কবিতা গ্লোবালিনী
“যদি তুমি চাও অমরতা
তবে সংহত কর বাক, থামাও প্রগলভতা।”
( শামসুর রাহমান )
এক সময়ে দীর্ঘ কবিতার দিকে ঝোঁক ছিল। পৃষ্ঠাকে পৃষ্ঠা আলসেমির মত পা ছড়িয়ে বসতে ভালবাসত আবেগ আর মননের যুগলবন্দী। বেশ কিছুকাল হল সেই উদ্যম স্তিমিত হয়ে আসছে বলে মনে হয়। কবিতাকে আর আবেগাক্রান্ত কোনো শিল্প বলে মনে হয় না। আট-দশ লাইনের বেশি লিখে বা পড়ে উঠতে পারাটা একদিকে যেমন ক্লেশ মনে হয়, অন্যদিকে বলবার কথাটাও ঐ সীমিত আয়তনে বলা হয়ে যাচ্ছে বলে দেখতে পাচ্ছি। আরও কত কিছুই তো বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তরুণ বয়সে কবিতার বিষয় আশয় ছিল বিরহ-দ্রোহ-ভালবাসা; আর এখন বিষয়ের পাশাপাশি কী কী বিষয়হীনতা আসছে সেটাও হিসেব করে দেখবার আছে। কবিতা ছিল নিভৃতির, লুকিয়ে রাখার, বুকপকেটে ভাঁজ করে রাখবার মত অমর্ত্য কোনো সম্পদ। আজকাল খাতা-কলম উধাও; খসড়া কবিতা লেখার জায়গা হয়ে দাঁড়াল প্রকাশ্য দিবালোকে নীলাভ ফেসবুকের পাতা। একটা তাৎক্ষনিকতার মোহ পেয়ে বসেছে আমাদের কবিজন্মকে। ভবিষ্যৎ কী ক্ষমা করবে তাকে, ক্ষমা করবে মহাকাল? এই করে করে কবিতা অতীত থেকে বর্তমানের বুড়ি ছুঁয়ে ভবিষ্যতের দিকে পিলপিল করে হেঁটে যাচ্ছে।
বলছিলাম, কবিতা ছিল নিভৃতির। আজও সদ্য লেখা পদ্য পূর্ণিমা রাতে খোলামকুচির মতো উড়িয়ে দিতে পারলেই বুঝি বেশ ছিল। কিন্তু কোন তাড়নায় এই ফানুসগুলো সংকলন করতে ইচ্ছে যায়! পাঠক পড়বে, পছন্দ করবে, সেটাই তো আরও নতুন পঙক্তি লিখবার প্রেরণা। নিভৃতির হলেও তা কিন্তু আত্মকথা থাকে না কেবলমাত্র, লিখতে বসে অন্যের জীবনের পৃষ্ঠায়, অন্যতর অভিজ্ঞতার পাতায় ঢুঁ মেরে আসা হয়। শেষাবধি অক্ষরের এক জগতে বসে অক্ষরের আরেকটা জনপদ নির্মাণ করে যাওয়া। ‘বর্ষা’ শব্দটি চোখে পড়লে ‘ব’ আর ‘ষ’ এর পেটের ভেতরের যে জানালাগুলো চোখে পড়ে, সেই জানালাগুলোর ভেতরে কত না ঝড় বাদল, কত না আষাঢ়- শ্রাবণ, কত না রবীন্দ্রনাথের গান! মাঝে মাঝে শব্দ এরকম ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে যায়, তার অনেক অনেক সংজ্ঞাবহির্ভূত কোমল অত্যাচার মেনে নিতে হয়।
“যদিও সে-সব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক
চেয়েছিলো – হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিল লুটোপুটি।”
( জীবনানন্দ দাশ )
অগ্রজ কবিরা মাথার ওপর বোধিবৃক্ষ, নীল চাঁদোয়া। কবিতার দীর্ঘ ইতিহাসের কোনো পৃষ্ঠায় কখনও বমাল ঢুকে যাওয়া, কারো সাথে মানসিক সমকক্ষতা অনুভব করা, সে এক স্বর্গীয় মুহূর্ত। কৈশোরের নরোম কাদায় তাঁরাই তো বুনে দিয়েছিলেন কবিতার বীজ, যৌবনে অন্ধকার আকাশজুড়ে নক্ষত্র গুনে গুনে, সে এক পৃথক পালঙ্কে শুরু হল রাত্রিচর কবিতার ভাসান। স্বপ্ন কিংবা শব্দগুলো চলল ছেঁড়াখোঁড়া, ঘুমের আকাশে ভেসে বেড়ানো বিপন্ন মেঘ।
তবুও কবিতা আজ গ্লোবালিনী। বাংলাদেশের এক কোণে বসে লেখা কবিতাটি মুহূর্তে প্যানডেমিক বৃষ্টির মতো অন্তর্জালে ছড়িয়ে গিয়ে পৃথিবীর অপর প্রান্ত ভিজিয়ে দেয়; অহরহ; কিংবা ভিন্ন গোলার্ধের কফি পেয়ালার ব্লিজার্ড দুলিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণের এই বারান্দা। জলে–স্থলে-অন্তরীক্ষে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলা কবিতা।
