের মধ্যে আবারও কোথাও চলে যাব। এভাবে আমার বাড়িঘর এক জায়গায় নির্দিষ্ট থাকে না কিন্তু আমার লেখার অভ্যাসটি বদলায়নি, বাধাপ্রাপ্তও হয়নি। একমাত্র লেখাই আমার জীবনের মহান স্থিতিশীলতা যা কখনও বদলাবে না। সবকিছুর পরেও আমার জীবনের সবচে বড় অপরিবর্তনীয়তা- আমার লেখা, কারণ আমি কখনওই লেখা বন্ধ করি না। লিমা ছেড়ে প্যারিস পৌঁছোবার পরের দিন লিমার অসমাপ্ত লেখাটি প্যারিসের লেখার টেবিলে লিখতে বসতে পারি, আর ঠিক একই ঘটনা ঘটে যখন আমি মাদ্রিদ হয়ে প্যারিস কিংবা লন্ডনে আসি, যেখানেই থাকি না কেন, পরের দিনই লিখতে বসতে পারি। প্রতিটি শহরে আমি এমন একটি লেখার টেবিল পাই যেখানে লেখার সমস্ত উপকরণ মজুদ থাকে- সিডি, ইনডেক্স কার্ড আর প্রয়োজনীয় বই; যেখানেই যাই না কেন এগুলি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারি। আমার রুটিন সবসময়ই এক : দিনের শুরুতে লিখতে বসে বিকেল পর্যন্ত একটানা লিখতে থাকি, অবিরত, এ আমার দীর্ঘদিনের নিয়ম, এই নিয়মের কখনও কোনও পরিবর্তন হয়নি। লেখালেখি ছাড়াও, একসময় আমাকে বেঁচে থাকবার জন্য বিভিন্ন কাজ করতে হয়েছে, সে আমার জীবনের ভিন্ন এক অধ্যায়; তারপর একসময় আসে যখন আমি আমার সমস্ত সময় লেখালেখির জন্য উৎসর্গ করি, একটা অপরিবর্তনীয় রুটিনও তখন তৈরি হয়ে যায়। দিনের শুরুর দিকে আমার লেখা সৃষ্টিশীল ধারায় প্রবাহিত হয়; নতুন লেখা লিখতে থাকি, অপরাহ্ণে সেই লেখায় কাটাকাটি, পুনর্পাঠ, পুনরূদ্ধার ইত্যাদি চলে, তারপর পরের দিন ঠিক কোথা থেকে শুরু করব, কী লিখব- এ সংক্রান্ত নোট লিখি। সৃষ্টিশীল কাজের এটাই ধারা। দিনশেষে কিছু গবেষণামূলক কাজ করতে হয়, সৃষ্টিশীল কাজকে যা সাহায্য করে।
প্রতিদিনের লেখালেখির রুটিনকে আমি কঠোরভাবে পালন করছি। রবিবার বাদে অন্য দিনগুলোতে নতুন বইয়ের কাজ করছি, রবিবারকে উৎসর্গ করছি আর্টিকেল লেখার জন্য। আসলে, লেখালেখির জন্য আমি আমার সময়কে উৎসর্গ করি বিভিন্নভাবে, মাসে কয়েকবার সংবাদপত্রে নিবন্ধ লেখার জন্যও সময় বের করতে হয়।
সাপাতা : একেবারে নির্দিষ্ট করে বললে ঠিক কোন বিন্দু থেকে আপনার লেখাটির যাত্রা শুরু হয়?
