ঘুমঘরের সুখ অসুখ : চেনা জীবনের গহন বৃত্তের উপাখ্যান
পৃথিবী এক আশ্চর্য ঘুমঘর! এই বাক্যটি দিয়েই শুরু হয়েছে বইটির ফ্ল্যাপ। আমাদের চেনাজানা পৃথিবীকে ঘুমঘরের সাথে তুলনা করার এই বিষয়টিতে একজন পাঠক নিজের অজান্তেই নড়েচড়ে ওঠেন বইয়ের ভেতরে ঢোকার জন্য। সেই সচেতনতা নিয়ে বইটি পড়তে শুরু করার পর থেকেই আমরা ঢুকে পড়তে থাকি কোনো এক অদ্ভুত অবচেতন ঘোরে, বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে গল্পের গভীরতর আখ্যানে। আমরা এই ‘পৃথিবী’ নামক ঘুমঘরের খুব চেনাজানা মানুষগুলোর, চেনাজানা জীবনগুলোর সুখ আর অসুখের গহীন যাপনের বলয়ে ঢুকে পড়তে থাকি ক্রমশ। সাদিয়া সুলতানার ‘ঘুমঘরের সুখ অসুখ’ নামের এ বইটি আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে যায় এক সুখ আর বিষাদের নিজস্ব জগতে, নিজস্ব বলয়ে।
গল্পকার সাদিয়া সুলতানার কলম সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের চেনা ছকের গল্পগুলিকে কেমন সুচারু দক্ষতায় তুলে আনতে পারঙ্গম, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতোপূর্বে প্রকাশিত দু’টি গল্পগ্রন্থ আর একটি উপন্যাসে লেখকের গল্প বুননের দক্ষতা আর বয়ানের শিল্পীত প্রকাশ পেয়ে গেছেন তাঁর পাঠককূল। গল্পকারের তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ‘ঘুমঘরের সুখ অসুখ’ গল্প বুননের কুশলতায় ছাড়িয়ে গেছে আগের বইগুলিকে। বইয়ের এগারটি গল্পে লেখক বলে গেছেন ঘুম আর জাগরণের মানুষগুলোর একান্ত সুখ বিষাদের নিবিড়গাঁথা।
বইয়ের প্রথম গল্প ‘তিরু, তোর জন্য’ থেকে শুরু করে শেষ গল্প ‘মিতালি’ পর্যন্ত প্রত্যেক গল্পে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ঘুরে আসা যায় সুখ আর অসুখের যাপিত জীবনের অনেকটুকু। মূল চরিত্রগুলোর সাথে সাথে গল্পগুলোর প্রয়োজনে তৈরি হওয়া ছোট ছোট চরিত্রগুলোর সুখ-বিষাদও আক্রান্ত করে পাঠককে।
‘তিরু, তোর জন্য’ গল্পের শুরুর বাক্য ‘তিরু নেই’। দুই শব্দের এ বাক্যটিই মনোযোগী পাঠককে গল্পটার প্রতি দারুণ আগ্রহী করে তোলে। তিরু নেই তো সে কোথায় গেল, কেন গেল, কীভাবে গেল এবং তারপর ওর কীই বা হলো- এমন প্রশ্নগুলো পাঠককে নিয়ে যায় এ গল্পের গভীরে। এ গল্পে একটা নকশিকাঁথার প্রতি তিরুর ভালবাসার দাবি কিংবা নিউজপ্রিন্টের ভেতরে তামাকপাতা পুরে চুপিচুপি ‘নাশা’ খাওয়া ঠাকুর্মা যেন আমাদের রোজকার মধ্যবিত্ত জীবনের কথাই বলে। মূল চরিত্রের আকস্মিক অন্তর্ধানে তার সহোদরা রাধার বয়ানে লেখা এ গল্প আপনজনের চলে যাওয়ায় সমাজে বিপন্ন হয়ে ওঠা একটি পরিবারের গল্পই বলে যায় না শুধু, সে পরিবারের মানুষগুলোর