পাঠের উঠোন
সূর্যাস্তভেদী গলুই : ভাঙা আয়নায় সময়ের মসৃণ ক্ষত
আজ বালিশের পাশ থেকে টেনে নিলাম ‘ফারহান ইশরাক’এর কবিতা-কিতাব ‘সূর্যাস্তভেদী গলুই’। সাদা-কালো প্রচ্ছদে দারুণ একটা নৌকো বসে আছে কভারে। আমি নতুন বইটার গন্ধশুকে প্রথম কবিতায় চোখ রেখেছি। চুলোয় ভাত বসানো ছিল। ভুলে গেছি। পর পর তিনটা কবিতা পড়ি। ভালো লাগে। ধানের মতো সোনালী কবিতা। গরম ভাতের মতো নরম কবিতা। বেহেস্তের বিপরীতে নরকের কবিতা। নানা রকমের কবিতা তাঁর। একেকটা একেকরকম। বোরিং লাগে না। জুড়ে বসে না একঘেয়েমি।
প্যানপ্যানানি বাদ দিয়ে কবিতায় ঢুকি। কিন্তু কবিতা নিয়ে কতটা বলা যায়? কবিতা তো আসলে পাঠের বিষয়। যার যখন ইচ্ছে সে তখন পাঠ করবে। জোর ও ঘোরে কোনো অবস্থায়ই কাউকে কবিতা পাঠ করানোর পক্ষে না আমি। তার প্রথম কবিতা ‘দক্ষিণেশিয়া’। এটা পড়ে আমি থমকে গেছি। বাংলা কবিতা নিয়ে যারা হতাশ কিংবা আনন্দিত কিংবা এই দুইয়ের মাঝে বসে লম্বা করে সিগারেট টেনে গোল করে ছেড়ে আবার চা পিঠাচ্ছেন আর আড্ডায় বাংলা কবিতার ফেনা তুলে দিচ্ছেন তাদের কাছেও আমার আর্জি, আমি আসলে কবিতাকে উপর-নিচ, উঁচু-নিচু এসব করে ভাবি না। কবিতা তো কবিতাই। আসুন পাঠ করি-
‘পায়ে জুতো নেই, দুঃখ করো না দক্ষিণেশিয়া
আট খণ্ড জমি হেঁটে হেঁটে সেলাই করেছি
ঐতিহাসিক
কত লাল মরিচের জমি বিষধর বনভূমি
বাঙ্গিচর তেজপাতাক্ষেত বেতের জঙ্গল
সুতার ফোঁড়ে অনটন ছিল না কখনো
ভেষজ গভীর আঠা দিয়ে সাঁঠা নরম পৃষ্টায়
বীজ বপনের এই আক্ষরিক আয়োজন
রাষ্ট্রের তারে কাঁটা আছে বটে, সে-ও সংহতি
নানা রাস্তার গতিফলকও তো থাকবে নিশ্চয়
উঞ্চতা জ্বেলে চলো খুঁজে দেখি, তার চেয়ে
মোটা পথ
যতই উড়ি, উড়োজাহাজের দাগ কত আর
ধরে রাখা যায় হাওয়াই মেঘের শ্লেটে?
পলি ঘেঁষে চলা পরিব্রাজকের ধূলিই সম্বল
পাখি-চলাচলে যত রেখা আছে, পুরোই মানছি
কাদাজলে চাই চিহ্নমালার অকপট অঙ্কিমা
চামড়ায় মোড়া অঙ্গের অনুভূতি
আন্তরিক নয় অত, খালি পায়ে যাই যদ্দুর সম্ভব
এদিকে সাগর, ফেনা জমে আছে উচ্ছ্বাসে
গতিই সংহতি, এ-বেলা ও-বেলা এ-ই সারকথা
কপালের ভাঁজ মুছে প্রশান্তি ফুটবে না?