ইয়োসা : সাধারণভাবে বলতে গেলে, স্মৃতিই হচ্ছে সেই বিশেষ বিন্দু। আমার স্থির বিশ্বাস এপর্যন্ত যতগুলি গল্প আমি লিখেছি সবগুলিই এমন সব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে যে-অভিজ্ঞতাগুলি আমার স্মৃতিতে চিরন্তন, লেখায় এইসব স্মৃতি এক একটি ছবি হয়ে ওঠে, সেই ছবিকে চারপাশ থেকে ঘিরে থাকে একটি কাঠামো, সে-কাঠামোকে কল্পনার জন্য দরকার হয় ভাবনার উর্বর মাটি। আবার এটাও তো সত্য যে- গল্প লিখতে গিয়ে সবসময়ই আমি একটি রূপরেখা অনুসরণ করেছি, একেবারে প্রথম গল্পটি থেকেই, সেজন্য আমাকে অসংখ্য নোট নিতে হয়েছে, ইনডেক্স কার্ড তৈরি করেছি, লিখতে বসার আগে প্লটগুলির স্কেচ পর্যন্ত করেছি। লেখাটা শুরু করতে সক্ষম হওয়ার জন্য আমার একটি কাঠামো (স্ট্রাকচার) প্রয়োজন হয়, হয়তো অতি সাধারণ এক কাঠামো, গল্পটিকে এই কাঠামো দিয়ে ধরতে হয়। কাঠামো হয়ে গেলেই লেখাটা আমি শুরু করতে পারি। প্রথমেই আমি একটি খসড়া তৈরি করি; প্রথম খসড়াটিই কাজের সবচেয়ে জরুরি অংশ যাকে আমার কাছে লেখার সবচেয়ে কঠিন দিক বলে মনে হয়। যখনই প্রথম খসড়াটি হয়ে যায়, লেখাটি তখন থেকেই আনন্দদায়ক হয়ে উঠতে থাকে, তখন আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যায় কয়েক গুণ; মনেও শক্তি আসে, নির্ভার লাগে, কারণ আমি তখন জানি গল্পটা কোথায় কী অবস্থায় আছে। আমার সমস্ত লেখালেখির পেছনে এসবই অনড় নিয়ম, যেন এক ধ্রুব সত্য রচিত হচ্ছে- থিম, সিচুয়েশন ও টাইম পিরিয়ডকে ধরে ধরে, গল্পটি যে-সময়কে আশ্রয় করে বেড়ে উঠছে।
আমার বাড়িঘর এক জায়গায় নির্দিষ্ট থাকে না কিন্তু আমার লেখার অভ্যাসটি বদলায়নি, বাধাপ্রাপ্তও হয়নি। একমাত্র লেখাই আমার জীবনের মহান স্থিতিশীলতা যা কখনও বদলাবে না। সবকিছুর পরেও আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অপরিবর্তনীয়তা- আমার লেখা, কারণ আমি কখনওই লেখা বন্ধ করি না। লিমা ছেড়ে প্যারিস পৌঁছোবার পরের দিন লিমার অসমাপ্ত লেখাটি প্যারিসের লেখার টেবিলে লিখতে বসতে পারি।
সাপাতা : ফরাসি-পেরুভিয়ান বিপ্লবী, তাত্ত্বিক ও নারীবাদী ফ্লোরা ত্রিস্তান এবং পল গগ্যাঁর মধ্যকার বিষয়গুলিও আপনার উপন্যাসে এসেছে।
ইয়োসা : কোনও সন্দেহ নেই, ফ্লোরা ত্রিস্তান এবং পল গগ্যাঁর মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়গুলো আমার উপন্যাসে অবশ্যই এসেছে কেননা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের নিয়েই উপন্যাসটিতে কাজ হয়েছিল; যদিও আমি ‘ঐতিহাসিক পরিস্থিতি’ নিয়ে কাজটি করিনি, যে জায়গাটির কথা গল্পে ঘুরে ফিরে এসেছে আমি সেখানে বারবার গিয়েছি, দেখেছি, বিভিন্ন সাক্ষ্যপ্রমাণ পর্যালোচনা করেছি, সেই সময়ের পত্রিকাগুলি পড়েছি, কিন্তু কোনও ঐতিহাসিক সত্যকে পুনঃউৎপাদন করতে চাইনি; গল্প ও তার চরিত্রদেরকে সেই সময়ের আবহে নিয়ে যেতে চেয়েছি মাত্র। লেখার পর বারবার সংশোধন ও পুনর্লিখন করতে হয়েছে। হোসে এমিলিও পাচোকো এ সম্পর্কে একবার বলেছিলেন যা আমার লেখার একটি বিশেষ প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে, আমিও যা সঠিক বলে মেনে নিয়েছি- আমি যা করতে পছন্দ করি তা আসলে ‘লেখা’ নয়, পুনর্বিবেচনা, পুনর্পাঠ, পর্যালোচনা, সমালোচনা ইত্যাদি। এটাই পরম সত্য। যতটুক লিখিত হয়েছে তা যখনই সংশোধন করেছি, যখনই পর্যবেক্ষণ করেছি, লেখালেখির মতো একটা কাজকে ঠিক তখনই আমার উপভোগ্য বলে মনে হয়েছে।
