অক্ষরবন্দী জীবন
বই ধার দিও না
সে এক স্বপ্নের জগত, সে এক মায়ার জগত এর পর থেকে-
আমার মনে হচ্ছে ‘বই ধার দিও না’ নামে কোনও বইয়ের মলাট আমি দেখেছিলাম; কিন্তু পড়া হয়নি সে বই। বই ধার করে করে ফেরত না দিয়ে কেউ কেউ একটা আস্ত লাইব্রেরিও গড়ে ফেলে – এ কথা তো এখন কিংবদন্তী! (পরে একজন মনে করিয়ে দিয়েছেন এই নামে বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস আছে)।
সারাটা জীবন ধরেই বই ধার করে আসছি, ধার দিয়ে আসছি তার চেয়ে বেশি! ফলাফল হিসেবে কিছু বই আমার র্যাকে রয়ে গেলেও র্যাক থেকে প্রস্থান করেছে সিংহভাগ।
শৈশবে বই ধার পেতাম শাহীনদের কাছ থেকে। সে এক বীররসে ভেজানো কাহিনি! ওরা ছুটি হলে সিরাজগঞ্জ যাবার সময় ওদের লাইসেন্স করা বন্দুকটা আমাদের বাসায় রেখে যেত, সাথে শাহীন আর লিটন ভাইয়ের কিছু গল্পের বই (যেমন- বাঙালীর হাসির গল্প, নেংটি ইঁদুরের গল্প, নীল পাতা) আমাকে ধার দিয়ে যেত। ছুটি শেষে ফেরার পথে বন্দুক আর বই একসাথে চলে যেত।
এই মাত্র আমার র্যাকটা রেকি করে এসে দেখলাম ধার করা বইয়ের মধ্যে বন্ধুবর রুমী আহমেদের কাছ থেকে ধার করা শক্তির ‘ভাত নেই, পাথর রয়েছে’ নামক একটা কৃশকায় কবিতার বই ছাড়া আমার তেমন কোনও অর্জন অবশিষ্ট নাই (শক্তির ভাষাতেই বলি- “লিখিও উহা ফেরত চাহ কীনা”)। দীর্ঘ কুড়ি বছর পর জিললুর ভাইয়ের কাছ থেকে ধার করা মাহমুদুল হকের ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’ ফেরত দিয়ে এসেছিলাম তিনি যখন হাঁটুর অপারেশনের জটিলতা নিয়ে এক পাঁচ তারকা হাসপাতালের শয্যায় সমাসীন ছিলেন। সাথে শাহাদুজ্জামানের ‘আমস্টারডামের ডায়েরি’টা ধার হিসেবে দিয়েছিলাম, সম্ভবত উনি সেটাকে উপহার-জ্ঞানে এস্তেমাল করেছেন!
ক্লাশ টেন-এ সুকান্ত খুব টানত, এমন দিনে ‘সুকান্ত বিচিত্রা’ নামে একটা বর্নাঢ্য, মনোরম বই দেখি ছোট খালুর বাসায়। ধার নিতে আর বিলম্ব করিনি, চোরাই মালের মতো রেখেও দিয়েছিলাম নিজের কাছে; কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সেই বইয়ের সূত্র ধরে সুকান্ত আর তাঁর বন্ধু অরুনের চিঠির ভাষায় প্রভাবিত হয়ে (যেমন প্রভূত আনন্দদায়কেষু, আশানুরুপেষু ইত্যাদি সম্বোধন) কবিবন্ধু উবাইদুল্লাহর সাথে পত্রালাপ করতাম।
ক্লাশ টেন-এ সুকান্ত খুব টানত, এমন দিনে ‘সুকান্ত বিচিত্রা’ নামে একটা বর্নাঢ্য, মনোরম বই দেখি ছোট খালুর বাসায়। ধার নিতে আর বিলম্ব করিনি, চোরাই মালের মতো রেখেও দিয়েছিলাম নিজের কাছে; কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সেই বইয়ের সূত্র ধরে সুকান্ত আর তাঁর বন্ধু অরুনের চিঠির ভাষায় প্রভাবিত হয়ে (যেমন প্রভূত আনন্দদায়কেষু, আশানুরুপেষু ইত্যাদি সম্বোধন) কবিবন্ধু উবাইদুল্লাহর সাথে পত্রালাপ করতাম। আরেক শিকদার বংশীয় খালুর বাসা ভর্তি ছিল সিরাজ শিকদারের রচনাবলী; ধার নিতে আগ্রহ পাইনি কখনো।
