[সমকালীন ভারতীয় প্রথিতযশা নারী লেখকদের মধ্যে কমলা দাস অন্যতম। কেরালা রাজ্যে ছোটগল্প এবং আত্মজীবনী লেখক হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। তিনি একাধারে একজন কথাসাহিত্যিক, কবি এবং কলাম লেখক। তাঁর ছদ্মনাম নাম ছিল মাধবীকুট্টি। তিনি রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারে ১৯৩৪ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। বাবার চাকুরীর সুবাদে তাঁর শৈশব কেটেছে কোলকাতায়। মা (মালয়ালাম ভাষার অন্যতম নারী কবি নালাপাত বালামনি আম্মা) এবং বড় মামা (প্রখ্যাত লেখক নালাপাত নারায়ণ মেনন)-এর অনুপ্রেরণায় তিনি অল্প বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেন। মাত্র পনেরো বছর বয়সে ব্যাংকের কর্মকর্তা মাধব দাসের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামী তাঁকে লেখালেখিতে উৎসাহ যুগিয়েছেন।
তিনি মালয়ালাম এবং ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সামার ইন ক্যালকাটা’ ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই তিনি আলাদা ঘরানার কবি হিসাবে ভারতীয় ইংরেজি কবিতার ভুবনে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করেন। ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর ছোটগল্প সংকলনগুলো হলো ‘এ ডল ফর দ্য চাইল্ড প্রস্টিটিউট, পদ্মাবতী দ্য হার্লট অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’, ‘দ্য স্যান্ডাল ট্রিজ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ এবং ‘দ্য কেপ্ট ও্যম্যান অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’। মানুষের জীবনের নানাদিক, বিশেষ করে দাম্পত্য জীবনের সুখ-দুঃখ, প্রেম-ভালোবাসা এবং চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশ, তিনি ছোটগল্পের মাধ্যমে তুলেছেন ধরেছেন। কখনো তাঁর গল্পের বিষয় যৌন নিপীড়নের শিকার গরীব বৃদ্ধ দাসী থেকে উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের নির্যাতিত নারী। তাই অনেকে মনে করেন তাঁর গল্পের বিষয় একতরফা। কেননা সব গল্পের অধিবক্তা বা প্রধান চরিত্র নারী। একথা সত্যি যে, তাঁর চরিত্রগুলো একঘেঁয়েমীর নয়, বরং বিভিন্ন অবস্থা, পারিপার্শ্বিকতা এবং বিষয় নিয়ে রচিত। তিনি অল্প সংখ্যক উপন্যাস রচনা করেন। সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতি হিসাবে তিনি একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন।
দাম্পত্য জীবনে কমলা দাস মোটেও সুখী ছিলেন না। যাহোক, স্বামীর মৃত্যুর পরে তিনি বয়সে ছোট ইসলামিক চিন্তাবিদ সাদিক আলীর প্রেমে পড়েন। একসময় সাদিক আলীর পরামর্শে তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে রাজী হন এবং পঁয়ষট্টি বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নাম রাখেন কমলা সুরাইয়া । তাঁদের সেই অসম প্রেমের কাহিনী তিনি অকপটে তুলে ধরেছেন ‘মাই স্টোরী’ আত্ম-জীবনী গ্রন্থে। তিনি পঁচাত্তর বছর বয়সে মহারাষ্ট্রের পুনে শহরে মৃত্যুবরণ করেন। কেরালার রাজধানীর পালায়াম জুমা মসজিদের পাশে তাঁর শবদেহ পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
গল্পসূত্র: ‘যে ছেলেটি ঈশ্বরের বিরোধিতা করেছিল’ এবং ‘পবিত্র গাভী’ অণুগল্প দু’টি কমলা দাসের ইংরেজিতে ‘দ্য বয় হু ডিফাইড গড’ এবং ‘হলি কাউ’ গল্পের অনুবাদ। মালয়ালাম ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ভি সি হ্যারিছ এবং সি কে মোহামেদ উমর। গল্প দু’টি লেখিকার ইংরেজিতে অনূদিত ‘দ্য স্যান্ডাল ট্রিজ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ সংকলনে অন্তর্ভুক্তএবং সেখান থেকে নেওয়া হয়েছে। -অনুবাদক]
যে ছেলেটি ঈশ্বরের বিরোধিতা করেছিল
সন্নাসী ছেলেটিকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করে:
‘এই ছেলে, পৃথিবীতে তুমি কাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসো?’
