জসীম উদ্দীনের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা
কবি জসীম উদ্দীন-এর পাঠক সংখ্যা যেমন অনির্ধারিত, তেমনি বর্ধিষ্ণু। তাঁর পাঠকেরা তাঁকে পল্লীকবি হিসেবেই চিনে আসছেন। কিন্তু যারা অতি আগ্রহের সাথে বিস্তারিতভাবে কবিকে জানতে চেয়েছেন–তারা নিঃসন্দেহে লক্ষ্য করেছেন যে, কবি শুধু কবিতাই লেখেননি, একদিকে কবি সাহিত্যিকদের অনুকূলে পারিপার্শ্বিকতা সৃষ্টি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন আর অন্যদিকে সমাজকে কলুষতা ও শোষণমুক্ত রাখতে দিয়েছেন নতুন পথের সন্ধান। লেখকদের নিয়ে পাঠকবৃন্দের সচেতনতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে ‘আরো বই পড়ুন’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “আপনারা বই কিনলে আরো কী হবে জানেন, দেশের লেখকেরা বই বিক্রি থেকে পয়সা পাবেন। দেশে একদল স্বাধীন মতের লেখক তৈরি হবে। তখন তারা যা ভাববেন তাই লিখতে পারবেন। দুর্বলের হয়ে, নিপীড়িতের হয়ে লড়াই করতে পারবেন। আপনাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার আদর্শবাদের তারা রূপ দিতে পারবেন। দেশের অধিকাংশ লেখককে যদি জীবিকার জন্য কোন সরকারের চাকরি করতে হয় তবে সেই সরকার কোন অবিচার করলেও লেখক সোচ্চার হতে পারে না। লেখক স্বাবলম্বী হলে সে তো আপনারই লাভ। সরকারের সমালোচনা করে আপনাকে তবে জেলে যেতে হবে না। লেখকের বইগুলি সেই কাজ করবে। রুশো, ভলতেয়ারের লেখাগুলো তাদের দেশে মহাপরিবর্তন এনেছিলো।”
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন নিজের দেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সভায়, বিশ্ববিদ্যালয় সেমিনারে, বেতারে, টিভিতে এ ধরনের সচেতনতামূলক বক্তব্য রাখতেন। সামাজিক ও জাতীয় বিষয় নিয়ে তিনি মতবিনিময় করেছন মার্শাল টিটো, পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু, চৌ এন-লাই, আইয়ুব খান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কমরেড মনি সিং, সাংবাদিক খুশওয়ান্ত সিং, লেখক কুদরত উল্লাহ সাহেবসহ বিশ্বের অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে। এছাড়া যুবক বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, অমরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশ চন্দ্র সেন, নন্দলাল বসু, জয়নুল আবেদীন, আব্বাসউদ্দীন, উদয় শংকর প্রমুখের সাথে তাঁর ছিল যোগাযোগ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ভাব আদান-প্রদানের বিশেষ ক্ষেত্র।
তিনি ছিলেন সামগ্রিক বাংলাসাহিত্যে এক বিস্ময়কর কবি। তাঁর সৃষ্টিকর্মের স্বভাব ও মেজাজ সমসাময়িক কালের অন্য কবিদের থেকে তাঁকে করেছে স্বতন্ত্র, স্বাধীন এবং বিচিত্র বিভায় আলোকিত। তাঁর লেখা আমাদের এক অলৌকিক গ্রামবাংলার দিকে ধাবিত করে এবং নিয়ে যায় মাটি ও মানুষের খুব কাছাকাছি। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের বিশালত্বের বলয় থেকে বেরিয়ে জসীম উদ্দীন এক নতুন ঘরানার জন্ম দিয়েছেন বাংলা কবিতায়। কিন্তু এই দুজনের দেশাত্ববোধ দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক সচেতনতার চেয়ে জসীম উদ্দীনের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক সচেতনতা কোন অংশেই কম ছিল না। তাঁকে পল্লীকবি মাটি ও মানুষের কবি গ্রামবাংলার কবি, আবার অনেকে গেঁও কবিও বলে থাকেন। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ও দেশাত্মবোধ নিয়ে তেমন ভাবে কেউ আলোচনা-সমালোচনা করেছেন বলে আমার নজরে আসেনি। এই নিবন্ধে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ও দেশাত্মবোধ তুলে ধরার প্রয়াস মাত্র।