ময়মনসিংহের চাকুরিজীবনে শ্বশুর সাহেবের কাছ থেকে বই ধার নিয়ে যেতাম, আবার ফেরত দিয়ে নতুন করে ধার নিতাম। এইভাবে পড়া হয়েছে টলস্টয়ের ‘পুনরুজ্জীবন’(রেজারেকশন), অবধূতের ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, সঞ্জীবচন্দ্রের ‘পালামৌ’, নজরুলের গল্প সংকলন, মোরারজী দেশাইয়ের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে লেখা বই। সবগুলো বইই কঠিন সময়ের উত্তম সঙ্গী বলে বিবেচনা করি। আমার ভাগ্নী চৈতি–অর্চিদের সংগ্রহ থেকে পড়েছি শীর্ষেন্দুর কয়েকটা নভেলা, ‘বাদশাহ নামদার’ সহ হুমায়ূন আহমদের কিছু উপন্যাস। ওদের বাসায় বসে কৃশকায়গুলো শেষ করতাম আর ধার করে ফিরতাম গুন্টার গ্রাসের ‘টিন ড্রাম’, শাহীন আখতারের ‘তালাশ’ কিংবা ‘আনা কারেনিনা’।
বই ধার দেয়া-নেয়াটা অবশ্য বন্ধুদের সাথেই ঘটেছে বেশি। স্কুলজীবনে কারো কাছে বই ধার চাইতে সঙ্কোচ বোধ করতাম; কিন্তু যেদিন থেকে সেটা দেয়া-নেয়ায় উন্নীত হতে থাকল, তখন সঙ্কোচ গেল ঘুচে। কলেজ জীবনে বন্ধু সোহেলের কাছ থেকে ধার করে পড়েছি রফিক আজাদের কবিতা সংগ্রহ; সাফায়েতের সাথে কতো বই বিনিময় হয়েছে তাঁর ইয়ত্তা নাই। তবে ও আমাকে দেশ পত্রিকার সুবর্ণ জয়ন্তী কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ সঙ্কলনগুলো ধার দিতে পারেনি, কেননা বইগুলো ছিল ওর বোনের। জয় গোস্বামীর ‘ঘুমিয়েছ, ঝাউপাতা’ বের হওয়ামাত্র তিতাসের বাসায় দেখে পড়ার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। ওর বাবা মমতাজ উদদীন আহমেদের ব্যক্তিগত সংগ্রহের বই বলে ধার না পাওয়ার বেদনা নিয়ে ফিরে আসছিলাম সেই ঈদের দিন- কিন্তু বন্ধু আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ঠিক দুদিনের জন্য ধার দিয়েছিল। অবশ্য আমার একটা রাতই যথেষ্ট ছিল জয়ের নবধারাজলে ‘স্নান’ সমাপন করতে!
ধার দেয়ার ব্যপারে আমি বেশ মুক্তহস্ত। কিন্তু যে সব বন্ধু বাসায় খুব কম আসতো, কিংবা হঠাত করেই আসত, তাদের কেউ কোনও একটা বই পছন্দ করে ফেললে প্রমাদ গুনতাম, কিন্তু অবলীলায় ধার না দিয়েও পারতাম না। ভাবতাম আমি পড়ে যে আনন্দটা পেয়েছি, অন্যেরাও সেই আনন্দটুকু পাক- আড্ডায় যখন বইটা নিয়ে কথা উঠবে তখন তা হবে আরও আনন্দের!
ধার দেয়ার ব্যপারে আমি বেশ মুক্তহস্ত। কিন্তু যে সব বন্ধু বাসায় খুব কম আসতো, কিংবা হঠাত করেই আসত, তাদের কেউ কোনও একটা বই পছন্দ করে ফেললে প্রমাদ গুনতাম, কিন্তু অবলীলায় ধার না দিয়েও পারতাম না। ভাবতাম আমি পড়ে যে আনন্দটা পেয়েছি, অন্যেরাও সেই আনন্দটুকু পাক- আড্ডায় যখন বইটা নিয়ে কথা উঠবে তখন তা হবে আরও আনন্দের! শঙ্কর আর হুমায়ূন আহমদের অনেক বইই সংগ্রহে ছিল, কিন্তু রয়ে গেছে কেবল ‘জন অরণ্য’ আর ‘অন্যদিন’। কলেজ জীবনে ইমদাদুল হক মিলনের ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ নামের একটা বই ছিল হটকেক! টিভিতে ফরিদী-সুবর্ণা ওই কাহিনির নাটকে অভিনয় করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। সেই বইতে এবং নাটকেও ডব্লু এইচ অডেনের সেই অমোঘ বাণীটি ছিল নায়কের মুখে– `উই শ্যাল লাভ ইচ আদার অর ডাই’– সেই বই ধার দিয়ে না হারিয়ে কী আর উপায় ছিল! আমি নিজেও বেশ প্রভাবিত হয়ে লিখেছিলাম– “ভালবাসব দুজন মোরা/ বলবে সবে কেমন জোড়া!/ নয়তো দেব গলায় ফাঁস/ দেখবে সবে যুগল লাশ!”