এই করে লিখতে শুরু করা। আকাশজুড়ে জোছনাসমেত চাঁদ লিখে দিয়ে কোনো সুনয়নার চোখের সীমানা দখল করবার সাধ পুষে রাখা। মনের কোণে জমে থাকে কত না স্মৃতির নাচন, কোনো মাহেন্দ্রক্ষণে উদ্ভিদের মতো ফুঁড়ে আসে কবিতা লেখার মৃত্তিকাময় খাতায়। কোনো কোনো স্মৃতিকথা শ্বাসরোধী, আজীবন ঝরনার মত বয়ে না গেলে শান্তি নেই। কখনোবা ঐ মেঘের পাহাড়, তারার প্রদেশ দখল করে নেয় হাহাকারের পদাবলী। বিরহরস, বেদনারস কিংবা হাহাকারের রসেও আনন্দের পাঁজি মেলে, কেননা শিল্পরস শেষাবধি আনন্দ ভৈরবী গাইতে থাকে। অন্যদিকে কবিতা লিখে যাওয়া মানে আদি কবিদের মিছিলে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত এক গৌরবোজ্জ্বল প্রাগৈতিহাসিক উল্লাসে শামিল হওয়া।
“মানুষের ভাষা তবু অনূভূতিদেশ থেকে আলো
না পেলে নিছক ক্রিয়া, বিশেষণ; এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল।”
( জীবনানন্দ দাশ )
বিভিন্ন পংক্তিমালা থেকে সতীর্থ কবিদের নাম মুছে ফেলে যখন মনে হবে সবাই মিলে একটাই কবিতা লিখেছেন, তখনও বাংলা কবিতার জলাশয়ের ধারে স্বতন্ত্র পিদিমগুলো আলো বিলিয়ে যাবে। কবিতায় সদর- মফঃস্বল একাকার।
কবিতা কখনও কী ভুল পথে নিয়ে যায় জোনাকির ছদ্মবেশে আলেয়ার মতো! কোনো কোনো পথ বিভূঁই দিগন্তে অস্ত যায়। বেশি দূর হেঁটে গিয়ে শেষ বিকেলে ভয়ে ভয়ে ফিরে কবি দেখতে পায়, নিজেরই তীর্যক ছায়া পড়েছে কবিতার চৌকাঠে। রহস্যঘেরা দিগন্তরেখা যতিচিহ্ন কিংবা বিস্ময়চিহ্ন হয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে।
অতল জলের ঢেউ ডেকে যায় কখনোবা। কোনো কোনো দিন ভেসে যেতে ভালবাসি, কোনো কোনো দিন আবার সুবিধাবাদীর মত বধির হয়ে যেতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি। ‘কবিতা তোমাকে দিলাম আজকে ছুটি’! কিংবা, ‘আমার রয়েছে বিশ্বলোক’! কবিই বুঝি পারে কবিতাকে উপেক্ষা বা অবহেলা করতে, কেননা কবিতা কোনোদিন বলেনি, ‘এসো ভাত খেয়ে নিই ভাত’। প্রতারক দিনের উদযাপন করেন কবি আর বিভ্রান্তিতে ভোগে কবিতা। বোতলবন্দী কোলাহল ছাড়া পায়, কবি বাস্তবতার জ্যাকেট গায়ে ঘুরে বেড়ায় শহরে বন্দরে। কবিতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে যাবে এমন বাল্মিকী আছে কী আজ কেউ ! কবি তাই খণ্ড অস্তিত্বের, কবিতা আজ নিরাভরণ খণ্ডপদী। কবি আর কবিতার আজ ক্ষণিকের পরকীয়া।
“আমাদের ঘুম পায়, প্রতীকের অন্ধকারে ঘন ঘন হাই ওঠে
আমাদের কবিজন্ম ঢেকে রাখে
শালুক-পদ্মের কিছু পাতা!”
( শ্যামলকান্তি দাশ )
তবুও কবিতা আজ গ্লোবালিনী। বাংলাদেশের এক কোণে বসে লেখা কবিতাটি মুহূর্তে প্যানডেমিক বৃষ্টির মতো অন্তর্জালে ছড়িয়ে গিয়ে পৃথিবীর অপর প্রান্ত ভিজিয়ে দেয়; অহরহ; কিংবা ভিন্ন গোলার্ধের কফি পেয়ালার ব্লিজার্ড দুলিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণের এই বারান্দা। জলে–স্থলে-অন্তরীক্ষে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলা কবিতা।