এই যে আপনি একটানা পড়ে ফেললেন। কি পড়লেন? বলতে পারবেন? আসলে সব কিছু বলা সম্ভব? তাও কবিতায়? আবার কি না বলা হয়েছে এখানে। পুরো দক্ষিণেশিয়ার পর্দা উঠে গেল নাকি? জানি না। যার যার রুচির সাথে কবিতা মূলত প্রিয় হয়ে ওঠে।
এভাবে যদি, ‘পাকা ধানের পাহাড়’ পড়েন। পাবেন আরেক রকম টলটলে স্বাদ।
‘চিনির সন্দর্ভ মুখে নিয়ে গুদাম-ফেরত
পিঁপড়া বললো, মজুদের লালসাকেন্দ্রে
স্বাদ বলতে তীব্রতার তলানি সংকট’
না শব্দ, না ভাষা, না বাক্য, না আরো আরো কাব্য আড়ালের সামগ্রী নিয়ে আমি কথা বলছি না। কবিতা পড়ে কবিতার স্বাদ পেলাম কিনা সেটাই মূখ্য। আরো মূখ্য আমরা কতটা নিবিড়ভাবে এই সময় এই সমাজ এই রাজনীতি এই দেশ এই দশকে দেখতে পেরেছি। সেটাও কিন্তু কম মূখ্য নয়। কারণ ইতিহাস-দর্শন-চিত্রকলা-কাব্য সবই আসলে সময়ের শার্টে এক একটা বোতামের মতো সেঁটে আছে আমাদের মানুষ্যকূলের বিবেকের নিটোল বুকে।
ধানের পাহাড় এই কৃষিভিত্তিক বদ্বীপের রূপকথার গান হয়ে ধরা দেবে। আমি ধানের পাহাড়ে গিয়ে বসে আছি চুপবালক এক। কোন সে পাঠক-কৃষক পাকা ধানের পাহাড়ের লোভ না রাখে লুকিয়ে।
তারপর যদি ‘পাউরুটি’ খেতে চান? নিশ্চয় ক্ষুধা বেড়ে গেছে। কিংবা পেট ভরে গেছে মনে। প্রত্যেক ক্ষুধার্তের চোখে যেমন খাদ্যমণ্ডলীকে সুন্দর দেখায় সেভাবে প্রত্যেক কবিতার পাঠক ফারহানের এই পাউরুটির স্বাদ না নিয়ে মিস করতে চাইবেন? আসুন একটু পাঠ করি-
‘একাকিত্বের কোনো স্থায়ী
ঠিকানাসূত্র নেই
কিংবা রোডম্যাপ
কখন, কোন তারা থেকে
ডাক এসে যায়
আলোকায়নের প্রতীকার্থে
এই অপ্রকাশ্য আংটির
প্রণোদনা!’
এভাবেই এগিয়ে যায় পাউরুটি। পাউরৃুটির ইতিহাস আমি জানি না। পা দিয়ে তৈরি হয় বলেই কি পাউরুটি? জানি না। কিন্তু পাউরুটিতে যে ঘি মাখন দিয়ে ঠাণ্ডা ঘরে আবন্ধ করে আরামের স্বাদ জুড়ে দেয়া যায় তা কিন্তু কারিগরের উপর নির্ভর করে। আসুন তাই আরেকটু এগিয়ে যাই।
এরপর ‘লাইন বে-লাইন’ পাঠ করি। যেন দৈনন্দিন ফর্দ লিখেছেন তিনি। কিন্তু কোথায় কোথায় যেন চুপচাব বসে আছে কাব্য। সে উঁকি মারে। শিষ দেয়। পড়তে বাধ্য হয় নাছোড় পাঠক।
‘অক্সিজেনদায়ী গাছ কেটে গড়ে তোলো
পাণ্ডুলিপির বিষাক্ত খামার
শাখায় শাখায় অপ্রাসঙ্গিক পাতা
এই অজুহাতে পৃষ্টা বেড়ে যাবে
কথা বলবো অপ্রাসঙ্গিক
লাইনমতো অনেক বলেছি
বে-লাইন অধ্যায় এবার শুরু হবে’
এভাবে পড়তে হয়। অপ্রাসঙ্গক কিন্তু যেন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে মুহূর্তে।
অতঃপর ‘সূর্যাস্তভেদী গলুই’-এ পৌছে যেতে হয়। পাঠের বৌঠা হাতে দায়িত্ব কাঁধে উঠাতে হয়। তরতর করে পানি কাটার শব্দে শুনতে হয় বইঠা বিচ্ছেদের গান।
নিজের লাশ নিয়ে দিকশূন্য একা
কোন দিকে যাবো এত রাতে!