‘আরো বই পড়ুন’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “আপনারা বই কিনলে আরো কী হবে জানেন, দেশের লেখকেরা বই বিক্রি থেকে পয়সা পাবেন। দেশে একদল স্বাধীন মতের লেখক তৈরি হবে। তখন তারা যা ভাববেন তাই লিখতে পারবেন। দুর্বলের হয়ে, নিপীড়িতের হয়ে লড়াই করতে পারবেন। আপনাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার আদর্শবাদের তারা রূপ দিতে পারবেন। দেশের অধিকাংশ লেখককে যদি জীবিকার জন্য কোন সরকারের চাকরি করতে হয় তবে সেই সরকার কোন অবিচার করলেও লেখক সোচ্চার হতে পারে না।…’
কবি জসীম উদ্দীন বাঙালির গৌরব, বাঙালির অহংকার। তিনি বলেছেন-“আমি সারাজীবন আমার দেশের জনগণকে লইয়া সাহিত্য করিয়াছি, তাহাদের সুখ-দুঃখ-স্নেহ-মমতা-ভালবাসা লইয়া কবিতা লিখিয়াছি, নাটক লিখিয়াছি, উপন্যাস লিখিয়াছি।” সাহিত্যে এ দেশের সাধারণ মানুষের সাথে তিনি একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। মানুষের জীবন ও সংগ্রাম থেকে নিজেকে তিনি বিচ্ছিন্ন করেননি। কেবল সাহিত্যে নয় ব্যক্তি জীবনেও তিনি ছিলেন দেশবাসীর এক আপনজন। তাঁর মধ্যে চিন্তা-চেতনা ছিল সুগভীর এবং কল্যাণমুখী। অনাকাঙ্খিত এবং গণবিরোধী শক্তিকে কবি আমৃত্য ঘৃণা করেছেন মনে-প্রাণে। প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতি তাঁর বিরূপ অভিব্যক্তি সাহিত্যকর্মে প্রকটভাবে প্রকাশিত না হলেও ব্যক্তি জীবনে তাঁর কমতি ছিল না।
কবি শিশুকালে সংসার বিরাগী হতে চেয়েছিলেন। স্বদেশী হয়ে দেশে ঘুরে বেড়ানোর প্রবল ইচ্ছা পোষণ করেছেন। তিনি বলেছেন-“বন্দে মাতরম’ ধ্বনি শুনিলে আমার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে আমার আর পড়াশুনা করতে ইচ্ছা করে না। তাঁর মনের গহনে ছোটবেলা থেকে রাজনৈতিক ভাবনার জন্য একটি পিঁড়ি আসন ছিল। তবে রাজনীতিকে তিনি জীবনের সিংহাসনে উপবিষ্ট করাননি। তবুও ব্যক্তিজীবনে রাজনীতি থেকে খুব বেশী দূরে বা বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। এক সময় কংগ্রেস অফিসের সাময়িক স্বেচ্ছাসেবক হয়ে তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে করতে কবি কলকাতায় উপস্থিত হন তরুণ অবস্থায়।
১৯২৫ সালে ফরিদপুরে অলবেঙ্গল কংগ্রেস কনফারেন্স, অলবেঙ্গল স্টুডেন্ট কংগ্রেস কনফারেন্স এবং অলবেঙ্গল মুসলিম কংগ্রেস কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে উভয় বাংলার বৃটিশ বিরোধী নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। প্রথমদিনে বঙ্গীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের (১৮৭০-১৯২৫) সভাপতিত্বে বক্তৃতা করেন মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮), নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু (১৮৯৭-১৯৪৫), সরোজিনী নাইডু (১৮৭৯-১৯৪৯), মওলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-১৯৫৮) প্রমুখ। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ওই সম্মেলনে যোগ দিয়ে তাঁর সব বিখ্যাত শেকল ভাঙ্গার গান ও কবিতা শোনান। কবি জসীম উদ্দীন দুইদিনব্যাপী এই সম্মেলনে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেন। নজরুল বামপন্থী একজন নেতাসহ চারজনের একটি দল নিয়ে জসীম উদ্দীনের বাড়িতে ওঠেন। রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার ধারা ও তাঁর দেশপ্রেম সম্পর্কে আমরা তাঁর তরুণ বয়সের একটি উদাহরণ এখান থেকে পাই।