জটিল মনস্তাত্ত্বিক গিঁটও একটু একটু করে খুলে দেয়। যে গল্পের শুরু তিরুর না থাকার কথা দিয়ে, সে গল্পের কথক পরে জানাচ্ছে- “তিরু আমাদের বুকের ভেতরে দুর্ভেদ্য তীরের মতো বিঁধে আছে। যাকে উপড়াতে গেলে প্রাণ যায় আর অস্পর্শ রেখে দিলে দূরগামী ব্যথায় কাতরাই। তাই আমাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ বিষয় ছিল, তিরুকে ভুলে যাওয়া….” সরল ভাষা আর বয়ানে লেখা এ গল্পটা পড়তে পড়তে মন আর্দ্র হয়ে ওঠে। গল্পের শেষ অনুচ্ছেদ কথকের মনস্তাত্ত্বিক এই জটিলতাকে যেন একেবারে চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। পাঠক তিরুর জন্য, আবার একই সঙ্গে রাধার জন্যও এক আশ্চর্য মন খারাপের অনুভূতি খুঁজে পাবে নিশ্চিত।
এ বইয়ের খুব ছোট অথচ শক্তিশালী একটি গল্প ‘আশার মতো মিথ্যে নেই’। আয়নামতি নামের প্রায় শুকিয়ে আসা, জল হারানো, ঢেউ হারানো একটি নদী আর তার তীরের ঠ্যাটা ইলিয়াসের এই গল্পটাও আজকের বাংলাদেশে আমাদের খুব চেনা একটি গল্প। ভূমিদস্যুদের প্রবল প্রতাপের কাছে চরা পড়া নদীর মতোই দুর্বল শরীরের ইলিয়াসের আশা আর প্রতিবাদের এ গল্পটা পড়তে পড়তে তার মতোই বারবার বলতে ইচ্ছে করে- ‘ও নদী তুমি ঢেউ হও, ঢেউ হও….’
‘মিতালি’, ‘সমুদ্রডাকিনী’ কিংবা ‘ভদ্রলোক’ শিরোনামের গল্পগুলো সমসাময়িক ব্যক্তিজীবন আর পারস্পরিক সম্পর্কের অস্থিরতা ও বিচ্ছিন্নতার গল্প বলে যায়। দিনশেষে এই গল্পগুলোর কেউ কেউ আবার ঘরে ফেরে, কেউ ফেরে না, কেউ কেউ নিজের ভদ্রলোক পরিচয়ের নিজস্ব ব্যবচ্ছেদে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কেউ আবার প্রতীক্ষায় কান পেতে থাকে কোনো অচেনা মায়াবী রূপকথার মতো ডাকের। এ গল্পগুলো পড়তে পড়তে কখনও অজান্তেই মনে হয়- আরে! এ আমার খুব পরিচিত গল্প। এদের আমি কত গভীরভাবে চিনি! এই গল্পগুলো পড়তে খুব আরামদায়ক, ছোট ছোট বাক্যগুলো আয়েশ করে পড়া যায়। অবশ্য পড়তে পড়তে মনে হয় ‘ভদ্রলোক’ শিরোনামের গল্পটায় মূল ও অন্যান্য চরিত্রের ব্যবচ্ছেদ আরও খানিকটা বিস্তারিত হতে পারত। এদের চরিত্রের আরও নানান দিক তুলে আনা যেত প্রাসঙ্গিকভাবে।
‘মিতালি’ গল্পটি বর্তমান ভার্চুয়াল ও বাস্তব সম্পর্কের এক বিশ্বাসযোগ্য রূপায়ন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বহুমুখী আর ছদ্মবেশি সম্পর্কের পাশাপাশি বদলে যাওয়া পরিচিত আর বিশ্বস্ত সম্পর্কগুলোও গল্পকার দক্ষ কলমে তুলে এনেছেন। আজকের অস্থির মানুষগুলোর নিজের নি:শ্বাসের মতোই একান্তে মিতালিও ধন্দে পড়ে যায়- অন্ধকারে ওর দুর্যোগ বাড়াতে কে আসে আজকাল! “কে? রাজাই তো? নাকি তৌহিদ? রবি নয় তো?”