ধার করে পড়েছিলাম ভূমেন্দ্র গুহের আলেখ্য জীবনানন্দ। মেডিকেল কলেজের ছাত্র ভূমেন্দ্র গুহ ও তাঁর বন্ধুদের ইচ্ছে ছিল জীবনানন্দ দাশের কাছ থেকে একটি কবিতা নিয়ে তাঁদের নতুন পত্রিকা ‘ময়ূখ’-এ প্রকাশ করবেন। কবির সাক্ষাৎ পেলেও তার কঠিন খোলশ অতিক্রম করা কঠিন ছিল। দিনের পর দিন তাঁরা সঙ্গী হলেন কবির বৈকালিক ভ্রমণে। কবিকে তাঁরা বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন যে তাঁকে সামনে রেখেই ময়ুখের যাত্রা শুরু হবে। ভূমেনরা রবার্ট ব্রুসের ধৈর্য নিয়ে কবির নৈকট্য লাভ করেন, নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হতে থাকে; কিন্তু সেই কবিতা আর পাওয়া হয় না। শেষাবধি কবি চলেই গেলেন। তখন জীবনানন্দের প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা মাত্র ২৭০ টি। ভূমেন ও তাঁর বন্ধুরা হাসপাতালে কবির জন্য অনেক খেটেছিলেন। শেষাবধি ময়ুখ বের হল কবির স্মৃতি নিয়ে। কালক্রমে কবির পাণ্ডুলিপি বোঝাই ট্রাঙ্কগুলো পুনর্লিখন করে, সম্পাদনা করে জনসমক্ষে আনার গৌরবময় কাজটিও ভূমেন্দ্র গুহেরই করা। বিখ্যাত এই ট্রাঙ্কগুলো নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিল। কে জানে কবির কী ইচ্ছে ছিল- তাঁর অপ্রকাশিত লেখাগুলো অপ্রকাশিতই থাকুক কিংবা পৃথিবীর পথে বেরিয়ে পড়ুক তাঁর মৃত্যুর পর! সেকালে গল্প উপন্যাসের অর্থমূল্য থাকলেও কবি যথেষ্ট অর্থকষ্টের মাঝেও লেখাগুলো লুকিয়েই রেখেছিলেন বলে কবির অভিপ্রায় নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। কবির ছিল অপ্রকাশিত ২০টি উপন্যাস আর ১২২ টি ছোটগল্প। আর সেই ২৭০টি কবিতা এখন প্রায় দশগুণ! কক্সবাজার সফরে গিয়ে বইটা কবি কালাম আজাদের কাছ থেকে ধার করে পড়েছিলাম হোটেলে শুয়ে-বসে। ফেরার দিন দুপুরবেলা একমাথা রোদ নিয়ে কবি গাড়ি যাবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল বইটা ফেরত নেয়ার জন্যে!
হোস্টেল জীবনে বই ধার দেয়ার ধারণাটা ছিল ভিন্ন। হোস্টেলের বন্ধু-অবন্ধু সকলের বইয়ের সংগ্রহ ছিল যৌথ খামারের মতো। একটা সমরেশ বা শীর্ষেন্দু লাইসিয়াম বা কারেন্ট বুক সেন্টার থেকে হোস্টেলে ঢুকবে, হাত আর রুম ঘুরতে ঘুরতে এক সময় লেডিজ হোস্টেলে যাবে, ফিরবে কী ফিরবে না জানা ছিল না! আমার ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘যাও পাখি’, ‘নিশি কুটুম্ব’ ইত্যাকার সমৃদ্ধ সংগ্রহ বন্ধুদের মারফত লেডিজ হোস্টেলে গিয়ে পথ হারিয়েছিল।