১৯২৬ সনে ভারতীয় কেন্দ্রীয় আইনসভা নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে নজরুল ফরিদপুরে এসে সরাসরি জসীম উদ্দীনের বাড়িতে ওঠেন। ‘স্বরাজ’ পার্টির প্রার্থী হয়ে তিনি নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচনী এলাকা ছিল ঢাকা-ফদিরপুর-বরিশাল-ময়মনসিংহ। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন–বরিশালের জমিদার মুহম্মদ ইসমাইল চৌধুরী, টাঙ্গাইলের জমিদার আবদুল হামিদ গজনভী, ঢাকার নবাব বাড়ির আব্দুল করিম ও মফিজ উদ্দিন আহমেদ। ঐ নির্বাচনেই তমিজউদ্দিন খান সে বছর ‘বঙ্গীয় নিম্ন আইন পরিষদ’ আসনে গোয়ালন্দ মহকুমা ও ফরিদপুর সদর মহকুমা এলাকা নিয়ে গঠিত মুসলিম লীগ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ফরিদপুরের জমিদার স্বরাজ পার্টির চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেন লাল মিয়ার বিপরীতে। নজরুলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ, মৌলবী তমিজউদ্দিন খানের সাথে সাক্ষাৎ, পীর বাদশাহ মিয়ার সান্নিধ্য সহানুভূতি লাভ, জমিদার লাল মিয়ার পৃষ্ঠাপোষকতা পাওয়া এমন সকল কাজেই তার সহযোগী চিলেন কবি জসীম উদ্দীন। যদিও নজরুল ইতোমধ্যেই গোঁড়া মুসলিম ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দেওয়া ‘কাফের’ ফতোয়া কাঁধে নিয়েই নির্বাচনেও সমাজে চলাফেরা করেছেন।
জসীম উদ্দীনের কবিতা পাঠে এ কথা আমরা জানতে পারি, প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির কোন কথাই তাতে নেই–তবুও একটি বিশেষ রাজনৈতিক পটভূমি তাঁর পিছনেও অলক্ষ্যে কাজ করেছে। কবির কাব্য প্রচেষ্টা শুরু ১৯২০ শতকে। তার ‘রাখালী’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সনে। ‘কবর’ কবিতা প্রকাশিত হয় আরো পূর্বে। সমগ্র এশিয়াব্যাপী তখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শিখা ধুমায়িত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এশিয়া তথা ভারতের প্রত্যেকটি দেশ তখন জাতীয় ইতিহাস কৃষ্টি খুঁজে বের করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। পারস্যের রেজা শাহ পাহলভী, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, আফগানিস্তানের আমির আমানুল্লাহর নেতৃত্বে স্বাধীন সত্ত্বার বিমূঢ় স্বাদ পাওয়া শুরু হয়েছে। ভারতে, বাংলামুল্লুকেও এর প্রভাব বিস্তার ঘটে। কবি এই প্রভাব মোটেই মুক্ত ছিলেন না।
জসীম উদ্দীনের ছাত্রজীবনী থেকে জানা যায়, তিনি প্রত্যক্ষভাবে অসহযোগ আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। কিন্তু তাঁর কবিপ্রাণ চরকা এবং আশ্রমে তৃপ্ত হলো না। তিনি মানুষের জয়গান গেয়ে কাব্য রচনা করলেন। মানুষের মাঝেই তিনি বাঁচতে চেয়েছেন, বৈরাগ্যময় জীবনে নয়। Whether People for the state or the state for the People এই প্রশ্নে কবি ছিলেন অতি পরিস্কার। সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ কবি জবাব দিয়েছেন জনগণই শেষ কথা।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে এসে Back to Village আন্দোলন শুরু করেন। স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার, বিদেশী দ্রব্য বর্জন এবং অসহযোগ আন্দোলন কবিকে প্রভাবান্বিত করে। Back to Village আন্দোলনের প্রভাবেই তিনি আপনজন গ্রামের চাষী, কুলি, মজুর এবং শোষিত মানুষের জীবন কাহিনী ভিত্তিক কাব্য রচনায় উদ্যোগী হন। সাহিত্য অঙ্গনে উপেক্ষিত পল্লীবাসীকে উপজীব্য করে শিক্ষিত সমাজে দক্ষ-হাতে উপস্থাপন করেন।