সাপাতা : আর যখন আপনি উপন্যাসটি শেষ করলেন, পরে বই হয়ে বের হলো, তখন কি আরও একবার পড়ে দেখেন কোথাও কোনও সমস্যা কিংবা ত্রুটি… সন্ধান করতে…
ইয়োসা : না। শেষবার যখন পড়েছি তখন বইটি সংশোধনের জন্য মুদ্রিত প্রুফ কপি ছিল, পরে কিন্তু আমি আর চেষ্টা করি না পড়ার, যদি পড়াটা একান্তই জরুরি না হয়। কখনও কখনও অবশ্য তা করতে হয় যখন অনুবাদকদের সঙ্গে কাজ করি, তখন ভুল শোধরানো ও সঙ্গতিবিধানের প্রয়োজনে পুনর্পাঠে বাধ্য থাকি, কিন্তু সাধারণভাবে, যা ইতিমধ্যে লিখিত এবং প্রকাশিত তার ভেতরের পথ দিয়ে দ্বিতীয়বার ভ্রমণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
সাপাতা : হতে পারে পুরো বইটি পড়লেন না কিন্তু বিশেষ একটি জায়গা পড়ে মনে হলো এই অধ্যায়টি যদি আবার লিখতে পারতাম, ভ্যালেরি কিংবা হোয়ান রামোন হিমেনেথ যেমনটা করতেন; এখন করেন হোসে এমিলিও পাচোকো, যিনি তার প্রখর, উজ্জ্বল কবিতাগুলিকে ক্রমাগত সংশোধন, পরিমার্জন করতেই থাকেন।
ইয়োসা : অবশ্যই, কতবারই তো এরকম মনে হয়েছে! আমার ধারণা এরকম মনে হওয়ার পেছনের কারণটা হচ্ছে- কোনও লেখা একবার প্রকাশিত হয়ে গেলে সেই লেখাটি আমি পুনর্পাঠ করতে পছন্দ করি না। ঠিক যতবার আমি প্রকাশিত লেখাটি পড়েছি ঠিক ততবারই মনে হয়েছে এই লেখাটিকে আরও সময় দেওয়া যেত, লেখাটি লিখতে বড় বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছি।
সাপাতা : এবার আপনার প্রিয় বইগুলো সম্পর্কে বলুন।
ইয়োসা : আচ্ছা, তাহলে এবার প্রিয় বই নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। প্রিয় বইদের মধ্যে মাদাম বোভারি, এছাড়াও ফ্লবার্টের আরও কয়েকটি বই আছে পছন্দের তালিকায়; তারপর প্রচণ্ড উচ্ছ্বাসে ফকনারের ‘লাইট ইন অগাস্ট’ বইটি হাতে তুলে নেব, আর সম্ভবত তার ‘স্যাংচুয়ারি’; তারপর- মেলভিলের ‘মবি-ডিক’, টলস্টয়ের ‘যুদ্ধ ও শান্তি’, বালজাকের ‘সেন্সেস ফ্রম এ কোর্টসান লাইফ’; জয়েসের ‘ইউলিসিস’, সার্ভেন্তেসের ‘কিহোতে’; এবং ‘টাইরান্ট দ্য হোয়াইট’, এ-বইটি আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ উপন্যাসের সামগ্রিকতার ধারণাটি আমাকে এই বইটিই দিয়েছে, বইটি নিজেই একটি দুনিয়াকে তার ভেতরে ধারণ করে আছে। এখন এভাবে আমি শত শত বইয়ের নাম বলে যেতে পারব…
…..তারপর একসময় আসে যখন আমি আমার সমস্ত সময় লেখালেখির জন্য উৎসর্গ করি, একটা অপরিবর্তনীয় রুটিনও তখন তৈরি হয়ে যায়। দিনের শুরুর দিকে আমার লেখা সৃষ্টিশীল ধারায় প্রবাহিত হয়; নতুন লেখা লিখতে থাকি, অপরাহ্ণে সেই লেখায় কাটাকাটি, পুনর্পাঠ, পুনরূদ্ধার ইত্যাদি চলে, তারপর পরের দিন ঠিক কোথা থেকে শুরু করব, কী লিখব- এ সংক্রান্ত নোট লিখি। সৃষ্টিশীল কাজের এটাই ধারা। দিনশেষে কিছু গবেষণামূলক কাজ করতে হয়, সৃষ্টিশীল কাজকে যা সাহায্য করে।
সাপাতা : আপনি কবিতা পড়েন?