‘আমার মাকে,’ বললো ছেলেটি।
‘তা ঠিক না,’ সন্নাসী বললো। ‘তোমার মা একজন নারী মাত্র। ঈশ্বরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতে হয়। সবকিছুর মূলে রয়েছেন ঈশ্বর। প্রয়োজন হলে ঈশ্বরের আদেশে মাকে খুন করার জন্য তৈরি থাকতে হবে।’
‘আমি কখনোই মাকে খুন করবো না,’ ছেলেটি বললো।
‘তাহলে তুমি ঈশ্বরের বিরোধিতা করছো, তাই কী?’ রাগী গলায় বললো সন্নাসী।
‘আমি যদি মাকে খুন করি, তাহলে রাতে কে আমার পাশে শোবে? আমার ভয় অন্ধকার।’
সন্নাসী তার পবিত্র পাত্র থেকে একটা চকলেট বের করে এবং ছেলেটিকে দিয়ে বললো, ‘এটা খাও। ঈশ্বরের দেওয়া প্রসাদ।’
ছেলেটি খুশি হয়ে খায় এবং তৎক্ষণাৎ সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
সন্নাসী বললো, ‘ওম্ নামাহ্ শিবা ।’
পবিত্র গাভী
একদিন ছেলেটি যখন রাস্তার পাশে ময়লার গাদা থেকে কলার খোসা তুলে খাচ্ছিল, তখন কলার খোসার জন্য একটা গাভী এসে ওকে গুতা মারে।
ছেলেটির মন খারাপ হয়ে যায় এবং সে গাভীটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। জোরে হাম্বা করতে করতে গাভীটা রাস্তা দিয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়।
তড়িৎ গতিতে সন্নাসীরা সেখানে এসে জড়ো হয়।
‘তুমি কী গাভীকে আঘাত করেছ?’ সন্নাসীরা ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করে।
‘আমি আঘাত করিনি,’ বললো ছেলেটি। ‘আমি কলার খোসা খাচ্ছিলাম। গাভী এসে সেটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তাই আমি তাড়িয়ে দিয়েছি।’
‘তোমার ধর্ম কী?’ সন্নাসীরা জিজ্ঞাসা করে।
‘ধর্ম? সে-টা আবার কী জিনিস?’ ছেলেটি পাল্টা জিজ্ঞাসা করে।
‘তুমি কী হিন্দু? মুসলমান? খ্রিষ্টান? তুমি কী মন্দিরে যাও, নাকি মসজিদে?’
‘আমি কোথাও যাই না,’ বললো ছেলেটি।
‘তাহলে তুমি প্রার্থনা করো না?’ সন্নাসীরা পুনরায় জিজ্ঞাসা করে।
‘আমি কোথাও যাই না,’ পুনরায় বললো ছেলেটি। ‘আমার কোন সার্ট নেই। প্যান্টটাও ছেঁড়া।’
সন্নাসীরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে।
‘নিশ্চয়ই তুমি একজন মুসলমান। গাভীকে আঘাত করেছ?’
‘আপনারা কী গাভীর মালিক?’ ছেলেটি জিজ্ঞাসা করে।
সন্নাসীরা ছেলেটির টুঁটি চেপে হত্যা করে এবং তারপর ময়লার গাদায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
সন্নাসীরা বললো, ‘ওম্নামাহ্শিবা।’
পবিত্র গ্রন্থ
বইয়ের দোকানের কর্মচারী ছেলেটির হাত থেকে পবিত্র কোরান শরীফ মেঝেতে পড়ে যায়।
‘তুই কোরান ফেলে দিয়েছিস!’ দোকানের মালিক আর্তচিৎকার করে ওঠে। ‘তোর কত বড় আস্পর্ধা।‘
‘আজ আমি এক গ্লাস পানিও পান করিনি। ক্ষুধায় আমার মাথা ঘুরছে। সেই কারণে আমার হাত ফসকে গ্রন্থটি পড়ে গেছে।’
‘নিকুচি করি তোর মিথ্যা অজুহাত এবং আল্লাহর দোহাই! আমি অইসব বাজে প্যাঁচাল শুনতে চাই না।’
দোকানের মালিক ছেলেটির বুকে একটা ছুড়ি ঢোকায়।’
‘হে আল্লাহ্! তোমার অপার মহিমা।’