জসীম উদ্দীনের ছাত্রজীবনী থেকে জানা যায়, তিনি প্রত্যক্ষভাবে অসহযোগ আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। কিন্তু তাঁর কবিপ্রাণ চরকা এবং আশ্রমে তৃপ্ত হলো না। তিনি মানুষের জয়গান গেয়ে কাব্য রচনা করলেন। মানুষের মাঝেই তিনি বাঁচতে চেয়েছেন, বৈরাগ্যময় জীবনে নয়। Whether People for the state or the state for the People এই প্রশ্নে কবি ছিলেন অতি পরিস্কার। সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ কবি জবাব দিয়েছেন জনগণই শেষ কথা। দেশ-বিভাগ হয়ে পূর্ব পাকিস্তান পত্তন হওয়া লগ্নকাল থেকেই কবি সকল শ্রেণীর মানুষের চরাচরে বিচরণ করতে থাকেন। তিনি উপলব্ধি করলেন মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা রাষ্টীয় স্বীকৃতি বিহনে বাঙালী তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না, হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অপসংস্কৃতির কৃষ্ণসাগরে ডুবে যাবে। কবি ভাষার প্রশ্নে ছিলেন আপোষহীন। সাহিত্য সভায়, পত্র-পত্রিকায় নিজের লেখায় ও বিবৃতিতে তার মনোভাব সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। ১৯৫০ সালে একজন সরকারি চাকুরিজীবীর পক্ষে শাসকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ একমাত্র কবি জসীম উদ্দীনের মধ্যেই উদ্ভাসিত হয়েছে।
Earnet Tollar বলেছেন-“Benith the yoke of barbarism one must not keep silence. One must fight. অনেকেই যখন শাসকদের ক্ষমতার আফিম এর মোহে তন্দ্রামগ্ন সে সময় কবি হয়ে উঠেন সোচ্চার। কবি ভাষার প্রশ্নে হলেন একজন সংগ্রামী সৈনিক। ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার ভাষা সৈনিক ছাত্র-জনতা বুকে শাসকদের বুলেটে ছিন্ন হলো। রক্তে লাল হলো ঢাকার রাজপথ। কবির মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠলো। ঢাকার ইডেন বিল্ডিং (বর্তমান সচিবালয়) এর কর্মচারীদের কক্ষে কক্ষে যেয়ে চিৎকার করে বললেন-“আমাদের ভাইয়েরা ভাষার জন্য প্রাণ দিচ্ছে আর আপনারা চেয়ারে বসে আছেন? আপনারা সবাই বেড়িয়ে আসুন।” সেক্রেটারীয়েটের সকল কর্মচারীদের নিয়ে তিনি মিছিল করলেন, শ্লোগান দিলেন খুনী সরকারের বিরুদ্ধে।
কবি মনে প্রাণে ছিলেন প্রগতিশীল। প্রগতিশীল চিন্তার শুধু ধারকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ বাহক। রাজনৈতিক সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত না হয়েও প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডে তাঁর উপস্থিতি ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পল্লীকবি নিজেই বলেছেন- “তাহাদের (গ্রামবাসীদের) দুঃখ ও শোষণ পীড়নের কাহিনী বলিয়া শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সহানুভূতি জাগাইতে চেষ্টা করি। আর চাই, যারা দেশের এই অগণিত জনগণকে তাহাদের মুখের আহার কাড়িয়া লইয়া তাহাদিগকে দারিদ্রের নির্বাসনে ফেলিয়া রাখে, তাহাদের (শাসকদের) বিরুদ্ধে দেশের শিক্ষিত সমাজের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাইতে।”