এ বইয়ের খুব ছোট অথচ শক্তিশালী একটি গল্প ‘আশার মতো মিথ্যে নেই’। আয়নামতি নামের প্রায় শুকিয়ে আসা, জল হারানো, ঢেউ হারানো একটি নদী আর তার তীরের ঠ্যাটা ইলিয়াসের এই গল্পটাও আজকের বাংলাদেশে আমাদের খুব চেনা একটি গল্প। ভূমিদস্যুদের প্রবল প্রতাপের কাছে চরা পড়া নদীর মতোই দুর্বল শরীরের ইলিয়াসের আশা আর প্রতিবাদের এ গল্পটা পড়তে পড়তে তার মতোই বারবার বলতে ইচ্ছে করে- ‘ও নদী তুমি ঢেউ হও, ঢেউ হও….’ ছোট এই গল্পটা পড়া শেষে স্তম্ভিত হয়ে থাকতে হয়, বুকে নদীর জলোহাওয়ার ব্যথা বাজে অনেকক্ষণ ধরে। গল্পে আয়নামতির বুকে জলের হাহাকারের কথা পড়তে পড়তে মনে হয় গল্পকার চাইলেই এই গল্পটা আরও বিস্তৃত করে তুলতে পারতেন কলেবরে। গল্পের পটভূমির ব্যাপ্তি আরও বাড়লে, ইলিয়াসের অনুভুতির আরও একটু ডিটেইলিং থাকলে এই চমৎকার লেখাটার আরও নিখুঁত হয়ে উঠবার সুযোগ ছিল।
বইটির একটি গল্প মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে, বলা ভালো যুদ্ধদিনে যুদ্ধ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাওয়া এক সরকারি চাকুরের স্মৃতিচারণের গল্প। মুক্তিযুদ্ধকালে ওয়াপদার রেস্টহাউসে থাকা সাবডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার নিজামউদ্দিন জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও ভুলতে পারেননি যুদ্ধদিনের নৃশংসতার কথা। কথার খেই হারিয়ে ফেলা, স্মৃতিবিভ্রমের দ্বারপ্রান্তে থাকা এ মানুষটার বয়ানে প্রথম পুরুষে লেখা ‘মৃত্তিকা মানুষ’ যেন একসাথে দু’টো গল্প বলে যায়, একটা যুদ্ধদিনের আতঙ্ক আর নিষ্ঠুরতার গল্প আর অন্যটা ওয়াপদা রেস্টহাউসের কেয়ারটেকার লতিফের গল্প।
“ফারুকের লাশ যখন জাল দিয়ে টেনে এনে পুকুরপাড়ে রাখা হয় তখন ওর মাথাটা জায়গামতো ছিল না। আসলে ওর মাথাটাই দেখা যাচ্ছিল না, হয়তো গুলি লেগে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ফারুকের পরনের খয়েরি শার্টের কলারের কাছে মুণ্ডুহীন গলার কাছটা রক্তাক্ত আর এবড়োখেবড়ো দেখাচ্ছিল। কেয়ারটেকার লতিফ ফারুকের লাশের গায়ে চাদর জড়াবে বলে হাতে একটা বিছানার চাদর নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তখনো লতিফকে দেখাচ্ছিল ভাবলেশহীন। সেবারই প্রথম প্রচণ্ড বিতৃষ্ণায় আমি লতিফের নির্লিপ্ততা দেখছিলাম, কীভাবে পারে ও! ও কী মানুষ? নাকি প্রাণহীন, অসাড় কোনো মাটির মূর্তি!”