:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
ওমর শামস

কবি

বাস্তবকে তুলে ধরা এদের কাছে অশ্লীলতা
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-এর চিঠি

বাস্তবকে তুলে ধরা এদের কাছে অশ্লীলতা

১০ জানুয়ারি ১৯৯৩
১২/৩ কে এম দাশ লেন
টিকাটুলি, ঢাকা ১২০৩

প্রিয় ওমর,
তোমার পাঠানো মিলান কুন্ডেরার উপন্যাস, উপন্যাসের ওপর লেখা, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ-র সঙ্গীত এবং সর্বোপরি তোমার অনূদিত কবিতা ও চিঠির জন্য সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানাই। আখতারের দেওয়া উপহার পেয়ে আমার স্ত্রী তুতুলও খুব খুশী হয়েছে। এই সঙ্গে ওর ধন্যবাদও জানিয়ে দিই।

তোমার কবিতা খোয়াবনামা আমার একটি উপন্যাসের নামকরণে উদবুদ্ধ করেছে, এ কথা তোমাকে আগেও লিখেছি। এই উপন্যাসের খানিকটা লেখা হয়েছে, তবে এখনও অর্ধেকের বেশি বাকি। এর একটু অংশ ছাপা হয়েছে চট্টগ্রামের “লিরিক” পত্রিকায়। পত্রিকাটি ভয়ে ভয়ে তোমাকে পাঠালাম, উপন্যাসের এইটুকু পড়ে কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবে। একটি মানুষ ঘুমের মধ্যে হাঁটে, জেগে থেকেও স্বপ্নের মধ্যেই থাকে, ভোঁতা হয়ে পড়ে যখন তাকে সত্যি জাগাতে হয়। বাস্তব জীবন থেকে পালাতে পারলেই লোকটা বেঁচে যায়, কয়েক পুরুষের স্মৃতি নিয়েই তার জগত। এই লোকটাকে নিয়ে লিখতে আমি যে খুব সুখে আছি তা নয়। তার স্মৃতি উদ্ধার করতে গিয়ে আমার গলদঘর্ম দশা। লোকটি আমাকে দিনরাত শাসায় পাছে তার ভুলভাল পরিচয় দিয়ে ফেলি। এখন এমন অবস্থা যে, আমার সমস্ত স্কিম সে ভন্ডুল করে দিচ্ছে। আমার কলম থেকে বেরিয়ে সে কেবলি ছিটকে পড়তে চায়। তার মেয়ের বয়সী বৌটাও স্বামীর স্বপ্ন ও বিভ্রমকে প্রাণপণে হাড়ে হাড়ে অনুভব করতে চায়, এই মেয়েটিও আমাকে ঠিকঠাক মানে না। লোকটির ছেলেটিকে গড়ে তুলতে চাই খুব কড়া বাস্তবের একটি মানুষে। কিন্তু ঐ বাস্তবতাকে একটু সম্ভ্রম মেশানো ভয়ের চোখে দেখলেও এবং ঐ ধরণের মানুষ জ্যান্ত অনেক দেখেও তাকে ঠিক তার মতো করে তুলে ধরতে আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করি না। তাই উপন্যাস এগোতে চায় না। এখন তাকে বাদ দিয়ে তো আর লেখা সম্ভব নয়। তার সঙ্গে আমার যুদ্ধ, কিন্তু তাকে জিতিয়ে দিয়ে আমার শান্তি। এই শান্তি যে কি ভাবে পাবো ভেবে কূল পাই না।

আরো ঝামেলায় পড়েছি আর একটা লেখা শুরু করে দিয়ে। গল্প লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে এটাকে উপন্যাস করতে পারলে এর প্রতি সুবিচার করা হয়। কোনো রকমে একটা গল্প দাঁড় করানো চলে বটে, কিন্তু তাতে মনটা খুঁতখুঁত করে। এই লেখাটা শেষ করতে পারলে তোমাকে পাঠাবো।

আজকাল মন খারাপ থাকে বলে দুটো লেখার প্রতিই যথাযথ মনোযোগ দিতে পারি না। এখানে চারিদিকের অবস্থা দিনদিন অসহ্য হয়ে উঠছে। এখানকার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত খুব দ্রুত বর্বরতার দিকে যে গতিতে দৌড়াচ্ছে তাতে আগামী শতাব্দী আসতে আসতে এখানে পাথর যুগের সূত্রপাত ঘটবে নিশ্চিত থাকতে পারো। মৌলবাদী কুত্তার বাচ্চারা দিনরাত ঘেউ ঘেউ করে চলেছে, শিল্পচর্চা বন্ধ করে দিয়ে এরা মানুষের জীবন যাপনের সমস্ত বিকাশ বন্ধ করে দেওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত। বিজ্ঞান চর্চা যারা করে তারাও বিজ্ঞান মনস্কতা থেকে বেরিয়ে পড়ার কাজে তৎপর। কল্পনা মানে এদের কাছে মিথ্যাচার, বাস্তবকে তুলে ধরা এদের কাছে অশ্লীলতা। শিক্ষিত মানুষ এদের খপ্পরে পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। শিল্প-সাহিত্য দূরের কথা, যে কোনো ধরণের বিদ্যা চর্চাই এদের কাছে উপহাস ও সন্দেহের বস্তু।