১৯৬৫ সনের ঘটনা। শাসক চক্রের চক্রান্তে এ দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করা হয়। নিরীহ দরিদ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নেমে আসে অনাকাঙ্খিত সাম্প্রদায়িক চক্রের বিষাক্ত ছোবল। বহু লোক হয় হতাহত। আগুন লাগিয়ে দরিদ্র হিন্দুদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয় ঢাকা নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে। জাতির এই দুঃসময়ে কবি সোচ্চার হলেন, ঝাঁপিয়ে পড়লেন দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে। ‘বাঙালী রুখিয়া দাঁড়াও’ ডাক দিলেন সাহসী বাঙালীদের। নিজে সংগঠিত করলেন শান্তি মিছিল। শান্তি মিছিল নিয়ে পরিভ্রমণ করলেন দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকাসমূহ।
‘যে দেশে মানুষ বড়’ গ্রন্থটি তিনি কমিউনিষ্ট নেতা মনি সিংকে উৎসর্গ করেন। কবিতায় উৎসর্গ লিপিতে বলেছেন:
“তুচ্ছ করেছ রাজপ্রাসাদের মণিমানিক্যের শোভা,
তুচ্ছ করেছ বন্ধুস্বজনের পরিজন মনোলোভা।
তুচ্ছ করেছ রাজভয় আর শাসন ত্রাস না জ্বালা,
কণ্ঠে পরেছ শত শোষিতের জীর্ণ হারের মালা।
চির অমানিশ নিকষ নিশিকর মহা কণ্টক পথ,
চারিদিকে তব ভয়াল বিশাল বাঁধা ঘেরা পর্বত;
তুচ্ছ করিয়া চলেছো একাকী যে বা শক্তির বলে
তাহারি স্মরণে এই উপহার সপিলাম করতলে”।
তাঁর এই উপহার ছিল শোষিত মানুষের মুক্তি আন্দোলনের সপক্ষে, নির্যাতিত মানুষকে সংগ্রামী করে তোলার লক্ষ্যে। অবসর গ্রহণের পর ন্যাপ মোজাফ্ফর দলে যোগদান কবির অভিপ্রায় ছিল। ন্যাপের কয়েকটি অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিয়েছেন। ১৯৭০ সনের নির্বাচনে ন্যাপ তাঁকে ফরিদপুর সদর আসনে মনোনয়ন দিয়েছিল। কিন্তু তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। পরবর্তী সময়ে তিনি দেশের মহৎ প্রাণ নেতা বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে আসায় তার রাজনৈতিক দলীয় মতবাদের পরিবর্তন ঘটে। সাংগঠনিক ভাবে না হলেও লেখায় ও কথায় তিনি বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হয়ে উঠেন।
কবি মনে প্রাণে ছিলেন প্রগতিশীল। প্রগতিশীল চিন্তার শুধু ধারকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ বাহক। রাজনৈতিক সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত না হয়েও প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডে তাঁর উপস্থিতি ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পল্লীকবি নিজেই বলেছেন- “তাহাদের (গ্রামবাসীদের) দুঃখ ও শোষণ পীড়নের কাহিনী বলিয়া শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সহানুভূতি জাগাইতে চেষ্টা করি। আর চাই, যারা দেশের এই অগণিত জনগণকে তাহাদের মুখের আহার কাড়িয়া লইয়া তাহাদিগকে দারিদ্রের নির্বাসনে ফেলিয়া রাখে, তাহাদের (শাসকদের) বিরুদ্ধে দেশের শিক্ষিত সমাজের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাইতে।”
স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তুজম্বর আলী ছদ্মনামে বলিষ্ঠ বক্তব্য নিয়ে কিছু কবিতা লেখেন। মুক্তিযুদ্ধের উপরে রচিত এই কবিতা আমেরিকায় মেয়ে হাসনা মওদুদের নিকট পাঠিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। ভারতে কবিতাগুলো প্রকাশিত হলে বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিক মুলুকরাজ আনন্দসহ বহুলোক তাঁর সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। ২৭শে মার্চ ১৯৭১ রক্ত-ঝরা দিনে কবি লিখেছেন:
বিশ্ববাসীরা শোন,
মোদের কাহিনী শুনিয়া কাঁদিবে নাই কি দরদী কেহ?