ইয়োসা : কবিতা তো অবশ্যই পড়ি। কবিতা পড়তে হয়। আমার প্রবণতা হচ্ছে সেই লেখকদের লেখা বারবার পড়া যারা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন, যাদের লেখা পাঠের ছাপ ভেতরে থেকে গেছে, তেমন একজন হলেন- রুবেন দারিও, প্রথম দিকে যাকে আমরা তেমন পড়িনি, আর এখন পর্যন্ত মনে করা হয় যে তিনি খাঁটি হিস্পানি কবিতার জনক, এক যাদুকর শিল্পী (দ্য ম্যাজিক্যাল মাস্টার)। নেরুদাকেও পড়তে হয়; বারবার পড়ার পরও আবার পড়ি। নেরুদাকে আমি আমার তরুণ বয়স থেকেই ভালবাসি, এবং অবশ্যই- শার্ল বোদল্যের, সম্ভবত সমস্ত কবির মধ্যে তাকেই সবচে বেশি শ্রদ্ধা করি। প্রিয় কবিদের মধ্যে অন্যতম আরেকজন-এলিয়ট, তাকে শুধু কবি হিসেবেই শ্রদ্ধা করি না, অসাধারণ প্রবন্ধগুলির জন্যও তিনি তাৎপর্যপূর্ণ।
সাপাতা : বোদল্যের আপনার ভেতর গভীর ছাপ ফেলেছেন, কবিরাও তাহলে কথাসাহিত্যিককে প্রভাবিত করতে পারেন!
ইয়োসা : হ্যাঁ, বোদলেয়ার, অবশ্যই তিনি আমার ভেতরে গভীর ছাপ ফেলতে পেরেছেন; তাছাড়া আরও যে-সমস্ত লেখককে পড়েছি, যারা আমার ভেতরে ছাপ ফেলেছেন, গভীরভাবে চিন্তা করতে উসকে দিয়েছেন তাদের সকলের দ্বারাই আমি প্রভাবিত হয়েছি; তারা আমার ঘুম ভাঙিয়েছেন, সংবেদনশীল করে তুলেছেন। কিন্তু কতদিন আর জোসেফ কনরাডের মতো লেখকের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারব? জানি না। কনরাড নিয়ে ভাবনার ব্যাপার আছে। অবশ্য আমি এখন কনরাডকে পুনর্পাঠ করছি, তিনি গুরুত্বপুর্ণ লেখক তো বটেই!
সাপাতা : তার কোন লেখাগুলি আবার পড়ছেন?
ইয়োসা : গত বছরও দ্বিতীয়বারের মতো ‘লর্ড জিম’ পড়েছি, আমার বিবেচনায় লেখাটি এক্সট্রাওর্ডিনারি এবং একটি মাস্টারপিস; অন্যদিকে, আমি যখন পুনর্বার ‘নস্ট্রোমো’ হাতে নিলাম তখন পাতার পর পাতা লাতিন আমেরিকার ক্লান্তিকর বিবরণ পড়তে আমার আর ইচ্ছা করল না… এই প্রথম কনরাডের কোনও উপন্যাস আমাকে দ্বিতীয় পাঠে হতাশ করল!
সাপাতা : হোসে মারিয়া আরগুয়েদাস সম্পর্কে আপনি কি এখন আগের মতো অনুভব করেন, যা ‘লা উইতোপিয়া আর্কাইকো’ বইটিতে ব্যক্ত করেছিলেন?