নৌকার পুরো খোল রক্তপ্লাবিত
কাঠ-মাচানের নিচে লাল নদী
বরফের ঠাণ্ডা আয়নায়…
নক্ষত্রের মুখচ্ছবি হয়ে আছে
অন্তভেদী হে গলুই অজানার মস্তকে-’
মোটামুটি আমাদের সবার ভেতরে এ রকম একটা খেলা চলে। নিজের লাশ নিয়েও কতো অসহায় আমরা? যেন ইহকালের হিসাব না মিটেই পরকারের মাথা নিয়ে নাচি। কিন্তু কেন? এমন কেন ভাবতে হয় কবিকে দিকশূন্য তিনি। এতো রাতে কোন দিকে যাবেন? পূর্ণিমার আলোতেও তো আমরা ভয় পাই রক্ত দেখে। আলোর নিচেও তো কেঁপে ওঠে আমাদের নিরাপত্তা। এভাবে সময় আর বর্তমানকে পাঠ করতে হয় ফারহান ইশরাকের কবিতায়। আর কেঁপে উঠতে হবে ভয়ে। ঘামতে হবে সাহসে।
‘ঋতু বদলের মৌসুমে’ পড়ুন একটু।
‘ঋতু বদলের মৌসুমে প্রচুর রক্তপাত দেখি
এই দ্বীপে. ধানের গর্ভাশয়ে, লতায় পাতায়
রক্তের দাঙ্গা দেখে বেড়ে উঠি
পরিত্যক্ত জুতার খোড়লে ঘাষফুল
এক ফুল আরেকের বিছানায় শুয়ে পড়ে
একটা মানুষ দিনের আলোয় এক ঘটে
জল খায়, চুষে নেয় লবণের লালা
অন্ধকারে তৃষ্ণার পাপড়ি গজায়,
আন্তঃমহাদেশ’
এই যে দেশে বসে মহাদেশ দেখা, পৃথিবীতে শুয়ে দক্ষিণেশিয়া পড়া, বদ্বীপে বসে কাল বা সময়কে শোনা, সবকিছু দারুণ উপমায় আর সুনিপুণ মুনশিয়ানায় তুলে ধরেন ফারহান ইশরাক। তাকে পড়তে পড়তে তাই নড়েচড়ে বসতে হয় আমাদের। হাত কচলাতে হয়। ঘাড় উঁচু করতে হয়। চিবুক নিচু করতে হয়। চুলকাতে হয় ইতিহাস আর আবহ পরিমণ্ডলের সমর-বেলুন।
এভাবে কখন যে ‘ভাষা কনফারেন্স’-এ ঢুকে পড়ি জানি না। মোটাদাগে এই যে ৯১টা কবিতা থেকে আমি মাত্র ৫টি কবিতার ইঙ্গিত বা ইশারা আপনাদের কাছে শেয়ার করছি এটাও কিন্তু মোটাদাগে অপরাধ। পুরো বইটা খুব সময় নিয়ে পড়লে আরো অনেক নান্দনিক কবিতার সাথে পরিচয় ঘটাতে পারতাম। সেটা আর হলো আজ।
‘মানুষ বাদে আর সবে এক ভাষায় কথা বলে
এই ইঙ্গিতে যে এই লোকটা স্টেইনলেস
ব্লেডের ভাষায় ভাষণ দিতো চৌ রাস্তার মোড়ে
সে তো বোবা ছিলো। জনতা ও যৌনতা
উভয়ই কি জাগতো না তার সেই প্রবলতায়?’
এভাবে পড়তে পড়তে প্রবল কাব্যপ্রেমীর তো প্রশ্ন উঠতেই পারে তিনি কি নিটোল কাব্যভাষা ব্যবহার করতে পেরেছেন? সে কথা ভিন্ন। ভাষা বাদ। যদি বলেন শব্দের নানামাত্রিক ব্যবহারেও কি তিনি প্রশ্নের উপরে উঠে গেছেন? সেটাও বাদ দিলাম। বাক্য গঠনের এই কিসিমবাজীর সময়েও তিনি কেন আরেকটু চতুর হলেন না? কেউ তো ছুড়ে দিতে পারেন এমনও কথা। বাক্য বাদ দিলাম। উপমা-চিত্রকল্প-উপমান- এসব তো আরো উন্নত চরিত্রের কারবারি। ফলে না শব্দ, না ভাষা, না বাক্য, না আরো আরো কাব্য আড়ালের সামগ্রী নিয়ে আমি কথা বলছি না। কবিতা পড়ে কবিতার স্বাদ পেলাম কিনা সেটাই মূখ্য। আরো মূখ্য আমরা কতটা নিবিড়ভাবে এই সময় এই সমাজ এই রাজনীতি এই দেশ এই দশকে দেখতে পেরেছি। সেটাও কিন্তু কম মূখ্য নয়। কারণ ইতিহাস-দর্শন-চিত্রকলা-কাব্য সবই আসলে সময়ের শার্টে এক একটা বোতামের মতো সেঁটে আছে আমাদের মানুষ্যকূলের বিবেকের নিটোল বুকে। আহ তাই আসুন আরেকটু বসন্তের ভেতর ঢুকে ঘামতে ঘামতে এবার বাড়ি ফিরি। কিংবা একটা লাল শেখ টানতে টানতে ঘুমের আয়োজন করি। কিংবা বউ অথবা প্রেমিকার বগলে চুমু এঁকে দিই গভীর গোপনে। আর নষ্ট পৃথিবীর ভ্রষ্ট মানুষের বিলে আবাদ করে আসুন পাঠ করি। পাঠ করি মানুষ ও মানবতা। ফারহান ইশরাকের কবিতা।