দস্যু সেনারা মারণ-অস্ত্রে বধি ছেলেদের তার
সোনার বাংলা বিস্তৃত এক শ্মশান কারাগার।
প্লাবনের চেয়ে-মারিভয় চেয়ে শতগুণ ভয়াবহ
নরঘাতীদের লেলিয়া দিতেছে ইয়াহিয়া অহরহ।
প্রতি মুহূর্তে শিশু মরিছে মার কোলে বুলেটের ঘায়
প্রতি মুহূর্তে শত শত অসহায় দলিত দস্যুর পায়।
মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর আর একটি কবিতায় ফরিদপুর জেলায় পাক-বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের কাহিনী তুলে ধরেছেন।
গোয়ালন্দের ঘাট হতে গেছে খানখানাপুরে আর,
রাজবাড়ী যেয়ে রাজার বিপণী পুড়ায়েছে একাকার।
ফরিদপুর শহর হতে কামান গোলার ঘায়
জগদ্বন্ধুর আশ্রমখানি দাঁড়ায় ভগ্নকায়।
তারপর করে মিউনিসিপিলির বাজার ভস্মময়
ধর্ম ধ্বজী সংহতিকারী সেনারা লভেছে জয়।
ফরিদপুরের শহর হতে ভাংগা করিয়া নাশ
ট্যাকের হাটের শত শত ঘরবাড়ী পেয়েছে আগুনে বাস।
তারপর গেছে গোপালগঞ্জের দু’পাশে গ্রাম গুলি
বিশ্বের কাছে মাগে ফরিয়াদ দগ্ধ লেলিহান তুলি।
(কি কহিব আর-২৭ এপ্রিল ১৯৭১)
স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং হানাদার বাহিনীর নরহত্যা ও ধ্বংসলীলা কবির মনে নিদারুণ আঘাত হানে। তার মধ্যে আসে সংগ্রামী মনোভাব। তিনি লিখলেন:
আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যু পিছনে ও আগে
ভয়াল বিশাল নখর মেলিয়া দিবস রজনী জাগে।
…………………………………………….
আমরা চলেছি রক্ষা করিতে মা-বোনের ইজ্জত,
শত শহীদের লহুতে জ্বালানো আমাদের হিম্মত।
(মুক্তিযোদ্ধা-৬ই জুলাই-১৯৭১)
কবি জসীম উদ্দীন মাটি ও মানুষের কবি। বঙ্গবন্ধুও এদেশের মাটি ও মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা। পরস্পরের দর্শন পরস্পরকে আলোকিত করেছে। জীবন শ্রোতে মানুষের জন্য দু’জনের মন কেঁদেছে। এদের দুঃখে-সুখে উভয়ের হৃদয়ে সমানভাবে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। দুঃখী মানুষের স্বপক্ষে কথা বলা ছিল উভয়ের মানবিক ধর্ম। কবির রাজনৈতিক দর্শন ছিল স্বদেশ প্রেম। শোষণহীন সমাজ গঠন, মানব প্রেম ও শান্তি স্থাপন।
পাক-হানাদার বাহিনীর দোসর এ দেশের কুসন্তান আলবদর, রাজাকার বাহিনীর কুকর্মে বীতশ্রদ্ধ হয়েছেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে ক্ষুব্ধ কবি বলেছেন-
তোদের উষ্ণ রক্ত পান করি মিটাবো তৃষ্ণার জ্বালা
কর্তিত শত মুণ্ডু ধরিয়া পথে জ্বালাইবো আলা,
যে অসিতে তোরা করিয়া ছেদন, পথে ঘাটে শত আনিলি মরণ
সে অসি আবার আসিয়া এখন তোদের রক্তে করিবো স্নান।
(গান-১০ই জুলাই, ১৯৭১)
১৯৭২ সনে কবি জার্মান সফরে যান। সেখানে একটি কলেজের ছাত্র শিক্ষক সমাবেশে কবি যে ভাষণ দেন তার মধ্য দিয়ে এদেশের প্রতি এবং প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর মমত্ববোধ এবং দেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন- “আপনারা জানেন অত্যাচার আর অনাচারের বিরুদ্ধে আমাদের জোয়ান ছেলেরা রুখিয়া দাঁড়াইয়াছিল। ইহারা অনেকেই আধুনিক যুদ্ধবিদ্যা জানিত না। বাংলাদেশের যুবকরা যুদ্ধ করিতে গিয়াছিল লম্পটদের হাত হইতে মা বোনদের মুক্ত করতে। পশ্চাদ-পটে থাকিয়া যিনি এইসব বীর পুরুষদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা যোগাইয়াছেন তিনি সেই মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে নির্যাতন করা হয়েছে। বন্দী অবস্থায় তিনি নির্যাতন সহ্য করেছেন এ দেশের শোষিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে, দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধনে।