ইয়োসা : হ্যাঁ। আমি বিশ্বাস করি যে পেরুর সাহিত্যে আরগুয়েদাস ছিলেন সত্যিকার অর্থেই এক ক্ষণজন্মা লেখক, কারণ তার শিকড় প্রোথিত ছিল দু-দুটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে, দুটিকেই তিনি জানতেন, এবং গভীর অনুভবের সঙ্গে নিজের মধ্যে ধারণ করতে করতেন; ধারণ করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। নানামুখি অভিজ্ঞতায় প্রখর হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আর এই অভিজ্ঞতা পেরু সম্পর্কে তাকে এমন এক গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছিল, যে-অন্তর্দৃষ্টি পেরুর অন্য লেখকদের মধ্যে ছিল না। একই সঙ্গে দুটি জগতের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ তারা কেউই ছিলেন না! আমার মতে আরগুয়েদাস মহৎ একটি উপন্যাস লিখেছিলেন, লস রিওস প্রপন্দস (গভীর নদীগুলি), যে-উপন্যাসে তিনি দুই সংস্কৃতির অভিজ্ঞতাকে ঢেলে দিয়েছিলেন, ঐতিহাসিক ও সামাজিক বাস্তবতা থেকে স্বতঃপূর্ণ একটি জগত সৃষ্টি করেছিলেন যাতে ছিল ভাষার নিপুণ গাঁথুনি, শিল্প আর সংবেদন। আমি মনে করি না তিনি তার পরের রচনাগুলিতে এই কাজ আর করতে পেরেছেন, যদিও পরে তিনি চমৎকার কিছু গল্প লিখতে পেরেছিলেন। পরের উপন্যাসগুলিতে তিনি সাহিত্যিক কারণে ব্যর্থ হননি, ব্যর্থ হয়েছিলেন সমাজতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক কারণে, যেমনটি ‘এল সরো দে আরিরিভা দে আবাহো’র (ওপর ও নিচের শেয়ালগুলি) ক্ষেত্রে ঘটেছিল।
সাধারণভাবে বলতে গেলে, স্মৃতিই হচ্ছে সেই বিশেষ বিন্দু। আমার স্থির বিশ্বাস এপর্যন্ত যতগুলি গল্প আমি লিখেছি সবগুলিই এমন সব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে যে-অভিজ্ঞতাগুলি আমার স্মৃতিতে চিরন্তন, লেখায় এইসব স্মৃতি এক একটি ছবি হয়ে ওঠে, সেই ছবিকে চারপাশ থেকে ঘিরে থাকে একটি কাঠামো, সে-কাঠামোকে কল্পনার জন্য দরকার হয় ভাবনার উর্বর মাটি।
সাপাতা : একটি উপন্যাস তিনি শেষ করতে পারেননি….
ইয়োসা : একদম শেষ মুহূর্তে তিনি হাল ছেড়ে দিলেন, আর লিখলেন না; সমস্ত লেখার মধ্য দিয়ে তার লেখকসত্তার এমন এক বিকাশ ঘটেছিল, এমন এক শক্তিমান কথক তিনি হয়ে উঠেছিলেন যে পেরুর লেখকদের মধ্যে তার লেখাকেই আমি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে পড়েছি, এখনও পড়ছি; এমনও হয়েছে একই লেখাকে বারবার পড়েছি। আরগুয়েদাস শুধুমাত্র একজন লেখকই নন বরং পেরুর ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চেরও তিনি একজন অন্যতম সাক্ষী। পেরুর সমাজ কাঠামোর দ্বিধাবিভক্তিকে তিনি যেভাবে নিজের মতো করে দেখেছেন তা ছিল একেবারে খাঁটি ও বিশ্বাসযোগ্য।
সাপাতা : উপন্যাস ও আত্মজীবনী নিয়ে এবার কিছু কথা হোক। ‘অ্যান্ট জুলিয়া এন্ড দ্য স্ক্রিপ্টরাইটার’ কিংবা ‘দ্য স্টোরিটেলার’ উপন্যাসে আপনি নিজেই কি ছদ্মবেশী চরিত্রের প্রতিভাস তৈরি করেননি, যাকে ক্যামোফ্লেজও বলা যায়?
ইয়োসা : না। উপন্যাসে যদিও আমার নামে কাউকে কাউকে দেখা যায়, আবার কখনও কেউ আমার নিজের জীবনাভিজ্ঞতা থেকেই গড়ে ওঠে কিন্তু সে সর্বদাই বাস্তবের মানুষটি থেকেও অধিক বিচিত্র, তার বেঁচে থাকবার অভিজ্ঞতার কারণেই সে বিচিত্র; এ কারণেই আমার কোনও উপন্যাসই একাধারে আত্মজীবনীমূলক নয়, এমনকি ‘আন্ট জুলিয়া’ও নয় যাকে সবচেয়ে বেশিই আত্মজীবনীমূলক বলে মনে করা হয়, কিন্তু আমার জীবনের বিশিষ্ট কিছু মুহূর্ত থেকেই আমি অ্যান্ট জুলিয়াকে নিয়ে লিখেছি, এমনকি ওরগাতাসের গল্পেও, যিনি শুধুই একজন লেখক হয়ে থাকতে চেয়েছেন, সেখানে যতটা ব্যক্তিগত স্মৃতি তারচেয়েও অধিক হচ্ছে কল্পনা। আত্মজীবনী হচ্ছে সাহিত্যের সম্পদ, ‘স্টোরিটেলার’-এ একারণেই ক্যামোফ্ল্যাজ সৃষ্টি হয়েছে।
সাপাতা : কীভাবে এই রূপান্তরটা করতে পারেন যেখানে আপনি আত্মজীবনীকেই আখ্যানে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছেন?