এর প্রভাবে অমৌলবাদী যারা, যাদের অনেকে এমন কি মৌলবাদের বিরোধী বলে নিজেদের জাহির করে, তারাও শিল্পচর্চাকে শাসন করার লাঠি হাতে তুলে নিয়েছে। সৃজনশীলতাকে রুদ্ধ করার ফন্দি এঁটে চলেছে এরা। এর মধ্যে লেখার কাজ করা শারীরিকভাবেই কঠিন কাজ। কিন্তু এও জানি যে, লেখাই আমার প্রধান কাজ। এই বৈরী পরিবেশে বাঁচতে হলে লেখা অব্যাহত রাখা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। সারা দুনিয়া জুড়ে এদের দাপট ক্রমে বেড়েই চলেছে। ভারতে এদেরই দোসররা বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে এখানকার পরিবেশ নষ্ট করে দ্যায়, আমরা অন্তত কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে পড়ি।

দিন-দিন যে হতাশ হয়ে পড়ছি তা বুঝি যখন দেখি যে আগের মতো রাগে জ্বলে উঠিতে পারি না, বরং মনটা খারাপ হয়ে যায়, ভয় হয় জীবিত থাকতে বোধ হয় অবস্থা আর ভালো হবে না। আগামী ১২ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আমার বয়স ৫০ বছর। একটি শতাব্দীর অর্ধেক তো কাটিয়েই দিলাম, আর কতোকাল যে বাঁচতে হবে কে জানে? আজকাল মানুষের আয়ু তো বেড়েছে, মনে হয় আরো ২০ বছর যদি না মরি তো কি দেখে যেতে হবে বুঝতে পারি না। যেটুকু আঁচ করি তাতে মোটেই স্বস্তি পাই না। বাঁচার ইচ্ছাও আমার ষোল আনার জায়গায় আঠারো আনা বলতে পারো, কিছু দায়িত্বও আছে যেগুলো পালন না করলেই নয়। এই দায়িত্ব আর বন্দিত্বর মধ্যে ফারাক নেই।

তুমি দেশ থেকে দূরে থেকে ভালোই করেছো, অন্তত দেশের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা তোমার কম। দেশে থেকে, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সংসর্গে দিনযাপন করে বাঁচার দায়িত্ব পালন করা ক্রমে কঠিন হয়ে উঠছে।

যাক এসব বলে তোমার মন খারাপ করে দেওয়াটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না। আমাদের “তৃণমূল” প্রকাশের এখনো ঢের দেরি। এসব সাংগঠনিক কাজ করার যোগ্যতা আমার নেই। পরকল্পনা করি অনেক বেশি, বাস্তবায়নের ক্ষমতা সেই তুলনায় অনেক কম। পত্রিকা বেরুবার আগেই তোমাকে জানাবো।

এবারেও তোমাকে একটি ঝামেলায় ফেলবো। ১৯৯৩ সালের জন্যে “ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন”-র গ্রাহক করে দিও। আখতার কিছুতেই টাকা নিতে চাইছিলেন না, আমি প্রায় অভদ্রর মতো টাকা গছিয়ে দিলাম। তুমি মনে কিছু করো না। ব্যাংকের মাধ্যমে আমার যে টাকা পাঠাতে হচ্ছে না, এতেই আমার অনেক লাভ। তুমি দয়া করে ওদের টেলিফোনে বলে দিও যে, ১৯৯১ সালে ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, অক্টোবর, মে এই পাঁচটি সংখ্যা এবং ১৯৯২ সালের জুলাই, জানুয়ারি ও ডিসেম্বর সংখ্যা আমি পাই নি। দুই বছরের ২৮ টি সংখ্যার মধ্যে ৮ টিই যদি না পাই তো গ্রাহক হিসাবে টিকে থাকা আমার পক্ষে আর কতোদিন সম্ভব হবে, একটু কড়া করেই বলো। ওদের কাছে আমি একটা চিঠিও দিচ্ছি, তুমি দয়া করে ডাকে দিয়ে দিও। চিঠিতেও এসব কথা লিখে দিলাম, তবে টেলিফোনে বললে ওদের টনক নড়তে পারে বলে ধারণা করি।

তুমি কেমন আছো? এর মধ্যে কি লিখলে? তোমার লেখা ও সুর দেয়া গানের ক্যাসেট পাঠাতে চেয়েছিলে। কৈ এখনও তো পেলাম না। এখন কি লিখছো? চিঠি দিও। অবশ্যই দিও। আমার শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই।

ইতি
[আখতারুজ্জামান ইলিয়াস/স্বাক্ষর]
১০.১.৯৩

 

টাইপ রাইটারে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিঠি ও স্বাক্ষর।

আরো পড়ুন- এখানে সব কিছু ধসে পড়ছে : আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিঠি

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.