এই প্রসঙ্গে কবি বলেছেন-
“বারে বারে মনে হয় এরূপ পরিস্থিতিতে আমি পড়িলে পাগল হইয়া যাইতাম অথবা স্বৈরাচারী শক্তির সামনে নিজের বিবেককে বলি দিয়া মুক্তি ভিক্ষা করিয়া লইতাম। কিন্তু মুজিব তাহা করেন নাই। তাঁর ভিতরে আমি যে অতি মানুষটির পরিচয় পাই এমন কদাচিৎ দেখা যায়।”
দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে কবি জসীম উদ্দীন ১৬ই মার্চ ১৯৭১ সনে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে যে কবিতা লিখেছিলেন তাঁর অংশ বিশেষ এখানে উদ্বৃতি করা হলো-
“মুজিবুর রহমান
ঐ নামে যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।
বঙ্গ দেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেঁয়ে
জ্বালায় জ্বলিছে মহা কালানল ঝঞ্ঝা-অশনি বেয়ে।ৎ
রাজভয় আর কারা শৃংখল হেলায় করেছ জয়
ফাঁসির মঞ্চে-মহত্ব তব তখনো হয়নি ক্ষয়
বাংলাদেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রমূর্ত রাজ
প্রতি বাঙালীর হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার ভক্ততাজ।”
(বঙ্গবন্ধু-১৬ মার্চ, ১৯৭১)
জসীম উদ্দীনের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে লেখক গবেষক ফরহাদ মজহার এর লেখা থেকে কিছুটা তুলে ধরলাম-
“যারা ঐতিহাসিক তাঁদের কাছে রাজনীতি ও সমাজতত্ত্বের উপাদান হিসাবে জসীম উদ্দীনের দুটো বই খুব কাজে লাগবে। ‘জীবন কথা’ (১৯৬৮) এবং ‘যে দেশে মানুষ বড়’ (১৯৬৪)। যে দেশে মানুষ বড় প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে বেড়ানোর কাহিনী। পাক-রুশ মৈত্রী সমিতির সভাপতি ডক্টর গস্কোওস্কি তাঁকে সোভিয়েত রাশিয়া ঘুরে যাবার দাওয়াত দিয়েছিলেন। জসীম দলেবলে যেতে চাননি, কারণ ওতে মন মতো ঘুরে বেড়াতে পারবেন না। সোভিয়েথ রাশিয়া সম্পর্কে বেশ অনুপ্রাণিত হয়েই জসীম উদ্দীন ফিরে এসেছিলেন। বইটি উৎসর্গ করেছিলেন কমরেড মণি সিংকে।”
কবি জসীম উদ্দীন মাটি ও মানুষের কবি। বঙ্গবন্ধুও এদেশের মাটি ও মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা। পরস্পরের দর্শন পরস্পরকে আলোকিত করেছে। জীবন শ্রোতে মানুষের জন্য দু’জনের মন কেঁদেছে। এদের দুঃখে-সুখে উভয়ের হৃদয়ে সমানভাবে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। দুঃখী মানুষের স্বপক্ষে কথা বলা ছিল উভয়ের মানবিক ধর্ম। কবির রাজনৈতিক দর্শন ছিল স্বদেশ প্রেম। শোষণহীন সমাজ গঠন, মানব প্রেম ও শান্তি স্থাপন। প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উচ্চারিত হয়েছে তার বাণী, লেখনীর কালি নিঃসরিত- শোষিত মানুষের জয়গান লিখে।
সহায়ক গ্রন্থ:
- জসীম উদ্দীন- এ কে এম আমিনুল ইসলাম।
- যে দেশে মানুষ বড়- জসীম উদ্দীন।
- জার্মানীর শহরে বন্দরে- জসীম উদ্দীন।
- জসীম স্মারকগ্রন্থ ১৯৯৩: জসীম উদ্দীন পরিষদ, ফরিদপুর।
- জসীম পল্লীমেলা স্মারকগ্রন্থ-২০০৮: সম্পাদক, মফিজ ইমাম মিলন।
- ভয়াবহ সেই দিনগুলি- জসীম উদ্দীন।
- ফরিদপুর ইতিহাস ঐতিহ্য পত্রিকা (১২)-বদিউজ্জামান চৌধুরী।
- শতবর্ষে জসীম উদ্দীন- নাসির আলী মামুন।