ইয়োসা : জীবনস্মৃতির সত্যগুলি উপন্যাসে এসেছে এমনভাবে যেখানে তাদের কল্পিত রূপটিকেই ব্যবহার করা হয়েছে, কিংবা আপনি যেমনটি বলেছেন- আত্মজীবনীর মধ্যে যে সত্যগুলি থাকে সেই সত্যের রূপান্তরিত ছবি। শেষ পর্যন্ত সেই- ইমাজিনেশন। এখন, এই যে আপনি বলছেন সাহিত্যের একটি আত্মস্মৃতিমূলক উৎস আছে, তাহলে আমি বলব- আমিও বিশ্বাস করতে বাধ্য হই এ-ব্যাপারে যে–স্মৃতিই হচ্ছে আখ্যানের যাত্রা বিন্দু। ছবিগুলি স্মৃতি থেকেই আসে। ছবিগুলিকে আপনি নিজের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে বহন করছেন আর এসবই সেই প্রাথমিক উপাদান যা নিয়ে একজন লেখককে কাজ করতে হয়। এসব হচ্ছে সেই প্রাথমিক উপাদান যার মাধ্যমে আপনি একটি নতুন জগত তৈরির পথে যাত্রা শুরু করেছেন। আমার মনে হয় শুধু কথাসাহিত্যিকই নন, কবিও এই প্রক্রিয়ার বাইরে নন। কবিও স্মৃতি থেকে শুরু করেন, জীবনের কোনও এক প্রগাঢ় অভিজ্ঞতা, মানুষ কিংবা বাস্তবতা থেকেই কবিতা আসে যেন কবি বিস্মরণের বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই করছেন।
সাপাতা : এখন আপনার লেখার সমালোচনা প্রসঙ্গে আসা যাক। এক্ষেত্রে কার কার কথা আপনি উল্লেখ করবেন যারা আপনার লেখার প্রধান দিকগুলিকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিশ্লেষণ করেছেন?
ইয়োসা : ডেভিড গ্যালাগার ‘ক্যাথিড্রালে কথোপকথন’ নিয়ে এমন এক প্রবন্ধ লিখেছেন যা সত্যিকার অর্থেই আমাকে বিস্মিত করেছে। আমার মনে হয়েছে- উপন্যাসের কাঠামোয় যে-আইডিয়াটি ছিল তিনি সেটা দেখতে পেয়েছেন। তিনি বলছেন, উপন্যাসটি আমাদের দেখায়- ক্ষমতা অত্যন্ত নোংরা একটা ব্যাপার। উপন্যাসে ক্ষমতাকে যতবার ‘থিম’ হিসেবে দেখায়, ঠিক ততোবারই তার ভাষাশৈলী কদাকার হয়ে যায়। ডেভিড গ্যালাগার বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে দেখান- আখ্যানের রূপ এমন হয়েছে, সমাজে বা রাষ্ট্রে উপন্যাস যা করতে চায়; উপন্যাস কখনও তর্ককে উসকে দিতে চায়, অস্বস্তি তৈরি করে। ডিস্টার্ব করে। এদিকে, হোসে মিগেল ওবিয়েদো আমার লেখার স্ট্রাকচার ও টেকনিক সম্বন্ধে সিরিয়াস আলোচনা করেছেন, তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি, অনেক কিছু পরিষ্কার হয়েছে। তবে, এফ্রিয়ান ক্রিস্তালের বইটিই আমাকে সত্যিকার অর্থেই উন্মোচন করেছিল। আমাকে প্রভাবিত করেছে এরকম যতগুলো বইয়ের কথা আমি নানা সময়ে বলেছি তিনি সে-বইগুলোর প্রতিটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন, বইগুলি থেকে বহু ঘটনার উৎস ও ‘মডেল’ খুঁজে বের করে দেখিয়েছেন কীভাবে তারা আমার বইয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। আমাকে চমকে দেওয়া বইগুলির মধ্যে ক্রিস্তালের বইটি অন্যতম কেননা বইটি দেখিয়েছে কীভাবে আমি লিখেছি। কীভাবে উপন্যাসের কাঠামোট নির্মাণ করেছি।