…. উত্তাল যুদ্ধদিনে যেখানে একটা রাত কাটিয়ে ভোরের দেখা পেলেই গল্পকথক একটা দিন নতুন করে বাঁচার আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়তেন, সেখানে লতিফ নামের এমন নিরাসক্ত, নিরাবেগ একজন মানুষ কীভাবে, কোন পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চলে গেল- সে গল্প পড়তে পড়তে আমরা আরও একবার একাত্তরে চলে । আরও একবার আমাদের প্রাণের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে নিজেদের আবেগ, ভালবাসা, ত্যাগ সব চোখের সামনে ছবি হয়ে ভেসে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা খুব সহজ কিছু নয়, এত গল্প লেখা হয়ে গেছে আমাদের সবার আবেগের এই সময়টা নিয়ে। কঠিন এ পরীক্ষায় গল্পকার উতড়ে গেছেন খুব ভালোভাবে, প্রথম পুরুষে লেখা এই গল্পটি অত্যন্ত সুলিখিত।
বর্তমান সাহিত্যজগত নিয়ে দারুণ এক প্রামাণ্য হয়ে উঠতে পারে এ বইয়ের ‘শব্দবাজি’ গল্পটি। বেশ কিছু পুরস্কারপ্রাপ্ত এক লেখককে কেন্দ্র করে এই লেখাটা মিলে যেতে পারে অনেকের সঙ্গে।
এ বইয়ে আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্প ‘মেহেরুন ও অনন্ত ঘুমকাল’। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোর মেধাবী ছাত্রী, বিতর্ক, আবৃত্তিতে অত্যন্ত প্রতিভাবান মেহেরুন কী করে এক বিরতিহীন ঘুমকালের চক্রে বন্দি হয়ে যায়, সে গল্প পড়তে পড়তে এই পৃথিবী নামক ঘুমঘরের প্রতি রাগ, করুণা, ক্ষোভ সবকিছুর এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগে মনে। যে মেহেরুনের হয়ে উঠবার কথা ছিল দেশের প্রথম শ্রেণির একজন কর্মকর্তা- সে তার নিজের ঘরের চার দেয়ালে কতটা বিপণ্ণ দশায় কাটায় তা পড়লে প্রথমে অবিশ্বাস জাগে, পরে সমসাময়িকতার কথা ভাবলে প্রচণ্ড বিষাদে তা মেনে নিতে হয়। আর বারবার মনে হয়- ইশ! এমনটা আমার সাথেও হতে পারত! বা আমার কোনো বন্ধু, বোন, ভাইয়ের সাথে! মেহেরুনের সঙ্গে সঙ্গে তখন সবকিছু থেকে নিরাসক্ত আর বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে, থুথু ছিটাতে ইচ্ছে করে নিজের ঘৃণ্য চারপাশে। লেখক হিসেবে সাদিয়া সুলতানা এ জায়গাতেই সার্থক। তাঁর বেশিরভাগ লেখাতেই তিনি চরিত্রগুলোর সাথে একাত্ম করে তুলতে পারেন পাঠকদের।
গল্পকার সাদিয়া সুলতানা ইতোমধ্যেই তাঁর লেখার মাধ্যমে সমসাময়িক লেখালেখির জগতে সুপরিচিত। কেবল তাঁর লেখার গুণেই নয়, সমসাময়িক অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে তিনি বরাবর সোচ্চার তাঁর লেখায়। গল্পকারের এ বইয়ের বিভিন্ন গল্পও আমাদের চেনাজানা নানা ঘটনার গভীরতা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সে সব গল্প পড়তে পড়তে পাঠক নিজেও এই পৃথিবী নামক ঘুমঘরের যাবতীয় ঘুম ও চেতনার ঘোরে নিমজ্জিত হতে থাকে।
পড়ুন সাদিয়া সুলতানা’র গল্প- ‘হারিয়ে যাবার আগে’