আমিও যা সঠিক বলে মেনে নিয়েছি- আমি যা করতে পছন্দ করি তা আসলে ‘লেখা’ নয়, পুনর্বিবেচনা, পুনর্পাঠ, পর্যালোচনা, সমালোচনা ইত্যাদি। এটাই পরম সত্য। যতটুক লিখিত হয়েছে তা যখনই সংশোধন করেছি, যখনই পর্যবেক্ষণ করেছি, লেখালেখির মতো একটা কাজকে ঠিক তখনই আমার উপভোগ্য বলে মনে হয়েছে।
সাপাতা : পেরুর সেই কবিদের কথা বলুন যাদের কবিতাকে গভীর আগ্রহে পড়েছেন।
ইয়োসা : বাইয়েহো’র কবিতা নিয়ে আমার আগ্রহ সীমাহীন, তারপর আছেন সেসার মরো, শুরু থেকেই আমি যার মুগ্ধ পাঠক ছিলাম, যখন কেউই জানতেন না তিনি কে। ওন্দ্রে কোয়েনের মৃত্যুর পর তাকে পড়তে শুরু করলাম, নাটকীয় ভঙ্গিতে লেখা একটি প্রবন্ধের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। লেখাটি পড়ার পর আমি তার কবিতাগুলি খুঁজে, বের করে পড়েছি। কোয়েনের কিছু অপ্রকাশিত লেখা প্রকাশের জন্য আমি উদ্যোগও নিয়েছিলাম। পেরু’র কবিতার এক নিবেদিত, অনুগত ও উৎসাহী পাঠক ছিলাম আমি। কবি কার্লোস হেরমান বেইয়িকে নিয়ে আমি গদ্যও লিখেছি।
সাপাতা : কী লিখছেন এখন?
ইয়োসা : উপন্যাসই লিখছি, ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধেক লেখাও হয়ে গেছে। ভিক্টর হুগো’র ওপর বইটি শেষ করার পরই উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেছিলাম।
সাপাতা : এই উপন্যাসের বিষয় কী?
ইয়োসা : ছোটোগল্পের একটি সিরিজের মতো করে উপন্যাসটিকে গড়ে তুলছি। প্রতিটি অধ্যায় আসলে একটি স্বতন্ত্র গল্প যাকে আলাদাভাবে শুধু গল্প হিসেবে পাঠ করা যাবে, আর, একই সঙ্গে উপন্যাসের এক একটি চ্যাপ্টার হিসেবেও পড়তে অসুবিধা হবে না; মনে হবে- উপন্যাসটি প্রতিটি গল্পকে যেন অধ্যায়ের পর অধ্যায়ে একসূত্রে গেঁথেছে, যেন গল্পগুলি কিছুতেই আলাদা গল্প নয়। গল্প বিস্তৃত হয়েছে অধ্যায়ের পর অধ্যায়ে, সিরিজের প্রতিটি গল্পে এমনই এক ঐকতান তৈরি হয়েছে। এই সিরিজটি ভিন্ন ভিন্ন শহরে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ঘটা ঘটনাগুলির গল্প, যা প্রকৃতপক্ষে আমার বিভিন্ন শহরে থাকার অভিজ্ঞতার আলোকে গড়ে উঠেছে। শহরগুলোয় আমি বিভিন্ন সময়ে থেকেছি সত্য কিন্তু কাহিনীগুলি পুরোপুরি আত্মজীবনীমূলক নয়…
সাপাতা : উপন্যাসের নামও ঠিক করে ফেলেছেন?
ইয়োসা : হ্যাঁ, ‘ত্রাবেসুরাস দে লা নিয়্যা মা’লা’, পছন্দ হয়েছে?
সাপাতা : নামটি চমৎকার! পছন্দ হয়েছে। সম্ভবত এটা হতে চলেছে ইরোটিক-ডিসকোর্সের ওপর আপনার অবিচল পক্ষপাতের আরও একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ।
ইয়োসা : এটা আপাতকালীন নাম… অবশ্যই, যেখানে আমরা নিজেরাই…